Monday, 2 October 2017

// // Leave a Comment

অথ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল লেখক – প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

অথ  মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল
লেখক – প্রদীপ কুমার বিশ্বাস
    মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল সম্পর্কে পক্ষে – বিপক্ষে নানা রকম মন্তব্য প্রচলিত। যারা বিপক্ষে কটুক্তি বা বিরূপ মন্তব্য করেন, তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র, মিথ্যা অভিযোগের হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া ক্যাসেটটি যোগেন মন্ডল, আম্বেদকরের সৌজন্যে উপকৃত,  ফলভোগকারী তপশিলী সমাজের মানুষ মহাদায়িত্বের সঙ্গে উক্ত ক্যাসেট বাজান এবং প্রথম  পোষমানা চতুষ্পদ প্রাণীর ন্যায় ব্রাহ্মণ্যবাদের পদ সেবায় নিজেদেরকে ধন্য মনে করেন।

    মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের সংগ্রাম এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রঃ –

   ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে সারা ভারতবর্ষে তপশিলী ফেডারেশন থেকে একমাত্র জয়ী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলে নির্বাচিত সদস্য পদ বাতিল করবার জন্য কংগ্রেস তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি পরাজিত কামিনী কুমার সমাদ্দারকে দিয়ে কেস করায়কিন্তু ৮/২/১৯৪৬  তারিখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে জয়ী ঘোষণা করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী কংগ্রেস  জানত বঙ্গপ্রদেশে যোগেন মন্ডলই হ’ল তপশিলী সমাজের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তাই যোগেন মন্ডল যেন বিধান পরিষদে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ষড়যন্ত্র করে গেছে।

      ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জয়ী না হ’লে বাবাসাহেব আম্বদেকরকে গণপরিষদে পাঠানো সম্ভব হ’তো না। গণপরিষদের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে আম্বেদকরের অবস্থিতি; অস্পৃশ্য তথা তপশিলী জাতি ও উপজাতির শিক্ষা ও চাকুরীর সংরক্ষণের    সুবিধার প্রতিষ্ঠা পেল। সংরক্ষণের সুবিধা ভোগীদের মধ্যে যে সব মহাজ্ঞানী মহাপন্ডিত যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, আম্বেদকরের বিরুদ্ধ সমালোচক তারা ব্রাহ্মণ্যবাদীর শিকল পরা সেবকশুধু তাই নয়,  সংরক্ষণের সুবিধা ভোগী ঐ সব মহাপন্ডিতগণ তপশিলী সমাজ ধ্বংসের জন্য বিষাক্ত ভাইরাস।

    ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আশঙ্কা সত্য প্রমানিত করে ১৯৪৬ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলীমলীগের প্রধান মন্ত্রী সুরাবর্দ্দীর মন্ত্রীসভায় বাংলার তপশিলী সমাজের উন্নতি ও অধিকার রক্ষায় মন্ত্রী হিসাবে  যোগদান। শুরু হ’ল ব্রাহ্মণ্যবাদী কংগ্রেস সহ গান্ধী, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর গাত্রদাহ। মুসলিম লীগের  মন্ত্রীসভায় একমাত্র হিন্দু মন্ত্রী হলেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। (বিশেষভাবে জানা দরকার ঐসময়ে প্রদেশের মন্ত্রী পরিষদের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী বলা হ’ত)১৯৪৬ সালের ২৪শে এপ্রিলের আগে পর্যন্ত শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তপশিলী সমাজের কেউ ইঞ্জিয়ারিং পড়বার সুযোগ পেত  না। ঐ কলেজে ব্রাহ্মণদের ছিল একচেটিয়া অধিকার। প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দ্দীর  মন্ত্রীসভার সদস্য   হিসাবে শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর মোয়াজ্জেমুদ্দিন হোসেনের সহযোগিতায় ১৯৪৬ সালে যোগেন  মন্ডলের একান্ত প্রচেষ্টায় তপশিলী সমাজের ছাত্রদের সর্ব প্রথম শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়বার সুযোগ হয়। শুধু তাই নয়, ঐ কলেজের ছাত্রাবাসে ব্রাহ্মণ ছাড়া কারো থাকবার অধিকার ছিল না। তাই তপশিলী এবং মুসলমান ছাত্রদের জন্য সরকারী সহযোগিতায় ছাত্রাবাস তৈরি করেন। এছাড়াও তপশিলী সমাজের মেধাবী ছাত্রদের ইংল্যান্ড আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দ্দি সরকারের থেকে বৃত্তির(অর্থ) ব্যবস্থা করেন। ঐ বিষয়গুলি কংগ্রেস, বর্ণবাদী  গান্ধী, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মেনে নিতে পারল না। যোগেন মন্ডল সম্পর্কে ভুলবার্তা দিতে ষড়যন্ত্র করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যোগেন মন্ডলকে বলল যোগেন আলী মোল্লা। মূল উদ্দেশ্য ছিল যোগেন মন্ডল যেন হিন্দু তথা তপশিলী জাতির প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠা না পায়।   

