Sunday 13 July 2014

// // Leave a Comment

বিষয়: হিন্দু (HINDU ) জগদীশ রায়

                   


     
বিষয়: হিন্দু (HINDU)

লেখক-জগদীশচন্দ্র রায়   

    বর্তমান ভারত বর্ষের সব থেকে বড় ধর্ম হচ্ছে হিন্দুধর্ম এদেশের বেশিরভাগ জনগণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাঁরা তাঁদের ধর্মকে বিশ্বাস করে আবার অনেকে নিজেকে হিন্দুবলে গর্ববোধও করেন যেটা স্বাভাবিক।      

     এখানে এই আলোচনায় কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত করার উদ্দেশে নয় আর আঘাত লাগলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ, কখনও কখনও বিশ্বাসে আঘাত লাগাটাও স্বাভাবিক হয়, যখন সেটাকে যুক্তিতর্ক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা না করা হয় অথবা সুদীর্ঘ দিনের বিশ্বাসকে এক ঝট্‌কায় ছুঁড়ে ফেলা অতসহজ নয়তবুও বিশ্বাসের পাথরকে মূ্র্তিতে রূপান্তরিত করতে হলে যুক্তি-তর্ক-তথ্য ও বিশ্লেষণের ছেনি ও হাতুড়ি দিয়ে সতর্ক ভাবে কাটার চেষ্টা করলে মূ্র্তিতে রূপান্তরিত হবে।

     আমি কেবলমাত্র সেই বিশ্বাসের পাথরকে মূ্র্তিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছি মূ্র্তি হবে কি না সেটা জানি না, সেটা পাঠকরা বলতে পারবেন আমি আবার বলছি কারো ব্যক্তিগত  বিশ্বাসে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয় উদ্দেশ্য, সঠিক তথ্যকে আপনাদের সামনে তুলে ধরা

(১) হিন্দু শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ:

প্রথমেই আমরা চেষ্টা করি হিন্দু শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ সম্পর্কে জানতে হিন্দু শব্দটি হচ্ছে পার্শি শব্দ যার অর্থ হীন্ বা নীচতা। উর্দু অভিধানে ‘হিন্দু’ অর্থ চোর, ডাকাত, ম্লেচ্ছ, ভৃত্য, দাস ইতিয়াদি উল্লেখিত আছে। হিন্দুশব্দটি বৈদিক  কোন ধর্ম গ্রন্থে নেই। সংস্কৃতের কোনো মৌলিক গ্রন্থ, যথা- শ্রুতি,পুরাণ, বেদ,গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদিতে ‘হিন্দু’ শব্দটি নেই।  

() ভারতীয়দের কেন হিন্দু নাম দেওয়া হল?

     ভারতবর্ষে ৭ম শতাব্দি থেকে ১২ম শতাব্দি পর্যন্ত বিশেষ করে বিদেশি মুসলমানদের আক্রমন হয় আক্রমনকারী মুঘলরা ভারতবর্ষ জয় করার পর এদেশে তাদের রাজত্ব স্থাপিত হয় এদেশে শাসন কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে তারা দুটো প্রধান সমস্যার সম্মুখীন হয়

    প্রথমত,-তারা ভাবল, ‘আমরা বিজেতা, আমরা এখানের লোকদের পরাজিত করেছি, সুতরাং পরাজিতদের সঙ্গে আমাদের রক্ত ও সংস্কৃতি যেন মিশে না যায় কারণ, যারা পরাজিত হয় তারা হীন্‌ হয় তাদের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি ও রক্ত মিশে যাওয়া উচিত নয় এটা হল মিশ্রণের সমস্যা

     দ্বিতীয়ত, এই পরাজিতদের পৃথক রাখার জন্য তাদের নতুন পরিচয় দেওয়া এটা স্বভাবিক যে পরাজিতদের কেউ ভাল নাম দেবে না তাই আক্রমনকারী মুঘলরা এদেশের জনগনকে হিন্দু’ (পরাজিত, হীন্, নীচ্) নাম দিল যেমন-বৈদিকবাদীরা ভারতের মূলনিবাসীদের নাম দিয়েছে-দাস, দস্যু, দানব, রাক্ষস ইত্যাদিপরবর্তিতে এরা SC, ST, OBC দের ENCOUNTER করার জন্য নাম দিল হরিজন, গিরিজন, বনবাসি ও দলিত

     এবিষয়ে বাবা সাহেব Dr. B.R AMBEDKAR, ANNIHILETION OF CASTE এ বলেছেন-

সর্ব প্রথম এই চরম সত্যকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, হিন্দু সমাজ একটি পৌরাণিক কাহিনি হিন্দু নামটা একটা বিদেশি নাম হিন্দুনাম (আক্রমনকারী) মুসলমানদের দেওয়া নাম স্থানীয় অধিবাসী এবং মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্র বোঝানোর জন্য তারা স্থানীয় অধিবাসীদের হিন্দুনামে অভিহিত করেছিল ভারতে মুসলমানদের আক্রমনের পূর্বেকার সময়ে সংস্কৃত ভাষার লেখকদের নেশন’ (জাতি) সম্বন্ধে কোন ধারনা ছিলনা তারা ভারতীয় অধিবাসীদের একটি সাধারণ নামকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি তাই হিন্দু সমাজের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই এটা শুধু জাতিগুলির একটি সমষ্টিগত নাম

     ‘The first and foremost thing that must be recognized is that Hindu Society is a myth. The name Hindu is itself a foreign name. It was given by the Mohammedans to the natives for the purpose of distinguishing themselves. It does not occur in any Sanskrit work prior to the Mohammedan invasion. They did not feel the necessity of a common name because they had no conception of their having constituted a community. Hindu society as such does not exist. It is only a collection of castes.’

