Friday 4 September 2020

// // Leave a Comment

কোন শিক্ষককে স্মরণ করে ''শিক্ষক দিবস" পালন করবো? লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

 

 

আমরা কোন শিক্ষকের “শিক্ষক দিবস” পালন করবো?

লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

(লেখাটি আমার বই চেতনার জাগরণ থেকে তুলে দিলাম) 

     যিনি শিক্ষা দেন তিনিই শিক্ষক বলে মনে করি। তাই জন্মের পর থেকে আমৃত্যু আমরা যাঁদের কাছ থেকে শিখি তাঁরাই শিক্ষক। সেই শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম হচ্ছেন ‘মা’তারপরে পরিবার ও প্রতিবেশিরা। একটু বড় হলে শুরু হয় পাঠ্যক্রম। সেই পাঠ্যক্রমের শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে হয় বিদ্যালয়ে। পর্যায়ক্রমে চলে সেই শিক্ষা। সেখানে মূলত পাঠ্যক্রমের শিক্ষাই দেওয়া হয়। তবে শিক্ষার মাধ্যমে চেতনার বিকাশ হয়, সেটাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। আর সেই শিক্ষা শুধু পাঠ্যক্রম থেকেই পাওয়া যায় না। তার জন্য দরকার সামাজিক শিক্ষারও। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত not only education for earning but also education for learning. অর্থাৎ শিক্ষা শুধু উপার্জনের মাধ্যম হওয়া উচিত নয়; শিক্ষা বৌদ্ধিক বিকাশের জন্যও হওয়া উচিত। যদিও সমাজে Education for Earning টাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যারফলে এক একটা Certificate-ই হাতে পাওয়া যাচ্ছে শিক্ষার মাপকাঠি হিসাবে। কিন্তু education for learning খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

     আমরা জানি, সমাজে এমন বেশ কয়েক জন্য ব্যক্তি আছেন, যাঁরা Certificate ধারী ননকিন্তু মহান বিদ্বান ব্যক্তি। যেমন প্রথমেই উঠে আসে মাতা সাবিত্রি ও জ্যোতিরাও ফুলের নাম। যাঁরা জীবন পন করে ছিলেন, সমাজে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও   একাধারে পুথিগত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক শিক্ষা প্রদান করার জন্যতাঁরা ঘোষণা করেন-     


  বিদ্যা বিনা মতি (বুদ্ধি) গেছে

মতি বিনা নিতি (আদর্শ) গেছে

নিতি বিনা গতি (দিশা) গেছে

গতি বিনা বিত্ত (সম্পত্তি) গেছে

বিত্ত বিনা শূদ্রের পতন হয়েছে

এতো সব অনর্থ একমাত্র অবিদ্যার জন্য হয়েছে।

     এই একই কথার সুর ধরে আমরা দেখতে পাই- পতিত পাবন হরিচাঁদ ঠাকুর স্বীয় পুত্রকে শিক্ষা দানের কাজ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন-

 অনুন্নত জাতিমাঝে শিক্ষা প্রচারিতে।

আজ্ঞা করেন হরিচাঁদ তারে বিধি মতে।। -গুরুচাদ চরিত- পৃঃ ১০১

    এই পিতৃ আজ্ঞাকে শিরো ধার্য করে শিক্ষার অগ্রদূত গুরুচাঁদ ঠাকুর শ্লোগান তুললেন-               

                        “খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।

ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই”।। 
-গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪৪

‘খেতে না পাওয়ার অভাব থেকে অশিক্ষার অভাব আরো অনেক বড়। তাই খাদ্য কষ্টের যন্ত্রনা সহ্য করতে পারলেও শিক্ষা স্বরূপ খাদ্য থেকে যদি কেউ বঞ্চিত থাকে তাহলে সে যন্ত্রনা কারো একার নয়, সেটা দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রেও প্রগতির অন্তরায় স্বরূপ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানকে শিক্ষিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভিক্ষা করেও এই অশিক্ষার অন্ধকারকে দূর করতে হবেতিনি অবিদ্যাকে মারণ ব্যাধির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাই তিনি বলেছেন-

অজ্ঞান ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।

জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩৭ 

    তিনি সব সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে  জানিয়েছেন যে,-

তাই বলিভাই       মুক্তি যদি চাই 

      বিদ্বান হইতে হবে।  

পেলে বিদ্যাধন       দুঃখ নিবারণ

     চির সুখি হবে ভবে।।       -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩০

   তিনি বিদ্যা অর্জনকে সমস্ত ধর্ম কর্মের ঊর্ধে স্থান দিয়েছেন-

বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার। 

বিদ্যাধর্ম, বিদ্যাকর্ম, অন্য সব ছার।।      -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১০৮ 

    তিনি এখানে থেমে জাননি। তাঁর এই শিক্ষা-আন্দোলনে নারীশিক্ষা পেয়েছিল অগ্রাধিকার।   তাই তিনি বলেন-

মাতা ভাল নাহি হ’লে পুত্রভাল নয়।

“মা’র গুণে ছা’ ভাল” লোকে তাই কয়।। গু.চ. ৩৬২

তিনি নারীদের শিক্ষার জন্য ‘শান্তি সত্যভামা’ নামে স্কুল গড়ে তোলেন। সেখানে শুধু নারীর শিক্ষা নয়, নারীর সমাজিক অধিকারের কথাও দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন।  

                           শুনেছি পিতার কাছে আমি বহুবার

নারী পুরুষ পাবে সম অধিকার।।

সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার 

নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।।

গুরুচাঁদ ঠাকুর শুধু এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মধ্যেই সীমিত থাকেননি। সঙ্গে  সামাজিক শিক্ষারও প্রসার ঘটান তিনি। তাই তিনি কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

কুসংস্কার আছে যত      দূর কর’ অবিরত

         বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ.১১৯

     তবে তিনি বিদ্যা অর্জনকে সকল শক্তির মূল হিসাবে মেনে নিয়ে জানিয়েছেন-

বুদ্ধি আছে যার        শকতি  তাহার

        দেহ-বল কিছু নয়।

বিদ্যা দেয় বুদ্ধি       চিত্তে আনে শুদ্ধি

      তাতে বুদ্ধি বৃদ্ধি হয়।।   -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১২৯

এই মহান শিক্ষা বিদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে গঠিত স্কুল সংখ্যাটা আমরা বর্তমান দশম শ্রেনির ‘স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ’ –বইতে দেখতে পাই- তাঁর উদ্যোগে ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।’

কিন্ত এই মহান শিক্ষাবিদকে আমরা কয়জনে জানি? প্রশ্ন আসে কেন জানি না?

এখানেও কি লুকিয়ে আছে সেই জাতিগত সমীকরণ?

    এরকম আরো অনেক মহামনীষী আছেন যাঁরা শিক্ষার জন্য জীবন পণ করেছেন। যেমন  আমরা দেখে পাই মহারাষ্টের গাড়্গে মহারাজ। যিনি একজন থামস্‌ আপ অর্থাৎ আঙ্গুঠা ছাপ ব্যক্তি হয়েও ঘোষণ করেন- “ভগবানের জন্য খরচা করোনা। ঐ পয়সা শিক্ষার জন্য ব্যয় কর। পয়সা মন্দিরে না দিয়ে কোন ছাত্র-ছাত্রীকে দাও। ভক্তির প্রচার ভালো নয়। শিক্ষার প্রসার অতি ভালো।”



আর মহান পণ্ডিত বাবা সাহেবকে কে না জানেন? কিন্তু তাকেও জাতিগত সমীকরণে গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যাকে আধুনিক ভারতের সাংবিধানিক ভারত নির্মাতা বলা হয়েছে। বিশ্ব যাকে Symbol of Knowledge বলেছেনসেই বাবাসাহেব শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন যে,-  দুটাকা উপার্জন করলে এক টাকা দিয়ে পেটের ক্ষুদা মিটানোর জন্য খাবার কিনে খাও। আর এক   টাকা দিয়ে বই কিনে সন্তানদেরকে শিক্ষিত কর। তিনি বলেছেন, শিক্ষা হচ্ছে বাঘিনীর দুধ। এই দুধ পান করলে সব কিছুতে তেজদীপ্ত হওয়া যায়। তিনি আরো বলেছেন, আমাকে মূর্তির মধ্যে পাবেনা। আমাকে পাবে বইয়ের মধ্যে। তাই বই পড়ো। তাঁর শ্লোগান- শিক্ষিত হও সংগঠিত হও সংঘর্ষ কর।    

    


  এবার প্রশ্ন হচ্ছে এই মহান শিক্ষাবিদদের ‘শিক্ষক দিবস’-এ স্মরণ করবো না কি যিনি অন্যের থিসিস চুরি করে নিজের বলে চালিয়ে ছিলেন তাঁকে স্মরণ করবো? নির্ণয় আপনাদেরই গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে প্রথাগত শিক্ষক দিবস পালন হবে। আর যাঁরা প্রকৃত ‘শিক্ষক’। যাঁরা সমাজের জন্য জীবনকে বাজি রেখে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন, তাঁরা এই দিবসে অন্ধকারেই থেকে যাবেন! 

