Saturday 16 April 2022

// // Leave a Comment

গান্ধিজি বাস্তবে কাদের স্বার্থে অনশন করেছিলেন অস্পৃশ্য না উচ্চবর্ণীয়দের জন্য?

 

   


গান্ধিজি বাস্তবে কাদের স্বার্থে অনশন করেছিলেন অস্পৃশ্য না উচ্চবর্ণীয়দের জন্য?

 অস্পৃশ্যদের বিরুদ্ধে যেভাবে গান্ধিজি অনশন করে তাদের অধিকারকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সেটা যাতে অস্পৃশ্যরা বুঝতে না পারে তার জন্য কংগ্রেস গান্ধিজি উল্টো প্রচার শুরু করে যে, এই চুক্তির ফলে অস্পৃশ্যরা বেশি সুবিধা পাবে আর সঙ্গে সঙ্গে বাবসাহেবকে বৃটিশদের এজেন্ট বলেও প্রচার শুরু করে   

     কংগ্রেসীরা অস্পৃশ্যদের কাছে এই কথাটাই সর্বদা প্রচার করে চলেছে যে, গান্ধিজি তাদের মুক্তিদাতা তারা শুধু একথা প্রচার করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তারা অস্পৃশ্যদের একথা বিশ্বাস করাতে চেয়েছে যে, গান্ধিজি হলেন তাদের একমাত্র মুক্তিদাদা এই কথার যখন প্রমাণ চাওয়া হয়েছে তখনই তারা নির্দ্বিধায় বলেছে যে, একমাত্র গান্ধিজিই অস্পৃশ্যদের স্বার্থে আমরণ অনশন করতে চেয়েছেন আর কেউ সেটা করেননি বিন্দুমাত্র বিবেক দংশন না করেই তারা অস্পৃশ্যদের বলছে -পুনাচুক্তির মাধ্যমে অস্পৃশ্যরা যে সুযোগ সুবিধা লাভ করেছে সবটাই গান্ধিজির অবদান এরকম প্রচারের উদাহরণ হিসাবে ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল তারিখে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত অস্পৃশ্যদের একটি সভায় রায়বাহাদুর মেহেরচাঁদ খান্নার বক্তব্যটি তুলে ধরছি-  

     আপনাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু মহাত্মা গান্ধি আপনাদের স্বার্থে পুনাতে অনশন করেছেন- যার ফলে পুনাচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং আপনারা আইনসভায়, স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটাধিকার লাভ করেন আমি জানি আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ . আম্বেদকরকে সমর্থন করছেন, যিনি হলে একজন বৃটিষের এজেন্ট এবং যার উদ্দেশ্য হল বৃটিশ সরকারের হাতকে শক্ত করা- যাতে ভারত ভাগ হয় এবং বৃটিশ শাসন স্থায়ী হয় আমি আপনাদের বৃহত্তম স্বার্থের দিকে তাকিয়ে আপনাদের কাছে আবেদন রাখছি যে, কে আপনাদের প্রকৃত বন্ধু এবং কে স্বঘোষিত নেতা সেটা আপনারা চিনে নিন

     মেহেরচাঁদ খান্নার জবাবে . আম্বেদকর বলেন, “আমি জানি না কতো সংখ্যক অস্পৃশ্য কংগ্রেরসের এই ধরনের মিথ্যা প্রচারের শিকার হবে তবে হিটলারের নাজি বাহিনীর দৃষ্টান্ত থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, কোনো মিথ্যা যদি বৃহৎ আকারে হয় যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজে বোধগম্য নয়  এবং সেটা যদি বার বার সত্য বলে প্রচার করা হয় তাহলে অনেকে সেই মিথ্যা কথাটা সত্য বলে ধরে নিতে পারে তাই আমার পক্ষে গান্ধিজির আসল ভূমিকাটি অস্পৃশ্যদের কাছে তুলে ধরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যাতে তারা মিথ্যা প্রচারের শিকার না হয়  

     গান্ধিজির ভূমিকা সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গেলে এটা আমাদের জানা দরকার কখন  গান্ধিজির প্রথম বোধগম্য হল যে, অস্পৃশ্যতা একটি সামাজিক ব্যাধি সম্পর্কে আমরা তাঁর নিজস্ব বক্তব্যটা শুনি ১৯২১ সালের ১৪ ১৫ এপ্রিল আমেদাবাদে অস্পৃশ্য সমাজের একটা সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে গান্ধিজি সভাপতি হিসাবে বলেনঃ-

