স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাবাসাহেব আম্বেদকর।
লেখক -জগদীশ রায়
ভারতের স্বাধীনতার নাম শুনলেই ভেসে ওঠে গান্ধী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, খুদীরাম, সূর্যসেন
ইত্যাদি নাম। বিপ্লবীরা অবশ্যই দেশের জন্য
স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিলেন। দেশের নেতারা কিন্তু সমগ্র ভারতবাসীর স্বাধীনতা জন্য
আন্দোলন করেন নি। তার একটা প্রমাণ-
গান্ধিজি বলেছিলেন,“যদি ইংরেজরা ভারতের স্বাধীনতা
দেয়, তার বদলে অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার বদলে যদি অচ্ছুৎদের (বর্তমান তপশিলি) অধিকার
দেয় তাহলে এই ধরনের স্বাধীনতা আমি চাই না।”
ইংলণ্ডের গোল টেবিল বৈঠকে বাবা সাহেব ইংরেজদের
সঙ্গে দেশের বঞ্চিতদের জন্য যেসব অধিকার অর্জন করেছিলেন, সেই অধিকার যাতে বঞ্চিতরা
না পায় তার জন্য গান্ধিজি ২৪ অক্টোবর ১৯৩২ পুনার যারবেদা জেলে অনশন করেন। আম্বেদকর এক বিবৃরতিতে বললেন গান্ধিজির প্রাণ বাঁচানোর জন্য সব
রকমের সম্ভাব্য প্রয়াস চালানো উচিত।
কিন্তু যে অধিকার আমরা অর্জন করেছি তা
ছাড়তে রাজি নই। সংবাদ পত্রগুলি আম্বেদকরের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো শুরু করল। তাঁর
কাছে রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি আসতে শুরু করল ‘তোমাকে
আমরা মেরে ফেলব।’ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল জেলের মধ্যে এসে গান্ধিজির সঙ্গে দেখা করে
বললেনঃ- “বর্ণহিন্দু এবং অস্পৃশ্যদের মাঝখানে কেন আপনি নিজেকে স্যান্ডউইচ বানাচ্ছেন? আপনার বেঁচে থাকা জরুরি। আপনি
অনশন ত্যাগ করুন।”
গান্ধীর আপ্তসহায়ক মহাদেব ভাই দেশাই কাছেই বসে ছিলেন। তিনি এঁদের দুজনের কথাবার্তা তাঁর
ডাইরিতে লিখে রেখেছিলেন।
গান্ধিজি প্যাটেলকে বোঝালেন- “অস্পৃশ্য এবং মুসলমানরা যদি পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে
জনতার মধ্য থেকে ইমানদার এবং সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করে, তাহলে তাঁরা বিধানসভা ও লোকসভা কংগ্রেসকে
স্বাধীনভাবে সরকার চালাতে দেবেনা। স্বাধীনদেশে তাঁরাই
নির্ণায়ক শক্তিতে পরিণত হবেন। তোমাদের স্বার্থেই আমার এই অনশন।”
এই কথোপকথন লেখাছিল মহাদেব দেশাইয়ের ডাইরিতে। আমেরিকার এলিনার জুলিয়েট একজন
গবেষক ছাত্রী। গবেষণার কাজে ভারতে এসে এই ডাইরি খুঁজে বের করেছেন এবং বই লিখেছন। (তথ্যসূত্রঃ
আত্ম নিরীক্ষণ;
6 জুলাই
2006, বাংলা ভাগ কেন হল; নিকুঞ্জবিহারী হাওলাদার, পৃষ্ঠা 105)
আবার আমরা জানি তিলক বলে ছিলেন স্বরাজ
আমার জন্মগত স্বাধীনতা। কিন্তু সেই স্বরাজের অর্থ কী? আসুন সে সম্পর্কে দেখে
নেওয়া যাক।
তিলক মহারাষ্ট্রের
আকোলা, ইভাৎমাল ও ভুষাওয়ালের খোলা ময়দানে ভাষণ দেন। এই ভাষণ ‘কেশরী’
নামক পত্রিকায় ছাপা হয়। তিলক বলেন–“আমাদের স্বরাজের অর্থ এটা নয় যে, ইংরেজদের ভারত
থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। ইংরেজরা চাইলে ভারতে থাকতে পারবে। কিন্তু শাসন প্রসাশনে আমাদের
প্রতিনিধিত্ব দিতে হবে।’’ এর জন্য তিলক মনুস্মৃতির উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, “মনুস্মৃতি
অনুসারে যে কোন রাজা তার রাজ কাজ চালাতে চাইলে বুদ্ধিমান লোকদের সঙ্গে নিয়ে শাসন প্রশাসন
চালানো উচিত।” বুদ্ধিমান অর্থাৎ লেখাপড়া শেখা
পণ্ডিত। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ। এর অর্থ তিলকের আন্দোলন শুধুমাত্র উচ্চবর্ণীয়দেরকে ইংরেজদের
শাসন প্রশাসনে প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার আন্দোলন ছিল। যাকে স্বরাজ বা হোমরুল আন্দোলন বলা
হয়। এটা কোন প্রকারে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন
ছিল না। যদিও এটাকে স্বাধীনতার আন্দোলন বলেই প্রচার করা হয়। স্বরাজ এবং স্বাধীনতার
মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
ভারতে আমরা যে স্বাধীনতার
আন্দোলন দেখতে পাই, বাস্তবে ভারতে স্বাধীনতার জন্য দুই ধরনের আন্দোলন চলছিল। এক- ইংরেজদের
অধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উচ্চবরণীয়দের স্বাধীনতার আন্দোলন। দুই- উচ্চবর্ণীয়দের
অধীনতা বা গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন। দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন
সম্পর্কে আমরা প্রায় জানিই না। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোন করেছিলেন জ্যতিরাও ফুলে,
শাহু মহারাজ, বাবাসাহবে আম্বেদকর, পেরিয়ার, গুরুচাঁদ ঠাকুর ও অন্যান্য মূলনিবাসী মহামানবেরা।
(বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে ‘স্বাধীনতার দুই আন্দোলন’ বইতে)।
বাবাসাহেব যে স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিলেন সেটা ছিল যেমন
উচ্চবর্ণীয়দের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন তেমনি ভারতের সর্বসাধারণের
সার্বিক স্বাধীনতার আন্দোলন। যার প্রমাণ
আমরা পাই, তিনি গোল টেবিল বৈঠকে ইংরেজদের সামনেই বলছেন- ভারতে তাদের শাসন তুলে
নিয়ে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য ও জনগণের শাসন চাই। যে কথা আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলনে By the
people, for the people of the people. সেই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।
বাবা সাহেবের এই
স্বাধীনতার আন্দোলন সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আগে গোল টেবিল বৈঠক থেকে পুনাচুক্তি
পর্যন্ত জানতে হবে। এর ফলে বোঝা যাবে তিনি কিভাবে উচ্চবর্ণীয়দের গোলামি থেকে মুক্তির
জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিলেন। (যদিও এটা কারো কারো কাছে ধান বান্তে শিবের গীত
বলে মনে হতে পারে।)
১৯১৬ সালে বাবাসাহেব ড.
আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের সমস্যার সমাধান করার জন্য চেষ্টা শুরু করেন। তিনি
অস্পৃশ্যদের সমস্যার প্রতি ব্রিটিশদের মানসিকতা ও দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করার জন্য
চেষ্টা করেন। যার ফল স্বরূপ মন্টেংগু চেমসফোর্ড-এর যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সে কমিটির রিপোর্টে অস্পৃশ্যদের সমস্যার
কথা স্বীকার করে। শুধু স্বীকারই করেনি, বরং আইন পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য সর্বোত্তম
ব্যবস্থা করার প্রতিজ্ঞাও করা হয়।
১৯১৮ সালে যখন ‘সাউথ বরো
কমিশন’ ভারতে আসে তখন বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর ঐ কমিশনকে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক ও
অন্যান্য দাবী ও অধিকারের জন্য লিখিত মেমোরাণ্ডাম দেন। ঐ
মেমোরাণ্ডামে বাবা সাহেব, ‘স্বয়ং ওদের(অস্পৃশ্য) জন্য, স্বয়ং ওদের দ্বারা এবং স্বয়ং ওদের মাধ্যমে পৃথক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব’-এর
দাবী জানান। ১৯১৯ সালে প্রথম ভারতীয় আইন তৈরি হয়। এই আইন অনুসারে অস্পৃশ্যদের নির্বাচনে নমিনেশনের অধিকার অর্জিত হয়।
ভারতের ইতিহাসে দুহাজার বছর পরে বঞ্চিতদের নমিনেশনের অধিকার মেলে।
সাইমন কমিশনের বিরোধীতা কেন করেছিল কংগ্রেস ও গান্ধীজি?
১৯১৯ সালের প্রথম ভারতীয় আইনের প্রস্তাবনা ছিল যে, দশ বছর পরে এই আইনের সমীক্ষা করা হবে। আর তার
জন্য একটা কমিটি নিযুক্ত করতে হবে। তখন ঐ কমিটি সংবিধানের আইনের (India Act) সমীক্ষা করে যেখানে যতটুকু পরিবর্তনের
প্রয়োজন মনে করবে তার জন্য প্রস্তাব করবে। আর এই আইনের প্রস্তাবনানুসারে ১৯২৮ সালে
স্যার জন সাইমনের অধ্যক্ষতায় একটি কমিশন নিযুক্ত করা হয়। যাকে ‘সাইমন কমিশন’
বলা হয়। সাইমন কমিশনে মিশ্র প্রতিনিধি থাকবে ভারতীয়রা এরকম আশা করেছিল। কিন্তু ঐ সময় ‘সেক্রেটারী অফ স্টেট
ইন্ডিয়া’ ছিলেন ‘লর্ড বর্কনহেড।’ তিনি কমিশনের উপর ভারতীয় প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা
করেন। তখন এই কমিশনকে কেবলমাত্র
“সাংসদীয় কমিশন” হিসাবে স্থাপন করা হয়। এর ফলে কংগ্রেসের মাধ্যমে সাইমন কমিশনের তীব্র বিরোধীতা করা হয়। আসলে কংগ্রেস
ও গান্ধিজির
সাইমন কমিশনের
বিরোধিতার আসল কারণ ছিল, ১৯১৯ সালের প্রথম ভারতীয় আইন অনুসারে ব্রিটিশ লোকেরা এখানকার পিছড়ে বর্গের লোকেদের যে অধিকার দিয়ে ছিল, তার বিস্তার না হয়ে যায়। যদিও কমিশনের বিরোধীতার
কারণ হিসাবে জানায় যে,
‘এই কমিশনে ভারতীয়দের
প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি।’ আসলে হাতির দেখানোর দাঁত আর খাওয়ার দাঁত আলাদা হয়। কারণ, কংগ্রেস ও গান্ধীজি মনে করলেন যে, এই কমিশন পিছড়েদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ের
সমাধানের চেষ্টা করবেন। আর যদি এই লোকদের প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হয় তাহলে তো এরা
আমাদের(গান্ধীজি ও উচ্চবর্ণীয়দের) স্বাধীনতারও ভাগীদার হয়ে যাবে। কারণ, তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনতো সর্ব সাধরণের
জন্য নয়। সেটা শুধুমাত্র উচ্চবর্ণীয়দের
জন্য। তাই কমিশনের বিরোধিতা। সাইমন কমিশন গান্ধিজির কাছে বিরোধিতার কারণ জানতে চাইলে তখন গান্ধিজি জানান, ‘কমিশনে ভারতীয় প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি বলে এর
বিরোধিতা করা হচ্ছে।’ তখন কমিশন জানান, এই কমিশন স্ট্যাটুটরী কমিশন, সরকারী কমিশন। আর আপনাদের লোকেরা তো সরকারী
নয়। তাই এই কমিশনে বেসরকারী লোকেদের গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সরকার আপনাদের কিছু
সুবিধা দিতে চায়,
সেখানে আপনাদের
প্রতিনিধিদের গ্রহণ করা কী করে সম্ভব?
