ভারতের প্রাচীন
ভাষা কোনটি সংস্কৃত না পালি? ইতিহাস কী বলে?
লেখক- ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ
সিংহ (বই- ইতিহাস কী মুআয়না-হিন্দি)
অনুবাদক- জগদীশচন্দ্র
রায়। (বই-ইতিহাসের পর্যালোচনা)
ভাষার ইতিহাস
১৬
ভাষার আচার্যরা সংস্কৃতকে পালির সাথে, পালিকে প্রাকৃতের সাথে এবং প্রাকৃতকে
অপভ্রংশের সাথে যুক্ত করেছেন।
এবার বলুন, পালিতে সংস্কৃতের কোনো ততসম শব্দ আছে
কি? নেই।
এবার বলুন, অপভ্রংশে সংস্কৃতের কোনো ততসম শব্দ
আছে কি? নেই।
আর্য ভাষার ১৫০০ বছরের
ইতিহাসে
পালি, প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ সংস্কৃতের ততসম শব্দে
সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। যদিও আধুনিক আর্য ভাষাতে সংস্কৃতের ততসম শব্দ প্রচুর
পরিণামে পাওয়া যায়।
যদি আপনার ভাষার ইতিহাস সঠিক
হয়, তবে
সংস্কৃত শব্দগুলি বেশিরভাগ পালিতে, তার থেকে কম প্রাকৃতে, তার থেকে কম
অপভ্রংশে এবং সব থেকে কম
আধুনিক ভাষায় হওয়া উচিত ছিল।
আপনাদের এটা
উল্টো মনে হচ্ছে না কি?
২৩
সংস্কৃতের পন্ডিতরা ঘোমটাকে আবেষ্টনীর
সঙ্গে, নথকে নস্ত-এরর সঙ্গে, ঢাকনাকে স্থগ-এর সঙ্গে, ছেকনিকে ক্ষরণ-এর সঙ্গে এবং যাঁতাকে যন্ত্রকের
সঙ্গে যুক্ত করে সংস্কৃত শব্দ বানিয়েছেন।
আপনি যদি সহজ থেকে জটিল করার কৌশল শিখতে চান, তাহলে সংস্কৃতের মাস্টারদের
কাছ থেকে শিখুন।
প্রকৃতপক্ষে ওড়ার জন্য ওড়না, নথের জন্য নাক, ঢাকার জন্য
ঢাকনা, ছাঁকার জন্য ছাঁকনি এবং যান্তনের (পেষার) জন্য যাঁতা।
ভাই এই সব সহজ ব্যাপার। কোনো জটিলতা নেই। এর জন্য সংস্কৃতের জঙ্গলে বেশি দূর ঘোরাঘুরি করার দরকার নেই।
২৪
ধরুন, মানুষ বানর থেকে বিবর্তিত হয়েছে, তাহলে বানরের অধিকাংশ গুণ প্রাচীন
মানুষের মধ্যে পাওয়া যাবে এবং আধুনিক মানুষের মধ্যে কম পাওয়া যাবে।
একইভাবে, ধরুন সংস্কৃত থেকে আধুনিক হিন্দির বিকাশ হয়েছে, তাহলে সংস্কৃতের বেশিরভাগ গুণ প্রাচীন ভাষায় পাওয়া যাবে
এবং আধুনিক ভাষায় কম পাওয়া যাবে।
কিন্তু এটাতো
উল্টো। প্রাচীন ভাষা পালি-প্রাকৃতে
সংস্কৃতের গুণগত মান বা শব্দাবলিই নেই, এটা
আধুনিক হিন্দিতেই বেশি।
সিদ্ধান্তে এটা বেরিয়ে আসে যে, পালির - প্রাকৃতের বিকাশ সংস্কৃত থেকে হয়নি।
২৫
সংস্কৃতকে
ভারতে দেবভাষা বা দেবতাদের বলা হয়। কিন্তু
বিখ্যাত ফার্সি গ্রন্থ “শাহনামা”-তে (১০১০ খ্রি.) ফেরদৌসি বলেছিলেন যে দেবতা কাদের বলা হয়?
শাহনামাতে দেব/দেবতা নামে একটি উপজাতির (উপজাতি)
বর্ণনা করা হয়েছে।
দেব নামের এই উপজাতি ঘোড়ায় চড়ত, যোদ্ধা ছিল এবং
মেয়েদের অপহরণ করত।
তুলসী রাম লিখেছেন যে দেব নামের এই উপজাতি ইরান থেকে ভারতে
এসেছিল।
আজও ফার্সি ভাষায় দেব মানে রাক্ষস, লম্বা মানুষ এবং নরখাদক হিসাবে মনে করা হয়।
২৬
পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষেত্রের বিকাশ
হচ্ছে। ভাষার ক্ষেত্রেও বিকাশ হচ্ছে।
তাহলে ভারতে সংস্কৃত যুগের পর অপভাষার (অপভ্রংশ) যুগ অর্থাৎ পতন হওয়া
ভাষার যুগ কীভাবে এলো?
এটাতো কলিযুগের মতো কথা হলো। কলিযুগের কথা এটাই তো এটাই তো যে, শুভ যুগের পরে খারাপ যুগ এসেছে।
২৭
ভারতে আর্যদের আগমন যদি
সকলের পরে হয়ে থাকে, তাহলে আর্যভাষা ‘সংস্কৃত’, ভারতের প্রাচীনতম ভাষা কীভাবে হবে?
ভাষাবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায়ে লেখা আছে যে,
ভাষাবিজ্ঞানের অধীনে শুধুমাত্র মানুষের ভাষাই অধ্যয়ন করা হয়।
সংস্কৃত যদি দেবতাদের বাণী হয়, দেবতাদের ভাষা হয়, তাহলে তা মানুষের ভাষাকে ভাষা হিসেবে
গণ্য হবে না।
তাহলে সংস্কৃতকে ভাষাবিজ্ঞান
থেকে বের করতে হবে এবং ভাষাবিজ্ঞান থেকে সংস্কৃত ভাষাকে পড়ানো বন্ধ করতে হবে।
২৯
গুজরাটি ভাষা গুজরাটের। বাংলা ভাষা বাংলার। ওড়িয়া
ভাষা ওড়িশার। তামিল ভাষা তামিলনাডুর। সংস্কৃত ভাষা কোথাকার? সংস্কৃতের ভূগোল আপনি কোথাও
খুঁজে পাবেন না।
৩০
ধরে নিলাম
যে সংস্কৃত ভারতের গৌরবোজ্জ্বল এবং জনপ্রিয় ভাষা।
তাহলে সংস্কৃতে কেন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় না?
টিভির লোকেরা কেন সংস্কৃতে সিরিয়াল করে না?
ভারতে সংস্কৃত ভাষায় কেন সিনেমা তৈরি হয় না?
গ্রামে-গ্রামে কেন সংস্কৃত ছবির গান বাজানো হয় না?
ভাই! যেকোনো পুঁজির বিনিয়োগ করা
হয় শুধুমাত্র জনগণের চাহিদা অনুযায়ী। সংস্কৃত পণ্যের জন্য পুঁজিকে ডুবাবে?
৩১
পুরাণ-এর অর্থ
হচ্ছে অনেক পুরানো, একদম প্রাচীন কালের, জীর্ণশীর্ণ! এর নাম
নিজেই প্রমাণ করে যে পুরাণগুলি খুব পুরানো নয়।
যে সময়ে পুরাণ লেখা হবে, তখনতো পুরাণ নতুন হবে। কিন্তু লেখক চতুরতার সাথে এর নাম দিয়েছেন পুরাণ, যাতে মানুষ ভ্রান্তিতে এটিকে অনেক পুরনো বলে বুঝে নেয়।
নতুনকে পুরোনো বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্যই এই গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছে
পুরাণ।
৩২
হিন্দির ‘বারহ’
(বারো) শব্দটি মূলত আদিবাসী শব্দ।
সংস্কৃতের দ্বাদশ থেকে ‘বারহ’
(বারো) তৈরি হবে না।
বা/বার হচ্ছে মুন্ডা ভাষার ডি এন এ। বা/ বার-এর অর্থ হয়- দুই। এই বা/বার থেকে তৈরি হয়েছে
– বারহ (বারো)। তাই মুন্ডা ভাষার ডিএনএ হচ্ছে -বা/বার। এই জন্য তার
সব ভাষায় বা/বার-এর দুটি অর্থ হয়। আর্য
ভাষায় শুধুমাত্র সিন্ধি এবং গুজরাটি দুটির জন্য বি/বে আছে। তাই
আর্য ভাষার কোনো ডিএনএ নেই,
এমনকি দ্রাবিড় ভাষারও নেই এবং কিরাত ভাষারও নেই।
বারহ (বারো)শব্দটি সংস্কৃতের নয়, মুন্ডা ভাষার।
৩৩
কুর্মিকে, কোয়রীকে আর্য ভাষা সংস্কৃতে কী বলা হতো? বলুন? নিরব কেন? এটা ফালতু কথা যে এরা আর্য ছিল। যদি আর্যরা থাকত, তাহলে কি আর্য ভাষায় তাদের নাম থাকত না?
৩৪
আগে বুদ্ধের অনুসারীকে বুদ্ধু বলা হত। কিন্তু পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বুদ্ধর অর্থ পাল্টে বোকা বা বেকুফ বানিয়েছে। একইভাবে অশোকও বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন। তাই দেবনাম্পিয়-এর অর্থকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বোকা
বা বেকুফ করে দিয়েছে (স্ট্যান্ডার্ড হিন্দি অভিধান)। প্রকৃতপক্ষে পালি ভাষায় দেব মানে বুদ্ধ। (পালি-হিন্দি
অভিধান)। তাই দেবানম্পিয়-এর অর্থ বুদ্ধের
প্রিয় রাজা (অশোক) হয়েছিলেন। এখন আপনি যদি বুদ্ধের প্রিয় রাজা
(অশোক) অর্থ ধরে নিয়ে আবার শিলালিপি পড়ুন, বিশেষ করে প্রথম ছোট শিলালিপি বা রুম্মিনদেই শিলালিপি, তাহলে এটা পরিষ্কার হবে যে দেবানম্পিয়
মানে দেবতাদের প্রিয় নয়, বুদ্ধের প্রিয় হবে।
0 comments:
Post a Comment