(৩) বৈদিকবাদীরা নিজেদের হিন্দু বলে স্বীকার করেনি কেন?

     ঐ সময়ের বৈদিকবাদীরা নিজেদের হিন্দু বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে তারা বলল, যদি তোমরা পরাজিতদের হিন্দুঅভিহিত কর তাহলে আমরা হিন্দুনই যেভাবে তোমরা আক্রমণকারী এবং বিজেতা ঠিক একইভাবে আমরাও আক্রমণকারী এবং আক্রমণ করে আমরাও এখানকার লোকদের পরাজিত করেছিলাম এর প্রমান হচ্ছে মুসলমান শাসকরা যখন জিজিয়া কর অর্থাৎ ধর্ম কর (RELIGIOUS TAX) চালু করেছিল সেটাতে বৈদিকবাদীদের ছাড় (EXEMPTION) ছিলবৈদিকবাদীদের এই যে ছাড় ছিল যা প্রমাণ করে যে, তারা নিজেদের হিন্দু বলে মেনে নিতে স্বীকার করত না

     বর্ণাশ্রমে বেষ্টিত ভারতীয়দের হিন্দু বলে প্রমাণিত করার রাস্তাটা প্রসারিত হতে শুরু করে ১৯২১ সাল নাগাদ প্রকৃত পক্ষে বৈদিকবাদীরা এখনও নিজেদের হিন্দু মনে করেনা এর কারণ পরে বলছি১৯১৫ সালে তারা নাসিকে হিন্দু মহাসভাএর স্থাপন করে কিন্তু কেন? সে ইতিহাস ধাপে ধাপে প্রকাশ করছি তার আগে আমরা দেখছি রাজা রামমোহন রায় ২০ আগষ্ট ১৮২৮ সালে ব্রাহ্ম সমাজস্থাপন করেনদয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ সালে আর্য সমাজস্থাপন করেন এই আর্য সমাজস্থাপনের পিছনেও একটা ষড়যন্ত্র আছে কে এই দয়ানন্দ সরস্বতী? যিনি গুজরাটি ব্রাহ্মণ তিনি রাজকোট জেলার টংকারা নামক জায়গা থেকে বোম্বে (মুম্বাই) আসেন বোম্বেতে কেন? কারণ, ১৮৭৩সালে মহারাষ্ট্রে মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে সত্যশোধক সমাজ স্থাপণ করেনসত্যশোধকঅর্থাৎ সত্য কলুষিত হয়ে গিয়েছিল বৈদিকবাদীদের ষড়যন্ত্রে, তাই তাকে শোধন করা দরকার পড়ে কিন্তু চক্রান্তকারীর ষড়যন্ত্রের অভাব হয় না তাই সত্যশোধককে ENCOUNTER কারার জন্য এই আর্য সমাজ’-এর স্থাপন

     এখানে একটা জিনিস আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কেউই হিন্দু সমাজ স্থাপন করেননি অর্থাৎ ১৯২১সালের পূর্ব পর্যন্ত ব্রাহ্মণ বা আর্য নামেরই সংগঠণ নির্মাণ হয়েছে তাঁরা হিন্দু নামের কোন সংগঠণের নির্মাণ করেনি।(ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে পারে)। অর্থাৎ হিন্দু নামকে স্বীকার করেনি

 

     () বৈদিকবাদীরা কখন ও কেন হিন্দু বলে মেনে নিল বা হিন্দু বলে প্রচার শুরু করল?