                               __________________

(তথ্য সংগ্রহ- 

১) শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত – মহানন্দ হালদার

আমার লেখা- 

২) গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলন 

৩) গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজ সংস্কার ও মুক্তির দিশা)

 ভিডিওটি অবশ্যই দেখবেন-



 

Dr. Sarvepalli Radhakrishnan: The teacher who stole from his student’s thesis


Read More

Monday 13 July 2020

// // Leave a Comment

বাবাসাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠানো ও সাতটি ভোট পাওয়ার ইতিহাস লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়

বাবাসাহেকে সংবিধান সভায় পাঠানো ও সাতটি ভোট পাওয়ার ইতিহাস
লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়

    আমরা জানি, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও তাঁর সহযোগিদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে পৃথিবীর অস্টম আশ্চার্য হচ্ছে ১৯৪৬ সালে বাবাসাহবেকে সংবিধান প্রেরণের ইতিহাস। যেখানে কম করে পাঁচটি ভোটের প্রয়োজন ছিল আর হাতে মাত্র একটি ভোট ছিল সেখানে বাবাসাবে কীভাবে  সাতটি ভোট পান সেই ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের ‘মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ (দ্বিতীয় খণ্ড) পৃ. ৪২ থেকে আমরা জানতে পারি ড. আম্বেদকরকে যাঁরা ভোট দেন তাঁর হলেন-
 ১.  যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল; এম এল এ (বাখরগঞ্জ দক্ষিণ-পশ্চিম)
 ২. দ্বারিকনাথ বারুরী; এম এস এ (ফরিদপুর)
 ৩. গয়ানাথ বিশ্বাস; এম এল এ ময়মন সিংহ পশ্চিম)
 ৪. নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস; এম এল এ (রংপুর)
 ৫. ক্ষেত্রনাথ সিংহ; এম এস এ (রংপুর) উভয় রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত।
 ৬. মুকুন্দ বিহারী মল্লিক; এম এস এ (খুলনা)
 সপ্তম জনের নাম পাই চুনীলালা বিশ্বাস এর লেখা বই ‘দলিত জনের সামাজিক ইতিহাস’ বইতে। তিনি হলেন বীর বিরসা; এম এস এ (মুর্শিদাবাদ)।

     প্রথমেই এই সপ্তম ভোট দাতার সম্পর্কে জেনে নিতে চাই। কিন্তু তার আগে আমরা দেখতে চাই শ্রদ্ধেয় জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল কেন সপ্তম জনের নাম উল্লেখ করেনি।
জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল তাঁর বই ‘মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ও বাবা সাহবে আম্বেদকর’ -এর ১১৮/১১৯ পাতায় ‘কিছু কথা’ বিষয়ে লিখেছেন, ‘দিল্লী নিবাসী শ্রীচুনীলাল বিশ্বাস মহাশয়ের “ডঃ আম্বেদকরের অসামান্য বিজয়” এই শিরোনামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধকার লিখেছেন- “ঘটনাকাল ১৯৪৬ সালের জুন-জুলাই মাস। এ ইতিহাসের অনেক পার্শচরের মধ্যে আমার নিজেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে প্রবন্ধটি উত্তমপুরুষে লেখা হল”
   “সে সময় আমি ছিলাম নিখিলবঙ্গ তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারী তথা অখিল ভারত তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। পরবর্তীকালে বিখ্যাত স্পিকার শ্রীঅপূর্বলাল মজুমদার ছিলেন নিখিলবঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। (পৃষ্ঠা-৭৭)

    “নাগপুর অখিল ভারত তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের (দ্বিতীয় বার্ষিক) অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২৫, ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৬। উক্ত অধিবেশনের সংবাদ জাগরণ পত্রিকা ৪র্থ বর্ষ, ২০ ও ২১ সংখ্যা। ৪ঠা মাঘ, শনিবার, ১৩৫৩ সাল, ইংরাজী ১৮ জানুয়ারী ১৯৪৭। প্রকাশ পায় শ্রীচুনীলাল বিশ্বাস, অখিল ভারত তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। উক্ত সম্মেলন উপলক্ষে যে পুস্তক প্রকাশি হয়, (১৯৪৭) তাতে চুনীলাল বিশ্বাসকে প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক বলে উল্লেখ করা হয়, কোথাও প্রেসিডেন্ট বলে উল্লেখ নাই। কাজেই চুনীলাল বিশ্বাস নিজে-নিজেকে স্ব-ঘোষিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে উল্লেখ করায়, আমরা বিস্মিত হলাম।
   “ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ,” গ্রন্থের ১৭৬ পৃষ্ঠায় জগদীশচন্দ্র লিখেছেন, “তাঁহাকে (ডঃ আম্বেদকর) যে সকল এম. এল. এ. ভোট দিয়েছিলেন। গ্রন্থকার মাত্র ছয়টি ভোটদাতার নামের উল্লেখ করেছন। অথচ আমরা জানি ডঃ আম্বেদকর সাতটি প্রথম ভোট পেয়ে, প্রথম স্থানাধিকারীর গৌরব অর্জন করেছিলেন।------ সপ্তম ভোটদাতার নাম শ্রীবীরশা। ইনি ছিলেন কংগ্রেস দ্বারা মনোনীত এবং মুর্শিদাবাদ থেকে নির্বাচিত তপশীলী সদস্য। ভোটদানের ৩০ মিনিট পূর্বেও তাঁকে কেউ আমরা জানতাম না। (পৃ. ৭৯-৮০)
  “Assembly Proceedings, Official Report. Vol. LXX. 1946. Alphabetical List  of Members এবং The Indian year ‘Book & who’s. 1947. এর Page-91 Bengal Legislative Assembly- যে নির্বাচিত সদস্যদের তালিকা দেওয়া আছে, তাতে কোথাও শ্রীবীরশা এক নামটির উল্লেখ নাই।’

    উপরে জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল তাঁর বইতে যে কথা লিখেছেন, সে সম্পর্কে আমরা জানলাম। তাঁর শেষ বক্তব্য হচ্ছে, “শ্রীবীরশা এই নামটির উল্লেখ নাই।”
   পাঠকদের অনুরোধ করছি, জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের উল্লেখিত সুত্র The Indian year ‘Book & who’s. 1947. এর Page-91 Bengal Legislative Assembly. আপনারা google এ গিয়ে search করুন। আর ৯১ পাতায় গিয়ে একটু খুঁজে দেখুন; পাতাটির মাঝা মাঝিতে ডান দিকে আছে – Bir Birsha.
https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.11657/page/n137/mode/2up

   যেকোনো কারণেই হোক, জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের কাছে বিষয়টি ছুটে গেছে। আমি তাঁকে কোনো দোষ দিচ্ছি না। এই বিষয়ে আমাকে জানার জন্য সহযোগিতা করেছেন শ্রদ্ধেয় কানাই লাল বিশ্বাস (মুম্বাই)।

