Saturday 30 July 2016

// // Leave a Comment

ডাঃ সি, এস, মীডের সংক্ষিপ্ত জীবনী -লেখক_ শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর। সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার

ডাঃ সি, এস, মীডের সংক্ষিপ্ত জীবনী
  ডাঃ সিসিল সিলাস মীড,(১৮.১০.১৮৬৬  ১৭.৬.১৯৪০)
(সৌজন্যে- শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র সুধা। লেখক_ শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর। সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার, পৃষ্ঠাসংখ্যা-৩৪৩-৩৪৪)  
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই অক্টোবর তাঁর জন্ম হয়। তাঁর মৃত্যু হয় দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুন। তিনি ছিলেন ভারতের পূর্ব বাংলায় ব্যাপ্টিস্ট মেডিক্যাল মিশনারী। তাঁর পিতার নাম সিলাস মীড, যিনি এডিলেড শহরের ফ্লিন্ডার স্ট্রীট ব্যাপ্টিষ্ট চার্চে থাকতেন। এখানেই তিনি খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হন, অর্গান বাদক হয়ে যান এবং গীর্জার গায়ক দলের মাস্টার হয়ে যান। তিনি প্রিন্স আলফ্রেড কলেজ ও এডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বি. এ. পাশ করেন। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে এম.বি;বি.এস-এ স্বর্ণমেডাল পেয়ে পাশ করেন (এখানে স্মরণীয়, বাবাসাহেব ডঃ বি.আর. আম্বেদকর সেই ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দেই ১৪ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন।)

ডাঃ সুভাস চন্দ্র বিশ্বাস লিখিত অস্ট্রেলিয়ার ড. সি,এস,মীডের জীবন কাহিনীগ্রন্থের ৮ পৃষ্ঠার ড. সি.এস. মীডের জন্ম তারিখ লেখা আছে ১৬ অক্টোবর ১৮৬৬ খ্রিঃ।
* ২৯ বছর ৪ মাস বয়সে ২৪ ফেব্রয়ারি ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে Miss. Aliec Pappin-কে বিবাহ করেন। পৃঃ ১৮
* Miss. mead ১৯২৫ খ্রি. মারা যান (পৃষ্ঠা : ৩৭)।
* ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ওড়াকান্দি তথা ভারত ত্যাগ (পৃষ্ঠা: ৪৯- মীডের চিঠি)
* মৃত্যু ১৭ই জুন ১৯৪০ খ্রিঃ। মৃত্যুকালে বয়স ৭৪ বছর ৬ মাস ২১ দিন (পৃষ্ঠা ৩৯)
* ডাঃ সি. এস. মীডের বাড়ির ঠিকানা ৬৫, Finder Street, Near Victoria Square, Adelaide, Asutralia.
   ১৯০৬ সালে ওড়াকান্দি আমন্ত্রণ, ১৯০৬ সালে ফরিদপুরে।

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপ্টিস্ট ইউনিয়ন পরিচালিত ফরিদপুর মিশনের চাকুরিতে যোগদান করেন ডাঃ সি.এস.মীড। তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে আগমন করেন। বৃহত্তর পাবনা ও ফরিদপুরে মেডিক্যাল মিশনারী হিসেবে কাজ করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে এ্যালিস পাপ্পিন নাম্নী অস্ট্রেলিয়ার প্রথম দিককার এক ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীকে বিয়ে করেন। তাঁদের ছিল দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটি শৈশবেই মারা যায়। ২ কন্যার নাম কুমারী ডরথী ও কুমারী মার্জ্জরী (পি.আর.ঠাকুরের আত্মচরিতপৃঃ ৫৬)। মীড সাহেব বাংলায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন এবং তিনি ছিলেন মুক্ত মাঠের ক্লান্তিহীন ধর্মপ্রচারক। তিনি স্থানীয় ভাষায় প্রচার পুস্তিকা ও ছন্দোবদ্ধ স্তব স্তোত্র ও ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করতেন। বঙ্গদেশে তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশন ফেডারেশনের সকল ক্রিয়া কর্মের চালিকা শক্তি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার সিডুল্ড কাস্ট নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণ পান ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে ডাঃ সি.এস.মীডের আগমন। কয়েকটি অস্ট্রেলীয় এবং ভারতীয় মিশনের কর্মীবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ নমঃশূদ্র কেন্দ্র ওড়াকান্দি গ্রামে যান এবং ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডাঃ সি.এস.মীডের নেতৃত্বে কর্মীবাহিনীও সেখানে যান। বহু বাধা পেরিয়ে ওড়াকান্দি গ্রামে ৫ বিঘা জমি অর্জন করেন এবং সেখানে মিশন , অনেক স্কুল, একটি দাতব্য চিকিৎসালয়, একটি বিধবা নিবাস, একটি চার্চ এবং তার কর্মীবাহিনীর আবাসন গৃহাদি তৈরি করেন। যদিও এসব করেও মিশনারীদের উচ্চাশার সব কিছু পূরণ করতে পারেন নি কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে বাংলার যে কোনো চার্চের চেয়ে ওড়াকান্দি চার্চের সদস্য সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এখানেই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্টগণ তাদের কাজকর্ম চালাতেননমঃশূদ্রদের মধ্যে কাজ করার জন্য ডাঃ সি.এস. মীডকে কাইজার-ই-হিন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
    স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ার কারণে তিনি ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে অবসরে যেতে বাধ্য হন। এবং অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে গিয়ে বাস করার সময়ে এডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের স্টাফ হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ব্যাপ্টিস্ট মিশনের দক্ষিণ অস্ট্রেলীয় সেক্রেটারী হিসেবে উদ্বুদ্ধকারী প্রচারক ও লেখক হিসেবে মিশনারী স্বার্থের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অগ্রগামী করে চলেন।
W.Barry লিখিত There Was A Man (Melbourne. Nd.)  GERARD B. BALL-এর বর্ণনা অনুযায়ী প্রাপ্ত। সাউথ ক্রস কলেজ, ২০০৪, ইলেক্ট্রনিক ভারসান এটি, Evangelical History Association O Australia and the author, 2004 Gi content.
প্রসঙ্গ ডাঃ সি.এস. মীড
ডাঃ সিসিল সিলাস মীড, সংক্ষেপে ডাঃ সি.এস.মীড, একজন অস্ট্রেলীয় মিশনারী ডাক্তার। ব্রিটিশ ভারতে তিনি এখানে এসেছিলেন ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে। শিক্ষা, চাকুরী, আত্মসম্মান এবং সামাজিক ন্যায়বিচার পেতে তিনি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে প্রভূত সাহায্য ও পথনির্দেশনা দান করেছিলেন। আজকাল অনেকে বলে থাকেন মিশনারীদের একমাত্র লক্ষ্য গরীব মানুষদের খ্রিষ্টান বানানো। কিন্তু কতজন নমঃশূদ্র খ্রিষ্টান হয়েছেন? তথাকথিত উচ্চবর্ণদের চেয়ে কম। তিনি এ রকম একজন মহান ব্যক্তি। মনেপ্রাণে একজন সত্যিকার খ্রিষ্টান ব্যাপ্টিস্ট। ভারতীয় সংস্কৃতির বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একটি সমাজকে প্রস্তুত করেছিলেন। শিক্ষিত সমাজ যাঁদের ত্যাগ করেছিল, শাসকেরা যাঁদের কথায় কর্ণপাত করেনি, তাঁদের দায়িত্ব তিনি নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। দুঃখজনক ব্যাপার হল এই উপমহাদেশের লোকেরা তাদের সমস্ত প্রচেষ্টার দ্বারা সেই সব মানুষদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের আন্দোলনের বদলে তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে কোণঠাসা করে রেখেছিল। এতে ভারত ধর্মীয় জাতবৈষম্যের দেশের তালিকায় নথিভুক্ত হয়ে গেছে।
Dr. C.S. Mead-এর জীবনী Walter Barry “There Was a man”. তাঁর মৃত্যুর ৫ বছর পরে লেখা।

