Friday, 15 April 2022

// // Leave a Comment

ড. বাবা সাহেবের জীবন ও কর্ম লেখক– জগদীশচন্দ্র রায়

 

                    ড. বাবা সাহেবের জীবন ও কর্ম


লেখক– জগদীশচন্দ্র রায়  

        জন্মঃ- ১৪ই এপ্রিল ১৬৯১ সালে। পিতার নাম রামজী শকপাল। বাল্য নাম ভীমরাও।  তিনি এক অচ্ছুৎ দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে স্কুলে তাঁকে সর্বদা জাতি বৈষম্যের শিকার হতে হতো। অস্পৃশ্য বলে বর্ণবাদীরা তাঁকে স্পর্শ করত না। পিপাসার জলও পান করতে পারত না। তিনি ছিলেন ভারতীয় সংবিধান নির্মাতা। ২০১২ সালে  একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা তিনি “শ্রেষ্ঠ ভারতীয়” নির্বাচিত হন।

     শিক্ষা ও সম্মান প্রাপ্তিঃ-- ১৯১৫ সালে কলম্বিয়া উনিভারসিটি থেকে এম. এ. পাশ করেন। ১৯১৭ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী পান। ১৯২১ সালে এম.এস.সি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯২২ সালে ব্যারিষ্টারী পাশ করেন। ১৯২৩ সালে ডি. এসসি ডিগ্রী পান ‘টাকার সমস্যা’ থিসিস লিখে লণ্ডন উনিভারসিটি থেকে। ভারতের সংবিধান রচনার জন্য কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট (ডক্টর অব ল) প্রদান করেন। তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্যের জন্য ভারতের মুসলমান পরিচালিত ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট(ডক্টর অব লিটারেচার) সাম্মানিক ডিগ্রী প্রদান করেন। কিন্তু ভারতের উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা পরিচালিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এরূপ সম্মান প্রদান করেনি। নিচুজাত বলে গুণি আম্বেদকরকে তাঁরা কোনো দিনই এই ধরনের সম্মান দিতে পারেনি এবং আজ পর্যন্ত দেয়নি। তবে ২০১২ সালে  একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা তিনি “শ্রেষ্ঠ ভারতীয়” নির্বাচিত হন। আর Apr 26, 2016 Baba Saheb Ambedkar is considered as SYMBOL OF KNOWLEDGE in the world.

     বাবা সাহবে আম্বদেকর একজন সূর্য। সেই সূর্যকে পূর্ণ প্রকাশের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী ঘনকালো মেঘকে সরিয়ে তাঁকে সংবিধান সভায় প্রেরণ করেন বাংলার ‘আম্বেদকর’ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। যার অক্লান্ত সংগ্রামের ফলে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়। যদিও বাংলার মানুষ এই মহান মহামানবদ্বয়ের সংগ্রামের ফসল ‘সংরক্ষণ- representation’ কে তো  ভোগ করছে, কিন্তু যাদের জন্য এই মহার্ঘ তাদের আজও আপন করে নিতে পারেনি।

    অবদানঃ- ড. আম্বেদকরের ভারতের বিকাশের ক্ষেত্রে যতোটা যোগদান আছে হয়তো অন্য কোনো রাজনেতার সেটা নেই। তিনি  ছিলেন অর্থতজ্ঞ, সমাজতজ্ঞ, আইন বিশারদ। তিনি আধুনিক ভারতের নির্মাতা। তিনি সংবিধান রচনা সমিতির অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি এমন সংবিধান রচনা করেছেন, যেখানে সকল নাগরিক সমান অধিকারী, ধর্মনিরপেক্ষ। বাস্তবে তিনি স্বাধীন ভারতের ডি.এন.এ. রচনা করেছিলেন সংবিধানের মাধ্যমে। তাঁর প্রেরণায় Finance Commission এর নির্মাণ করা  হয়। তিনি Reserve Bank of India এর নির্মাতা। দামোদর ভ্যালী, হিরাকুণ্ড পরিকল্পনাও তাঁর ভাবনার প্রকাশ। Employment Excenge এর স্থাপনাও বাবা সাহবে করেন। জল ও বিদ্যুৎ এর Gird System এর স্থাপন তিনি করেন।  স্বতন্ত্র নির্বাচন আয়োগের নির্মাতা বাবা সাহেব। যদিও এই সব অবদানের কথা ভারতের কোনো সরকারই  সরাসরি স্বীকার করে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি। অর্থাৎ এইসব পরিকল্পনা ও বিচার আম্বেদকরের ছিল কিন্তু সেটার শ্রেয় অন্যে লুটে নিয়েছে।   

      নারী ও শ্রমিকদের সুবিধাঃ- বাবা সাহেব হিন্দুকোড বিল বানিয়েছিলেন নারীদের সমমর্যাদার অধিকার দেওয়ার জন্য। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার সমান অধিকার, বিবাহিত পুরুষ এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে অন্য স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেনা। যদিও তখনকার সরকার সেটার  স্বীকৃতি দেয়নি। পরবর্তীতে সেটা চালু করা হয়। মহিলাদের মাতৃত্বকালী ছুটি, এবং প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ বাবা সাহেবের অবদান। তিনি যখন শ্রমসচিব (মন্ত্রী) তখন (১)কয়লা শ্রমিকদের নানা ধরনের সহায়তা প্রদান,