    তাহলে আমরা সপ্তম ভোটদাতা সম্পর্কে জানলাম। কিন্তু আমি এখানে থামতে চাই না। বীর  বীরশার বিষয় নিয়ে চুনীলাল বিশ্বাস তাঁর বইতে কী লিখেছেন সে বিষয়ে এবং চুনীলালের কী অবদান ছিল সে বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক- “আজকে যা লিখতে বসেছি তাহা ঠিক যেমন কোন প্রবন্ধ নহে, তেমনি কোন কাহিনীও নয়। ইহা ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। ইহা বাস্তবিক পক্ষে একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ, যদিও ইহা কোন রাজা বা রাজ্যের ইতিহাস নয়। ইহার নায়ক হচ্ছেন ড. ভীমরাও আম্বেদকর। ঘটনা কাল হল ১৯৪৬ সালের জুন-জুলাই মাস। এই ইতিহাসের অনেক পার্শ্বচরের মধ্যে আমার নিজেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে ইহা উত্তম পুরুষে লিখিত হল। তৎকালে আমি ছিলাম নিখিল বঙ্গ তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারী তথা অখিল ভারত তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। পরবর্তী কালের বিখ্যাত স্পীকার শ্রীঅপূর্বলাল মজুমদার ছিলেন নিখিল বঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট।
     “দুইটি কারণে আজকের লেখাটি লিখতে বসেছি। প্রথমত বাবাসাহেবের জন্মশতবার্ষিকীতে  তাঁহার জীবনের যে অধ্যায়টি লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে বা ঠিকমত ভাবে প্রকাশিত হয়  নাই, সে বিষয়ে আলোকপাত করা।

    “দ্বিতীয়ত প্রাধিকারী জীবনীকার শ্রীধনঞ্জয় কীর তাঁহার গ্রন্থ Dr. Ambedkar Life and Mission, পৃ. ৩৮২ তে এই অসামান্য বিজয়কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মত বিবৃত করে জনসাধারণের মধ্যে যে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করেছেন তাহা দূর করা। শ্রীকীরের মতে, “Dr. Ambedkar had no men in the Bombay Assembly to support his candidature, and so his name was put up through the Scheduled Castes representation in Bengal Assembly. These with the backing of Muslim League, he was elected to the Constituent Assembly.” এই মন্তব্য যে কতখানি ভ্রান্তিপূর্ণ তাহা একটু পরেই বিশ্লেষণ করে দেখানো হচ্ছে।

    “ইহা ছাড়া মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ -প্রথম খণ্ডের লেখক শ্রীজগদীশচন্দ্র মণ্ডল তাঁর গ্রন্থে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচনের জন্য ড. আম্বেদকরের বেঙ্গল লেজিস্‌সেটিভ কাউন্সিলের তফসিলী সদস্যদের দ্বারা নির্বাচন বিষয়টি বিশদভাবে লিখেছেন বটে, অনেক বিষয়ে অজ্ঞতার  পরিচয় দিয়েছেন। এ বিষয়ে আলোচনা করে প্রকৃত ইতিহাস লেখার দরকার আছে বলে মনে করি।

   “শ্রীধনঞ্জয় কীর মহাশয় লিখবার সময় বোধহয় ভুলে গিয়ে ছিলেন যে কেবল বোম্বাই-এর লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলই নয়- সারা ভারতবর্ষের কোনও লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিল থেকে যাতে ড. আম্বেদকর সংবিধান সভার সদস্য না হতে পারেন সে বিষয়ে কংগ্রেস অত্যন্ত বেশি সতর্ক ছিল। দেখা গেল কংগ্রেস সামান্য ব্যতিক্রম কেবলমাত্র বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিল ছাড়া ভারতের অবশিষ্ট সমস্ত লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচনী দ্বারাই ড. আম্বেদকরের বিরুদ্ধে অতি  নিপুন কঠোরতার সহিত রুদ্ধ করে দিয়েছে। সেই সব আইন পরিষদ থেকে নির্বাচিত হবার কোনও সম্ভাবনা নাই। দেখতে পেয়ে, অবশেষে তাঁহার সব আশার বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের দিকে ড. আম্বেদকর অগ্রসর হলেন। তাঁহার আশা  ছিল বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের ইয়োরোপীয় সদস্যদের ভোট তিনি পাবেন এবং তৎসহ বঙ্গীয় তফসিলী ফেডারেশনের একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ভোটটি পেয়ে সহজেই তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন। এই সম্ভাবনার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করবার জন্য ড. আম্বেদকর জুন মাসের শেষ দিকে কলিকাতায় আসিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের ইয়োরোপীয় সদস্যগণ ইতিমধ্যে স্থির করিয়া বসিলেন যে তাঁহারা সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচনে কোন অংশ যেমন গ্রহন করবেন না তেমনি কাউকে ভোটও দিবেন না। ড. আম্বেদকর তাঁর আশার শেষ দীপশিখাটিকে এইভাবে নির্বাপিত হতে দেখে অতিশয় হতাশা কাতর হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করিলেন।  
    “এই ভাবে নিরাশ হয়ে বাবাসাহেব ফিরে গেলেও নিরাশ হলনা কিন্তু বঙ্গীয় তফসিলী ফেডারেশন তথা নিখিল বঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের কর্মকর্তা ও কর্মীরা। তাঁহারা প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিলেন যে যেমন করেই হোক না কেন ড. আম্বেদকরকে বেঙ্গল কাউন্সিল থেকে সংবিধান  সভার সদস্য নির্বাচিত করাবেনই করাবেন।

   “শ্রী ধনঞ্জয় কীর মহাশয় লিখেছন যে মুসলিম লীগের সাহায্য (with baking of Muslim League) ড. আম্বেদকর বেঙ্গল থেকে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাহা কতদূর সত্য? বর্তমান কালের লেখকদের জানা না থাকলেও তখনকার দিনের লেখকদের একথা অবশ্যই জানা ছিল যে সে সময় দুই প্রকার নির্বাচনী প্রথার প্রচলন ছিল। কথা (১) মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন, তথা অবশিষ্টদের জন্য; (২) যুগ্ম-নির্বাচন প্রথা চালু ছিল। মুসলমানেরা কেবল মাত্র মুসলমানকে সদস্য নির্বাচনের জন্যই ভোট দিতে পারত, হিন্দু তফসিলী বা অপরাপর ধর্মের লোকদের ভোট দিতে পারতো না। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে ড. আম্বেদকর মুসলমান বা মুসলিম লীগের ভোটে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন নাই। মুসলিম লীগের সাহায্য বলতে যদি তিনি তাদের moral support অর্থাৎ নৈতিক সমর্থন ও সহানুভূতির কথা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলেও বলতে হবে যে কেবলমাত্র নৈতিক সমর্থন বা মৌখিক সহানুভূতির দ্বারা কাহাকেও নির্বাচিত করা যায় না। শুধু কথায় চিড়া ভিজান যায় কি? শ্রীধনঞ্জয় কীরের মত একজন প্রাধিকারী জীবনীকারের পক্ষে এই প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী মন্তব্য অবশ্যই নিন্দনীয়। তাহলে বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর সর্বাপেক্ষা বেশি প্রথম (ভোট ৭) ভোট (First preference vote) সাতটি পেয়ে বেঙ্গল থেকে কীভাবে সংবিধান সভায় সদস্য নির্বাচিত হলেন? সেই কথা বলব বলে আজ ঘটনার  চুয়াল্লিষ বৎসর পরে কালি-কলম নিয়ে বসেছি সাতের দশকে বয়স হওয়া সত্ত্বেও।

   “ছাত্র আন্দোলন যে যুগান্তর ঘটাতে পারে সে কথা আজ কাহারও অবিশ্বাস করবার উপায় নাই। ------চল্লিশের দশকে নিখিল বঙ্গ তফসিলী ছাত্র ফেডারেশন তখনকার দিনে বাংলা তথা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এক প্রমুখ ভূমিকা গ্রহণ করে ছিল। সে সময় আমি নিখিল বঙ্গ তফসিলী  ছাত্র ফেডারেশনের যেমন ছিলাম জেনারেল সেক্রেটারী তেমনি ছিলাম নিখিল ভারত তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। আমাকে বিভিন্ন সময়ে হিল্লী-দিল্লি করতে হয়েছিল।

