জাতব্যবস্থা থাকার ফলে হিন্দু জীবন এক এবং হিন্দুরা একজাতি,
এই চেতনাবোধ গড়ে ওঠেনি।
ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর (Annihilation of Caste)
জাতব্যবস্থার ফলে
অর্থনৈতিক দক্ষতা হতে পারেনা। জাতিপ্রথা জাতির (Race) উন্নতি করতে পারেনি আর করতে পারবেও না। তবে এর ফলে একটা বিষয় অবশ্যই হয়েছে
সেটা হচ্ছে যে, এতে হিন্দু সমাজ সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলা বিহীন এবং হতাশা গ্রস্থ
হয়েছে।
সর্বপ্রথম এই চরম সত্যকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, হিন্দু
সমাজ একটি পৌরাণিক কাহিনি। হিন্দু নামটা একটা বিদেশী নাম। ‘হিন্দু’ শব্দটা
(অক্রমণকারী) মুসলমানদের দেওয়া নাম। স্থানীয় অধিবাসী এবং মুসলমানদের মধ্যে পৃথকতা
বোঝানোর জন্য তারা স্থানীয় অধিবাসীদের হিন্দু নামে অভিহিত করেছিল। ভারতে
মুসলমানদের আক্রমণের পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কোনো গ্রন্থে ‘হিন্দু’ শব্দটি
পাওয়া যায়না। ভারতে মুসলিম আক্রমণের পূর্বেকার সময়ে সংস্কৃত ভাষার লেখকদের ‘নেশন’
(জাতি) সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলনা। তারা ভারতীয় অধিবাসীদের একটা সাধারণ নামকরণের
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। তাই হিন্দু সমাজের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা
শুধু জাতিগুলির একটা সমষ্টিগত নাম। (The first and foremost thing
that must be recognized is that Hindu Society is a myth. The name Hindu is
itself a foreign name. It was given by the Mohammedans to the natives for the
purpose of distinguishing themselves. It does not occur in any Sanskrit work
prior to the Mohammedan invasion. They did not feel the necessity of a common
name because they had no conception of their having constituted a community.
Hindu society as such does not exist. It is only a collection of castes.)
প্রত্যেক জাতির লোক তাদের জাত (caste) সম্বন্ধে খুব সজাগ। প্রত্যেক জাতকে
বাঁচিয়ে রাখাই প্রত্যেকে জাতের মানুষের একমাত্র লক্ষ্য। তাই জাতগুলি মিলে মিশে
একটা সংগঠন তৈরি করতে পারেনা। কোনো জাত (caste)
এটা অনুভব করেনা যে, সে অন্য জাতির সঙ্গে জুড়ে আছে। এটা শুধু অনুভব
করে যখন হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা হয়। বাকি সময় নয়। বাকিসময় এক জাতের লোক
অন্য জাতের লোক থেকে সব সময় পৃথক হয়ে চলার চেষ্টা করে। প্রত্যেক জাতের লোকেরা
নিজেদের জাতের মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া ও বিবাহ সম্বন্ধ করে। একমনকি প্রত্যেক জাতের
লোকেরা তাদের আলাদা পরিচয় দেখানোর জন্য
আলাদা আলাদা পোষাক নির্দিষ্ট করে। এছাড়া অন্য কারণ কি হতে পারে যে জন্য ভারতের নর-নারী
অসংখ্য ধরনের পোষাক পরিধান করে? আর এর ফলে পর্যটকরাও সমস্যায় পড়ে যায়। বস্তুতঃ প্রত্যেক
আদর্শ হিন্দু ইঁদুরের মতো নিজের গর্তের
মধ্যেই থাকে, আর অন্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায়না।
হিন্দুদের মধ্যে চেতনাবোধের অভাব আছে। যাকে সমাজ
বিজ্ঞানীদের ভাষায় সমচেতনাবোধ বলা হয়। তাদের মধ্যে চেতনাবোধ সব শ্রেণির সঙ্গে নেই।
প্রত্যেক হিন্দুর মধ্যে যে চেতনাবোধ পাওয়া যায়, সেটা তাদের নিজের জাতের (caste) চেতনাবোধ। হিন্দু চেতনাবোধ না
থাকায় হিন্দুরা একটি সমাজ বা একটি রাষ্ট্র (nation) গঠন করতে
পারেনি। এমন অনেক
স্বদেশপ্রেমী ভারতীয় আছেন, যারা একথা স্বীকার করতে চান না যে, ভারতীয়রা একটি
রাষ্ট্র নয়; অথবা তারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এক অব্যবস্থিত সমূহ। এইসব দেশপ্রেমিক