    অস্পৃশ্যতা ব্যাপারটা যখন প্রথমে আমার নজরে এল তখন আমার বয়স বড় জোর ১২ বছর উখা নামে একজন জমাদার আমাদের বাড়িতে পায়খানা পরিষ্কার করতে আসত আমি প্রায়ই আমার মাকে জিজ্ঞাসা করতাম তোমরা কেন আমাকে ওকে ছুঁতে বারণ করছ? ওকে ছুঁয়ে দিলে আমার কী ক্ষতি হবে? যদি কখনো আমি উথাকে ছুঁয়ে ফেলতাম তখন আমাকে স্নান করতে হত আমি পিতামাতার অত্যন্ত অনুগত সন্তান ছিলাম তবুও তাদের সঙ্গে এবিষয়ে আমার তর্কাতর্কি হতো আমি মাকে বলতাম যে, উথাকে স্পর্শ করাতে কোনো পাপ হয়েছে বলে মনে করি না

“--- আমরা ভগবান সম্পর্কে বলি তিনি অপবিত্রকে পবিত্র করেন অথচ সেই ভগবানের সৃষ্ট কোনো একটা পরিবারে জন্ম গ্রহণকারীকে কী করে অস্পৃশ্য বলে মনে করতে পারি? তাই আমি অস্পৃশ্যতাকে পাপ বলে মনে করি না তবে আমি একথাও বলব না যে, আমি সেই ১২ বছর বয়সেই অস্পৃশ্যতাকে পাপ বলে মনে করতাম না 

    উপরের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল যে ১২ বছর বয়সে গান্ধিজি অস্পৃশ্যতা সম্পর্কে জানতেন এখন অস্পৃশ্যরা যে কথাটি জানতে চাইছেন সেটা হল, অস্পৃশ্যতা সম্পর্কে জানার পর এই ব্যাধি দূর করার জন্য গান্ধিজি কী করেছিলেন? ক্ষেত্রে ১৯২২ সালে প্রকাশিত গান্ধিজির জীবনী মূলক গ্রন্থইয়ং ইণ্ডিয়া ভূমিকায় মাদ্রাজের প্রকাশকট্যাগোর এণ্ড কোম্পানীযে কথা লিখেছে তার কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরলামঃ- 

    “---গান্ধিজিকাথিওয়াড় হাই স্কুলেশিক্ষা লাভ করেন- পরেলণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়এবং শেষে   ইনার টেম্পলে লণ্ডন থেকে ফিরে বোম্বাই হাইকোর্টের এডভোকেট হিসাবে নাম রেজিস্ট্রি করেন কিছু দিন পরে তিনি আফ্রিকার নাটাল ট্রান্সভালে আইন সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য যান এবং নাটাল সুপ্রিম কোর্টে এডভোকেট হিসাবে নাম রেজিষ্ট্রী করেন সেখানে ১৮৯৪ সালে তিনিনাটাল ইণ্ডিয়া কংগ্রেসগঠন করেন ১৮৯৫ সালে ভারতে আসেন আবার ডারবানে ফিরে যান ফেরার পথে তিনি সেখানে আক্রান্ত হন এবং অল্পের জন্য বেঁচে যান ১৯০১ সালে শরীর ভাল করার জন্য  ভারতে আসেন পরে ফিরে যান ১৯১৪ সালেভারতীয় এ্যাম্বুলেন্স বাহিনী করেন

     উল্লেখিত ঘটনা থেকে বোঝা গেল যে, তিনি ১৮৯৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিদেশে ছিলেন এই দীর্ঘ ২১ বছরের মধ্যে তিনি অস্পৃশ্যদের সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবর রাখেননি ১৯১৫ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন ফিরে এসে তিনি অস্পৃশ্যদের জন্য কিছু করার কী চেষ্টা করেছিলেন? এবিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলোঃ-  

