Saturday 1 January 2022

// // Leave a Comment

মহিমান্বিতা তাড়কা মাতা। লেখক- ধীবর ডাঃ গুণধর বর্মণ

 


মহিমান্বিতা তাড়কা মাতা

—ধীবর ডাঃ গুণধর বর্মণ
অমিত তেজস্বিনী মহীয়সী জননী রাক্ষসী তাড়কা,
কে তোমারে আঁকিয়াছে বিভৎস আকারে ?
ভীতি সঞ্চারিতে সবার অন্তরে !
উন্মোচন কর আজি সেই প্রহেলিকা ।
তুমি যক্ষ সূতা,
মহাবল সুকেতুর কন্যা অপরূপা ।
গল্প কথায় মনোহারী
এ ধরায় যত সুন্দরী
বলে সবে উপমায়–
যেন যক্ষের দুহিতা ।
তবে, যক্ষ কন্যা কেহ
নহে অবলা দুর্বল দেহ
ভারতের আদিম সন্তান
পুরুষের সাথে নারী ছিল সমানে সমান ।
বাল্মীকির রামায়ণে
দেখি লেখা সসম্মানে
পিতা সদাচারী মহাপরাক্রান্ত
বিন্ধ্যের উত্তরে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড
ছিল তাঁর আধিপত্য ।
তাঁরই যোগ্য কন্যা হয়ে
সহস্র হস্তীর বল গায়ে
রূপবতী যুবতীরূপে বর্ণনা তোমার
আর মহাবীর জম্ভ-পুত্র সুন্দ সহ বিবাহিত
ছিল তব সুখের সংসার,
সেথা বীরপুত্র প্রসবিনী
ধন্যমাতা যক্ষ রাণী
মহাবীর মারীচ তোমারই কোঙর ।
সেই কালে–
পশ্চিম এশিয়ার মরু প্রান্তরে
দীর্ঘস্থায়ী শীতার্ত অঞ্চলে
খাদ্য আশ্রয় খুঁজি খুঁজি
ঘুরিত যারা দলে দলে
যাযাবর হিংস্র বর্বর
আর্যনামে অর্ধসভ্য বিকৃত রুচির কিছু নর
দুর্ধর্ষ শিকারী বেশে দুর্গম গিরি কান্তার শেষে
ঢুকে পড়ে তারা গান্ধার দেশে ভারতের ঐ কোনে।
দলে ভারী হয়ে ক্রমে তারা দিকে দিকে ভ্রমে
নদীতীর ধরি চলে পূবে ও দক্ষিণে ।
আদি ভারতভূমে ছিল নাকো ঘোড়া,
পারস্য অঞ্চলে তার আবির্ভাব ধারা,
পারসীকরাই অশ্ব বশ করে,
বুনো আর্যরাও অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে
ক্ষিপ্রতায় ঘোরে ।
উর্বর অঞ্চলে আসি
ভারত মাটিতে তারা হয় মহাখুশি,
বর্বরতার উগ্ৰতায় মাতি দল বাঁধি
হিংস্র আঘাত হানে
সভ্যতায় উন্নীত ভারতের শান্তিপ্রিয়
সুস্থির নগর জীবনে ।
যে সমাজের ধারা তাড়কা'র পূর্বপুরুষেরা
গড়েছিলেন কৃষিশিল্পে সমুন্নত হ'য়ে
চলেছিলেন ক্রমোন্নত শান্তির সন্ধানে।
অর্ধসভ্য আর্যরা জানতও না কৃষিশিল্প বস্ত্র ব্যবহার,
জানত না স্থায়ী বাসগৃহ গড়া, রুচিপূর্ণ ঘরের বাহার,
পর্ণকুটির বাঁধি পশুচর্ম বৃক্ষের বল্কল ছিল
দেহ আচ্ছাদনে,
জীবিকার পথ ছিল মৃগয়া গোপালন আর
ফলমূল আহরণে।
সুদূর পারস্য দেশে শীত ঋতু ছিল দীর্ঘস্থায়ী,
বস্ত্রহীন দেহে সেথা আগুন পোহান ছাড়া
বাঁচিবার উপায় তো নাই ।
সেই আগুন জ্বালানো তখন সমস্যা যে কত !
প্রাণরক্ষা তরে তাই অতি নিষ্ঠাভরে
