Tuesday 30 April 2024

// // Leave a Comment

*মে দিবস। বাবাসাহেব আম্বেদকর ও শ্রম আইন * লেখক -জগদীশচন্দ্র রায়


 *মে দিবস। বাবাসাহেব আম্বেদকর ও শ্রম আইন *

লেখক -জগদীশচন্দ্র রায়

বাবা সাহেব আম্বেদকর একজন সূর্য। সেই সূর্যকে পূর্ণ প্রকাশের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী ঘনকালো মেঘকে সরিয়ে তাঁকে সংবিধান সভায় প্রেরণ করেন বাংলার ‘আম্বেদকর’ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। যার অক্লান্ত সংগ্রামের ফলে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়। যদিও বাংলার মানুষ এই মহান মহামানবদ্বয়ের সংগ্রামের ফসল ‘সংরক্ষণ- representation’ কে তো ভোগ করছে, কিন্তু যাঁদের জন্য এই মহার্ঘ তাঁদের আজও আপন করে নিতে পারেনি।

অবদানঃ- ড. আম্বেদকরের ভারতের বিকাশের ক্ষেত্রে যতোটা যোগদান আছে হয়তো অন্য কোনো রাজনেতার সেটা নেই। তিনি ছিলেন অর্থতজ্ঞ, সমাজতজ্ঞ, আইন বিশারদ। তিনি আধুনিক ভারতের নির্মাতা। তিনি সংবিধান রচনা সমিতির অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি এমন সংবিধান রচনা করেছেন, যেখানে সকল নাগরিক সমান অধিকারী, ধর্মনিরপেক্ষ। বাস্তবে তিনি স্বাধীন ভারতের ডি.এন.এ. রচনা করেছিলেন সংবিধানের মাধ্যমে। তাঁর প্রেরণায় Finance Commission এর নির্মাণ করা হয়। তিনি Reserve Bank of India এর নির্মাতা। দামোদর ভ্যালী, হিরাকুণ্ড পরিকল্পনাও তাঁর ভাবনার প্রকাশ। Employment Excenge এর স্থাপনাও বাবা সাহবে করেন। জল ও বিদ্যুৎ এর Gird System এর স্থাপন তিনি করেন। স্বতন্ত্র নির্বাচন আয়োগের নির্মাতা বাবা সাহেব। যদিও এই সব অবদানের কথা ভারতের কোনো সরকারই সরাসরি স্বীকার করে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি। অর্থাৎ এইসব পরিকল্পনা ও বিচার আম্বেদকরের ছিল কিন্তু সেটার শ্রেয় অন্যে লুটে নিয়েছে।

নারী ও শ্রমিকদের সুবিধাঃ- বাবা সাহবে হিন্দুকোড বিল বানিয়েছিলেন (যদিও হিন্দুকোড বিলের খসড়া মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন মন্ত্রী থাকাকালীন) নারীদের সমমর্যাদার অধিকার দেওয়ার জন্য। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার সমান অধিকার, বিবাহিত পুরুষ এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে অন্য স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেনা। যদিও তখনকার সরকার সেটার মান্যতা দেয়নি। পরবর্তীতে সেটা চালু করা হয়। মহিলাদের মাতৃত্বকালী ছুটি, এবং প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ বাবা সাহেবের অবদান। তিনি যখন শ্রমসচিব (মন্ত্রী) তখন
(১)কয়লা শ্রমিকদের নানা ধরনের সহায়তা প্রদান,
(২) মহিলা শ্রমিকদের প্রসবকালীন ৩২৯দিন ছুটি,
(৩) কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র,
(৪) ৮ ঘণ্টা কাজের আইনী স্বীকৃতি,
(৫) ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ,
(৬) ন্যূনতম বেতন —সহ নানা শ্রমিক কল্যাণ আইন পাস ও কার্যকর করেন।
আর এই আইনগত সুবিধাগুলো কিন্তু জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য ছিল। যদিও এক শ্রেণির সুবিধাভোগীরা শুধু ভোগ করছে আর কারণ অকারণে জেনে বা না বুঝে বাবাসাহেবের বদনাম করছে।





Read More

Thursday 4 April 2024

// // Leave a Comment

যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কেন দেশ ত্যাগ করে ভারতে গেলেন? লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়।

 


যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কেন দেশ ত্যাগ করে ভারতে গেলেন?

লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়।  

     দেশভাগ তথা বাংলাভাগের সময় থেকে এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন বলে মনে করি। তাই তিনি কেন দেশে থেকে গেলেন? কার নির্দেশে? নাকি কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য? আবার তিনি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্যইবা কেন হলেন? সেখানেই বা কী ঘটনা ঘটে ছিল?

    মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের জীবনটাই যেন বিতর্কিত। তিনি আজীবন সমাজের পিছিয়ে রাখা মানুষদের জন্য নিজের জীবনের বিনিময়ে সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে কাজ করেছেন। চারবার মন্ত্রী হয়েও আপন সম্বল বলতে ফুটো কড়িও ছিল না। কিন্তু সারা জীবন সমালোচকদের কুঠার আঘাতে জর্জরিত হয়েও নিজের সামাজিক কর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। আজও সেই সমালোচনা যেন থামতে চাইছে না। এর কারণ কি তাঁকে নিয়ে সঠিক মূল্যায়নের অভাব?   

     আমার মনে হয়, তাঁর অদম্য সাহস ও গভীর মানব প্রেম তাঁকে তাঁর উদ্দেশ্যের শিখরে তুলে নিয়ে গেছে। তবে এই বিতর্কের প্রধান কারণ হচ্ছে, তিনি কখনো কারো কাছে অন্যায়ভাবে মাথা নত করেননি। এছাড়া তিনি এই কর্মের জন্য কখনো নিজের স্বার্থচরিতার্থ করার কথা ভাবেন নি। ফলে প্রতিপক্ষরা কখনো তাঁকে কোনো দিক দিয়ে দুর্বল করতে না পেরে বাইরে থেকে মিথ্যা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিতে চেষ্টা করেছে।   

    কেন বলছি এ কথা। কারণ, একজন হক্‌ সাহেবের সঙ্গে মন্ত্রীসভা গঠন করেও তাঁর কোনো বদনাম হয় না। যিনি পরবর্তিতে বলেছিলেন, ‘ভারত ভাগ হোক না হোক, বাংলাভাগ চাই।’ কিন্তু যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সেই মন্ত্রী সভার দুর্নীতি তুলে ধরলে যখন বৃটিশ নেতৃত্ব সেই মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয় আর তারপরে হক্‌ সাহেবের সঙ্গে মন্ত্রীসভা গঠন করেন, তখন তিনি হয়ে যান যোগেন আলী মোল্লা। পূর্বে যিনি মন্ত্রীসভা গঠন করলেন তাঁর নাম কেন এরকম হবে না বা বাংলাভাগের জন্য তাঁকে কেন দায়ী করা হবে না?        

   এবার আসি ঘটনা প্রসঙ্গে।

    দেশভাগ তথা বাংলাভাগ হওয়ার পর বাংলার নিরিহ অসহায় অমুসলমানদের দেখার জন্য কোনো নেতৃত্বকে তেমনভাবে চোখে পড়ে না। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলও দিশাহীন হয়ে পড়লেন। তখন তিনি বাবাসাহেব আম্বেদকরের শরনাপন্ন হয়ে চিঠি লিখলেন। কারণ, বাবাসাহেবকে তিনি রাজনৈতিক গুরু  হিসাবে মেনে চলতেন। তাই এই রকম পরিস্থিতিতে তাঁর কী করা উচিত সে বিষয়ে বাবাসাহেব একটা চিঠি লিখলেন ২রা জুন ১৯৪৭। যায় কয়েকটি লাইন এখানে তুলে ধরছি।     