    তিনি ১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে এলেন আমেদাবাদেসত্যাগ্রহ আশ্রমস্থাপন করলেন ১৯১৭ সালে চম্পারণ শ্রমিক আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন ১৯১৮ সালে দুর্ভিক্ষের প্রতিকার এবং আমেদাবাদে শ্রমিক ধর্মঘটের কাজে নামলেন ১৯১৯ সালে রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি খিলাফৎ আন্দোলনে যোগদান করেন ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন ১৯২১ সালের মে মাসে লর্ড রীডিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এই বছর কংগ্রেসের অধিবেশনে কংগ্রেস পার্টির পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯২১ সালে স্বরাজ  লাভের উদ্দেশ্যে কোটি ২৫ লক্ষ তাকারতিলক স্বরাজ ফাণ্ডগঠন করেন  ১৯২২ সালে গণআইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় তিনি মার্চে গ্রেপ্তার হন ১৯২৪ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেলেন ১৯৩০ সালে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন ১৯৩১ সালে লণ্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন ১৯৩২ সালে পুনরায় জেলবন্দী হন ১৯৩৩ সালে মন্দিরে প্রবেশ আন্দোলনের প্রগ্রাম প্রস্তুত করেন এবংহরিজন সেবক সংঘগঠন করেন ১৯৩৪ সালে কংগ্রেস থেকে তিনি  সদস্যপদ ত্যাগ করেন ১৯৪৪ সালেভারত ছাড়োআন্দোলনের পরিকল্পনা করেন ১৯৪৫ সালেকস্তুরবা ফাণ্ডগঠন করেন 

   ১৯২৪ থেকে ১৯৩০ এই বছর তিনি অস্পৃশ্যদের জন্য বা অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য কিছুই করেননি তিনি নিষ্ক্রিয় থাকলেও অস্পৃশ্যরা কিন্তু সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে সাধারণ জলাশয় থেকে জল নেওয়া এবং মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য

     তিনি বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবাসীদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য সত্যাগ্রহ অস্ত্রটিকে বহুবার প্রয়োগ করেছেন হিন্দু বলে কথিত অস্পৃশ্যদের সাধারণ জলাশয়ে বা দেবমন্দিরে প্রবেশের স্বাভাবিক অধিকার লাভের জন্য গোঁড়া বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে তিনি কি একবারও সত্যাগ্রহ অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন? এটা বলা হয় যে গান্ধিজি তাঁর জীবনে ২১ বার অনশন করেছেন রাজনৈতিক কারণে, হিন্দু মুসলমান ঐক্যের কারণে, সরকারের অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে, তাঁর আশ্রমের নানা ব্যাপারে কিন্তু তিনি একবারও কি অস্পৃশ্যতা নিবারণের জন্য এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেছেন? এটা কি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়?

     ১৯৩৩ সালে গান্ধিজি অস্পৃশ্যদের জন্যহরিজন সেবক সঙ্ঘগঠন করেন এর শাখা প্রশাখা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয় এর পিছনে তিনটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয় () অধিকাংশ বর্ণহিন্দুদের মনে অস্পৃশ্যদের কল্যাণের জন্য উদার হস্তে অর্থ সাহায্য করবে () অস্পৃশ্যরা দৈনন্দিন জীবনে যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হয় সেটা দূর করার জন্য বর্ণহিন্দুদের স্বতস্ফূর্ত সহযোগিতা পাওয়া যাবে () এসবের মাধ্যমে বর্ণহিন্দুদের প্রতি অস্পৃশ্যদের বিশ্বাস সৃষ্টি হবে

    দুঃখের বিষয় এই তিনটি উদ্দেশ্যের একটিও বাস্তবে রূপায়িত হয়নি বর্ণহিন্দুরা মাত্র লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে যেখানে রাজনৈতিক কারণে তারা কোটি কোটি টাকা দিয়েছে এখন সঙ্ঘ চলছে সরকারী অনুদানে, গান্ধিজির নিজের লেখা বই বিক্রী করা অর্থে তাঁর কৃপাধন্য হওয়ার জন্য  ধনবান ব্যক্তিদের বদান্যতায় অস্পৃশ্যদের প্রাথমিক প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে সংঘ তার পরিচালনায় কোনো অস্পৃশ্যদের সাহায্য দানের কথা চিন্তা করেছে সঙ্গে কোনো অস্পৃশ্য সদস্যকে গ্রহণ করা হয়নি

     এই সব চিত্র যদি গান্ধিজির অস্পৃশ্যতা-বিরোধী চরিত্রটিকে জনসমক্ষে উদ্ঘাটন করে থাকে তাতে পাঠকদের আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই এখন পাঠকরা হয়তো তাদের ধারণাটিকে স্পষ্ট করার জন্য কয়কটি প্রশ্ন তুলতে পারেনঃ-

   () ১৯২১ সালে গান্ধিজিতিলক স্বরাজ ফাণ্ডেরজন্য কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা তুলেছিলেন তিনি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে, অস্পৃশ্যতা দূর না হওয়া পর্যন্ত স্বরাজ লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই তাহলে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে কেন মাত্র ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হলো?