    “মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ গ্রন্থের ১৭৬ পৃষ্ঠায় জগদীশচন্দ্র ---- মাত্র ছয়টি ভোটদাতার নামের উল্লেখ করিয়াছিলেন। অথচ আমরা জানি ড. আম্বেদকর সাতটি প্রথম ভোট পেয়ে প্রথম স্থানাধিকারীর গৌরব পেয়েছিলেন। ---- আমি এই সপ্তম ভোট দাতার নাম জানাচ্ছি। তিনি হলেন শ্রীবীরশা। ইনি কংগ্রেসের দ্বারা মনোনীত এবং মুর্শিদাবাদ থেকে তফসিলী সদস্য। ভোট দানের  ৩০ (তিরিশ) মিনিট পূর্বেও তাঁহাকে কেহই আমরা জানিতামও না চিনিতামও না। সেই কারণে পূর্বে তাঁহার সহিত যোগাযোগ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই।

    “১৯৪৬ সালের ১৮ই জুলাই প্রাতঃ (৯-৩০) সাড়ে নয়টা পর্যন্ত শ্রীবীরশাকে চেনা তো দূরের   কথা তাঁর নামটা পর্যন্ত আমরা কেহই জানিতাম না। সে দিন নিখিল বঙ্গ তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের অনেক কর্মী সহ আমি ও অপূর্বলাল সদলবলে বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিল  ভবনের প্রাঙ্গনে, করিডরে বা আশেপাশে উপস্থিত। ভোট গ্রহণ শুরু হবে বেলা দশটায় কাউন্সিল ভবনের একটি করিডরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। তখন সাড়ে নয়টা বাজে। এমন সময় অতি সাধারণ জামা কাপড় পরিহিত নিরীহ গোছের এক ব্যক্তিকে দেখলাম সদস্যদের হাজিরা রেজিস্টারে নাম সই করতে। তড়িৎ তাঁহার সামনে উপস্থিত হয়ে ভাববাচ্যে জানতে চাইলাম তিনি হরিজন কিনা। তিনি হরিজন একথা স্বীকার করায় আমি অতি সংক্ষেপে কিন্তু অত্যন্ত দরদভরা আন্তরিকতার  সুরে তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম ড. আম্বেদকরকে তাঁহার প্রথম ভোটটি দিতে। তিনি, আমি, আমরা এবং ড. আম্বেদকর যে একই অস্পৃশ্য জাতির এবং আমাদের উদ্ধারের জন্যই যে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচন করে তাঁহাকে পাঠান একান্ত প্রয়োজন এই সব কথা অতি আন্তরিকতার সুরে শ্রীবীরশাকে বুঝাইয়া দিলাম। তাঁহার সহিত কথা বলার সময় আমাদের একান্ত নৈকট্য ও একাত্মতা স্থাপনের জন্য অতি আপন সম্মোধন তুমি, তোমরা তোমাকে ইত্যাদি ব্যবহার  করেছিলাম। কাউন্সিল হলে তাঁহার প্রবেশ করবার মুখেই আমাদের এইরূপ আন্তরিকতাপূর্ণ দরদী সুরের আবেদনে তিনি এতই প্রভাবিত হয়ে পড়লেন যে তৎক্ষণাৎ তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি তাঁহার প্রথম ভোটটি অবশ্যই ড. আম্বেদকরকে দিবেন। তিনি তাঁহার প্রতিশ্রুতি  মতই ভোট দিয়েছিলেন। ইহাই হইল ড. আম্বেদকরকে দেওয়া সপ্তম প্রথম ভোটের ইতিহাস।” (‘দলিত জনের সামাজিক ইতিহাস’ বিষয়- স্মৃতিচারণ ড. আম্বেদকরের অসামান্য বিজয় তথ্য  পৃ.৬৩-৬৮) http://www.mediafire.com/file/rweo0pm3d7wh5w1/দলিত_জনের_সামাজিক_ইতিহাস_-চুনীলাল_বিশ্বাস.PDF  

    আমরা বাবাসাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠানোর সপ্তম ভোট প্রাপ্তি সম্পর্কে জানলাম। যেটা নিয়ে বিভিন্ন সংশয় ছিল। 
Read More

Thursday 9 July 2020

// // Leave a Comment

“বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা হলে বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।” – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি


   
  “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা  হলে বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।” – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি

( লেখক – আমিনুল ইসলাম। ঢেকুয়া, মেদিনীপুর। প্রকাশ- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১.০৮.২০০০; বৃহষ্পতিবার।)

    শ্যামাপ্রসাদ সম্বন্ধে একপেশে চিঠিগুলি পড়ে (২/৮) কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি।  চিঠিগুলির মূল বক্তব্য হলঃ পাকিস্তানের হিংস্র কবল থেকে সমগ্র বাংলাকে বাঁচাতে ও হিন্দুদের  নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগের দাবি জানাতে বাধ্য হন। এটাই যদি বাংলা ভাগের কারণ হয় তা হলে ভারতের সীমানার মধ্যেও তো অখণ্ড বাংলা গড়তে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর অনুগামীরা। কেনই বা তাঁরা ভারতের মধ্যকার অখণ্ড বাংলারও বিভাজন চেয়েছিলেন? উত্তরটা জলের মতো পরিষ্কার- ভারতের মধ্যে থাকলেও মুসলিম প্রাধান্যযুক্ত অখণ্ড বাংলায় পূর্বের মতো হিন্দুদের আর একাধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই দেখা যায় ১৯৪৭ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির ঘোষণার দু’দিন পরেই শ্যামাপ্রসাদ বাংলার ছোটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করলেন যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলে সাম্প্রদায়ক ভিত্তিতে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে। বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। (অমৃতবাজার পত্রিকা ২৪/২/১৯৪৭)। তখনকার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি কৃপালনী এই দাবি সমর্থন করলে শ্যামাপ্রসাদ বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন শুরু করলেন।

     ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন পরিকল্পনা ঘোষণা করলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে আরও জোরদার করলেন। তাঁরা বক্তৃতা দিয়ে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে বোঝাতে লাগলেন যে, হিন্দুরা বিপন্ন, বাংলা ভাগ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বাংলা পাকিস্তানে গেলে তো বটেই, স্বাধীন সার্বোভৌম হলেও, এমনকী ভারতে থাকলেও হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। সেই মতো তাঁরা বাংলার হিন্দুদের প্রভাবিত করতে লাগলেন। জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও প্রভাবিত হতে লাগলেন।

   এর পূর্বে সুরাবর্দি বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাব বাঙালির আত্মহত্যারই শামিল। বাঙালির উচিত হবে এক অখণ্ড ও অবিভক্ত, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলা গঠন। লিগের সম্পাদক আবুল হাশিম চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’- এর কথা উল্লেখ করে বলেন, “Let the Hindus and Muslims agree to C R Das’s formula of 50:50 enjoyment of political power and economic privileges, I appeal to the youths of Bengal in the name of her past traditions and glorious future to unite.” মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭- এর ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান-বিযুক্ত অখণ্ড বাংলার সম্বন্ধে জিন্নার বক্তব্য জানতে চাইলে জিন্না বললেন, I should be delighted. What is the use of Bengal without Calcutta? They had much better remained united and independent. I am sure that they would be on friendly terms with us. “অখণ্ড বাংলার প্রশ্নে শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ নেতারা সুরাবর্দি, হাশিম প্রমুখ নেতার সঙ্গে অখণ্ড বাংলার জন্যে ৬ দফা সূত্রের মধ্যে  সাম্প্রদায়িকতার ভুত খুঁজে পেলেন এবং এর তীব্র সমালোচনা করে বললেন, ‘Sovereign Bengal is a sugar-coated alternative to Pakistan.’