     ইংলন্ডে ১৯১৭-১৮সাল নাগাদ প্রাপ্ত বয়ষ্কের ভোটাধিকারের আন্দোলন শুরু হয় কারণ ইংলণ্ডেও সকল প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ভোটাধীকার ছিল না ওখানে যারা ট্যাস্ক দিত এবং যারা লেখাপড়া শেখা লোক ছিল তাদেরই ভোটাধীকার ছিলআন্দোলন ইংলণ্ডে শুরু হয় আর বিপদের ঘন্টা ভারতের বর্ণবাদীরা শুনতে পায় কেন? কারণ, ঐসময় ভারত ছিল ব্রিটিশদের অধীন ভারেতর   বৈদিকবাদীরা মনে করল যে, ইংলণ্ডে যদি প্রাপ্ত বয়ষ্কের ভোটাধীকার চালু হয়ে যায়, তাহলে তো সেটা ভারতেও লাগু হবে কারণ, ব্রিটেনে যে আইন পাশ হবে ভারতেও সেটা যেকোনো সময় লাগু হতে পারেআর ভারতে যদি প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ভোটাধিকার আইন লাগু হয়, তাহলে ভারতে যে শুদ্র (OBC) ও অতিশুদ্ররা (SC & ST) আছে এদের সংখ্যা অনেক গুণ বেশি হওয়ায় ভোটাধিকার হিসাবে নির্বাচন হলে যাদের সংখ্যা বেশি রাজ ক্ষমতা তাদেরই হবেবৈদিকবাদীরা তাদের বর্ণের  হিসাবে ভোট চাইলে সব বর্ণবাদী যদি এক জনকে ভোট দেয় সেটা 3.5% থেকে ৭%-ই হবে ফলে তারা কোন নির্বাচন ক্ষেত্রেই জিততে পারবেনা এর ফলে তাদের যে হাজারো বছর ধরে  শাসনপ্রনালী চলে আসছিল সেটার সমূহ বিপদ ঘনিয়ে আসবে কিন্তু হিন্দু নামের সংগঠন হলে নেতা ব্রাহ্মণই হবে, আর সমস্ত ‍SC,ST, OBC -দেরকে নিজেদের CONTROL -এ রাখতে পারবে এই ভাবনা থেকে তারা ১৯১৫ সালে নাসিকে হিন্দু মহাসভাএর স্থাপন করে আর ১৯২৫ সালে R.S.S. অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-এর স্থাপন করে এই হিন্দু শব্দ হচ্ছে বর্ণবাদীদের একটা রণকৌশলের মাধ্যমতাই তারা প্রচার করছে গর্ব করে বল আমি হিন্দু’

     () ব্রাহ্মণরা সত্যি সত্যি কি নিজেদের হিন্দু বলে মনে করে?

     এবার ভাবুন ব্রাহ্মণরা সত্যি সত্যি কি নিজেদের হিন্দু বলে মনে করে? যদি করে তবে তারা ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতির মেয়েকে কেন বিয়ে করেনা? ব্যতিক্রম ২/১ টা ধরার মধ্যে নয়, তার পিছনেও গভীর ষড়যন্ত্র থাকা অসম্ভব নয় কিন্তু কখনও তাদের মেয়েকে অন্য জাতের ছেলের সঙ্গে যখন বিবাহ দেয়, সেটাও রণকৌশল হিসাবে কারণ, অন্য জাতের ছেলেটি যদি মেধাবী হয় তাহলে সে যাতে তার সমাজ নিয়ে না ভাবে- তাকে তাদের গোলাম বানিয়ে রাখার জন্য তুলে নেয়ব্রাহ্মণরা  শুধু ‍SC,ST, OBC-দের সামনে এসে বলে যে তারাও হিন্দু কিন্তু লোক গণনায়ও তারা নিজেদের ধর্ম ও জাত দুটোই ব্রাহ্মণ বলে লেখায় বেশির ভাগ

 

     বর্ণবাদীদের অনুসারে হিন্দুশব্দের ব্যাখ্যা কি?

 

     বর্ণবাদীরা প্রচার করছে গর্ব করে বল আমি হিন্দু এই ভাবে বহুজনদের কাছে এসে শ্লোগান দেয় কারণ এটা ওদের কথা ওদের মনে আশঙ্কা শুরু হয়েছে যদি কেউ জানতে চায় যে, কীসের ভিত্তে গর্ব করা হবে? ‘হিন্দুনাম তো আক্রমনকারী মুসলমানদের দেওয়া? তাই তারা প্রচার করছে ইতিহাসের পাতায় পাতায় যে, সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়েছে কীভাবে? মুসলমানরা ফার্সি ভাষায় কথা বলত ফারসিতে ’ ‘এর মত উচ্চারিত হয় বা তারা কে বলত, তাই সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়েছে কিন্তু এদের কথা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও, সেটাতো মুসলমানদের দেওয়া নাম তা নিয়ে হিন্দুদের গর্ব করা কী করে সম্ভব? কারণ হিন্দুত্ববাদীরাতো সব সময় মুসলমানদের বিরোধিতা করছে

     যদি সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকে তবে সেটা শুধু সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিল সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের লোকদের ক্ষেত্রে হিন্দু নামাঙ্কণ হওয়ার দরকার পড়ে নাসম্পূর্ণ ভারতবর্ষের লোকদের ক্ষেত্রে হিন্দু নামে চিহ্নিত হওয়ার আসল কারণ হচ্ছে- সারা ভারতে (আক্রমনকারী) মুসলমানদের শাসন কায়েম ছিল তাই হিন্দু শব্দের প্রসার সারা ভারতব্যাপী হয়েছিল আর একটা কথা সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকলে শুধুমাত্র সিন্ধু অঞ্চলে এই নাম সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিলএতে প্রমা হয় সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়নি আরও একটা কথা কে যদি বলত তাহলেদিয়ে আরও যে সব শব্দ আছে সেগুলোরও পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল কিন্তু সেটা তো হয়নিযেমন মুসলমান উচ্চারণ ‘মুহলমান’ হয়নি পার্সি ‘পার্হি’ শিয়া ‘হিয়া’ সুন্নি ‘হুন্নি’ বা সুলেমান ‘হুলেমান’ হয়নি।