“The only course left to the Scheduled castes is to fight for safeguards either in United Bengal or a divided Bengal. ---- I agree that you should work in alliance with the League and secure adequate safeguards for them. ----The Muslim League, however, will be ready to give to the Scheduled Castes separate electorates more probably because they themselves want separate electorates for their own community. So far as the Eastern Bengal Scheduled Castes are concerned that no doubt is an advantage.” (তথ্য- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, লেখক-জগদীশচন্দ্র মণ্ডল, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২-৪)

    বাবাসাহেবের পরামর্শ মতো তিনি ভারতে না গিয়ে আপন সমাজের দরিদ্র অসহায়দের স্বার্থে তিনি পূর্বপাকিস্তানে থেকে গেলেন। দুঃখের বিষয়ে বাবাসাহেবের এই চিঠির বিষয়ে এখনো বেশিরভাগ মানুষ জানেন না বা জানলেও না জানার ভান করে কুৎসা রটাতে থাকেন।   

    এরপর তিনি পূর্বপাকিস্তানের তপশিলি অন্যান্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের পরামর্শক্রমেই ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের মুসলিমলীগ মন্ত্রীসভায় আইন ও শ্রম মন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন।

    মন্ত্রীসভায় যোগদান করে তিনি তপশিলিদের স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তবে তাঁর এই মন্ত্রীসভায় যোগদানকে জিন্না, নাজিমুদ্দিন ও সুরাবর্দি ছাড়া অন্যরা ভালোভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি। এখান থেকেই শুরু হয় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে বিতাড়িত করার চিত্রনাট্য।

     ১৯৪৭ সালের ১১ অক্টোবর যোগেন্দ্রনাথের “Minorities Have Every Right To State Protection”- এর ব্যাখ্যা ও তার আইন প্রণয়নকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলিকে আরো অসহিষ্ণু করে তোলে। তবে জিন্নার জন্য প্রধানমন্ত্রী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছিলেন না যোগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। তপশিলিদের জন্য বিভিন্ন দাবি প্রধানমন্ত্রী পুরণ করছেন না দেখে যোগেন্দ্রনাথ জিন্নার শরণাপন্ন হন। তিনি নির্বাচনে তপশিলি জাতির সংরক্ষণ ও নির্বাচনের প্রসঙ্গের সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের দুজন সংখ্যালঘু মন্ত্রীর দাবি করেন। তবে জিন্না সে কথা মানতে রাজি হন না। তখন দুজনের মধ্যে এরকম কথোপকথন হয়-

যোগেন্দ্রনাথ- “আমাকে পদত্যাগ করতে দিন।”

ক্রুদ্ধস্বরে জিন্না- “আপনি যদি মনে করেন যে, পদত্যাগের দ্বারা আরও ভালরূপে তপশিলি জাতির সেবা করিতে পারিবেন, তবে স্বচ্ছন্দে তাহা করিতে পারেন।”

   যোগেন্দ্রনাথও দমিবার পাত্র নহে। তিনিও স্বর চড়াইয়া বলেন- “আরও ভালোরূপে সেবা করিবার প্রশ্ন নহে। প্রশ্ন হইতেছে নীতি এবং সম্মানের। যদি আমি দেখি যে আমার নীতি ও মর্যাদা বিপন্ন, তবে আমার পক্ষে একমাত্র সম্মানজনক পন্থা হইতেছে পদত্যাগ করা এবং ফিরিয়া গিয়ে আমার লোকদের সেবা করা।” (তথ্য- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৬২)  

     যোগেন্দ্রনাথের আপোষহীন দাবির লড়াইয়ের ফলে জিন্না ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় পৌঁছান। তিনি ২১ মার্চ ঢাকার এক জনসমাবেশে প্রতিশ্রুতি দেন যে-