    ১৯০৫ সালে যাঁরা কার্জন পরিকল্পিত বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন, মাত্র ৪২ বছরের ব্যবধানে সেই শ্রেণীর মানুষেরা বাংলা ভাগের আন্দোলন শুরু করেন। তবে দু-একজন মুসলিম নেতা ১৯৪৭-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন   কারণ তাতে তাঁদের প্রভাবের ক্ষেত্র কমে যাবে। কিন্তু দু’একজন বাদে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা একজোট হয়ে বাংলার প্রায় সব হিন্দু নেতা বঙ্গভঙ্গের জন্য লাগাতার আন্দোলন করেছেন। কারণ ১৯৪৭ সালে বাংলার রাজনীতিতে মুললমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা অখণ্ড থাকলে সেখানে হিন্দুদের প্রাধান্যের কোনও রকম সম্ভাবনা নেই। তাঁরা বুঝেছিলেন সে অখণ্ড বাংলা যদি ভারতের মধ্যেও থাকে, তা হলেও সেখানে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে। মন্ত্রিসভার প্রধান একজন মুসলমানই হবেন। এ বিষয়টা হিন্দু নেতাদের একেবারেই অপছন্দ ছিল। তাই ‘হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায়’ বদ্ধপরিকর থাকতে শ্যামাপ্রসাদ ও অন্যান্য হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের দৃঢ় সমর্থক হয়ে পড়েন এবং অখণ্ড বাংলা মেনে নিতে পারেননি।

     জয়া চ্যাটার্জি তাঁর ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গ্রন্থে বাংলার জাগরণের সুফলভোগী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বাঙালির ধর্মীয় তথা ভদ্র সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ এবং বাংলাভাগের নাটকীয় কাহিনীতে এই শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা ও বহুবিস্মৃত কীর্তির ধর্মীয় চরিত্র উদ্ঘাটন করেছেন ও একই সঙ্গে এই শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থের অসংকোচ পরিপোষণার বহু দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছেন। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এই শ্রেণীরা নিজেদের সাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে ঢেকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল এবং বাংলাভাগের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

    শ্যামাপ্রসাদের হিন্দুভক্তি ছিল বর্ণহিন্দুদের জন্য, এলিট হিন্দুদের জন্য, বিত্তশালী হিন্দুদের জন্য। যুক্তবাংলার মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সমান অধিকার দেওয়ার বিষয়ে তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল। তিনি মনে করতেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই শিক্ষা, সংস্কৃতি, মেধা ও কর্মদক্ষতায় শ্রেষ্ঠ। তাই শাসন করার ও সমাজে আধিপত্য করার একমাত্র অধিকারী হচ্ছে উচ্চবর্ণের মানুষেরা। তিনি মনে করতেন, “মুসলিম প্রাধান্য বজায় থাকিবার অর্থ বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির উচ্ছেদ। ইসলামে ধর্মান্তরিত একদল নিচু জাতির হিন্দুকে (মুসলমানদের) সন্তুষ্ট করিবার জন্য সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিতে সে ক্ষেত্রে বলি দিতে হইবে।” (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পেপার্স)।

     শ্যামাপ্রসাদ ব্যক্তিগতভাবে সৎ, পণ্ডিত ও আদর্শবাদী হলেও তাঁর সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা ও বাংলাভাগের প্রশ্নে তাঁর সাম্প্রদায়িক ভূমিকা কী করে অস্বীকার করা যায়? যাঁরা শ্যামাপ্রসাদকে পশিমবঙ্গ সৃষ্টির কৃতিত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের জানা প্রয়োজন শ্যামাপ্রসাদ নিজেই পরে আক্ষেপ করেছিলেন বাংলা ভাগ করার জন্য। ১৯৫২ সালে নদিয়ার চাকদহে এক জনসভায় তিনি বলেন,      “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা হলে  বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।”
------------------

Read More

Sunday 28 June 2020

// // Leave a Comment

সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে সমাজের কোন উন্নতি করা কি সম্ভব? লেখক – বাবাসাহবে ড. আম্বেদকর


সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে সমাজের কোন উন্নতি করা কি সম্ভব?
লেখক – বাবাসাহবে ড. আম্বেদকর 
( from Annihilation of Caste)


যতক্ষণ আপনারা সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন না করবেন, ততক্ষণ তেমন কোন উন্নতি করতে পারবেন না। আপনারা আপনাদের সম্প্রদায়ের লোকদের একত্রে সমাবেশ করতে পারবেন না, কোনো আক্রমনের জন্য বা কোনো প্রতিরক্ষার জন্য জাতি-ব্যবস্থার ভিতের উপর আপনারা কোনো কিছু নির্মাণ করতে পারবেন না।  আপনারা রাষ্ট্রের নির্মাণ করতে পারবেন না। আপনারা আদর্শ নীতিবোধ ও তৈরি করতে পারবেন না। জাতিব্যবস্থার ভিতের উপর আপনারা যা কিছু নির্মাণ করুন না কেন সেটা ভেঙ্গে পড়বে। সেটা কখনও স্থায়ী হবে না।
    এখন আর একটি প্রশ্নের বিচার- বিশ্লেষণ করতে বাকি আছে। সেই প্রশ্নটি হল- হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় সংস্কার কিভাবে করা যায়? জাতিপ্রথাকে কিভাবে ধ্বংস করা যায়? এটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নএই ধরনের মতামত করা হয়েছে যে, জাতব্যবস্থার সংস্কার করতে হলে প্রথম পদক্ষেপ হল জাতের উপবিভাগগুলি (Sub-castes) সমাপ্ত করতে হবে। এই মতবাদের পিছিনে যুক্তি হল যে, আচার ব্যবহার এবং মর্যাদাবোধের দিক দিয়ে বিভিন্ন জাতের চেয়ে একটি জাতের উপবিভাগগুলির মধ্যে বেশি সাদৃশ্য আছে। আমি মনে করি, এটা একটা ভুল যুক্তি। দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণদের তুলনায় উত্তর ভারতের এবং মধ্য ভারতের ব্রাহ্মণদের সামাজিক পদমর্যাদা নিম্নস্তরের। উত্তর এবং মধ্য ভারতের ব্রাহ্মণরা শুধুমাত্র রান্না করা এবং জল আনার কাজ করে,  অথচ দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণরা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা দখল করে আছে। অপরদিকে উত্তর ভারতের বৈশ্য ও কায়স্থরা এবং দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধিতে ও সামাজিক মর্যাদায় সমকক্ষ। আবার আহারের ব্যাপারেও দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কাশ্মীর ও বাংলার   ব্রাহ্মণদের কোন মিল নেই। দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণরা নিরামিষাশী এবং কাশ্মীর ও বাংলার ব্রাহ্মণরা আমিষভোজী। আবার আহারের ব্যাপারে দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ এবং গুজরাটী মারোয়ারী, বনিয়া এবং জৈন প্রভৃতি অব্রাহ্মণদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মিল আছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণদের মধ্যে ঘনিষ্ট সামাজিক মিলন ঘটানোর চেয়ে উত্তর ভারতের কায়স্থ এবং দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় ও অব্রাহ্মণদের মধ্যে ঘনিষ্ট সামাজিক মিলন সহজসাধ্য