এদিকে বাবাসাহেব আম্বেদকর
‘সাইমন কমিশন’কে স্বাগত জানানোর ফলে দেশের প্রচার মাধ্যম গান্ধিজির কথা শুনে বাবা সাহেবকে দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করে প্রচার চালায়।
১৯৩১ সালে লন্ডনে গোল টেবিল (Round Table Conference):-
যাইহোক,
এই কমিশনের প্রতি তীব্র
বিরোধিতার ফলে
কমিশনের সুপারিশকে কার্যকরী করার পূর্বে ভারতীয় প্রতিনিধিদের পরামর্শ গ্রহণ করার
জন্য ১৯৩০,
৩১ ও ৩২ সালে লন্ডনে গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। গান্ধিজি (১ম বৈঠক) ছাড়া বাকি সব নিমন্ত্রিত ভারতীয় প্রতিনিধি এই বৈঠকে যোগদান
করেন। বাবা সাহেব এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ওখানে চারটি দাবি রাখেন।
(১) পৃথক নির্বাচন ক্ষেত্র।
( Separate Electorates)
(২) নিজেদের লোককে নিজেরাই
প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার। (Dwell Voting)
(৩) প্রাপ্ত বয়স্কদের
ভোটাধিকার। (Adult
Franchies).
(৪) দেশ আঞ্চলিক ক্ষেত্রে
তথা কেন্দ্রের আইন পরিষদে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের অধিকার (Adequate Representation).
যদিও জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের অধিকারের বিষয়টি কেবলমাত্র
তফশিলি জাতির জন্যই ছিলনা। বরং যত
সামাজিক জাতি সমূহ ছিল তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে অধিকার পাবে একথা বাবা সাহেবের দাবির পিছনে ছিল। শুধু আলাদা
নির্বাচন এবং দুবার ভোট দেওয়ার অধিকার তফশিলি জাতির জন্য বিষয় ছিল। তবে গান্ধিজি সকলের জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের বিরোধিতা করেছিলেন।
১৭ই আগস্ট ১৯৩২ সালে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নসমূহের রায় বা Communal Award ঘোষণা করা হয়। গান্ধিজির কোন ধম্কীই যখন ব্রিটিশ সরকার মানতে রাজি না হন, তখন তিনি তাঁর জীবনের প্রধান অস্ত্রকে প্রয়োগ
করেন অস্পৃশ্যদের অধিকারকে ছিনিয়ে নেবার জন্য। ২০শে সেপ্টম্বর ১৯৩২ তিনি তাঁর অনশন
শুরু করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর, বাবা
সাহেব দ্বারা লড়াই ঝগড়া করে পিছড়েবর্গের জন্য অর্জিত অধিকার গান্ধীজির অনশনের
দ্বারা ছিনিয়ে নেবার যে চুক্তি পুনাতে হয়েছিল সেটাই পুনাচুক্তি বা পুনাপ্যাক্ট।
মহত্তপূর্ণ কিছু শর্ত এই রকম ছিলঃ-
(১) সাধারণ নির্বাচন ক্ষেত্রে অস্পৃশ্য
শ্রেণির জন্য আসন সংরক্ষিত করা হবে।
(২) এই আসন গুলির
জন্য নির্বাচন; যৌথ নির্বাচক মন্ডলী
দ্বারা নিম্নবর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে অনুষ্ঠিত হবেঃ- অস্পৃশ্য শ্রেণির যে সব ভোটার সাধারণ নির্বাচক মণ্ডলীতে তালিকাভুক্ত
হবেন তাদের দ্বারা একটি পৃথক নির্বাচক মণ্ডলী গঠিত হবে। উক্ত
পৃথক নির্বাচক মণ্ডলীর প্রত্যেককে একটি
করে ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ভোট
প্রাপ্তির ক্রমানুসারে অস্পৃশ্য শ্রেণির চার জন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন। এটাকে বলা হবে অস্পৃশ্য শ্রেণির প্রাথমিক নির্বাচন। এইভাবে নির্বাচিত চার
জন্য প্রার্থীর মধ্যে একজন সাধারণ নির্বাচক মন্ডলী কর্তৃক চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত
হবেন।
(৩) প্রাথমিক
নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক আইন সভার জন্য নির্যাতিত শ্রেণির প্রার্থীদের প্যানেল তৈরি করার নিয়ম
দশ বছর পরে শেষ হয়ে যাবে। ..ইত্যাদি ইত্যাদি।
পুনাচুক্তির
এই শর্তগুলো গান্ধিজি মেনে নিয়েছিলেন এবং এগুলি ভারত শাসন আইনে বিধিবদ্ধ করে কার্যকরী করা হয়। এখন আমরা দেখছি যে, যে চারটি দাবি সাম্প্রদায়িক নির্ণয় (Communal Award) এ মেনে নিয়েছিল, যার মধ্যে সব থেকে বেশি মহত্ত্বপূর্ণ ছিল পৃথক নির্বাচন প্রণালী এবং দুবার ভোট দেওয়ার অধিকার।
এছাড়া প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার এবং পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের দাবিও ছিল। প্রথম দুটি মহত্ত্বপূর্ণ
দাবিকে গান্ধিজি পুনাচুক্তির মাধ্যমে শেষ করে দেন। এর
পরিবর্তে যৌথ নির্বাচন
পদ্ধতি চালু করা হয়। যৌথ নির্বাচন পদ্ধতির ফলে পৃথক নির্বাচন ক্ষেত্রের অধিকার
সমাপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু পুনাচুক্তিতে একটা বিষয় মেনে নিতে
বাধ্য করেন ড. আম্বেদকর। যেটা হচ্ছে দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়েছে যে, যৌথ নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে কিন্তু প্রার্থীর নির্বাচন মাত্র একবার