    () স্বরাজ আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে তা শুরু করার পূর্বে তিনি ৫টি শর্ত দিলেনঃ- () হিন্দু-মুসলমান ঐক্য () অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ () চরকায় সূতা কাটা খাদির ব্যবহার () অহিংস আন্দোলন এবং () সম্পূর্ণ অসহযোগ তিনি শুধুমাত্র এই শর্তগুলো আরোপ করেননি তিনি জানিয়েছেন, এই শর্তগুলো পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত স্বরাজলাভ কোনো মতেই সম্ভব নয় ১৯২২ সালে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য  অনশন করেছিলেন ১৯২৪ সালে চরকায় সূতা না কাটলে তাকে কংগ্রেসের সদস্যপদ দেওয়া হবে না অথচ অস্পৃশ্যতা পালন না করাকে কেন তিনি কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণের শর্ত হিসাবে ঘোষণা করলেন না?

   () গান্ধিজি অনেক কারণে অনেকবার অনশন করেছেন কেন তিনি একবারও অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য অনশন করলেন না?

    () গান্ধিজির নীতি অনুসরণ করে অস্পৃশ্যরা ১৯২৭ সাল থেকে সাধারণ জলাশয়ে মন্দিরে প্রবেশের জন্য বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ শুরু করেন তিনি কেন অস্পৃশ্যদের সত্যাগ্রহের নিন্দা করেছেন?

   () গান্ধিজি যদি অস্পৃশ্যদের প্রকৃত বন্ধু হতেন তাহলে তিনি কেন তাদের রাজনৈতিক রক্ষাকবচের বিরোধিতা করেছিলেন এবং মুসলমানদের সঙ্গে প্যাক্ট করে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক রক্ষাকবচ বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন? কেন তিনি অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক রক্ষাকবচমূলকসাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারারবিরুদ্ধে আমরণ অনশন শুরু করে ছিলেন?

   () পুনাচুক্তির পরে গান্ধিজি কেন তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন না করে অস্পৃশ্যদের রাজনীতিতে  হস্তক্ষেপ করতে থাকেন? কংগ্রেসীরা কেন অস্পৃশ্যদের মধ্যে থেকে এজেন্ট নিযুক্ত করে তাদের মাধ্যমে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকার লুণ্ঠন করেছে?

  এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কী গান্ধিজির চেলারা দেবেন?

    যে ব্যক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহকে জীবনের ব্রত হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন সেই ব্যক্তি যদি হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যাধি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে একবারও সত্যাগ্রহ না করে থাকেন তবে তাঁকে অস্পৃশ্যরা কী করে তাঁকে -কপট বলে মনে করবে?

    এবার দেখা যাক গান্ধিজি তপশিলিদের সম্পর্কে কী ধারনা পোষণ করতেন? তিনি কি তপশিলিদের সংখ্যালঘু হিসাবে স্বীকার করতে চাইতেন? সম্পর্কে তাঁর নিজের ভাষায় উত্তর খোঁজা যাক তিনি বলেন-

     আমি এতক্ষণ দেখাতে চেষ্টা করছি যে ভারতে যথার্থ সংখ্যালঘু বলতে এমন কোনো সম্প্রদায় নেই যাদের স্বার্থ দেশ স্বাধীন হলে ব্যাহত হবে একমাত্র নির্যাতিত শ্রেণি ছাড়া আর কোনো সম্প্রদায় নেই যারা তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম নয়

     এখানে গান্ধিজি স্পষ্টই স্বীকার করেছেন যে, ভারতে তপশিলিরাই একমাত্র সংখ্যালঘু যারা স্বাধীন ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে অক্ষম একথা স্বীকার করা স্বত্ত্বেও তিনি কিন্তু অস্পৃশ্যদের জন্য কোনোপ্রকার রাজনৈতিক রক্ষাকবচ অনুমোদনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন তাহলে কোন যুক্তিতে অস্পৃশ্যরা তাকে সৎ -কপট বলে মনে করবে?