 “Any impartial observer will agree with me that throughout these troubles, the minorities were looked after and protected in Pakistan better than anywhere else in India. —We have made it clear that the Pakistan Government will not allow peace to be disturbed.” (Star of India, March 22, 1948)

     জিন্নার এই প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী তথা অন্য কোনো লীগ মন্ত্রী ও মুসলমানরা ভালোভাবে নিতে পারেন নি। এখান থেকেই শুরু হয় জিন্নার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কারণ, তিনি যতদিন থাকবেন ততদিন পাকিস্তানে ১০০% মুসলমান শাসন কায়েম করা সম্ভব নয়। এর মাত্র কয়েক মাস পরেই ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্না কোনো এক অজানা ব্যাধিতে মারা যান। জিন্নার মৃত্যুর সাথে সাথে হিন্দু তপশিলিদের স্বার্থের দাবিরও মৃত্যু ঘণ্টা বেজে যায়।  

   প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি তখন পাকিস্তানের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। তিনি পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী পদ (তখন কেবিনেট প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত) থেকে নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে ইসলাম ধর্মের তাবেদার নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী করেন।

    সুরাবর্দিকেও (অভিবক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী) বন্দির মতো জীবন যাপন করতে হত। তাঁকে লিয়াকৎ আলির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতি নিয়ে চলাফেরা করতে হত। (তথ্য- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২১৮)  

  ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে পূর্ববাংলার হিন্দুদের উপর রাষ্ট্রীয় মদতে মুসলমানেরা অত্যাচার শুরু করে। প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পিত বক্তব্যে হিন্দুদের উপর অত্যাচার আরও বেড়ে যায়।  

     এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৫০ সালের ১৩ জুন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কলকাতায় ডাঃ বিধাচন্দ্র রায়ের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন- পূর্বপাকিস্তানে হিন্দুদের থাকা সম্ভব নয় এবং তাঁর নিজের পক্ষেও পাকিস্তানে  থাকা নিরাপদ নয়। কারণ, ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আদেশ দেন যে, “মি. মণ্ডলকে কোন সংবাদ পরিবেশনের পূর্বে তাঁহাকে দিয়ে তাহা অনুমোদন করাইতে হইবে।” (The Statemen, June 13, 1950/ (তথ্য- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৫২)   

    এদিকে তপশিলি ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি মুকুন্দ বিহারী মল্লিকও পাকিস্তানী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দ্বারা নজরবন্দি। তাঁরও কোনো বিবৃতি দেওয়া নিষিদ্ধ।   

    এমতো অবস্থায় লিয়াকৎ আলি দ্বারিকনাথ বারুরীকে পূর্বপাকিস্তানের মন্ত্রী করেন। মন্ত্রী হয়েই তিনি ও ভোলানাথ বিশ্বাস যৌথভাবে যোগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেন- “কেন্দ্রীয়সভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও মি. মণ্ডল তপশিলি সম্প্রদায়ের লোকদিগকে পূর্বপাকিস্তান ত্যাগ করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে  প্ররোচিত করিয়াছেন। দেশত্যাগ করার জন্য তপশিলি সম্প্রদায়ের লোক অবর্ণনীয় দুর্দশায় পতিত হইয়াছেন। ইহার জন্য মি. মণ্ডল দায়ী।” (আজাদ, ২৪ জুলাই, ২৯৫০/ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৫৭)

    “রাষ্ট্রবিরোধী কার্য করিয়া এবং পাকিস্তানের প্রতি-অবিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়া মি. মণ্ডল পাকিস্তানের তপশিলি সম্প্রদায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছেন, কাজেই তপশিলি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় সদস্য থাকিতে পারেন না।” (তথ্য ঐ)

    আবার কিছু শিক্ষিত তপশিলি বুদ্ধিজীবী দাবি করেন, “মি. মণ্ডল পাকিস্তানের তপশিলিদের দেশত্যাগে বাধা দান করে, নিজে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন।” (পৃঃ ঐ)