সংক্ষিপ্ত সার
শিক্ষা, সঙ্গীত এবং খেলাধুলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডাঃ সিসিল সিলাস মীড অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় পুরস্কার প্রদানের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সার্জারীতে প্রথম সোনার মেডেল তিনিই পেয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে। তথাপি তিনটি ক্ষেত্রে নিশ্চিত উজ্জ্বল আশাপ্রদ জীবন ছেড়ে তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে একজন মিশনারী ডাক্তার হিসেবে পূর্ববঙ্গে (বর্তমানের বাংলাদেশে) চলে আসেন। তথাকথিত উচ্চজাতের মধ্যে ধর্মযাজকত্ব শেষে ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিয়ে স্ত্রী ও দুটি ছোট মেয়ে নিয়ে বঙ্গের গাঙ্গেয় বদ্বীপের জলাভূমিতে বসবাসরত সমাজবাহ্য নমঃশূদ্রদের মধ্যে বসবাস ও যাজকত্ব করার জন্য এলেন। তাঁদের জীবনে প্রচণ্ড পরিবর্তন আনার কারণে - বাস্তব এবং আধ্যাত্মিকভাবে - ভারতের ভাইস্‌রয় তাঁকে রূপার মেডেল দিয়ে পুরস্কৃত করেন।
    শ্রী সুভাষ বিশ্বাস লিখিত অস্ট্রেলিয়ার ডঃ সি. এস মীডের জীবন কাহিনীগ্রন্থের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠা ডঃ সি.এস মীডের বাড়ির ঠিকানা ও বর্ণনা।
    জন্ম - ১৬ই অক্টোবর ১৮৬৬, পিতা-সিলাস মীড M.A. LLB. ৫ আগস্ট ১৮৬১ প্রতিষ্ঠিত ফিল্ডার স্ট্রীট ব্যাপটিস্ট মিশনারির প্রথম ধর্মযাজক। বিবাহ- মিস স্টাপেলের সঙ্গে। মৃত্যু-১৭ই জুন ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর ৬ মাস ২১ দিন। মিসেস মীড মারা যান ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। মীডের ২ মেয়ে- বড় Miss Dorothy, ছোট মেয়ে মারজেরী, কোন ছেলে নেই - পৃষ্ঠা ২৩। ডাঃ মীডকে সাহায্য করতেন Mrs. Mead এবং Miss. Bertha Tuck, Miss Alice Pappin. এ্যালিস প্যাপিন সাউথ অস্ট্রেলিয়ার উইলিয়ামস্টোনে-এ জন্মগ্রহণ করেন - পৃষ্ঠা ১৯। ২৯ বছর ৪ মাস বয়সে ডাঃ মীড বিয়ে করেন ২৪ ফেব্রয়ারি ১৮৯৬-এ অন্ধ্র প্রদেশের Ongole-এ বসে, কোলকাতা থেকে ১৩৭০ কি. মি দক্ষিণে, মাদ্রাজ থেকে ২৯৩ কি. মি উত্তরে - পৃষ্ঠা ১৮। Octaober, ১৮৯৩-এ যখন মীড ফরিদপুরে এলেন তখন ফরিদপুর মিশনারি সেন্টারে ছিলেন Miss Arnold, Miss Gilbert, Miss Alice Pappin, Miss Parsous, Miss Tack & Miss Archer. ৮ বছর বয়সে C.S. Mead-কে প্রিন্স আলফ্রেড কলেজে ভর্তি করেন। ১৮৮২ সালে Scholarship১৮৮৭-তে B.A, ঐ সালেই এডিলেড মেডিকেল কলেজে ভর্তি, ১৮৮৯ সালে M.B; Ch. B ডিগ্রি লাভ।
M.B = Bachelor of Medicine; Ch. B=Chiruragiae Baccalaures (Bachelor of Surgery) 1st class Hons. ৩০ বছর মানুষের সেবার পর Dr. Mead নিজেই হাঁপানীতে আক্রান্ত- পৃষ্ঠা ৩২