নয় বরং দুবার হবে। তফশিলি জাতির প্রার্থী কে হবেন সেটা কংগ্রেস ঠিক করতে পারবে
না। দুবার প্রার্থীর নির্বাচন করার পিছনে বাবাসাহেব ড. আম্বেদকরের উদ্দেশ্য ছিল যে, প্রথম বার প্রার্থীর নির্বাচন, মুখ্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য
প্রার্থী কে হবেন সেটা নির্ণয় করা। প্রথমবারের নির্বাচনে যে কেউ প্রার্থী হতে
পারতেন। কিন্তু ক্রমানুসারে যে চার জন সবথেকে বেশি ভোট পাবেন
তারাই মুখ্য নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হতে পারবেন। এর অর্থ কি? বর্তমান দিনে আমরা দেখছি যে তফশিলি জাতি ও তফশিলি উপজাতির প্রার্থী কে হবেন
সেটার নির্ণয় নেন পার্টির হাইকমাণ্ড। পার্টির হাইকমাণ্ড নির্বাচনে তাকেই
প্রার্থী করেন যিনি সমাজের সঙ্গে সব থেকে বেশি ধোঁকাবাজী
করতে পারবেন এবং এই ধোঁকাবাজী করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ
থাকবেন। বাবা সাহেব ড. আম্বেদকর দুবার প্রার্থীদের নির্বাচন করার পদ্ধতিকে রেখে
ছিলেন। আর এই প্রার্থীদের নির্বাচনের
অধিকার জনগনের হাতেই রেখে ছিলেন। শেষ নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন সেটা আমাদের লোকেরাই
নির্ণয় করবেন। পুনাচুক্তি নামক যে শয়তান ছিল, সেই শয়তানকে একশ
শতাংশ না হলেও ৫০ শতাংশ কমজোর করার চেষ্টা ড. আম্বেদকর করেছিলেন। কিন্তু যখন ভারতে
সংবিধান লাগু হয়, তখন কংগ্রেসের বেশি ক্ষমতা থাকার ফলে দুবার প্রার্থী নির্বাচনের পদ্ধতিকে শেষ
করে দেয়। তখন থেকে নির্বাচন কেবলমাত্র
একবারই হয়, আর প্রার্থী নির্বাচনের অধিকার জনগণের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পার্টি হাইকমাণ্ডের
কাছে যায়। কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল বা যেকোন দলেই পার্টি হাইকমাণ্ডের সামনে এখন আমাদের SC, ST, OBC এর লোকেরা প্রার্থী হওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। এই ধরনের লোকেদেরই আমাদের সমাজের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়
করায়। দুবার প্রার্থী নির্বাচনের অধিকার থাকলে এটা করা সম্ভব হতো না, কিন্তু আজ স্বাধীন (?) ভারতে উচ্চবর্ণীয় নিয়ন্ত্রনাধীন পার্টিগুলো এটা করে
ছেড়েছে।
তুলনামূলক বিশ্লেষণঃ-
পুনাচুক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর নিজেই বলেছেনঃ “সাধারণভাবে এটা প্রচার
করা হয়েছে যে, পুণা চুক্তির ফলস্বরূপ অস্পৃশ্যদেরকে
সাম্প্রদায়িক নির্ণয় (Communal Award) থেকে বেশি সিট দেওয়া
হয়েছে। এটা সত্যি যে পুণাচুক্তির ফল স্বরূপ অস্পৃশ্যদের ১৫১টি-আসন দেওয়া হয়েছে, যেখানে Communal Award এর ফল স্বরূপ তারা ৭৮ টি
আসন পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক নির্ণয়ের চেয়েও বেশি আসন দিলেও
সাম্প্রদায়িক নির্ণয়ে অস্পৃশ্যদের যে মৌলিক অধিকার দিয়েছিল তা তারা পুনাচুক্তির ফলে হারালেন।
সাম্প্রদায়িক
নির্ণয় অস্পৃশ্যদের দুটি সুযোগ দিয়েছিল।
(১) অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচক মণ্ডলীর
মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সংরক্ষিত আসন, যে গুলি কেবলমাত্র অস্পৃশ্য প্রতিনিধিদের দ্বারা পূর্ণ করা হবে। (২) অস্পৃশ্যদের
দুটি করে ভোট-একটি করে তাদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট, অন্যটি সাধারণ নির্বাচক
মণ্ডলীর ভোট।
পুণা-চুক্তি
একদিকে সংরক্ষিত আসনের কোটা বাড়িয়ে দিল, অন্যদিকে দুটি
ভোটের অধিকারকে হরণ করল। আসনের বাড়তি
কোটা, দুটি ভোটের অধিকারের বিকল্প হতে
পারেনা। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় প্রদত্ত দ্বিতীয় ভোটটি একটি অমূল্য
সম্পদ। রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে এই ভোটটির মূল্য অপরিসীম।
বিভিন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে
অস্পৃশ্যদের শক্তি (১:১০) এক থেকে দশভাগ পর্যন্ত ছিল। এই শক্তি সাধারণ নির্বাচনের ভোটের ফলাফলের নির্ণায়ক না
হলেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে কোন সাধারণ আসনের প্রার্থীই তার নির্বাচন ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যদের অবহেলা করতে সাহসী হতে পারত না, কারণ তাকে জিততে হলে অস্পৃশ্যদের
ভোটের উপর কিছুটা নির্ভর করতে হত। চুক্তিতে অস্পৃশ্যরা কিছু আসন বেশি পেলেও ঐটুকুই যা লাভ। বাটোয়ারার রায় কার্যকরী হলে