    ধরুন, এক জাতির উপ-বিভাগগুলির মধ্যে ঘনিষ্ট সামাজিক মিলন সম্ভব হলে এবং উপবিভাগগুলির বিলোপ সাধন হলে জাত ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে, এর কি গ্যারান্টি আছে? অপর পক্ষে একটি জাতির উপবিভাগগুলির বিলুপ্তি হওয়ার সাথে সাথে জাতিভেদ প্রথার বিলুপ্তি হওয়ার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, জাতের উপবিভাগের বিলুপ্তি ঘটানোর এই তত্ত্ব অবাস্তব এবং অকার্যকারী।
   জাতিব্যবস্থা সমাপ্ত করার আর একটি পদ্ধতি হচ্ছে- অসবর্ণদের মধ্যে একত্রে বসে খাওয়া-দাওয়া শুরু করাকিন্তু আমার মতে অসবর্ণ  ভোজন জাতব্যবস্থা নামক সামাজিক ব্যধির আসল  ঔষধ নয়। অনেক জাতির মধ্যে অসবর্ণ ভোজনের বাধা নেই। কিন্তু সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, অসবর্ণ  ভোজন স্বজাতি প্রীতি এবং জাত চেতনাবোধ ধ্বংস করতে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ‘জাতিভেদ’ প্রথা নামক সামাজিক ব্যাধির খাঁটি ঔষধ হল ‘অসবর্ণ বিবাহ’।  শুধুমাত্র রক্তের সংমিশ্রণই আত্মীয়তা বোধ সৃষ্টি করতে পারে।  যতক্ষণ  বিভিন্ন জাতের মধ্যে আত্মীয়তা বোধ সৃষ্টি না হবে, ততক্ষণ জাত ব্যবস্থা নির্মূল হবে না। জাত ব্যবস্থার মাধ্যমে একজাতের লোক অন্য জাতের লোককে পর ভাবে। একমাত্র অসবর্ণ বিবাহের ফলে রক্তের মিশ্রণের দ্বারা ঘনিষ্ট মিলনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতের মধ্যে আত্মীয়তাবোধ গড়ে উঠবে। হিন্দুর সামাজিক জীবনে মিলনের পথ সৃষ্টি করতে অসবর্ণ বিবাহ একটি অপরিহার্য  উপাদানকোনো  সমাজ যখন অন্যান্য বন্ধনের দ্বারা দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হয়, তখন বিবাহ মানুষের একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু যে সমাজ সামাজিক মিলনের জন্য কোনো বন্ধন নেই সেখানে বিবাহ  সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি করতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। জাত ব্যবস্থা ভাঙার প্রকৃত প্রতিকার হল অসবর্ণ বিবাহ। অসবর্ণ বিবাহ ছাড়া অন্য কিছু জাতিব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটাতে সক্ষম হবেনা।(The  real  remedy for breaking Caste is inter-marriage. Nothing else will serve as the solvent of Caste.)
   আপনাদের ‘জাতপাত তোড়ক মন্ডল’ অসবর্ণ বিবাহকে উৎসাহ দিতে চায়। আমি এজন্য আভিনন্দন জানাইজাত-ব্যবস্থাই হিন্দু সামাজের দুরারোগ্য ব্যাধি। জাতপাত তোড়ক মন্ডল হিন্দু সমাজের এই রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং হিন্দুদের বলতে সক্ষম হয়েছে যে, হিন্দুদের মধ্যে দোষ-ত্রুটিগুলো কোথায়। মন্ডলের এই সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য আমি তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। সামাজিক অত্যাচারের কাছে রাজনৈতিক অত্যাচার কিছুই নয়। যে রাজনীতিবিদ সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান, তার চেয়ে যে সমাজ-সংস্কারক সমাজের অন্যায় নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান- তিনি অনেক বেশি সাহসী এবং বীর। প্রত্যেক জাতির সাধারণ মানুষ যখন অধিক সংখ্যায় অসবর্ণ ভোজন এবং  অসবর্ণ বিবাহ করতে রাজী হবে এবং তা অনুসরণ করবে তখন জাত-ব্যবস্থার কঠিন বন্ধন খসে  পড়তে বাধ্য হবে- আপনাদের এই মতবাদ নির্ভুল।
  আপনারা রোগের মূল কারণ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু রোগ নিরাময়ের জন্য আপনাদের প্রতিবিধান কি ঠিক? আপনারা নিজেরাই নিজেদের কাছে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন। কি কারণে হিন্দুদের একটা বড় অংশ অসবর্ণ ভোজন ও অসবর্ণ বিবাহ করে না? আপনাদের এই উদেশ্য জনপ্রিয় না হওয়ার কারণ কি? এই প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর আছে; সেটা হ’ল, অসবর্ণ ভোজন এবং অসবর্ণ বিবাহ হিন্দুদের পবিত্র ধর্মমত ও বিশ্বসের সম্পূর্ণ বিরোধী। জাত, ইটের দেওয়াল বা কাঁটা তারের বেড়ার মত নিরেট বস্তু নয় যে সেটা ভেঙে ফেললে পথের সব বাঁধা অপসারিত হবে। জাত হল একটি ধারনা, এটা একটা মানসিক অবস্থা। অতএব জাত-ব্যবস্থা নষ্ট করার অর্থ কোনো নিরেট বস্তু ধ্বংস করা বুঝায় না। এর অর্থ বিচার পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্তজাতব্যবস্থার ফলে মানুষ মানুষের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার করে। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, মিঃ গান্ধিসহ যে সমস্ত সংস্কারকরা অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের কাজে নিযুক্ত আছেন, তাঁরা হয়তঃ  বুঝতে পারেননি যে, জনগণের সামাজিক আচরণগুলি শাস্ত্র নির্দেশিত নীতিগুলির প্রতি অবিচল বিশ্বাসের ফল। শাস্ত্রের মাধ্যমে যেটা তাদের মনের মধ্যে গেথে দেওয়া হয়েছে। জনগণ শাস্ত্রের প্রতি যতক্ষণ পবিত্র ভাব ও বিশ্বাস  করা বন্ধ না করবে, ততক্ষণ তারা তাদের আচরণের পরিবরতন করবেনা। কারণ যুগযুগ ধরে বংশ পরম্পরায় শাস্ত্র নির্দেশিত আচরণ হিন্দুদের রক্তের  সঙ্গে মিশে গেছে। পিতামাতার কাছ থেকে অজ্ঞাতসারে সন্তানরাও ঐ আচরণবিধি মেনে চলছে। তাই অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের প্রচেষ্টাগুলি বিশেষ ফলপ্রসু হয়নি। আর এর জন্য আশ্চর্য হওয়ারও কোন কারণ নেই।

     অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য সমাজ সংস্কারকরা যে ভুল করছেন, আপনারাও সেই একই ভুল করছেন। অসবর্ণ ভোজন এবং অসবর্ণ বিবাহের জন্য আন্দোলন করা বা হিন্দুদের সংগঠিত করা, কৃত্রিম উপায়ে জোর করে খাদ্য খাওয়ানোর মত। প্রত্যেক নরনারীকে শাস্ত্র নির্দেশিত বিধির নাগপাশ থেকে মুক্ত করে দিন। শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে যে সব অনিষ্টকর ধারণাগুলি তাদের   মনের মধ্যে গেঁথে আছে, সেই সব ভক্তি-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, মনোবাভ, বিচারকে নির্মূল করুন তখন দেখতে পারবেন যে, প্রত্যেক নরনারী অসবর্ণ ভোজন ও অসবর্ণ বিবাহ করতে দ্বিধাবোধ করবে না। শাস্ত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ক্ষতিকর ধারণাগুলি মাথা থেকে বেরিয়ে গেলে তখন দেখবেন আপনারা না বললেও তারা অসবর্ণ ভোজন ও বিবাহের আয়োজন করবে।

     কথার মার-প্যাঁচের সাহায্য নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। শাস্ত্রগুলি জাত মেনে চলতে বলেনি বা শাস্ত্র বাক্যগুলি জাত-ব্যবস্থা সমর্থন করেনা, অথবা শাস্ত্রবাক্যের ব্যাকরণগত অর্থ বা তর্কশাস্ত্রের নিয়মগত ব্যাখ্যা অনুসারে জাতিভেদ প্রথার জন্য শাস্ত্রগুলি দায়ী নয়, এরকম বাকচাতুরী করে কোন লাভ হবে না। এখানে প্রধান বিচার্য বিষয় হল, সাধারণ মানুষ শাস্ত্রগুলির অর্থ কিভাবে করেছে এবং বুঝেছে। গৌতম বুদ্ধ যেরকম বলিষ্ঠ পথ দেখিয়েছিলেন আপনাদেরও সেরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বুদ্ধ এবং গুরুনানকের মত আপনাদেরও শুধু শাস্ত্র প্রত্যাখ্যান করলে চলবে না। শাস্ত্রের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে হবে। হিন্দুদের একথা বলতে আপনাদের সাহস থাকা দরকার। হিন্দুধর্মের মধ্যেই ত্রুতি রয়েছে। এই ধর্ম জাতব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। জাত খুব ভাল জিনিস এই ধারণাটি প্রত্যেক হিন্দুর মনের মধ্যে গেথে দিয়েছে। হিন্দুদেরকে এসব কথা বলতে আপনারা সাহস দেখাবেন কি?