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে চিরকালের জন্য ওড়াকান্দি ত্যাগ- গুরুচাঁদকে চিঠি পৃষ্ঠা ৪০।
Read More

Saturday 23 July 2016

// // Leave a Comment

শ্রীশ্রী হরিচাঁদ কে কে কে ? ? ? -কালিদাস বারুরী


শ্রীশ্রী হরিচাঁদ কে ?
-কালিদাস বারুরী
     ইংরাজী ১৮১২ সনের ১১ই মার্চ পৃথিবীতে একটি জ্যোতিষ্কের জন্ম হল। খানা-খন্দ-বিল-বাওড় ঝুপড়ির ভিতরে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর উজ্জল দীপ্তি। হাজার বছরের অন্ধতমস কারারুদ্ধ ঘৃণিত দাস  জীবনে লাগল দীপ্তি ছটা কালরাত্রির ঘোর কাটিয়ে অজ্ঞানতার জড়তা সরিয়ে আলোর তলায় জড় হতে লাগল মানুষ। জাত পাতের যাতাকলে পিষ্ট মানুষ শিকল ছিড়ে অচ্ছতের বাঁধন কেটে ছুটে এলকাতারে কাতারে মানুষ জ্যোতিষ্কের আকর্ষণে। জ্যোতিষ্কের স্পর্শে অন্ধ পেল আলোর সন্ধান, মুক পেল বাকশক্তি, নিরক্ষর পেল বর্ণমালা আদর্শলিপি। আপামর মানুষ পেল সহস্রাব্দের ঘৃণা লাঞ্ছনা, শোষণ দাসত্ব গোলামীর হাত থেকে মুক্তির স্বাদ। জ্যোতিষ্ক সকলকে সস্নেহে ধর্ম দিলেন, কর্ম দিলেন, বিদ্যা দিলেন, ধন মান যশ দিলেন। দিলেন সামাজিক মর্যাদা। দিলেন অদম্য সাহস আর বীরত্বের শিরস্ত্রাণ।
      কে এই যাদুকর জ্যোতিষ্ক ?
      যার যাদুবিদ্যায় তেত্রিশ কোটি দেবতার সিংহাসন টলমল। কার অঙ্গুলি হেলনে দেবতাদির জন্মদাতা ফন্দিবাজ শোষক দলক বিধি বিধান প্রবর্তক সুতোধারী চামচেদের কঠিন গেড়ো ফসকা গেড়োয় ভূপতিত হয়। কে কে এই যাদুকর জ্যোতিষ্ক ?
যাঁর যাদুতে দন্ডমুন্ডের কর্তা সমাজ পতিদের কঠোর ডান্ডা ঠান্ডাঘরে জমা পড়ে। যিনি বেদবিধি,  কল্পিত মূর্তিপূজা, তন্ত্ৰ-মন্ত্রতিলক, দেব-দেবী, ঘট-পট বাম পদে ঠেলে দিয়ে মুক্ত কষ্ঠে এদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। অস্ত্র নয়, মন্ত্র নয়, তন্ত্র নয় অথচ বিনা রক্তপাতে বিনা যুদ্ধে উদ্ধার করলেন কোটি কোটি মানুষকে। কে কে কে এই অভয়ানন্দ জ্যোতিষ্ক ?
      এই জ্যোতিষ্কই যুগনায়ক বহুজন সমাজের মুক্তিসূর্য শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ। প্ৰেম-জ্ঞান-সাম্য-স্বাধীনতা দীপ্ত জ্যোতি বিকিরণকারী মহাজন হরিচাঁদ। হীনমন্য,দলক মনুর মেরুদন্ড ভঙ্গকারী পতিত পাবন শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ। ফুসমস্তরী দৈব দাসত্বের ঐশ্বরীক শৃঙ্খল ভেঙ্গে হরিচাঁদ দিলেন নতুন ধর্ম। নতুন  মত ও পথ। তিনি বললেন -যে ঈশ্বর মানুষকে বঞ্চনা করেছে, ঘৃণা করেছে - বর্ণবর্মে বিভাজন  করেছে, শিক্ষা ও ধর্মাচরণ থেকে দূরে ঠেলে রেখেছে, প্রতিপদে অপমানের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে, সেই ঈশ্বরকে আমি মানি না। তার পূজাও করি না। ফুৎকারে অস্বীকার করলেন হিন্দুত্ববাদীদের যাবতীয় মেকী ধর্মাচার, শৌচাচার। অস্বীকার করলেন হিন্দুধর্মের পক্ষপাতদুষ্ট সমস্ত দেব দেবী। বাণী দিলেনঃ- পূর্ণ আমি সর্বময় অপূর্ণের পিতা। সাধনা আমার কন্যা আমি জন্মদাতা।
আমিই ভগবান - আমিই পূর্ণ অবতার। সাধনা (স্ত্রীলিঙ্গ)-র আমি জন্ম দিয়েছি। আমাকে সাধনা কর আমাকে ভজনা কর। আমি তোমাদের সব দিতে এসেছি।
                       রাম-কৃষ্ণ বুদ্ধ - যীশু কিংবা গৌরাঙ্গ।
                      আমাকে সাধনা করে, পেতে মম সঙ্গ।