     যদি সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকে তাহলে হিন্দুধর্ম অনুসারে গঙ্গানদীর পরিবর্তে সিন্ধু নদীকে পবিত্র হিসাবে মানা উচিত ছিল কিন্তু সেটা মানা হয় না অতএব সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়েছে একথাটি মিথ্যা* (এ বিষয়ে নতুন তথ্য হাতে এসেছে দেখুন Subject- সিন্ধু থেকে হিন্দু না হিন্দু থেকে সিন্ধু?https://roymulnivasi.blogspot.com/2022/04/blog-post_16.html)

() মুসলমানরা কি তলোয়ারের জোরে হিন্দুদের মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে ছিল? যদি করে থাকে তখন বর্ণবাদীরা কি করছিল?

     ইতিহাস অনুসারে আমরা জানতে পারি যে, ৩য় শতাব্দীর পর বর্ণব্যবস্থা জাতিব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে জাতিব্যবস্থার সঙ্গে বৈদিকবাদীরা অস্পৃশ্যতার সৃষ্টি ও প্রয়োগ করে তাদের কট্টর বিরেধীদের তারা অস্পৃশ্য ঘোষণ করল ৭ম শতাব্দীতে আমরা ইসলামের অনুগামী সুফি-সন্তদের কেরালা অঞ্চলের আশে পাশে দেখতে পাই এই সময় কেরালায় প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় ইসলাম কেরালার মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভারতে আসে সুফি-সন্তদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ভারতে শুরু হয়েছিল পরবর্তীকালে ইসলামের অনুগামীরা রাজত্ব করার মানসে ভারতে আসতে থাকে তারা এদেশের মানুষদের যুদ্ধে পরাজিত করে

ভারতের বৈদিকবাদীরা বলেছে যে, মুসলমানরা তরবারির শক্তিতে ভারতীয়দের ইসলাম ধর্মে পরিবর্তিত করেছেএটা কতটা সঠিক? না কি তারা নিজেদের অক্ষমতাকে লুকিয়ে রাখার জন্য এই চালাকি করছে? আমরা এটা জেনেছি যে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম দেশের সাধারণ জনগণকে নীচ্ মনে করততারা শিক্ষা, সম্পত্বি ও অস্ত্রের অধিকার হরণ করেছিল এবং এদেশের মূলনিবাসীদেরকে অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করেছিল তাদের সঙ্গে পাশবিক অত্যাচার করত এই সব পাশবিক অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লোকেরা ধর্মান্তর করে ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেছিল তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে মুসলমানরা তরবারির জোরে এদেশের জনগণকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে যে, তখন বৈদিকবাদীরা কী করছিল? তারা তাদের ধর্ম রক্ষা করার জন্য কোনো সংগ্রাম বা আত্মত্যাগ বা আত্মবলিদান করেছিল কি? যদি করে থাকে তাহলে দুচারজন তো হীদ হয়ে থাকবে? কিন্তু তার কোনো নাম গন্ধ আজ পর্যন্ত কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি খুঁজে পওয়া যাবে কী করে, থাকলে তবে তো? যদিও গীতায় তারা লিখে রেখেছে-‘ধর্ম রক্ষোতি রক্ষম অর্থাৎ তুমি ধর্মকে রক্ষা কর, ধর্ম ‍তোমাকে রক্ষা করবেসুতরাং জীবন দিয়ে বৈদিকবাদীদেরকে ধর্ম পরিবর্তন রোখা উচিৎ ছিল এবং তার জন্য আত্মবলি দেওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু ভারতের ইতিহাসে ধর্ম পরিবর্তন রোখার জন্য বৈদিকবাদীরা কোনো প্রকার আত্মত্যাগ করেছে এরকম কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না

     ‘এ বিষয়ে, স্বামী বিবেকানন্দ আরো স্পষ্ট এবং তীক্ষ্ম ভাষায় দরিদ্র এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদিগের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মূলগত কারণ সম্বন্ধে বলেছেনঃ ভারতবর্ষে দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশি কেন? এ কথা বলা মুর্খতা যে, তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহনে বাধ্য করা হইয়াছিল। বস্তুত জমিদার ও পুরোহিত বর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল।’

 (তথ্যঃ জাতি-ধর্ম ও সমাজ বিবর্তন – যতীন বাগ্‌চী পৃ. ৩২)