Read More

Thursday 25 June 2020

// // Leave a Comment

*তপশিলি উন্নয়নে- যোগেন্দ্রনাথ বনাম শ্যামাপ্রসাদ* লেখক – প্রদীপকুমার বিশ্বাস




তপশিলি উন্নয়নে- যোগেন্দ্রনাথ বনাম শ্যামাপ্রসাদ

     লেখক – প্রদীপকুমার বিশ্বাস
     ১৯৪১ সালে নভেম্বর মাসে ফজলুল হক সাহেবের প্রথম মন্ত্রীসভা ভেঙে যায়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদের সাহায্যে দ্বিতীয়বার হকসাহেব মন্ত্রীসভা গঠন করেন। অখণ্ড বাংলায় যা “শ্যামা-হক” মন্ত্রীসভা নামে পরিচিত। অর্থাৎ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের আগেই শ্যামাপ্রসাদ মুসলিম মন্ত্রীসভা গঠনের শরিক ও তার মন্ত্রী হয়েছিলেন।
     ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রীসভার অন্যতম ক্ষমতার অধিকারি শ্যামাপ্রসাদ তপশিলি সমাজের উন্নতির জন্য কিছুই করেননি। তিনি শুধুমাত্র বর্ণহিন্দু তথা উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যস্ত। তপশিলি সমাজের মানুষ যাতে শিক্ষা ও চাকুরীতে কোনো সুযোগ না পায়, তার জন্য শ্যামাপ্রসাদ হকসাহেবকে দিয়ে সেই ষড়যন্ত্রই করে গেছেন। শুধু তাই নয়, হকসাহেবের সময়কালে মুসলমানেরাও তপশিলি সমাজের ন্যায় শিক্ষা ও সরকারী চাকুরী থেকে সমানভাবে বঞ্চিত হয়। শ্যামাপ্রসাদের ষড়যন্ত্রে সরকারী সমস্ত সুযোগ সুবিধা বর্ণহিন্দুরা পেতে থাকে।
শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার নেতৃত্বে সংগঠিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো-
(১) শ্যামা-হক মন্ত্রীসভায় District School Board গঠনের জন্য একটি আইন প্রণীত হয়। Board এর সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি অনুসারে তপশিলি জাতির কোনো সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না।*১
(২) এই মন্ত্রীসভার সময়কালে ২৫০০ টাকার চাকুরীতে মুসলমান ও তপশিলি সমাজের কেউ কে ইনিয়োগ করা হয়নি। এক্ষেত্রে সবটাই নিয়োগ হয়েছিল বর্ণহিন্দুরা।*২
(৩) Communal Ratio Rule প্রবর্তিত থাকা সত্ত্বেও তপশিলি জাতির প্রার্থীগণকে তদানুসারে চাকুরী দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়।*৩
(৪) তপশিলি জাতির শিক্ষার জন্য বার্ষিক পাঁচ লক্ষ টাকার রেকারিং গ্রান্ট শ্যামাপ্রসাদের পরামর্শে ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রীসভা বন্ধ করে দেন। *৪
(৫) বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারী বৃত্তির সুযোগ অধিক মাত্রায় বর্ণহিন্দুরাই পেতে থাকে। তপশিলি সমাজের একজনকেও সরকারী বৃত্তি দেওয়া হয়নি। সুযোগের তালিকায় মুসলমানেরাও ছিল নগণ্য।   
     শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার ঐ অপশাসনের বিরুদ্ধে তপশিলি সমাজের পক্ষ থেকে বাংলার তৎকালীন গভর্ণর জন্‌ আর্থার জি. সি. আই-ই-এর কাছে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল অভিযোগ করেন। লীগের পক্ষ থেকে নাজিমুদ্দিনও একই অভিযোগ করেন। গভর্ণর অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে হকসাহেবেক প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। অর্থাৎ দুর্নীতি পরায়ণ শ্যামা-হক মন্ত্রী সভার পতন ঘটে।
     শ্যামাপ্রসাদ, হিন্দুমহাসভা (বর্তমানে R.S.S.)-এর বর্ণহিন্দুগণ তপশিলি  সমাজের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের এই সংগ্রামকে মেনে নিতে পারেনি। তাই শ্যামাপ্রসাদ, হিন্দুমহাসভা তথা বর্ণহিন্দুদের কাছে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মহাশত্রুতে পরিণত হন।
    