সমাজের কিছুজন ছিল সদা সেই কাজে রত।
অগ্নিরক্ষা ও অগ্নিপূজার সেই আদিম সমাজধারা
ঐ পারস্য হ'তে বিভিন্ন দেশে বয়ে চলে আর্যরা ।
ঐতিহ্য মত অভ্যাসগত আগুনের সেই অর্চনা
প্রবাসী আর্যরা ভারতেও করে,
প্রয়োজন যার ছিল না ।
আর শীতের দেশে সোমের রসে
উজ্জীবিত হতো যারা
সেই অভ্যাসও এই দেশে আনে
বহিরাগত ঐ আর্যরা ।
দিবারাত্রি সেই অগ্নি জ্বালাইয়া রাখে যতন ভরে,
অগ্নির এই অর্চনাই কালে 'যজ্ঞ' নাম ধরে।
অগ্নি পূজায় সোমরস চাই বিশেষ সংযোজন,
সোম না হ'লে হোমের শিখা হয় না তো সুশোভন।
সোমে মত্ত যজ্ঞের সেই উগ্ৰ হুতাশনে
প্রায়শই হেথা দাবানল হ'ত বনে বনে,
পুড়িত শস্যের ক্ষেত বাসগৃহ বহু
অসংযত আগুনের তীব্র লেলিহানে ।
গ্ৰীষ্ম দেশের আদিবাসীরা আগুনে করে যে ভয়,
আগুন নেভাতে ছুটে যেত তারা যেখানে যজ্ঞ হয়।
কৃষি শিল্পের শান্ত সমাজে এদেশের অধিবাসী
আগুন জ্বালানো ঐ কৃষ্টির প্রতি হয়ে ওঠে বিদ্বেষী।
কেউ কারও ভাষা বুঝিত না তারা থাকিত পাশে
তায় রোষবহ্নির প্রবাহ জ্বলিত তীব্র অন্ধ আক্রোশে।
পরে যজ্ঞের মহান প্রশস্তি গান
যত আর্য সাহিত্যে পাই
শুদ্ধ জ্ঞানের যুক্তিবিচারে তার কোনো ত মূল্য নাই।
আগুন জ্বালি অং বং মন্ত্র বলি
ভুত খেদানোর যাদু বিদ্যা
অজ্ঞ সমাজে আজও তো বিরাজে
শক্তিশালী কত গুণীন ও ওঝা।
বেদের মন্ত্রে যাদুর মন্ত্রে
ঐ ভাষা ছাড়া ফারাক কিছুই নাই,
'তুকতাক্' করি অজ্ঞ মানুষে ঠকানো বুদ্ধি সবটাই।
যজ্ঞ নামের সেই যাদুবিদ্যার বিরোধী যাহারা ছিল
বহিরাগত আর্যরা তাদের রাক্ষস নাম দিল ।
মাটির সন্তান সেই রাক্ষসগণ যজ্ঞ মানিতে চায়নি
নিজেদের কৃষ্টি রক্ষা করিতে মরিতেও ভয় পায়নি ।
ঐ ব্রাহ্মণ্যবাদী যজ্ঞ নিয়েই সংঘর্ষ কালে কালে
কত কুরুক্ষেত্র লঙ্কাকান্ড ঘটে চলে অবহেলে ।
আজও তার শেষ নাই,
ব্রাহ্মণ্যবাদী জিঘাংসাতেই দেশ পুড়ে হয় ছাই ।
তাতেই স্বদেশপ্রেমী তাড়কা জননী
বীভৎসারূপে আঁকা
কারণ তাহার খুঁজিয়া ঐ রামায়ণে আছে লেখা ।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
বাল্মীকির নামে কথিত রামায়ণে
অগস্ত্য মুনির কথা সকলেই শুনে ।
সেই মুনি নাকি অসীম শক্তিধর,
তাঁহার প্রতাপে ত্রিভুবন কাঁপে
ব্রহ্মতেজ তাঁর এত প্রখর ।
মহাসমুদ্র ধরি গণ্ডুষ করি করেছিলেন তিনি পান,
বাতাপি ইল্বলে দুই রাক্ষস-প্রবলে
হেলায় করে যে নিধন,
সেই মুনি —
তাড়কার দেশে অতর্কিতে পশে,
হত্যা করে সুন্দ-রে,
কিন্তু মহিমময়ী
তাড়কার রোষে পালায় শেষে
ঐ দেশ ছেড়ে ।
লাথি মেরে তারে বিন্ধ্যের পারে