    নিজের পরিচয়ে নিজেই উজ্জ্বল আলোর মত পরিস্কার করে দিলেন পূৰ্ণব্রহ্ম হরিচাঁদ। মতুয়ারা কি সত্য সত্যই হরিচাঁদের স্বরূপ বুঝেছে? কৃষ্ণ মন্ত্র নয়, রাধা মন্ত্র নয়, রা-স্বাও নয়। মন্ত্র দিলেন  নিজ নাম হরিবোল-হরিবোলএতেই মুক্তি, এতেই মোক্ষ, এতেই জীবনের বিকাশ, শক্তি ও চেতনা। কেবল হরিচাদের নামকীর্তন। ধর্ম দিলেন মতুয়া ধর্ম। বাণী দিলেন –
কোথায় ব্রাহ্মণ দেখো কোথায় বৈষ্ণব।
                            স্বার্থবশে অর্থ লোভী যত ভন্ড সব।
                            স্বাৰ্থ শূন্য নামে মত্ত মতুয়ার গণ।
                           ভিন্ন সম্প্রদায় রূপে হইবে কীর্তন।।
- মতুয়া ধর্মের অনুগামীদের বিধি বিধান ও ধর্মাচরণ পদ্ধতি ও দয়াধীশ দরবেশ শ্রীহরি দিলেন - দীক্ষা নাই করিবে না তীর্থ পর্যটন
মুক্তি স্পৃহা শূন্য নাই সাধন ভজন।।
                             যাগ-যজ্ঞ, তন্ত্র - মন্ত্র, দীক্ষা
                             কোন কিছুর নাহি প্রয়োজন।
                            হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বজন।........
মালা টেপা ফোঁটা কাঁটা জল ফেলা নাই।
                           হাতে কাম মুখে নাম, মন খোলা চাই।
                           বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
                           অন্য তন্ত্র - মন্ত্র এরা বাম পদে ঠেলে।
                           সহজ গার্হস্থ্য ধর্ম সর্বধর্ম সার,
                          গৃহীকে মিলাবে মুক্তি শ্রীহরি আমার
    অর্থাৎ প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় বিধানীয় আচার অনুষ্ঠান যাগযজ্ঞ, মালা টেপা ফোঁটা কাঁটা কোন কিছুর   প্রয়োজন নেই। তিনি বললেন, দায় দায়িত্ব, কর্তব্য সেবা ধর্ম ফাঁকি দিয়ে একক মুক্তি সর্বস্ব গুহা সন্ন্যাসী, জঙ্গল সন্ন্যাসী নাহি প্রয়োজন। তিনি, সহজ গার্হস্থ্য ধর্মপালনী সন্ন্যাসী হবার বিধান  দিলেন। তিনি গার্হস্থ্য ধর্মকে সর্ব ধর্ম সার বলে মুক্ত এবং মুক্তির সুমহান রথ ও পথের দিশা দিলেন।
     কবি রসরাজ প্রভুর মুখ নিঃসৃত রোমহর্ষক বাণী লিখলেন। লিখলেন, হরিপ্রেমী মতুয়া ভক্তদের শুদ্ধ বুদ্ধ চরিত্র গঠন ও অধ্যাত্মবাদের চরম চেতনাদীপ্ত ঐশী শক্তির আত্মদীপ প্রজ্জলনী আচরণের কথা।
                          নাহি চেনে দেব দেবী ঘট-পট কিংবা ছবি।
                          জানে, মনে প্রাণে শুধু হরিচাঁদে।।
                          জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
                          ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্ৰষ্টা।।
 হরিচাঁদ নামরূপ কোরামিন ট্যাবলেট সেবন করেই জেগে উঠল
মৃতপ্রায় জাতি। 
                          পরম উদার এই হরিনাম মন্ত্র।
গুপ্ত মন্ত্র নহে ইহাত স্বচ্ছ স্পষ্ট শান্ত।।...
                           হরিনাম মন্ত্র বিনা, সব মন্ত্র ফাঁকি।।
হরিচাঁদ ঠাকুর কুকুরের উচ্ছিষ্ঠ খেতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু মানতে রাজি ছিলেন না হিন্দুধর্মের ভেদাভেদ ব্যবস্থার মেকি শুদ্ধাচারপবিত্র অপবিত্রতার নিয়ম কানুন। নিরালম্ব ও স্বাবলম্বী ছিলেন তিনি। মতুয়াধিপতি শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ সত্যদ্রষ্টা ত্রিকালজ্ঞ সর্বদশী হরিচাঁদ। 