     আশ্চর্য জনক কথা হচ্ছে যে, যাদের উপর তরবারির জোরে ধর্ম পরিবর্তন করার আরোপ লাগানো হয়েছে, তাদের প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ব্রাহ্মণদের হাতেঔরঙ্গজেবের উপদেষ্টা ছিল শ্রীধর কুলকার্ণী নামক ব্রাহ্মণউল্টা বৈদিকবাদীরা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজার বদনাম করে বলেছে, তিনি হিন্দবীঅর্থাৎ হিন্দু স্বরাজ স্থাপন করেছিলেন তিনি না থাকলে সকলের ছুন্নত করেদিত মুসলমানরাকিন্তু ইতিহাস বলছে তিনি বিশেষ কোনো ধর্মের জন্য পক্ষপাতিত্ব কখনও করেননিকারণ, তাঁর প্রশাসনে তাঁর পরামর্শদাতা ছিলেন কাজী হায়দর নামের একজন মুসলমানতাঁর সেনাবাহিনীতে ৩০% মুসলমান সেনা ছিল বাংলায় নবাব হুসেন শাহ্-এর সময়ে ধর্মান্তর ঘটেছেকিন্তু তখন তার মন্ত্রী ছিলেন সুবুদ্ধি রায় নামের ব্রাহ্মণজানিনা তিনি কি সুবুদ্ধি দিতেন। তবে একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, অবিভক্ত ভারতের %মুসলমান SC, ST এবং OBC থেকে ধর্মান্তরিত।

     () ভারত বা INDIA কে হিন্দুস্থান বলে প্রচার করা হয় কেন?

     ভারতবর্ষ বহু ধর্মীয় ও বহু ভাষাভাষীর দেশভারত, সংবিধান অনুসারে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশকিন্তু সেই ভারতের দুটো নাম (ভারত ও INDIA) থাকা সত্বেও এদেশের নামটা প্রচার করা হয় হিন্দুস্থানবলে হিন্দুদের স্থান হিন্দুস্থান তাহলে সংবিধান অনুসারে দেশটা ধর্ম নিরপেক্ষ থাকল কি করে? শুধু মাত্র সরকারীভাবে ভারত বা INDIA বলা বা লেখা হয় কিন্তু প্রচার মাধ্যম এবং তথাকথিত দেশপ্রেমী নেতারা হিন্দুস্থান বলেই প্রচার করেন যে রাজনৈতিক পার্টির নাম ভারতীয়দিয়ে শুরু তাঁরা কিন্তু সব সময় হিন্দুস্থানই বলেন আর আমজনতার কথা কি বলব তাদের নিজেদের মাথাটাকে তো প্রচার মাধ্যম CAPTURE করে নিয়েছে প্রচার মাধ্যম যেটা ২৪ ঘন্টা প্রচার করছে, জনতার মুখেও সেই কথা বেরিয়ে আসছে তাইতো দেখি মুসলমানরাও এদেশটাকে হিন্দুস্থান বলে চলেছেন তাই তো একজন বলেছিলেন যে, এদেশটাকে তো মুসলমানরাও হিন্দুস্থান বানিয়ে দিচ্ছেINDIRECTLY বৈদিকবাদীদের উদ্দেশ্যকে সফল করছে

     আসলে এসব কিছুর পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে যেটা বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর বুঝতে পেরেছিলেন তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে এরা একদিন INDIA বা ভারতের অর্থকে হিন্দুস্থানে পরিবর্তনকরবে তাই তিনি PRIAMBALE OF THE CONSTITUTION এ সেই অর্থটা পরিস্কার করে দিয়ে লিখেছেন INDIA THAT IS BHARAT.

     তবে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের হিন্দুস্থান করার প্রক্রিয়া নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে আর সেই প্রক্রিয়াকে জেনে না বুঝে সাধারণ জনগণ ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা সাথ দিচ্ছে এটা খুবই গভীর ভাবনার বিষয়তাই আপনাদের জানতে ও বুঝতে হবে যে আপনারা যেটা বলছেন বা করছেন সে বিষয়ে আপনার বিচার-ধারা কতটা আছে স্রোতের অনুকুলে চললে আপনি নিজেও একদিন না বুঝে ভেসে যেতে পারেন আর যেদিন বুঝতে পেরে পিছন দিকে তাকাবেন তখন দেখবেন প্রতিকূলে ফিরে যাওয়ার আর কোন অবকাশ নেই

     কেউ কেউ বলেন- না, আমরা তো ভালবেসেই দেশটার নাম হিন্দুস্থান বলছি ভালবাসার এই অযৌক্তিক কথা শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়মানুষ কোন গড্ডালিকার প্রবাহে ভেসে চলেছে! কারন, দেশশুধু মাটিতে নয় দেশ, গঠিত প্রধানত তার জনগণকে নিয়ে তারপর তাদের ভাষা-সংস্কৃতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও মতপ্রকোশের সতন্ত্রতা নিয়ে কিন্তু এর প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু বাধা আর লাঞ্ছনা, অন্যায় আর অবিচার, বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে হিন্দুস্থান বলে দেশকে ভালবাসা নয় দেশের মধ্যে বিভেদের বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে

(তথ্য ১. দৃষ্টিকোন ও জন আন্দোলন। লেখক- ওয়ামন মেশ্রাম। অনুবাদক- জার্নালিস্ট ভীমরাজ।  প্রকাশক – মূলনিবাসী পাবলিকেশান ট্রাস্ট, পুনা, মহারাষ্ট।