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল অনুধাবন করলেন অখণ্ড বাংলায় প্রধানতঃ তপশিলি ও মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ প্রতি ক্ষেত্রে তপশিলি ও মুসলমানেরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত ও অপমানিত।
 ১৯৪৩ সালের ২৮শে মার্চ বাংলার গভর্ণর ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেন। পরবর্তীতে শ্যামাপ্রসাদ, হকসাহেবকে পুনঃরায় প্রধানমন্ত্রী করে নিজে ক্ষমতার কেন্দ্রে যাবার চেষ্টা করতে থাকেন। অপর দিকে লীগের এম.এল.এ.গণ নাজিমুদ্দিনকে বাংলার প্রধানমন্ত্রী করবার চেষ্টা করতে থাকেন।
    এমতো অবস্থায় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল তপশিলি সমাজের উন্নতি ও অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হন। তিনি ২১ জন তপশিলি সমাজের এম.এল.এ.গণকে নিয়ে কলকাতার স্যাভয় হোটেলে অবস্থান করেন। তপশিলি সমাজের উন্নতি ও অধিকার রক্ষায় বিস্তর আলোচনা হয়। আলোচনার পর তপশিলি এম.এল.এ.গণ সর্বসম্মতভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্তের মধ্যে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত হলো তপশিলি সমাজের উন্নতি ও অধিকার রক্ষার শর্তগুলি যে মন্ত্রীসভা মেনে নেবে তপশিলি এম.এল.এ.গণ সেই মন্ত্রীসভাকেই সমর্থন জানাবে।  
শর্তগুলি নিম্নরূপঃ-
 (১) তপশিলি জাতির তিনজন মন্ত্রী এবং তিন জন পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী নিযুক্ত করতে হবে। *৫  
(২) তপশিলি জাতির শিক্ষার জন্য বার্ষিক পাঁচ লক্ষ টাকা রেকারিং মঞ্জুর ও কার্যকরী করতে হবে। * ৬
(৩) ‘কমিউনাল রেশিও (Communal Ration Rule)’ অনুসারে সকল চাকুরীতে তপশিলি জাতির প্রার্থী নিয়োগ করতে হবে।* ৭   
(৪) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভায়, District Board, Union Board, Municipality প্রভৃতি স্বায়ত্ত্ব শাসন মূলক প্রতিষ্ঠানে তপশিলি জাতির  সংখ্যানুপাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণ করতে হবে।*
(৫) ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তির জন্য আসন সংরক্ষণ। * ৯
    স্যাভয় হোটেলে তপশিলি এম.এল.এ.গণ উক্ত শর্তের সমর্থনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। উক্ত দাবি যিনি মেনে নেবেন তাকেই নেতা মনোনীত করবার পক্ষে স্বাক্ষর করবেন।
    পরদিন শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হকসাহেব স্যাভয় হোটেলে উপস্থিন হন। শ্যামাপ্রসাদ,  যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলসহ অন্য তপশিলি এম.এস.এ.গণকে হক সাহেবকে নেতা মনোনীত করে স্বাক্ষর  করতে বলেন। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে তপশিলি এম.এল.এ.গণ তপশিলি জাতির উন্নতি ও  অধিকার রক্ষার পূর্বগৃহীত শর্তগুলি তুলে ধরেন। তখন শ্যামাপ্রসাদ বলেন,-“আগে দলপতি মনোনয়ন করুন, তারপর দাবির বিষয় বিবেচনা করা যাবে।” *১০ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলসহ তপশিলি  এম.এ্ল.এ.গণ আগে শর্ত মানা পরে নেতা মনোনীত করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। তখন শ্যামাপ্রসাদ ‘দাবি মানা সম্ভব নয়’*১১  বলে হক সাহেবকে নিয়ে স্যাভয় হোটেল ত্যাগ করেন।   
     এখানে বিশেষভাবে লক্ষনীয় শ্যামাপ্রসাদ তপশিলি জাতির উন্নয়ন ও স্বার্থের জন্য কোনো শর্ত  মানেননি এবং হক সাহেবকেও মানতে দেননি। অর্থাৎ বাংলার তপশিলি সমাজের প্রধান শত্রু ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। বর্তমানে সেই শ্যামাপ্রসাদের দর্শনের মুখোশ R.S.S.এবং B.J.P.
    পরদিবস নাজিমুদ্দিন, সুরাবর্দি, সাহাবুদ্দিন লীগের পক্ষে স্যাভয় হোটেলে উপস্থিত হন।  যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে তপশিলি এম.এল.এ.গণের পূর্ব গৃহীত সিদ্ধান্তের শর্তগুলি নাজিমুদ্দিন ও তাঁর সহযোগীগণ মেনে নিলেন। অবশেষে ১৯৪৩ সালের ১৯শে এপ্রিল ২১ জন তপশিলি এম.এল.এ. ও লীগের যৌথ সভায় নাজিমুদ্দিনকে নেতা মনোনীত করেন। নাজিমুদ্দিনকে নেতা   মনোনীত করে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলসহ ২১ জন তপশিলি এম.এল.এ. স্বাক্ষর করেন। ২৩শে এপ্রিল (১৯৪৩) সম্মিলিতভাবে গভর্ণরের নিকট সেই স্বাক্ষরিত কপি পেশ করেন। পরদিন অর্থাৎ ২৪শে এপ্রিল নাজিমুদ্দিন ১৩ জনের মন্ত্রী পরিষদ গঠনের মাধ্যমে বাংলার প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করেন। (তৎকালীন সময়ে প্রাদেশিক শাসন কর্তাকে প্রধান মন্ত্রী বলা হতো, যেটা বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী নামে পরিচিত)।
     শর্তমতো মন্ত্রীসভায় তিনজন তপশিলি মন্ত্রী হলেন-
(১) যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল
(২) প্রেমহরি বর্মণ
(৩) পুলিনবিহারী মল্লিক।
শর্তমতো তিনজন পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী হলেন-
১) অনুকুলচন্দ্র দাস
২) বঙ্কুবিহারী মণ্ডল
৩) রসিকলাল বিশ্বাস।
    ১৯৪৩ সালের ২৬শে আগস্ট নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভার বাজেট পাশ হলো। বাজেটে তপশিলি জাতির শিক্ষার জন্য বার্ষিক পাঁচ লক্ষ টাকা (বর্তমানের নিরিখে কয়েক কোটি টাকা) রেকারিং গ্রান্ট  মঞ্জুর হলো এবং সেটা কার্যকরী হলো। শুধু তাই নয়, Communal Ratio Rule অনুসারে বিদেশে তপশিলিদের উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকারি বৃত্তি প্রদান হতে লাগল।  
      তপশিলি সমাজের জন্য শিক্ষার এই সুযোগ ও অধিকার পাওয়াটা শ্যামাপ্রসাদসহ বর্ণহিন্দুররা অশনি সঙ্কেত পেল। আর তখনই চক্তান্ত করে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কেন লীগ মন্ত্রীসভায় জোটবদ্ধ হলেন তা নিয়ে অপপ্রচার, কুৎসা রটনা শুরু করল। অথচ হকসাহেবের মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ যখন ছিলেন, তখন তিনি শুধুমাত্র বর্ণহিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার দূর্নীতি করেগেছেন। সেকথা বলা হলোনা। বর্তমান সময়ে তপশিলি সমাজের কিছু অকৃজ্ঞ শিক্ষিত স্বঘোষিত পণ্ডিত,  যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের অবদান অস্বীকার করছে। তারা বলতে পারছেনা যোগেন মোল্লা হলে শ্যামাপ্রসাদ মৌলবী।
    যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভার সৌজন্যে Communal Ratio Rule অনুসারে অর্থাৎ সংরক্ষণ মেনে তপশিলি জাতির প্রার্থীগণ সমস্ত বিভাগে চাকুরী পেতে লাগলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, মুন্‌সেফ, কোঃ অপারেটিভ ইন্সপেক্টর,  সাবরেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সুপারিশে বহু তপশিলি প্রার্থী রাইটার্স বিল্ডিংয়ে চাকুরী পান। ঐসব চাকুরীতে বর্ণহিন্দুদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের প্রয়াসে তপশিলি সমাজের শিক্ষাও চাকুরিতে অধিকার বর্ণবাদীরা মেনে নিতে পারলনা। তাই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, অপপ্রচারের কারিগর বর্ণহিন্দু তথা ব্রাহ্মণ্য সমাজ।
    এতো প্রচেষ্টার মধ্যে ১৯৪৩ সালে ফুড রেশনিং বিভাগের চাকুরীতে Communal Ratio Rule অর্থাৎ সংরক্ষণ মানা হচ্ছিলনা। ফলস্বরূপ তপশিলি চাকুরী প্রার্থীগণ বঞ্চিত হতে থাকে। মোর্চার পার্টি মিটিং-এ এবিষয়ে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল নাজিমুদ্দিনের দৃষ্টিগোচর করে বলেন,- Communal Ratio Rule যদি অন্যান্য বিভাগে না মানা হয়, তবে আমার বিভাগেও ইহা মানিবনা। আমি আমার বিভাগে একটি চাকুরিও মুসলমান কিংবা বর্ণ হিন্দুকে দেবনা। সমস্ত চাকুরী তপশিলি জাতির প্রার্থীগণকে দিয়ে অন্য বিভাগের ক্ষতিপূরণ করিব।”*১২    
    এরূপ মন্তব্যে হামিদুলহক চৌধুরীসহ লীগের প্রভাবশালী সদস্যগণ ক্রুদ্ধ স্বরে যোগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বাক্য প্রয়োগ করতে থাকেন। তখন যোগেন্দ্রনাথও অনুরূপ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলেন- “মিঃ হামিদুলহক চৌধুরী, লাল চোখ দেখাবেন না। লাল চক্ষু আমাদেরও আছে। আমি মন্ত্রীত্ব করি, চাকুরী নহে, এ মন্ত্রীত্ব কাহারও দেওয়া দান নহে। যে সুখের ঘর বেঁধে দিয়েছি, প্রয়োজন হলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তা ভেঙ্গে দিতে পারি।” *১৩  
    মোর্চার পার্টি মিটিংয়ে তখন যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী ২০ মিনিট সভা স্থগিত ঘোষণা করলেন। সভার সন্বিহিত একটি কক্ষে প্রধানমন্ত্রী নিজামুদ্দিন ও সুরাবর্দি সাহেব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেন। পুনঃরায় সভার শুরুতে যোগেন্দ্রনাথের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নাজিমুদ্দিন প্রতিকারের আশ্বাস দেন। পরবর্তী সময়ে Communal Ratio Rule মেনে তপশিলি প্রার্থীদের ফুড রেশনিং বিভাগে প্রচুর চাকুরী হয়।
শুধু তাই নয়, যোগেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে তপশিলি এম.এল.এ.গণ-তপশিলি সমাজের চাকুরীপ্রার্থীগণের  শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কে কি চাকুরী প্রার্থী সে তালিকা প্রস্তুত করে বিভিন্ন দপ্তরে পাঠাতেন। বিনা ইন্টারভিউতে তাঁরা বিভিন্ন দপ্তরে সুপারিশের বিনিময়ে চাকুরী পেয়েছেন। তপশিলি সমাজের  উন্নতির অধিকার রক্ষার স্বপক্ষে বাংলায় যোগেন্দ্রনাথের মতো প্রভাবশালী আর কেহ ছিলেন না।  
    বাংলার তপশিলি সমাজের উত্থানের নায়ক ও মুক্তির দূত যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে শ্যামাপ্রসাদসহ বর্ণহিন্দুদের ব্যানার হিন্দুমহাসভা(বর্তমানে R.S.S.) ও কংগ্রেস শেষ করে দিতে ষড়যন্ত্র শুরু করল।
অতএব স্পষ্টভাবেই বলা যায় ‘যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে রাজনৈতিকভাবে শেষ করতে না পারলে তপশিলি সমাজের অগ্রগতি কোনোভাবে ঠেকানো যাবেনা’- এই চরম সত্য উপলব্ধি করেই   শ্যামাপ্রসাদ ও কংগ্রেস বাংলাভাগ করে নিল। তপশিলি সমাজের বৃহৎ অংশ এই সত্যটি এখনো বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারলেন না।
________________
(সহায়ক গ্রন্থ-
*(১)(৮) এবং (৯) মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, ১ম খণ্ড, লেখক- জগদীশচন্দ্র মণ্ডল পৃ. ৯০; প্রকাশক –চতুর্থ দুনিয়া, স্টল ২২ ভবানী দত্ত লেন। কলকাতা- ৭৩.  
* (২)&(৩) ঐ পৃ. ৯৩  
* (৪) ঐ  পৃ. ৮৭   
* (৫),(৬)এবং(৭) ঐ পৃ. ১০২
* (১০)ও (১১) ঐ পৃ. ১০৩
* (১২) ও (১৩) ঐ পৃ. ১১০   
এছাড়া অন্য সহায়ক গ্রন্থ- বাংলাভাগ হল কেন? লেখক –নিকুঞ্জবিহারী হাওলাদার।)


Read More