ভারতীয়রা জোর দিয়ে বলেন যে, আপাততঃ দৃষ্টিতে আলাদা-আলাদা দেখা গেলেও আমাদের দেশের
জনগণের মধ্যে একটা মৌলিক একতা আছে; যেটা
হিন্দুদের বিশেষ লক্ষণ। কারণ, তাদের আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মধ্যে
অনেক সাদৃশ্য আছে। যেটা ভারতের সর্বত্র সৃষ্টিগোচর হয়। তাদের আচার-ব্যবহার বিশ্বাস
ও চিন্তাধারার সাদৃশ্যতায় কোনো সন্দেহ করা যায়না। কিন্তু তাই বলে কেউ এ
সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না যে, হিন্দুরা সকলে মিলে একটা সমাজ গঠন করেছে। একটি সমাজ
গঠন করতে যে উপাদানের প্রয়োজন, জাতিভেদ যুক্ত হিন্দুদের মধ্যে সেই সমস্ত উপাদানের
অভাব আছে। অনেক দূরে বসবাস করলেও যেমন একজন মানুষ তার সমাজের সভ্য পদ
থেকে বঞ্চিত হয় না, তেমনি পাশাপাশি বসবাস করলেও শুধুমাত্র প্রতিবেশী মানুষগুলি
নিয়ে একটি সমাজ গঠিত হয়না। দ্বিতীয়তঃ একটি সমাজ গঠন করতে শুধুমাত্র আচার-ব্যবহার,
বিশ্বাস ও চিন্তাধারার সাদৃশ্যই যথেষ্ট নয়। ‘ইট’ যেমন এক হাত থেকে অন্য হাতে সহজেই
হস্তান্তরিত হতে পারে, সেরকম এক গোষ্ঠীর আচার ব্যবহার, বিশ্বাস ও চিন্তাধারা আর এক
গোষ্ঠী সহজেই গ্রহণ করতে পারে। তখন মনে হতে পারে যে, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটি
সাদৃশ্য আছে। পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করতে পারে;
কিন্তু তাতে একটি সমাজ গড়ে ওঠেনা।
এটাও দেখা যায় যে, পরস্পর পাশাপাশি প্রতিবেশী
হিসাবে বসবাস না করলেও বিভিন্ন আদিম অধিবাসীদের মধ্যে আচার ব্যবহার, বিশ্বাস ও
চিন্তাধারার সাদৃশ্য আছে। কিন্তু তাই বলে কেউ একথা বলতে পারেন না যে, এই
অধিবাসীদের এরকম সাদৃশ্য থাকলেও তারা একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত।
একটি সমাজ গঠন করার
ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কয়েকটি বিষয়ের সমদৃশ্যই যথেষ্ট নয়। একটি সমাজ গঠন করতে হলে সেই
সমাজের অন্তর্ভুক্ত সকল মানুষের সকল বিষয়ে সমান অধিকার থাকা দরকার। একই রকম জিনিস থাকা এবং সকল জিনিসের উপর সাধারণ
অধিকার থাকা, এই দুটি বিষয় সম্পূর্ণ
আলাদা। মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র পরস্পর যোগাযোগের ফলে সমাজের অস্তিত্ব গড়ে উঠতে
পারে। একটি সমাজকে বাস্তবে রূপ দেওয়া বা একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে এবং
মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি করতে হলে, এক শ্রেণির মানুষের কর্মের সঙ্গে
অন্য শ্রেণির মানুষের কর্মের সাদৃশ্য থাকাটাই যথেষ্ট নয়। হিন্দুদের বিভিন্ন জাতের
মধ্যে একই রকম উৎসব পালন এ-কথার সত্যতা প্রমাণ করে। একই রকম উৎসব উদ্যাপন বিভিন্ন
জাতের মানুষের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে পারেনি। একটি
অবিচ্ছেদ্য সামাজিক বন্ধনের সৃষ্টি করতে হলে এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত সকল মানুষের
এমন একটি সাধারণ কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে, যার ফলে তাদের মধ্যে একই রকম ভাব ও
অনুপ্রেরণা আসবে। তাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে হলে সেই সমাজের
অন্তর্ভুক্ত সকলের সঙ্গে এমনভাবে পরস্পর মেলামেশা ও সাধারণ কাজ-কর্মে অংশীদার
হওয়ার সুযোগ থাকা দরকার, যাতে একে অপরের সুখ-দুঃখ অনুভব করতে পারে।
জাতিভেদ প্রথা যে কোনো দুটি জাতির মানুষের
মধ্যে এরকম সাধারণ কাজে এবং মেলামেশায় বাঁধা সৃষ্টি করে হিন্দুদের মধ্যে একটি
পূর্ণাঙ্গ সমাজ গড়তে প্রচন্ড বাঁধা দিয়েছে। জাত-ব্যবস্থা থাকার ফলে হিন্দু জীবন
এক এবং হিন্দুরা এক জাতি, -এই চেতনাবোধ গড়ে ওঠেনি।
0 comments:
Post a Comment