অস্পৃশ্যদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য গান্ধিজির এই অনশন ছিল প্রকৃতপক্ষে একটা জঘণ্য রাজনৈতিক চাল তাঁর এই অনশনের মধ্যে মহত্ব কিছু ছিল না এর মধ্যে অস্পৃশ্যদের স্বার্থরক্ষার বিন্দুমাত্র প্রয়াস ছিল না এটা ছিল অস্পৃশ্যদের স্বার্থবিরোধী, বিশেষ করে অস্পৃশ্যদের সাংবিধানিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর রায়ের বিরুদ্ধে অসহায় জনগণকে পীড়নমূলক তাঁর হীন কৌশল তাহলে অস্পৃশ্যরা কী করে গান্ধিজিকে তাদের হিতাকাঙ্খী বলে মনে করবে?

    পুনাচুক্তি স্বাক্ষতির হওয়ার পর গান্ধিজির ভক্তরা প্রচার করতে থাকে যে, তিনি বিশ্বাস করতেন যে রাজনৈতিক নিরাপত্তার বিধান অস্পৃশ্যদের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক এই জন্য তিনি মুসলমানদের সঙ্গে এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং আমরণ অনশণ করেছিলেন সূক্ষ্ম বিচার করলে দেখা যাবে যে, ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারাপুনাচুক্তির মধ্যে পার্থক্য অতি সামান্য পুনাচুক্তিতেও অস্পৃশদের পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যদি তিনি সৎ -কপট হতেন তবে পুনাচুক্তির কৌশলকে অবলম্বন করে তিনি কি আত্মরক্ষার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তে পারতেন?

    অস্পৃশ্যরা কি গান্ধিজিকে তাদের বন্ধু বা সহযোগী হিসাবে গণ্য করতে পারে? কখনো নয় কী করে পারবে? হতে পারে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, অস্পৃশ্যদের সমস্যা সামাজিক সমস্যা যিনি মনে করেন জাতব্যবস্থা ভালো অস্পৃশ্যতা খারাপ, সেই গান্ধিজিকে তারা কি করে তাদের বন্ধু বলে স্বীকার করতে পারে? অস্পৃশ্যতা হলো জাতব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি জাতব্যবস্থার বিলোপ না করে কি অস্পৃশ্যতা দূর করা কখনো সম্ভব?

   হতে পারে গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন যে, অস্পৃশ্যদের সমস্যা সামাজিকভাবে সমাধান করা যেতে পারে এটা যে কেউ চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে, সামাজিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে  পুরোপুরি করা না গেলেও সমস্যার সমাধানে তা যথেষ্ট পরিমাণে সহায়ক অথচ গান্ধিজি ছিলেন অস্পৃশ্যদের কোনোপ্রকার রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের ঘোর বিরোধী তাহলে কি করে অস্পৃশ্যরা তাঁকে তাদের বন্ধু হিসবে গণ্য করতে পারে?   

    তিনি যদি অস্পৃশ্যদের বন্ধু হতেন তবে তিনি তাদের রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য নিজেই সংগ্রামে নামতেন কিন্তু আমরা কি দেখলাম? তিনি অস্পৃশ্যদের অধিকারের বিরুদ্ধে অনশন করছেন  

    অবশেষে একথা কি বলা যেতে পারে যে, অস্পৃশ্যরা তাদের যে মানবিক অধিকারগুলো থেকে হাজার হাজার বছর বঞ্চিত রয়েছে গান্ধিজি তার কতটা অর্জন করে দিতে পেরেছেন? না কি . আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের জন্য যে রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করেছিলেন অস্পৃতা মোচনের জন্য, সেটাকে গান্ধিজি শুধু ছিনিয়ে নিলেন না; আরো হাজার বছরের জন্য তাদের পিছনে ঠেলে দিয়ে  তাদের গোলামিকে দীর্ঘস্থায়ী করে দিলেন? 

 

  

 

 

 

 

Read More