দেয় যে তাড়কা দূর করে,
ভয়ে তাড়কার অগস্ত্য আর
ফেরেনি বিন্ধ্যের উত্তরে ।
ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্র সাহিত্যে
অন্যভাবে এর প্রচার বেশি,
ঐ লাথি খাওয়া ঋষির অভিশাপে নাকি
হয়েছে তাড়কা রাক্ষসী।
ব্রাহ্মণ শাস্ত্র আসল সত্য প্রচার কভু তো করে না
বলে অগস্ত্য হুকুমেই নাকি বিন্ধ্য মাথা তোলে না।
অত যার তেজ সে কেন পারেনি
নিজে তাড়কারে বধিতে,
বামুনের শাস্ত্র সবই ভরা হায়
এমনি ধাপ্পাবাজিতে ।
'রক্ষ' ধাতু হইতে যে 'রাক্ষস' কথা, সে সবার জানা
সুবিধাবাদী ব্রাহ্মণেরা সেই ব্যাকরণ কেন মানে না !
স্বজাতি-সমাজ-স্বদেশরক্ষা করিত যাহারা সেকালে
সেই রক্ষা কর্মের জন্যই ঐ রাক্ষস নাম চলে !
তাই 'রাক্ষস' কোনো বিরূপ শব্দ নয়
ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রেই তার বিকৃত প্রচার হয় ।
তাড়কা রাক্ষসী সত্যই তাই জননী মহিমময়ী মানবতাবাদী স্বদেশপ্রেমী তাঁর মত কেহ নাই ।
আরও দেখ রামায়ণে–
তাড়কা বধিতে বিশ্বামিত্র কেন
রামে ধরে টানি আনে !
কেবা ছিল সেই রাম–
বানানো গল্পের নায়ক ছাড়া তো
কিছু নাহি তার দাম ।
অলীক কাহিনী বানাইয়া শেষে তাড়কারে মারা হয়,
বিশ্বামিত্র যে বিশ্বজয়ী তার নিজ বল গেল কই !
কি অদ্ভুত সেই বর্ণনা দিয়াছে কবি কৃত্তিবাসে–
তাড়কার কাছে আসি মহামুনি পালায় কী সন্ত্রাসে।
কৃত্তিবাসের আসল লেখাটি এই–
" কর বাড়াইয়া তার ঘর দেখাইয়া
মহাত্রাসে মুনিবর যান পলাইয়া ॥
শ্রীরাম বলেন, ভাই, মুনির সহিত
শীঘ্র যাহ, গুরু একা যান, অনুচিত ॥
গেলেন মুনির সঙ্গে লক্ষ্মণ তখন
তাড়কার প্রতি রাম করেন গমন ॥ "
গিয়া কি দেখেন–
" শুয়েছিল তাড়কা সে সুবর্ণের খাটে
ধনুক টঙ্কার শুনি চমকিয়া উঠে ॥ "
কী আশ্চর্য– একেবারে "সুবর্ণের খাটে" ?
এমন খাট কোন্ দীনহীন অসভ্যের ঘরে থাকে ?
কৃত্তিবাসের পরবর্তী বর্ণনা–
" ব্রাহ্মণের চর্ম তার গায়ের কাপড়
চলিতে তাহার বস্ত্র করে খড় মড় ॥
ব্রাহ্মণের মুণ্ড তার কর্ণের কুণ্ডল
ব্রাহ্মণের মুণ্ডমালা গলার উপর ॥ "
এই বর্ণনার যদি কিছু সত্য হয়
তবে দেশপ্রেম কারে কয়
ভাব মহাশয় ।
মাটির সন্তানে যারা বঞ্চিয়া কৌশলে
বাঁধিবারে চায় চিরদাসত্ব শৃঙ্খলে
মানবতায় হত্যা করে জাতপাতের ধর্মীয় আইনে
সেই রাম বিশ্বামিত্র আজও পূজা পায় কেমনে ।
জাতি ভুলি নিজ সন্তানেরে মানুষ করিতে হয়
ব্রাহ্মণবাদে ধ্বংস করি, তাড়কা মায়ের পূজা
যেন ঘরে ঘরে হয় ॥
(সৌজন্যে- Laku Subhankar Barman)
Read More