     হিন্দুর ভগবান রামচন্দ্র অন্যায় ভাবে কাপুরুষের মত ধ্যান মগ্ন সৎচরিত্রবান শম্ভুকের শিরচ্ছেদ করেছে। ছলনার আশ্রয় নিয়ে বালীকে বধ করেছেবীর মেঘনাদ ও রাবণকে নোংরা ছলচাতুরি করে হত্যা করেছে। শ্রীকৃষ্ণ শূদ্রপাপীদের বিনাশ করার জন্য এবং সাধু ব্রাহ্মণ বাণিয়া পূণ্যবানদের রক্ষার জন্য বার বার যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। কৃষ্ণের ছল চাতুরীর কথা লিখে শেষ করা যাবে না। ব্রাহ্মণ কুমার অশ্বথামা পাঞ্চালীর পাঁচ শিশুপুত্রকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছে। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে এমন কীর্তি কাহিনী পাপ নয় বরং পূণ্যের।
      কিন্তু দলিত রাজ হরিচাঁদ কোনদিন অস্ত্র স্পর্শ করেন নি। হিংসা দ্বেষ মিথ্যাচার ছলনা কূটনীতি এবং বিভেদনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। বরং এইসব বদগুণে পরিপুষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে  তাঁর ছিল আপোষহীন মুক্তি সংগ্রাম ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ও বিধিবিধান অনুযায়ী অস্পৃশ্য চন্ডাল হরিচাঁদ ছিলেন সর্বনিম্নস্তরের ঘৃণিত মানুষ। তাঁর মানব হিসাবে কোন স্বীকৃতি ছিল না। ধর্মাচরণের অধিকার ছিল না। মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। শিক্ষার  অধিকার ছিল না। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদীদের ত্রিসীমানার বাইরে রাখা হয়েছিল শ্রীহরিকে। প্রশ্ন এখানেই - এ হেন অবস্থার  প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ প্রবর্তিত মতুয়া ধর্ম হিন্দুধর্ম বা তার লেজুড় হয় কি করে ? প্রেমই তো ধর্ম। ঈশ্বর প্রেমময় জগদীশ্বর। কমই ধর্ম। ঈশ্বর অনন্ত কর্মময় সঞ্চালক। ধর্মই জ্ঞান, সত্য আর সত্যই তো ঈশ্বর। একমাত্র ঈশ্বরই তো পূর্ণ স্বাধীন। মতুয়া ধর্মের তাত্ত্বিক
তত্ত্ব এইসকল অবস্থার এককিভবন অর্থাৎ প্রেম কর্মজ্ঞান স্বাধীনতার তত্ত্ব কথা। কিন্তু হিন্দু ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি, অপ্রেম, ভেদাভেদপূর্ণ।
     দাসত্বের আগল ভেঙ্গে হরিচাঁদের মতুয়া  ধর্ম প্রেম বন্যায় ভাসিয়ে গলাগলি, মাখামাখি,  মেশামেশি করে ঐক্যবদ্ধ হল বাঙলার মানুষ।
স্বাৰ্থত্যাগী প্রেমোন্মত্ত ভাবের পাগল।......
                           মেয়ে পুরুষেতে বসি একপাতে খায়।
                           মেয়েদের এটো খায় পদধূলা লয়।।
 যে যুগে কুলীনের দল শত শত বিবাহ করে যৌন সুখ ও আত্মসুখে মশগুল সেই যুগে গার্হস্থ্য ধর্মের এই বলিষ্ঠ প্রকাশ সমাজ বিপ্লবের মহান কীর্তি। আর এই কীর্তির মহাজন মহাজ্যোর্তিময় শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ তাঁর ধর্মের নাম ‘মতুয়া ধর্ম’
প্রেম অনুরাগে সব ভকত জুটিল।
মতুয়া বলিয়া দেশে ঘোষণা হইল।।
 হিন্দু বলে ঘোষণা হয় নাই। ব্রাহ্মণ, কায়স্ত, বৈদ্য, শূদ্র , হাড়িমুচি-ভোম বলেও ঘোষণা হয় নাই। হরিচাঁদ প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মানুরাগীরা ‘মতুয়ানামে পরিচিত হল আর এখনও তাঁরা পথে ঘাটে সংবাদে অনুষ্ঠানে পোষ্টারে মেলায় নেতা নেত্রীর মুখে ‘মতুয়া’ নামেই খ্যাত। তা সত্বেও মতুয়ারা    হিন্দুত্ববাদী আচরণের দুৰ্গন্ধ শরীর থেকে বুয়ে ফেলতে পারে নাই। দাসত্বের অমাবস্যার রাত এখনও কাটল না। এরা কি মতুয়া? না মতুয়া নামের কলঙ্ক? যৌবনে তার কন্তে ধ্বনিত হল  তথাগতের মহান বাণী আত্মদীপ ভব।
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য
যশোবন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ
মহাচীন জাপানেতে যত জাতি রয়,
বৌদ্ধনীতি মানে তাঁরা বীর পরিচয়।
বৌদ্ধধর্মে মুক্তিমন্ত্র তাঁরা সব পায়
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তলে ভারত ঘুমায়।।’
  মৃতসঞ্জীবনী সুধা দিলেন  মতুয়ানাথ হরিচাঁদ। শোনালেন স্বাধীনতার মন্ত্র। যুদ্ধের নিশান লালঝান্ডা সঙ্গে শান্তির প্রতীক সাদা বর্ডার। রণডঙ্কা আর শিঙ্গা বাজিয়ে হুঙ্কার দিলেন করুণাঘন শ্রীহরি সিদ্ধ মহাপুরুষ হরিচাঁদের প্রেম প্রক্ষালনে উত্তাল তরঙ্গায়িত পতিত জনসমাজের ভগ্ন হৃদয়ে প্লাবিত হল হারানো আত্মসচেতনতা এবং ঘটল আত্মনির্ভরতার  অজেয় শক্তির স্ফুরণ। সংঘবদ্ধ হল সমাজ। অসহায় ব্রাহ্মণ সমাজ হয়ে পড়ল নীরব, বিক্ষুব্ধ দর্শক। শুরু হল বঙ্গের চন্ডাল বিপ্লব। বেদ-বিধি, শৌচাচার, স্নানাহ্নিক-সন্ধ্যাহিক, তন্ত্ৰ-মন্ত্র, মালাটেপা, ঘট-পট, দেব-দেবী, মূর্তিপূজা, তীর্থযাত্রা, গুরুগিরি সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে পচাপুকুরে ঘৃণায় নিক্ষেপ করলেন হরিচাঁদ।‘হরিবোল’ সম্বল করে ডঙ্কা বাজিয়ে বিজয় নিশান উড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ মতুয়া সংঘ শক্তির প্রতাপের সামনে ব্রাহ্মণ সমাজের ব্রহ্ম তেজ লুপ্ত হল বঙ্গের মাটিতে। গলার সুতো ছিড়ে অক্ষয় চক্রবতীর বন্য জীবন ধন্য হল হরিচরণ বরণ করে। বিনা রক্তপাতে মানবতাবাদী ধর্ম বিপ্লব ঘটিয়ে পরমপুরুষ হরিচাঁদ বিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ শিরঃচুড়ামণি ৷        সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও সম মর্যাদার দাবিতে কাবাবদের (কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য) বিরুদ্ধে মহাবিপ্লবের রণডঙ্কা বেজে উঠল ঐক্যবদ্ধ সংগঠিত চন্ডালদের গণ-আন্দোলন। ১৮৭২ সাল। ধর্মের দোহাই দিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ, মৌরুসিপাট্টার ব্যভিচারী আত্মসুখ চিরস্থায়ী করার নামে শঠতা, প্রবঞ্চনা, হীনমন্যতা সৃষ্টিকারী  কাবাবদের একচ্ছত্র কায়েমী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অগ্নিবান ছুঁড়লেন মতুয়াধীশ চন্ডালাধিপতি হরিচাঁদ, সঙ্গে বালক উত্তর পুরুষ শিষ্য ও সন্তান রাজর্ষি গুরুচাঁদ। গুরুচাঁদ মিটিং করলেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রামে গ্রামে জানিয়ে দেওয়া হল।