কেবলমাত্র সংরক্ষিত আসনেই নয়, সমস্ত সাধারণ
আসনের প্রতিনিধিরাও তাদের প্রতিনিধিত্ব করত। তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে পুনাচুক্তির বাড়তি আসন দুটি ভোটের বিকল্প হিসাবে গন্য হতে পারে
না।
তর্ক করার জন্য মেনে নেওয়া যাক যে, পুনাচুক্তির ফল স্বরূপ কিছু আসন বেশি পাওয়া গেছে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন এটা এসে যায় যে এই অতিরিক্ত আসন কোন্ উপকারে আসবে? সাধারণত ভোটাধিকারের
ব্যাপারে বলা হয় যে এটা রাজনৈতিক সুরক্ষার হাতিয়ার, কিন্তু এটা বোঝা গেছে যে, অস্পৃশ্যদের বিষয়ে কেবলমাত্র ভোট দেওয়ার অধিকারই সর্বাধিক নয়, আশাঙ্কা এটা ছিল যে, যদি অস্পৃশ্যদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তি
স্বয়ং অস্পৃশ্য না হন, তাহলে তিনি মিথ্যা আচরণ করতে পারেন, আর এটাও হতে পারে যে, তিনি অস্পৃশ্যদের প্রতি কোন আগ্রহই নেবেন না। পুনাচুক্তির ফল স্বরূপ বেশি আসন
প্রাপ্তি হয়েছে। কিন্তু সে সব আসনগুলো গোলামদের দ্বারা পূর্ণ করা হয়েছে, যদি গোলামদের লাইন লাগানোতে কোন লাভ হয়, তাহলে এটা বলা যেতে পারে যে, পুনাচুক্তির ফলে লাভ হয়েছে।
কংগ্রেস, যেটা হিন্দুদের
রাজনৈতিক উপনাম। তাদের ক্ষমতা ছিল পুনাচুক্তির
দ্বারা নির্ধারিত আসনের থেকে বেশি আসনের সুবিধা অস্পৃশ্যদের
দেওয়ার। সাধারণ আসনে নির্বাচনে লড়ার জন্য অস্পৃশ্য প্রার্থীদের তারা সুযোগ করে দিতে পারত।
আইনে এটা করার ক্ষেত্রেও কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস এই ধরনের কিছুই
করেনি। এতে বোঝা যায় যে, যদি অস্পৃশ্যদের জন্য কোন আসনের সংরক্ষণ না হোত তাহলে হিন্দুরা কখনও
এটা দেখার চেষ্টা করত না যে, কোনো অস্পৃশ্যকে আইন পরিষদের জন্য নির্বাচিত করা হোক। (পরবর্তিতে
বাস্তব উদাহরণঃ- গান্ধীজী এবং কংগ্রেস সংবিধান সভার নির্বাচনে একজনে ও.বি.সি কেও
প্রার্থী করেন নি।)
পক্ষান্তরে যখন আসনের সংরক্ষণ হয়, তখন হিন্দুরা সেই সংরক্ষিত আসনের প্রভাবকে বিফল করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহন করে। আর তারা চেষ্টা করে সংরক্ষিত আসনে এমন ধরনের অস্পৃশ্য দেওয়া হোক, যে তাদের গোলাম
হয়ে থাকতে রাজি হবে।
রাজনৈতিক অধিকারের জন্য অস্পৃশ্যদের
সংঘর্ষের দুঃখ জনক অধ্যায়ের এইভাবে অন্ত হয়। নির্দিধায় বলা যায় যে, এই সবের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী মিঃ গান্ধি।
সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার বিরোধিতা গান্ধিজি এই জন্য
করেছিলেন যে, তাতে পৃথক নির্বাচক-মণ্ডলীর ব্যবস্থা ছিল। যদি হিন্দুরা গান্ধিজির অনশন করার ফলে
উদ্মাদ হয়ে না পড়ত তাহলে তারা বুঝত যে গান্ধিজির এই অনশন করা
সম্পূর্ণ ভুল ছিল। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় পৃথক নির্বাচক মণ্ডলী ছাড়া সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রেরও ব্যবস্থা ছিল। অস্পৃশ্যদের দেওয়া
দ্বিতীয় ভোটের প্রয়োগ, সাধারণ নির্বাচন ক্ষেত্রের উচ্চবণীয় হিন্দু প্রার্থী নির্বাচনে
করা যেত। অবশ্যই এটা যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি ছিল। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা আর পুনাচুক্তির মধ্যে যে বিভেদ সেটা নির্বাচন ক্ষেত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত
আছে। দুটোর মধ্যেই সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে, দুটোর মধ্যে এটা ছিল যে, সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায়
পৃথক নির্বাচন ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ছিল যে উচ্চবর্ণীয় প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে অস্পৃশ্যরা তাদের উপর যেন প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু পুনাচুক্তির যৌথ নির্বাচন ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ছিল যে, অস্পৃশ্য প্রার্থীর নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করবে কিন্তু উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা যেন তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে
পাবে। দুটোর মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য হচ্ছে এটা।
অস্পৃশ্যদের শুভাকাংখী কোনটা চাইবেন? তিনি সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রকে সমর্থন করবেন, নাকি পুণাচুক্তির যৌথ নির্বাচন ক্ষেত্রকে সমর্থন করবেন? অবশ্যই অস্পৃশ্যদের প্রকৃত উদ্ধার