   দুই দিক থেকেই যোগেন্দ্রনাথকে দায়ী করা হয়েছে। এটাই হচ্ছে তপশিলিদের যোগেন্দ্রনাথ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানার বিষময় ফল।

    যোগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এতো ষড়যন্ত্র হওয়া সত্বেও তিনি হিন্দুদের বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি যোগেন্দ্রনাথকে বলেন-“আপনি নাকি আপনার বক্তৃতায় মুসলমানগণকে ডাকাত, হত্যাকারী, গুণ্ডা ও দুর্বৃত্ত বলিয়া ভীষণ গালিগালাজ করিয়াছেন?”

    উত্তরে যোগেন্দ্রনাথ বলেন- “যাহারা বিনা অপরাধে ও নির্বিচারে নরহত্যা করে, সম্পত্তি লুণ্ঠন করে, বাড়িঘর জ্বালাইয়া ছারখার করে এবং নারীধর্ষণ, নারীহরণ করে, তাহাদিগকে আর কি বলিয়া বর্ণনা করা যায়? কিন্তু আমি তো সেই সব মুসলমানের প্রশংসাও করিয়াছি যাহারা গৃহত্যাগী ও ভয়ার্ত হিন্দুগণকে আশ্রয় দিয়াছেন এবং নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা করিয়াছেন।” (মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, ৪র্থ  খণ্ড, পৃঃ ১৪৫) সেইদিনই যোগেন্দ্রনাথ বুঝে গিয়েছিলেন পূর্ববাংলায় হিন্দুরা পাকিস্তানী প্রশাসনের দ্বারা নিরাপত্তা পাবে না।     

    ‘পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে যোগেন্দ্রনাথ বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করিয়া যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াছেন এবং যে সব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কাহিনী শ্রবণ করিয়াছেন তাহাতে তাঁহার মন বিষিয়ে যায়। এই তাণ্ডবলীলার বিরুদ্ধে তিনি যে সকল জ্বালাময়ী বক্তৃতা বা প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন তাহার ফলে পাকিস্তানে তাঁহার জীবন ও মান সম্মান বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রতিনিয়ত স্মরণ -পথে উদিত হইয়া তাঁহার মনকে এমনভাবে ব্যথিত করিয়া তুলিত যে তাঁহার আহার ও নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া তিনি বিচলিত হইয়া উঠিলেন। তিনি পাকিস্তানে মন্ত্রী থাকিয়াও যখন হিন্দুদের নির্যাতন ও নিপীড়নের হাত হইতে রক্ষা করিতে অসমর্থ এবং পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বিপদকালে সুদূর করাচী হইতে তিনি কোন সাহায্য করিতে ও তাহাদের মধ্যে উপস্থিত হইতে যখন অসক্ষম তখন তাঁহার পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীপদে বহাল থাকা আদৌ সমীচীন কিনা এই চিন্তা দ্বন্দ তাঁহার মনকে ভারাক্রান্ত ও বিষন্ন করিয়া তুলিল। তিনি আরও চিন্তা করিলেন যে, পাকিস্তানে মন্ত্রী থাকিলে তাঁহাকে সংখ্যালঘুদের পাকিস্তান ত্যাগ না করিতে অনুরোধ জানাইতে হয়। কারণ, মন্ত্রী হিসাবে ইহা তাঁহার কর্তব্য। কিন্তু তাঁহাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা সম্বন্ধে তিনি কোন আশ্বাস দিতে পারিবেন না, অথচ তাঁহাদের পাকিস্তান ত্যাগ না করিতে অনুরোধ জানিতে হইবে- ইহা বিবেক সম্মতভাবে তিনি কিরূপে করিবেন, সেই চিন্তাও তাঁহাকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিল। তিনি উপলব্ধি করিলেন যে, এ দায়িত্ব বহন করা তাঁহার পক্ষে যুক্তিযুক্ত হইবে না। সুতরাং তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন যে, “পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাচ্ছন্ন” এই কথা বলিয়া তিনি পদত্যাগ করিবেন।’ (তথ্য-মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, লেখক- জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৬৮)