১) রমণীরা দ্রব্যসামগ্রী বেচতে আর হাটে বাজারে যাবে না।
২) স্বজাতি ভিন্ন অন্য কোন জাতের বাড়ি কাজ করবে না।
 ৩) ব্রাহ্মেণেতর কোন হিন্দু জাতির রান্না গ্রহণ করবে না।
 ৪) কেউ হাসপাতাল এবং জেলখানার নোংরা পরিস্কার করবে না যে পর্যন্ত কর্মীদের সরকারী বেতন ও মর্যাদা না দেবে।
      এতেই আগুনের অগ্নিবলয় দাউ দাউ করে জুলে উঠল। আমগ্রাম, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনার চন্ডালরা অগ্নিতেজে জলে উঠল। ভারতবর্ষের প্রথম ট্রেড ইউনিয়নের মুভমেন্টের সূত্রপাত এবং প্রথম স্ট্রাইক বা হরতাল। হাস্পাতার চত্তর আর জেলখানা নরক কুন্ডে ভরে গেল। গুরুচাঁদ ব্যর্থ হননি। তাঁর দাবী মেনে ইংরেজ সরকার-এর ফরিদপুর ডি.এম. ১৯৭৩ সনে লিখলেন “......... Like Hospital, Jail and dust become too dirt and blowing serious bad smell. So complete was the strike that the fields…….. untilled the houses untouched, and not a chandal in the service of Hindu or Mohmandun or a chandal woman was seen in any market. ব্যর্থ হয়নি দলিলদের প্রথম গণ আন্দোলন। লাল নিশানের তলে তীব্র শক্তিতে উল্লফন দিল শতাব্দীর ঘুমন্ত চন্ডাল সমাজ, অনেকে বলে থাকেন, চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব আন্দোলনই বাঙালি জীবনে প্রথম রেনেসাঁস। আসলে চৈতন্যদেবের প্রচেষ্টায় একটাআধ্যাত্মিক গণতন্ত্র তৈরী হয়েছিল সত্য। সেখানেও হিন্দুত্ববাদী দৈব শক্তির প্রভাব বর্তমান। শ্রীশ্রী জগন্নাথ এবং শ্রীকৃষ্ণের যাবতীয় দৈব দোহায়ী কল্প জগতের আধ্যাত্মবাদ পরিপুষ্ট এই বৈষ্ণবীয় আচার অনুষ্ঠান। শ্রীচঈতন্য সাধারণ মানুষের অর্থনঈতিক ও শিক্ষার দিকে কোন দৃষ্টিপাত করেন নি। ইহকাল, পরকাল, পুর্নজন্ম, স্বর্গ, নরক, বিগত জীবনের কর্মফল ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের মৌলিক দিকগুলি ও বৈষ্ণব ধর্মকারবাদিদের বিভীষিকাময় এক কল্পলোকের মোহজালে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে এর থেকে বিরিয়ে আসা শিক্ষিত জনের পক্ষেও কঠিন।  
    কিন্তু, সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ আশা আকাঙ্খা আনন্দ বেদনার বাস্তব সমাধান ও বিশ্বাসের ভিত্তিই হল মতুয়া তত্ত্বদর্শন। মতুয়াধৰ্ম বাহিক আড়ম্বর পূর্ণ ধর্মাচারে আবদ্ধ না থেকে মানুষের বাস্তব মানবিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যথার্থ মানবীয় ধর্ম আখ্যায়িত করেছ। অবাস্তব পুত্তলিকা জড়পদার্থ পূজার ধর্মাচরণে মতুয়া ধর্ম আদৌ বিশ্বাসী নয়। বৃহৎ মানুষের উন্নয়নমূলক সাধনাই মতুয়া ধর্মের শ্রেষ্ঠ সাধনা।
“গৃহস্থ্য আশ্রম ধন্য ভূতলে নরের জন্য
                             সবতীর্থ সর্ব পূণ্য গৃহাশ্রমে রয়।
  গৃহীকে আশ্রয় করি, জীব রহে দেহ ধরি,
গৃহাশ্রম সর্বোত্তম সেই হেতু কয়
শ্রীশ্রী ঠাকুর হরিচাঁদ আবার বললেন-
ঠাকুর কহেন বাছা, ধর্ম কৰ্ম্ম সার।
                              সর্বধর্ম হতে শ্রেষ্ঠ পর উপকার।
     কে এই হরিচাঁদ? যিনি এখন থেকে পৌনে দুশ বছর পূর্বে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন-সমাজের পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
 নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।। তাই, শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর মতুয়া ধর্মই বাঙালি  জনমানসে প্রথম রেনেসাঁস এনেছিলেন। ব্যবসাভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্ম ফুসমন্তরে মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক গড়ে দেয় কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবধান বজায় রাখে। সেবাদাসী, দেবদাসী, প্রসাদী দাসী এসব হিন্দু ধর্মের অঙ্গ। মতুয়া ধর্ম এর চরম বিরোধী।
     এরই প্রেক্ষাপটে প্রমাণ করে, মতুয়াধর্ম স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন ধর্ম। অন্য কোন ধর্মের উৎস থেকে মতুয়া ধর্মের জন্ম হয়নি। বিশেষ করে ফাদারলেস হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক কেউ নয়, এর  জন্মের কোন সাচ্চা ইতিহাস নাই। মতুয়া ধর্ম কোনক্রমেই হিন্দু ধর্মের লেজুড় নয়। মতুয়া ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জনক পূৰ্ণব্রহ্ম হরিচাঁদ-মাতা শান্তিদেবী। মতুয়াদের দুটি গোত্র, হরিচাঁদ গোত্র এবং  গুরুচাঁদ গোত্র।
জয় হরিচাঁদ-জয় গুরুচাঁদ
--------------------------------------------------------