এটাতে আছে যদি হিন্দুদেরকে অস্পৃশ্যদের ভোটের উপর নির্ভরশীল করা যায়। সেটা
সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় ছিল। কিন্তু অস্পৃশ্যদের হিন্দুদের ভোটের উপর নির্ভরশীল
করে দেওয়া যাতে অস্পৃশ্যরা হিন্দুদের গোলাম হয়ে যায়। গোলাম তো অস্পৃশ্যরা প্রথম
থেকেই আছে। পুনাচুক্তির এটাই হচ্ছে আসল রহস্য। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার
উদ্দেশ্য ছিল, অস্পৃশ্যদেরকে হিন্দুদের শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্য। আর পুণা-চুক্তির
উদ্দেশ্য হচ্ছে অস্পৃশ্যদেরকে হিন্দুদের অধীন করে রাখার।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত তথাকথিত স্বাধীনতা অর্জন
করেছে, এটা স্কুল কলেজে পড়ানো হয়। আর দেশের জনগণ এতো বছর ধরে এই কথা শুনতে শুনতে মেনেও
নিয়েছে। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালের সে প্রস্তাব
পাশ হয়েছিল সেটা ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরণের প্রস্তাব। It was Transfer of Power Bill
and not India’s Independence Bill. ক্ষমতা হস্তান্তরণের যে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল
তাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন-
১. লর্ড এড্উইন মাউন্ট
ব্যাটেন
২. লেডি এড্উইন মাউন্ট
ব্যাটেন
৩. জহরলাল নেহেরু।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ভারত স্বাধীণ
হয়েছে বলা হয়। বাস্তবিক ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে শুধুমাত্র ক্ষমতার হস্তান্তর। এক বিদেশী
ইংরেজ চলে গেছে। আর যাওয়ার সময় তারা অন্যদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে গেছে।
গোল টেবিল বৈঠকে
বাবাসাহবে-
“ভারতের জনগণের মধ্যে
অস্পৃশ্যরা পঞ্চম ভাগ। আমি চাই ভারত থেকে বৃটিশ সরকার সরিয়ে সেখানে জনগণের দ্বারা
জনগণের জন্য জনগণের শাসন চালু করা হোক। পিছিয়ে রাখা শ্রেণি বৃটিশদের এই আশা নিয়ে
স্বাগত করেছিলে যে, তারা কট্টর উচ্চবর্ণীয়দের দমন-পীড়ন আর অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার
কাজ করবেন। বৃটিশদের পূর্বে আমরা মন্দিরে যেতে পারতাম না। আমরা এখনো কি সেখানে যেতে পারি? বৃটিশদের পূর্বে অচ্ছুৎরা
পুলিশ আর সেনাবাহিনিতে ভর্তি হতে পারত না।
এখনো কি এ সুবিধা আছে আমাদের জন্য? আমাদের সমস্ত ক্ষত এখনো একই রকম রয়েছে। যদিও বৃটিশ
শাসন কাল ১৫০ বছর অতিক্রম করেছে। ---- পিছিয়ে পড়াদের সমস্যা ততক্ষণ মেটানো সম্ভব
নয়, যতক্ষণ তাদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা আসবে না।” (তথ্য- Babasaheb Ambedkar
movie থেকে সংগৃহীত)
-এখানে বৃটিশদের সামনেই
বাবাসাহবে বলছেন ভারতের শাসনভার ভারতের জনগণের দ্বারা পরিচালনার কথা। অর্থাৎ ভারতের
সর্বসাধারণের স্বাধীনতার কথা। এতে প্রমাণিত হয় তিনি কতবড় দেশভক্ত ও স্বাধীনতা সংগ্রামী
ছিলেন।
আমরা বাবাসাহেব
ড. আম্বেদকর ও গান্ধিজির মধ্যে চর্চা লক্ষ্য করতে পারি-
ড. আম্বেদকর- মিস্টার গান্ধি, স্বাধীনতার ব্যপারে
আপনিতো নৈতিকতার কথা বলেন। কিন্তু আপনারাতো আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছেন। তাই প্রথমে
আমাদের স্বাধীন করুন তারপর নৈতিকতার থেকে আপনাদের স্বাধীনতার কথা বলুন।
মি. গান্ধি- ড. আম্বেদকর, আমি তো ইংরেজদের গোলাম।
আমি আপনাকে কি করে স্বাধীন করব? প্রথমে আমাকে ইংরেজদের থেকে স্বাধীন হতে দেন, তারপর
আমি আপনার স্বাধীনতার বিষয়ে সহানুভূতির সঙ্গে ভাবনাচিন্তা করব।
ড. আম্বেদকর-মি.
গান্ধি, আপনিতো ইংরেজদের গোলাম। আমরা শূদ্র অতিশূদ্ররা তো আপনাদের গোলাম। অর্থাৎ আমরা
গোলামদের গোলাম। আপনি তো ইংরেজদের গোলাম কিন্তু আমাদের তো মালিক। আর পৃথিবীতে যেকোন
মালিক তার অধীন গোলামকে মুক্ত করার অধিকারী। (যদিও কোন মালিক কোনদিন কোন গোলামকে
মুক্ত করে না। মুক্ত করে দিলে মালিক আর মালিক থাকে না। গোলয়ামকে তার গোলামি থেকে মুক্তি
পাওয়ার জন্য সংঘর্ষ করতে হয়।) তাই আপনি আমাদের মুক্ত করতে পারেন। তবুও আপনি আমাদের
মুক্ত করছেন না।
স্বাধীনতাকে গোলামিতে রূপান্তর
১৭ আগস্ট ১৯৩২ সালে ড. আম্বেদকরের চারটি
দাবি স্বীকৃত হয়। এরফলে মূলনিবাসীরা স্বাধীন হয়ে যায়। গান্ধিজি ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে
স্বাধীনতা লাভ করেন। আর মূলনিবাসীদের ১৭ আগস্ট ১৯৩২ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ড.