     যোগেন্দ্রনাথ এককথায় পাকিস্তানে নজরবন্দি। পাকিস্তান সরকার যে কোনো অজুহাতে তাঁকে গৃহবন্দি করার চেষ্টা করছে। এরকম সময় ১৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মুরীতে জুডিশিয়াল সাব কমিটির সভায় তাঁর সভাপতিত্ব করার কথা বলা হয়। সভায় রওয়ানা হবার একদিন আগে কলকাতায় পাঠ্যরত পুত্র জগদীশ মণ্ডলের অসুখের খবর পান। তখন তিনি সেই কর্মসূচী বাতিল করে কলকাতায় চলে আসেন। এদিকে যোগেন্দ্রনাথের দপ্তর থেকে করাচী হয়ে ফেরার জন্য টেলিগ্রাম আসে। কিন্তু তাঁর দেহরক্ষীর দেওয়া গোপন তথ্য ও নিজের প্রচেষ্টায় সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বুঝতে পারেন যে, করাচী ফিরলেই তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণ দেখিয়ে বন্দি করা হতে পারে। আর একবার বন্দি হলে জিন্নার মতো অস্বাভাবিক মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই তিনি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পাকিস্তানে আর ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

     পরিশেষে শিক্ষক, লেখক দীলিপ গায়েন এর এক লাইভ সাক্ষাৎকারে মহাপ্রাণ সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

 তিনি একজন মহান লিডার ছিলেন। তাই তাঁকে পাঠ্য বই স্থান দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু একটা গোষ্ঠী লাগাতার তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে চলেছে এবং ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তাঁরা যদি ১৯শতকের বা ২০ শতকের গোড়ার দিকে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিচার করে ব্যাখ্যা দিতেন তাহলে হয়তো মানুষের কাছে ভুল বার্তা যেতো না। তাঁর সম্পর্কে এই ভুল বার্তা দিয়ে এই আন্দোলনের জগৎ থেকে তাঁকে আলাদা করবার জন্য চিন্তাভাবনা নিয়েছে।  

      তিনি এমন একজন নেতৃত্ব ছিলেন যে, তিনি না থাকলে আমরা আম্বেদকরকে পেতাম না। তিনি একটা সাধারণ কৃষি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আইনে সুদক্ষ ছিলেন, সমাজ দরদী ছিলেন। ওকালতি করে তিনি সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু সেটা তিনি করেন নি। তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতা সম্পর্কে বলতে চাই-

১)ভারতবর্ষে ততকালীন সময়ে যত তপশিলি নেতৃত্ব ছিলেন তাদের সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল।

২) বৃটিশ শাসকদের উপর তলায় যে শাসকরা ছিল, তাদের সঙ্গে যোগেন মণ্ডলের সম্পর্ক ছিল বা তাদের সঙ্গে তিনি কথা বলার যোগ্যতা রাখতেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন।

৩) ব্রহ্মণ্য শ্রেণি বা স্ববর্ণদের নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, শরতচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে উপর লেবেলের ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির যে নেতৃত্ব ছিল তাদের সঙ্গে যোগেন মণ্ডলের লড়াই করার ক্ষমতা ছিল বা তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলার সাহস রাখতেন।

৪) সেই সময়ে মুসলিম সমাজের যে নেতৃত্ব ছিল, তাদের সঙ্গেও তিনি কথা বলার যোগ্যতা রাখতেন। সাহস রাখতেন।  

যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মূল্যায়ন বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে একান্ত আবশ্যক। তাতে বিশেষ করে পিছিয়ে রাখা সমাজের প্রগতি হবে। তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। 

                       ------------------------------------

 

 

 

 

 

 

    

  

 

Read More