   
Read More

Saturday 16 July 2016

// // Leave a Comment

মরিচঝাঁপি-নৈঃশব্দের অন্তরালে-এতব ছর পরে কেন? লেখক নিরঞ্জন হালদার

মরিচঝাঁপি-নৈঃশব্দের অন্তরালে-
-জগদীশচন্দ্র মন্ডল (পৃষ্ঠা সংখ্যা-চ,ছ,জ)
এত ছর পরে কেন?
লেখক নিরঞ্জন হালদার
(আনন্দবাজার পত্রিকার অবসরপ্রাপ্ত সহ-সম্পাদক এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশালের ভারতীয় শাখার প্রাক্তন সম্পাদক)
     অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, হাসনাবাদ ও মরিচঝাঁপিতে দণ্ডক-ফেরৎ উদ্ধাস্তুদের গণহত্যা  হয়েছে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে, ২৩ বছর পরে হাসনাবাদ ও মরিচঝাঁপিতে গণহত্যার ঘটনা নতুন  করে জানানোর কী দরকার? গণহত্যার এই কালো ইতিহাস বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসা প্রয়োজন ইতিহাসকে পুরানো ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। বামফ্রন্ট সরকারের চাপে ঘটনাগুলি ঘটার সময়ে সংবাদপত্র কার্যত কিছুই ছাপতে পারেনি। গোটা মরিচঝাঁপি আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে, ৪ দিনে ৩০টি লঞ্চে  করে অধিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে রেখে, অনেককে প্রেপ্তার করে, নেতাদের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে সরকার গণহত্যার কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে দেননি। ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট হাটু জলের মধ্যে আমি যখন নেতাজী নগরে যাই, তখনও মরিচঝাঁপি ঘিরে  পুলিশ মোতায়েন। নেতাজী নগরে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা আমার গহণা উদ্ধার করতে পারলে অর্ধেক তাদের দেব, এই শর্তে পুলিশ আমাকে নেতাজী নগরে নিয়ে যায় এবং পরে কুমিরমারীতে নামিয়ে দেয়। স্বভাবতই আমি ছবিও তুলতে পারিনি এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে না পারায় অ্যামনেস্টি ইণ্টারন্যাশানালকে অভিযোগ জানানো সম্ভব হয়নি উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির সম্পাদক রাইহরণ বাড়ৈ মরিচঝাঁপিতে অপারেশানের আশঙ্কা করে, সযত্নে রক্ষার জন্য আমাকে  একটি বাণ্ডিল দিয়ে যান। তাতে কী আছে, আমি খুলে দেখিনি, বহুবছর তিনি না আসায় উৎসুক্যবশত বাণ্ডিলটি খুলে আমি তাজ্যব বনে যাই। তার মধ্যে দণ্ডক ফেরৎ উদ্বাস্তুর উপর নৃশংসতার সব তথ্য রয়েছে। এই বইয়ের পরিশিষ্টে সেই তথ্যগুলি ছাপানো হয়েছে (পৃ ৮৩১৪৮)।
      দ্বিতীয়ত, তফসিলী সম্প্রদায়ের নিজস্ব নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনের করুণ পরিণতিও উদ্বাস্তু আন্দোলনের একটি ইতিহাস।  দুঃখের বিষয় ইতিহাসকে চাপা  দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন, তারাও নমঃশুদ্র ও পৌণ্ডক্ষত্রিয়দের পরিচালিত এই আন্দোলনের ইতিহাসের রচনার কোনো চেষ্টা করেননি। বরং চিরদিনের মত এই  ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। UN High Commission for Refugees এর  টাকায় এক  প্রাক্তন নকশাল নেতা ডঃ রণবীর সমাদ্দার তার নিজস্ব সংগঠন Calcutta Research Group এর উদ্যোগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনার করেছিলেন। সম্প্রতি সেমিনারের পেপারগুলি নিয়ে ঐ সংগঠনের ডঃ প্রদীপ কুমার বসু সম্পাদিত Refugees in West Bengal নামে একটি  বই ছাপা হয়েছে। এই বইতে সি-পি-আই (এম) পরিচালিত ইউ-আর-সিকে উদ্বাস্তু আন্দোলন্দের একমাত্র সংগঠন বর্ণনা করা হয়েছে। মরিচঝাঁপির উদ্ধাস্তু আন্দোলন ও গণহত্যা একটি পাদটীকায় স্থান পেয়েছে। ডঃ রণবীর সমাদারের Marginal Nations নামে বইটিও উদবাস্তুদের নিয়ে। সেই বইটিতেও মরিচঝাপিতে গণহত্যার কোনো উল্লেখ নেই। লেখক জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বাস্তু আন্দোলনকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন। এই বইটি উদ্বাস্তু আন্দোলনেরও একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও বটে।  
"১৯৬০ দশকের শেষার্ধে মিজোরামেসৈন্য বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন" জারি হওয়ার পর  সৈন্যবাহিনী নাগরিকদের উপর যে অত্যাচার চালায় তা সুপ্রীম কোটের মামলায় শুধু যে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে তাই নয়, প্রায় তিরিশ বছর বাদে মিজোরামের নাগরিক অধিকার রক্ষা সংগঠনের দায়ের করা মামলায় প্রথমে গৌহাটি হাইকেটে পরে সুপ্রীম কোর্ট ভারত সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩০ হাজার পরিবারকে মোট প্রায় ১৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ ২০.৩.৯৫ তারিখে দেন। ভারত সরকার ১৯৯৫ সালের ১৯মে সরকারী নির্দেশনামা (৪/১/৯২Mz) মারফৎ সেই অর্থ মঞ্জুর করেছেন।”-অধ্যাপক সুজাত ভদ্র। ( পৃঃ 48)