 (২) মহিলা শ্রমিকদের প্রসবকালীন ৩২৯দিন ছুটি,

 (৩) কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র,

(৪) ৮ ঘণ্টা কাজের আইনী স্বীকৃতি,

 (৫) ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ,

 (৬) ন্যূনতম বেতন সহ নানা শ্রমিক  কল্যাণ আইন পাস ও কার্যকর করেন।

   ধর্ম সম্পর্কে বাবা সাহবেঃ- তিনি ১৯৩৫ সালে ঘোষণা করেছিলেন, হিন্দুধর্মে জন্মগ্রহণ করেছি, যেটা আমার কোনো কিছু হাত নেই। তবে আমি হিন্দু হয়ে মৃত্যু বরণ করব না। তিনি ১৯৫৬ সালের ১৪ই অক্টোবর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে স্বধম্মে ফিরে যান। আর ওই বছর ৬ ডিসেম্বর তাঁর মহাপরিনির্বাণ ঘটে। ধর্ম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি ধর্মের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করি না। তবে, প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে জীবনের ভিত্তি এবং এই ভিত্তির উপরই গড়ে ওঠে দেশের ন্যায়পরায়ণ সরকার। তিনি আরও বলেন, মানব জাতির প্রগতি সাধনে ধর্মের(ধম্ম) প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য্য।  স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব এই মৌলিক নীতিগুলিকে ধর্ম অবশ্যই স্বীকার করে নেবে, এর উপর তিনি জোর দিয়েছেন।

      সংবিধানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাবাসাহেবঃ- সংবিধানের উদ্দেশ্য ছিল সমতা সতন্ত্রতা বন্ধুতা ও ন্যায়। যার জন্য জাতীয় পতাকায় আশোক চক্র ও জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ রাখা হয়েছে। তবে তিনি সংবিধান সংসদে পেশ করে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন-সংবিধান যতই ভালো লেখা হোক না কেন, সেটা বাস্তবায়িত করার লোকার যদি ভাল না হয়; তাহলে এর গুরুত্ব নেই। আবার সংবিধান যতই খারাপ লেখা হোক না কেন, তাকে বাস্তবায়িত করার লোকেরা যদি ভাল হয়, তাহলে সেটা বেশ কার্যকরী হবে।   

      তিনি বলেন, “২৬ জানুয়ারী ১৯৫০ আমরা একটা অসংগতিপূর্ণ জীবনে (life of contradiction) প্রবেশ করছি। রাজনৈতিক সাম্যকেই শুধু সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে পেরেছি, কিন্তু সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে অসাম্যকে সংবিধানে মেনে নেওয়া হয়েছে। রাজনীতিতে আমরা বিখ্যাত নীতি one man, one vote, and one value মেনে নিয়েছি। সমস্ত ভারতবাসী একজাতি। এই নীতিতে সামাজ জীবনে সৃষ্টি হবে ঐক্য। এটা হওয়া খুবই কঠিন। কারণ, জাতব্যবস্থাটাই anti-national, এই জাতব্যবস্থা মানুষকে মানুষ থেকে পৃথক কর। আরও জাতব্যবস্থা anti-national কারণ, সেটা জাতিতে জাতিতে ঈর্ষা এবং বিতৃষ্ণার (antipathy) জন্ম দেয়।আমার বিচারে, ধর্মনিরপেক্ষ ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে পার্থক্য করা অর্থহীন। তারা উভয়েই পরস্পরের আত্মীয়। তাঁরা একই শরীরের দুটি বাহু। এক বাহুর অস্তিত্বের জন্য অন্য বাহু যুদ্ধ করতে বাধ্য।

     জাতিপ্রথা নির্মূলন পদ্ধতিঃ- তিনি বলেন, ‘জাতিভেদ’ প্রথা নামক সামাজিক ব্যাধির খাঁট ঔষধ হল অসবর্ণ বিবাহ।  রক্তের সংমিশ্রণই আত্মীয়তা বোধ সৃষ্টি করতে পারে। তবে তিনি আরো বলেন,জাত-ব্যবস্থা নির্মূলনের প্রকৃত ঔষধ হল শাস্ত্রের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও ভক্তির মূলোচ্ছেদ করা।  

     উপদেশঃ- বাবাসাহেব বলেছেন, - যিনি তাঁর দুঃখ থেকে মুক্তি চান, তাঁকে লড়তে হবে। আর যিনি লড়াই করতে চান তাঁকে পড়তে হবে। কারণ জ্ঞান বিনা লড়াই করতে গেলে পরাজয় নিশ্চিত।

     আধুনিক ভারতের নির্মাণের জন্য বাবা সাহেবের দ্বারা পরিকল্পিত সমস্ত ব্যবস্থাকে চালু করা একান্ত আবশ্যক। যদিও বাবা সাহেবকে সর্বভারতীয়দের মসিহা হিসাবে তুলে না ধরে শুধুমাত্র পিছড়েবর্গদের মসিহা হিসাবে তুলে ধরেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থা। দেশে সকলের জন্য সমান অধিকারের স্বপন বাবা সাহেব দেখেছিলেন,  কিন্তু সেটা আজ পর্যন্ত অধুরা রয়েগেছে। ভারতবাসী ইংরেজদের গোলাম ছিল। আর অস্পৃশ্যরা ইংরেজ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের গোলাম ছিল। বর্তমানে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সকলকে আদেশ দিয়েছেন ‘শিক্ষিত হও, সংগঠিত হও আর আন্দোলন করো’।

0 comments:

Post a Comment