২. মূলনিবাসী বহুজন কি হিন্দু? লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক- ঐ

_______________
(৮) নম: শুদ্ররা কি হিন্দু ছিল
বিষয়টা ভিষণ গুরুত্ব পুর্ণ বিষয়টা পড়ে কারো কারো কাছে অবাক লাগতে পারে তাই এই বিষয়টার তথ্যমুলক বেশীরভাগ অংশ ‘‘অদল বদল এর ১৫ই অগষ্ট সংখ্যার’’ সত্যরঞ্জন তালুকদারের লেখা চন্ডাল নমশূদ্র এবং কাশ্যপগোত্র-তাদের পরিচয় কী’’ থেকে তুলে দিচ্ছি তবে প্রথমে ভারতে বিভিন্ন ধর্মের অনু্প্রবেশ ও বিস্তার সম্পর্কে অলোচনা করছি, আর বঙ্গে ব্রাহ্মণদের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে অলোচনা করছি
অবিভক্ত ভারতের তিনটি প্রধান ধর্ম () ব্রাহ্মণ্য ধর্ম( যাকে হিন্দু ধর্ম বলে প্রচার করা হয়),() ইসলাম ধর্ম এবং () খৃষ্টধর্ম্ এই তিনটি ধর্মই বহিরাগত ধর্ম খৃষ্টধর্মটি ধর্মের বাহকদের সঙ্গে ভারতে এসেছিল এবং এদেশের অধিবাসীরা সেই ধর্মটিকে গ্রহন করে সেটিকে তাদের আপন করে নিয়েছিল কালক্রমে ধর্মের বাহকরা ভারত ছেড়ে চলে গেলেও খৃষ্টধর্ম ভারতে থেকে গেল,এদেশের বিরাট সংখ্যক অধিবাসীর মধ্যে শিকড় বিস্তার করে দিয়ে এবং ফলে ফুলে শোভিত হয়ে ইসলামেরও ভারতে অনুপ্রবেশ বিদেশাগত মুসলমানদের সাথে বিদেশাগত সেই সব মুসলমানদের বংশধররা ভারত ছেড়ে চলে না গেলেও এদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানদের তুলনায় তাদের সংখ্যা খুবই সামান্য একথা নিশ্চয় করে বলা যায় যে ভারত বাঙলাদেশ পাকিস্থানের অধিকাংশ মুসলমানই ভারতের মূলনিবাসীদের বংশধর এবং ধর্মান্তরিত মুসলমান
এরকমটা মনে করা ঠিক হবে না যে এই তিনটি ধর্ম, ভারতের মাটিতে প্রচারিত হওয়ার আগে এদেশবাসীদের কোন ধর্ম ছিল না ভারতের মাটিতেও একটি ধর্ম জন্ম নিয়েছিল যেটি একসময় ভারত থেকে নির্বাসিত হয়েছিল কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য অসংখ দেশে টিকে ছিল এবং এখনও সেটি অনেক গুলি দেশের প্রধান ধর্ম সেই ধর্মটির নাম বৌদ্ধ ধর্ম বাস্তবে এটিকে ধম্ম ’(DHAMMA NOT DHARMA) বলা হয়
বহিরাগত যে তিনটি ধর্ম বৌদ্ধ ধম্মের পরিত্যক্ত স্থান দখল করে ভারতের সর্বত্র প্রচার লাভ করেছিল সেই তিনটি ধর্ম একই উদ্দেশ্যে এদেশে প্রচার করা হয়নি
খৃষ্টধর্মের প্রচারকরা কখনও রাজশক্তির সহায়তা পায়নি এবং খৃষ্টান রাজত্ব ভারতে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যেও এই ধর্ম প্রচার করা হয়নি এই ধর্মের মিশনারিদের কেবলমাত্র্ উদ্দেশ্য ছিল ভারতের অশিক্ষিত, অনুন্নত, গরীব এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগণকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা এবং শিক্ষার আলোয় উদ্ভসিত করা
মুসলমান ধর্ম প্রচারকদের সঙ্গে মুসলমান রাজশক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তাদের ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়ে ভারতের মাটিতে মুসলমান শাসন দীর্ঘস্থায়ী করে রাখাও এই ধর্ম প্রচারের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তার সুফল এই হয়েছিল যে নতুর ধর্মান্তরিতদের সঙ্গে তারা কোনরকম বিভেদ মূলক অচরণ করেনি এবং নবাগতদের তারা অতি সহজে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিল
হিন্দু ধর্মের প্রচার হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকেই বৌদ্ধ ধম্ম রাজানুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এবং ক্রমশ:দুর্বল হতে থাকে অন্য দিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম রাজানুগ্রহ লাভ করে ত্রমশ: শক্তিশালী হতে থাকে এবং গুপ্ত বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণরা খুবই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে তাদের পুরাতন শাস্ত্রগুলি তারা নতুন করে লিখতে অরম্ভ করে এবং আরও অনেক নতুন শাস্ত্র তৈরী করে সমাজ এবং রাজশক্তির উপর তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আর পালবংশের রাজত্ব স্থাপিত হলে ব্রাহ্মণরা সর্বশক্তিমান হয়ে উঠেছিল এবং অন্য কোন ধর্মের থেকে তাদের আর কোন বিরোধীতার সম্ভাবনা সমাপ্ত হয়ে যায় এই রকম পরিস্থিতিতে তারা ভারতের মূলনিবাসীদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে-কথা দৃঢ় সত্য যে, খৃষ্টপূর্বকালে বঙ্গে কোন ব্রাহ্মণ বাস করত না বৌধায়ণ-ধর্মসূত্রে নির্দেশ ছিল যে যদি কেউ প্রাচ্যের মগধ,পুন্ড্র,বঙ্গ,কলিঙ্গ ইত্যাদি দেশে কখনও যায় তাহলে ফিরে এসে তাকে পুনস্তোম অথবা সর্বপৃষ্ঠি যজ্ঞ করে শুদ্ধ হতে হবেবৌধায়ণ-ধর্মসূত্রের রচনা কাল 500 BC. থেকে 400 BC.