আম্বেদকরের যে চারটি দাবি স্বীকৃত হয়েছিল সেটাকে স্বাধীনতার যে অর্থে বলা যায় সেটা
হচ্ছে DOMENION STATUS এর স্বাধীনতা। ইংরেজরা ভারতেই থাকবে কিন্তু সাংবিধানিক
অধিকারের প্রয়োগ করার জন্য মূলনিবাসীদের স্বতন্ত্র অধিকার রাখা হয়েছে। ইংরেজরা
কেন্দ্রীয় শাসন কাজ চালাবে, তাদের শাসন ব্যবস্থা চলবে কিন্তু সব ধরনের সাংবিধানিক অধিকার আমাদের থাকবে। একে বলা হয় DOMENION STATUS এর স্বাধীনতা।
বাবসাহবে ড. আম্বেদকর ইংরেজদের বোঝান
যে উচ্চবর্ণদের স্বাধীন করার আগে আমাদের স্বাধীন করতে হবে।
তারা ইংরেজদের গোলাম আর আমারা উচ্চবর্ণের গোলাম। উচ্চবর্ণীয়দের স্বাধীন করে দিলে তারা
মূলনিবাসীদের কোনো দিন স্বাধীনতা দেবেনা। তাই উচ্চবর্ণীয়দের নয়, আগে মূলনিবাসীদের স্বাধীন করতে হবে। ১৭ আগস্ট ১৯৩২
সালে যে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা (COMMUNAL AWARD) ঘোষিত হয়েছিল সেটা DOMENION
STATUS এর স্বাধীনতা ছিল। এই স্বাধীনতাকে গান্ধিজি পুনাচুক্তির মাধ্যমে গোলামিতে রূপান্তরিত
করেন। কারণ তাঁর দ্বারা চালানো স্বাধীনতার আন্দোলন সকলের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন ছিলনা।
শুধুমাত্র শাসক জাতির (উচ্চবর্ণীয়) দ্বারা চালানো তাদের স্বাধীনতার আন্দোলন ছিল।
বাবাসাহেব কেন উচ্চবর্ণীয়দের স্বাধীনতার আন্দোলনে সহভাগী হননিঃ-
এবার আমরা দেখি বাবাসাহেব ড. আম্বেদকরের আন্দোলন। বাবাসাহেব
আমেরিকায় শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে লালা
লাজপত রায় গিয়ে বাবাসাহেবকে বলেন, “আপনি অনেক বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। আপনার মধ্যে
সমাজের জন্য কাজ করার চেতনা আছে। তাই আপনি কংগ্রেসের সঙ্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশ
গ্রহণ করুন।” বাবাসাহেব তাঁকে বলেন, “আমি এখানে পড়াশুনা করার জন্য এসেছি। আমাকে প্রথমে
শিক্ষা গ্রহণ করতে দিন। ভারতে গিয়ে পরে আমি এসব দেখবো।” পরবর্তিতে বাবাসাহেব ভারতে
এসে ‘বহিষ্কৃত ভারত’ পত্রিকায় নিজের প্রতিক্রিয়া
দিতে গিয়ে লেখেন, “পরতন্ত্রে ( পরের অধীন) যাদের কথা আমরা সহ্য করতে পারছিনা, স্বাধীনতার
পরে আমাদেরকে তাদের লাথি খেতে হবে।” পরতন্ত্র অর্থাৎ ইংরেজদের শাসনকালে আমরা যাদের কথা অর্থাৎ উচ্চবর্ণীয়দের কথা এখনই সহ্য
করতে পারছি না। আর এই উচ্চবর্ণীয়রা যদি স্বাধীন
হয় তাহলে তো তারা আমাদের লাথি মারবে। বাবাসাহেবের ভবিষ্যৎবাণী বর্তমানে অক্ষরে অক্ষরে
মিলে গেছে। বর্তমানে আমাদের সমাজের লোকদেরকে উচ্চবর্ণীয়দের কাছে গিয়ে টিকিট চাইতে হয়।
টিকিট যদিও পাওয়া যায় নির্বাচিত হয়ে আসার জন্যও তাদের সাহায্য নিতে হয়।
লালা লাজপত
রায় ও কংগ্রেস ইংরেজদের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন চালিয়ে ছিলেন।
বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর উচ্চবর্ণীয়দের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন চালিয়ে ছিলেন।
তিলক ওবিসিদের
আইন সভায় যেতে না দেওয়ার জন্য গালি দিয়েছেন। গান্ধিজি অস্পৃশ্যদের স্বাধীনতায় রাজি
নন। তাহলে এটা প্রমাণ হয় যে, তিলক, গান্ধিজি, গোখলে, রানাডে এবং এদের কংগ্রেসের স্বাধীনতার
আন্দোলন সকলের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন ছিল না। তাঁরা শুধুমাত্র ইংরেজদের গোলামি থেকে
মুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন চালিয়েছিলেন। আর সেটাকে সকলের স্বাধীনতার আন্দোলন বলে প্রচার
করেছেন। মূলনিবাসী মহামানবরা ব্রাহ্মণদের গোলামি
থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যে আন্দোলন ১৮৪৮ সালে শুরু করেছিলেন সে আন্দোলন এখনও চলছে। মূলনিবাসীরা
এখনও স্বাধীন হয়নি। তারা এখনও উচ্চবর্ণীয়দের গোলাম হয়ে আছে।
বাবাসাহেবের
কথায় আবার ফিরে আসি-
বাবাসাহেব
আম্বেদকর ইংরেজদেরকে একটা প্রশ্ন করেন। সেটা হচ্ছে- আপনারা ভারতকে যে স্বাধীনতা
দিতে যাচ্ছেন সেটা দেশের স্বাধীনতা নাকি দেশের জনগণের স্বাধীনতা? দেশের স্বাধীনতা হচ্ছে
Freedom of the country আর দেশের জনগণের স্বাধীনতা হচ্ছে Freedom of the
people of the country. এর পরেও ইংরেজরা দেশকেই স্বাধীন করেছে। দেশের জনগণকে
স্বাধীণ করতে দেননি গান্ধিজি আর কংগ্রেস।
বাবাসাহেব যে
উচ্চবর্ণীয়দের স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি তার প্রমাণ খোদ পাঞ্জাবী গোরা ব্রাহ্মণ
অরুণ শৌরি তাঁর বই Worshipping False Gods. অর্থাৎ ‘মিথ্যা দেবতার পুজা’ নামক বইতে
জানিয়েছেন।
এই বই-এ তিনি