    এত বছর পরে জ্যোতি বসুর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে অনুষ্ঠিত গণহত্যার বিবরণ প্রকাশের অন্য কারণও আছে। ১৯৭৫ সালে পাশ হয় UN Declaration of the protection of All Persons from Torture and Other Cruel, Inhuman or Degrading Treatment or Punishment. এই ঘোষণা অনুসারে "responsibility is placed on the state to provide the machinery for complaints, trials and compensation." (Torture in Greece. The First Torturers Trial, 1975. Amnesty International) রাষ্ট্রপুঞ্জের ঐ ঘোষণার ৯ ধারায় বলা হয়েছে, "wherever there is reasonable ground to believe that an act of torture as defined in article-1 has been committed, the competent authorities of the state concerned shall promptly proceed to an impartial investigation even if there has been no formal complain." (Tor
ture in Greece. P.8) international Committee of the Red Cross জাতীয় গণহত্যার তদন্ত করতে পারে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ আদালতে জার্মান নাৎসীদের বিচার হয়। গ্রীসে সামরিক নেতাদের বিচারের জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘নুরেমবাগ প্রিন্সিপলস' দুটি ধারা উদ্ধৃত করে। Nurembers Principles দুটি ধারা হচ্ছেঃ Article 3. The fact that a person acted as Head of State or as responsible official does not relieve him of responsibility for committing any of the offences defined in this code.
     Article 4: The fact that a person charged with an offence defined in this code acted pursuant to an order of his government or of a superior does not relieve him of responsibility in international law, if in the circumstances at the time, it was possible for him not to comply with that order. ( Torture in Greece, P. 5.)
     ১৯৭৮ সালে খমের রুজ শাসনকালে কম্বোডিয়ার গণহত্যার জন্য পলপট এবং তার সঙ্গীদের বিচারের ব্যবস্থা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল টমাস হ্যামারবাগ নিজে কম্বোডিয়াতে গিয়ে গণহত্যার মামলার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্ৰহ করেন। কম্বোডিয়াতে আলোচনা চলছে যে, বিচার রাষ্ট্রপুঞ্জের আস্তর্জাতিক ' অপরাধ বিচারালয়ে হবে, না কম্বোডিয়ার বিচারব্যবস্থায় হবে। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, মরিচঝাঁপিতে গণহত্যা হয়েছিল ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে"। অধ্যাপক সুজাত ভদ্র। (পৃঃ-১৭৮)
এই ধারাগুলি অনুসারে দেশে দেশে গণহত্যার বিচার হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে চিলিতে সামরিক বাহিনীর প্রধান পিনোশেত নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে। তারপর ক্ষমতা ছাড়ার পর তার অপরাধের বিচার শুরু হয়। ইংলণ্ডের আদালতে এবং চিলিতে অসুস্থতার মিথ্যা সার্টিফিকেট দেখিয়ে তিনি স্পেনে ও চিলিতে অপরাধের বিচার এড়িয়ে যান। কাজেই এতদিন পরেও মরিচঝাঁপির হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের গণহত্যার বিচারের দাবি খুবই সঙ্গত হবে।
     হাসনাবাদে সে সমষে উদ্বাস্তুদের খেতে না দিয়ে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেই সময়ে হাসনাবাদ লঞ্চ ইউনিয়নের সম্পাদক সি-পি-আই কর্মী আমার মেজদা প্রশাস্ত  হালদার পরিস্থিতি বর্ণনা করে আমাকে এক হৃদয়-বিদারক চিঠি লেখেন। কমুনিস্ট কর্মী হিসাবে  তিনি  একদা খুলনা ও যশোহর জেলার যে সব নমঃশূদ্র ও পৌণ্ডক্ষত্রিয় চাষীদের মধ্যে আন্দোলন  করেছিলেন। তাদের অনেকেই মরিচঝাঁপিতে বাসিন্দা হয়েছেন। তিনি নানাভাবে তাদের সাহায্য করেছেন। জগদীশ মণ্ডল আমাকে লেখা ঐ চিঠিটি পড়ে ঐ দিন থেকে মরিচঝাঁপি আন্দোলনের  সঙ্গে যুক্ত হন, প্রয়াত সন্তোষ কুমার মল্লিক ও প্রয়াত শক্তি সরকারের অনুগামী হয়ে কাজ করেছেন। তিনি এই বইটি লিখে গণহত্যার কালো ইতিহাস হারিয়ে যেতে দেন নি। সেজন্য তাকে ধন্যবাদ।
২০ জানুয়ারি, ২০০২ নিরঞ্জন হালদার ( আনন্দবাজার পত্রিকার অবসরপ্রাপ্ত সহ-সম্পাদক এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখার প্রাক্তন সম্পাদক। )





Read More