এর মধ্যে কাজেই সেই সময় যে বঙ্গে কোন ব্রাহ্মণ বাস করতে পারে না সেকথা অমরা বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারি Thous by 900 BC. Videha or North Behar was brahmanised. But, as I have shown elsewhere, Magadha or South Behar and Pundra and Vanga or West and East Bengal were not brahmanised before the third century A.D. They were certainly not so about 400 B.C. as the Baudhayana-Dharmasutra (1.1.2.14) distinctly lays down that `he who has vsited the (countries of the)…Pranunas…Vangas, Kalingas (or) Pranunas, shall offerd Punashtoma or Sarvaprishthi’ by way of Purification.” (‘Some Aspects of Ancient Indian Culture’ by D.R. Bhandarkar, P.51).
ভন্ডারকর বৌধায়ণ-ধর্মসূত্রের নির্দেশ থেকে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে সেই ধর্মসূ্ত্রের রচনাকাল অর্থাৎ 400 খৃষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত নিশ্চিতরূপে বঙ্গে তথা সমস্ত পূর্ব ভারতে কোন ব্রাহ্মণ বাস করত না কারন হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘‘East India was at this early period dominated by the Prachyas who had a culture and civilization of their own which resisted very strongly and for a long time the inroads of Brahmanise.”(ibid, p.51), ভান্ডারকরের মতে খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বে বঙ্গে ব্রাহ্মণ অনুপ্রবেশ ঘটেনি কিন্ত বিভিন্ন পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই যে , দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত দ্বারা বঙ্গ বিজয়ের পরে খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকেই বঙ্গে সর্ব প্রথম ব্রাহ্মন অনুপ্রবেশ ঘটেছিলকিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ব্রাহ্মণ আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গের লোকেরা ব্রাহ্মন্য ধর্ম স্বীকার করে নিয়েছিল রাজশক্তির রক্ষণাবেক্ষণে বঙ্গে সামান্য সংখ্যক ব্রাহ্মন সেই সময় প্রবেশ করলেও সেখানকার জনগণের সঙ্গে তাদের বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না
এবার আলোচনা শুরু করছি নম:শুদ্রদের সম্পর্কে :-
আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বঙ্গে যে সংখ্যাবহুল জাতিটি বসবাস করছে তাদের বর্তমান নাম নম: শুদ্র
বঙ্গে ব্রাহ্মনদের অনুপ্রবেশে তারাই বাধা দিয়েছিল।  তারা গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল নৃপতিদের রাজত্বকালে বঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্মের কোন প্রভাবই ছিল না। বঙ্গে কর্ণাটকী ব্রাহ্মন সেনবংশের রাজত্ব স্থাপিত হলে ব্রাহ্মণরা শক্তিমান হয়ে ওঠে এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মে প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়। একমাত্র নমঃরা ব্যতিরেকে বাংলার অন্যান্য সমস্ত জনগোষ্ঠী দ্বিধাহীন ভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মে আশ্রয় নেয়। নমঃরা ব্রাহ্মণ্যধর্মে আসতে রাজি না হওয়ায় বল্লাল সেন তাদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালাতে থাকলে তারা নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি রক্ষার্থে পূর্ববঙ্গের জলামূমিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ধীরে ধীরে নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি চর্চার অভাবে আত্মবিস্মৃতির তলায় তলিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে তারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুকরণ শুরু করে।
     ব্রাহ্মণরা সুযোগ বুঝে তাদের মনের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে সঞ্চিত বিশ নম:দের উপর বর্ষণ করতে শুরু করে কিন্তু ব্রাহ্মণরা কোনোদিন তাদেরকে বর্ণব্যবস্থার মধ্যে গ্রহণ করেনি। বরং তাদের অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ করে রাখে। গত আটশ বছর ধরে এই নম:রা অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ অবস্থায় পতিত হওয়ার ফলে প্রতিহিংসাকারী ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, অপমান, অবহেলা অঘাত এবং অবরোধ সহ্য করতে করতে বঙ্গের একদা সংখ্যাবহুল এবং শক্তিশালী জাতিটি আজ করুন অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে
     ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জাঁতাকলে প্রবেশের পূর্বে নম:দের ধর্ম কি ছিল সেটা পাল যুগের ঘটনাবলী  বিশ্লেষণ কররে অতি সহজে বোঝা যায় বর্তমান কালের পরিস্থিতিতে বিচার করে যদি একজন হিন্দু তথা ব্রাহ্মণকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করার কথা মনে করা হয়, সেটা যেমন কল্পনা করা সম্ভব নয়, যেহেতু সেখানকার অধিকাংশ জনগণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী তেমনি পশ্চিমবঙ্গে একজন বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীকে মুখ্যমন্ত্রী বানানোর কথা কল্পনা করাও অবাস্তব বর্তমানে যদি এই পরিস্থিতি হয় তাহলে অষ্টম শতাব্দীতে বাংলার জনগণ সর্বসম্মতিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ধর্মপালকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিলৈন, সেটা কোন মতেই সম্ভম হত না যদি সেই সময় সেখানকার অধিকাংম জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী না হত  আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, গুপ্ত এবং সেনবংশ অস্ত্রবলে বঙ্গ দখল করেছিল কিন্তু ধর্ম পালকে বঙ্গের জনগণই রাজসিংহাসনে বসিয়েছিল এর থেকে প্রমানিত হয় যে, সেই সময় বঙ্গের অধিকাংশ জনগন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল।  
     অতি প্রাচিন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত নম:রা বাঙলার একটি সংখ্যা-বহুল জাতি তাদের মধ্যে থেকে বহু সংখ্যক লোক ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার পরেও তারা পূর্ব এবং পশ্চিমবাংলা মিলে হিন্দুদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি অষ্টম শতাব্দীতে যদি বাঙলার অধিকাংশ লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয় তাহলে সেই সময় নম:দের ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম(ধম্ম)’ ছাড়া আর কিছুই   হতে পারে না তাই আমরা এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে, হিন্দু ধর্মের খোঁয়াড়ে প্রবেশের  পূর্বে নম:রা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল  বল্লাল সেনের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ্যধর্মকে স্বীকার করে নিয়েছিল
     বল্লাল সেনের অত্যাচারের কথা বংশ পরম্পরায় আটশ বছর পরে এখনও নম:দের মস্তিষ্কে বিরাজ করছে নম:রা মনে করে যে, বল্লাল সেনের তাদের পূর্ব পুরুষকে ব্রাহ্মণ থেকে চন্ডাল বানিয়েছিল এই ধারনা সম্পুর্ণ ভুল বল্লাল সেনের তাদের পূর্বপুরুষদের ব্রাহ্মণ থেকে নয়, বৌদ্ধ ধম্মের সম্মানজনক স্থান থেকে বিচ্যুত করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অসম্মান জনক স্থান স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছিল কোন পরাজিত জাতির এরকমই পরিনতি হয়
     ব্রাহ্মণধর্মাবলম্বী সেন-রা বঙ্গে ছিল বহিরাগত নম:রা যদি তাদের সঙ্গে একই ধর্মাবলম্বী হত তাহলে তাদের  উপর অত্যাচার করে দূর-দূরান্তে তাড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না বল্লাল সেন পালবংশকে হটিয়ে বাংলা দখল করেছিল বাংলা দখল করে নম:দের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিল কারণ পালরাজারা ছিল নমঃজাতির লোক। এই সন্দেহই  বল্লাল সেনকে নম:দের প্রতি অত্যাচারী করে তুলেছিল সে বিদেশ থেকে ব্রাহ্মণ ডেকে এনে এবং বঙ্গের কোনো  জাতিকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজের দলে টেনে সংখ্যা ভারী করেছিল
     আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, গুপ্ত যুগে খুব সামান্য সংখ্যক ব্রাহ্মণই বাংলায় প্রবেশ করেছিল আর পাল রাজত্বের শেষদিন পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের কিংবা ব্রাহ্মণ্য  ধর্মের প্রভাব বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়নি তাই সেই সময় বাংলার সব থেকে বড় জাতি নম:রা কোনমতেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুগামী হতে পারে না হিউয়েন সাঙ্-এর ভ্রমন কাহিনী (৬২৯- ৬৪৫ খৃষ্টাব্দ) থেকে এটাও জানা যায় সেই সময় বাংলায় দেব মন্দির থাকলেও বৌদ্ধ বিহারের সংখ্যাই বেশি ছিল তিনি বাঙলার সব জাগায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক দেখেছিলেন

এই আলোচনা থেকে নির্দিধায় আমরা এই সমাধানে আসতে পারি যে, নম:রা বা আজকের নম:শুদ্রদের পূর্বপুরুষরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল

Read More