লিখেছেন, ড. আম্বেদকর স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু নিজেকে আম্বেদকরবাদী বলে প্রচার করা আম্বেদকরের
ভক্তরা বই লিখে জানিয়েছেন যে বাবাসাহেব স্বাধীনতার
আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বাস্তবে অরুণ শৌরী এবং আম্বেদকরবাদীরা দুজনেই মিথ্যা কথা প্রচার
করেছেন।
অরুণ শৌরী
লিখেছেন ড. আম্বেদকর স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেননি। আসলে তাঁর লেখা দরকার ছিল ড. আম্বেদকর
উচ্চবর্ণীয়দের স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেননি। আর যে আম্বেদকরবাদীরা লিখেছেন বাবাসাহেব
স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এটাও মিথ্যা কথা। একই ব্যক্তি পরস্পর বিরোধী
দুটো আন্দোলনে কিভাবে যোগদান করতে পারেন? বাবাসাহেব নিজে মূলনিবাসী বহুজনদের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন
চালিয়েছিলেন। উচ্চবর্ণীয়দের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। তাই তিনি ব্রাহ্মণদের স্বাধীনতার
আন্দোলনে সহভাগী হননি। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে অরুণ শৌরী বাবাসাহেবের বিরুদ্ধে কেন
একথা লিখেছেন? আর সেটা ২০০০ সালেই বা কেন? কারণ ২০০০ সালে ভারতীয় সংবিধানের স্বর্ণ
জয়ন্তীর বছর ছিল। স্বর্ণ জয়ন্তীতে লোক সংবিধার চর্চা করবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে
আম্বেদকরবাদী লোকেরা সংবিধানের বেশি চর্চা করেন। ৫০ বছরের পরে সংবিধান কতটা মহত্ত্বপূর্ণ
থাকবে ইত্যাদি প্রশ্নের চর্চা আম্বেদকরবাদীরা করতে পারেন। এই ধরণের চর্চা যাতে না হয়
বা কোন প্রশ্ন যাতে আম্বেদকরবাদীরা না করেন তার জন্য অরুণ শৌরী আগেভাগে বই লিখে জানালেন
যে, আপনাদের বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর স্বাধীনতার আন্দোলনে সহভাগী ছিলেন না। কারণ, আম্বেদকরবাদীরা
প্রতিক্রিয়া দিতে ওস্তাদ। তখন তাঁরা লিখে জানাতে শুরু করলেন, না না বাবাসাহেব স্বাধীনতার
আন্দোলনে সহভাগী ছিলেন।
ভারতে যে স্বাধীনতার দুটো আন্দোলন চলেছে; তার একটা হচ্ছে- উচ্চবর্ণীয়দের
স্বাধীনতার আন্দোলন। এই আন্দোলন ইংরেজদের
গোলাম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। দ্বিতীয়টা হচ্ছে- মূলনিবাসী মহামানবদের স্বাধীনতার
আন্দোলন। এই আন্দোলন উচ্চবর্ণীয়দের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য।
বর্ণব্যবস্থা, জাতিব্যবস্থা আর অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের মূলনিবাসী
মহামণীষীরা স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিলেন। উচ্চবর্ণীয়দের মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস লিখে
শুধুমাত্র তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের কথা
তুলে ধরেছে। এটা তাদের দ্বারা বিকৃত ইতিহাসের সঙ্গে চালাকী ছিল। তাদের লেখা ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে যে, তারা
সবসময় তাদের সুবিধার কথাই লিখেছে আর যাতে তাদের ক্ষতি হবে যে কথার কোন উল্লেখই করেনি।
কারণ এতে তাদেরই লাভ হয়েছে। কিন্তু মূলনিবাসী বহুজনদের এতে লাভ তো দূরের কথা বদনাম
আর ক্ষতি হয়েছে। তাই আমাদের ইতিহাস আমাদেরকেই লিখতে হবে। উচ্চবর্ণীয়দের যেটাকে লুকিয়ে
রেখেছে, আমরা সেটাকে সবার সামনে তুলে ধরব। অর্থাৎ
If They hide it, We must highlight.
এতোকিছু জানার পরেও কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে,
‘আমরা কি স্বাধীন নই? তার উত্তর – অবশ্যই না। আমরা যেটুকু অধিকার আজ ভোগ করছি সেটা
হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলনের ফসল মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে
বাংলা থেকে বাবাসাহেব ড. আম্বেদকরকে সংবিধান সভায় পাঠানোর জন্য। বাবাসাহেব সংবিধানে
মূলনিবাসীদের জন্য অর্থাৎ তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি
আর ধর্ম পরিবর্তিত লোকদের জন্য সাংবিধানিক
অধিকার দিয়েছেন। সেই অধিকার ভোগ করে তারা নিজেদের স্বাধীন মনে করছেন। প্রকৃতপক্ষে মূলনিবাসীরা
এখনো উচ্চবর্ণীয়দের গোলাম হয়ে আছে। মানসিক গোলাম। এই গোলামি থেকে মুক্তি
পাওয়ার জন্য মূলনিবাসী বহুজন মহামানবদের বিচারধারাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতার
আন্দোলনের বিউগল বাজাতে হবে। তার জন্য প্রত্যেক মূলনিবাসী বহুজনকে তন মন ধন দিয়ে সহযোগীতা
করতে হবে।
(তথ্য- ১. পুনাচুক্তির দুষ্পরিণাম- লেখক- বামন মেশ্রাম।
অনুবাদক- জগদীশচন্দ্র রায়।
২. স্বাধীনতার দুই আন্দোলন- লেখক- ডি. আর.
ওহোল। অনুবাদক- জগদীশচন্দ্র রায়।)
0 comments:
Post a Comment