     ব্রাহ্মণ এবং কংগ্রেসের যোগেন মন্ডল সম্পর্কে আরো গাত্রদাহ এবং আতঙ্ক শুরু হ’ল যখন  বড়লাটের অন্তরবর্তী সরকারে জিন্না মুসলিম লীগের চার জনের সঙ্গে বাংলা তথা সারাভারত  তপশিলীর মন্ত্রী হিসাবে যোগেন মন্ডলকে মনোনিত করল। যোগেন মন্ডল হলেন অন্তরবর্তী সরকারের আইন মন্ত্রী। আগে থেকেই কংগ্রেস, গান্ধীজি, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সহ সমস্ত  ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মাথা ব্যথার কারণ – আম্বেদকর। এমত অবস্থায় যোগেন মন্ডলের সর্বভারতীয়  ক্ষেত্রে তপশিলী জাতির অধিকার রক্ষার প্রতিনিধি হিসাবে উত্থাত সমস্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি আতঙ্ক হয়ে পড়ে। আর তখনই একশ শতাংশ মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের মুখ বর্ণবাদী শঠতার প্রতীক গান্ধী বলল – যা ১৮ই অক্টোবর ১৯৪৬, স্টেটম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত হ’ল -“তপশিলী জাতির একব্যক্তি  মুসলিম লীগ কর্তৃক বড়লাটের শাসন পরিষদে নিযুক্ত হইয়াছেন, ইহাতে আমি যদি বলি সন্তুষ্ট হইয়াছি তাহা হইলে আমার নিজেকে প্রতারণা করা হইবে।” (তথ্য মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় খন্ড পৃঃ নং ৭২ )  

    গান্ধিজীর জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র তপশিলী জাতির প্রতি ছিলনা। ছিল, বাঙালী বিদ্বেষী মনোভাব। যা কিনা নেতাজীর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। আসলে গান্ধী সহ কংগ্রেসের ভিতরে ভিতরে বাংলা ভাগের ষড়যন্ত্র চলছিল। নেতাজীর অবর্তমানে বাংলা ভাগের ক্ষেত্রে যোগেন মন্ডল যাতে বাধা হয়ে দাড়াতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে যোগেন মন্ডলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং মিথ্যা প্রচার। যা শিক্ষা চেতনায় পিছিয়ে থাকা নমঃজাতি সহ তপশিলী সমাজ বুঝতে পারেনি।

   প্রসঙ্গগঃ আমাদের জানা দরকার ফজলুল হকের মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মন্ত্রী হয়েছিল।  সুরাবর্দ্দীর মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী হবার জন্য যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে যদি যোগেন আলি মোল্লা বলা হয়, তাহলে হক মন্ত্রী সভায় মন্ত্রী হবার জন্য তাকে কেন মোল্লা বলা যাবে না?   
   সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে গেলে ভারতের সব থেকে ইস্‌লাম দরিদী ছিল গান্ধিজী। কারণ, দেশভাগের ফলে পাকিস্থানে চলে যাওয়া মুসলমানদের পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্থ মসজিদের সংস্কাররের  জন্য ভারতকে অর্থ সাহায্য করতে হবে এই দাবীতে ১৯৪৮ সালের ১৩ই জানুয়ারী অনশন শুরু করে। শুধুমাত্র গান্ধিজীর জন্য ভারত সরকার পাকিস্থানকে ৫৫ কোটি টাকা দিতে বাধ্য হয়। যার ফল স্বরূপ ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী গান্ধিজীর পরিণতির কথা অজানা নয়। (তথ্য- বঞ্চিত জনতার মুক্তিযোদ্ধা ড. আম্বেদকর – লেখক রঞ্জিত কুমার সিকদার পৃঃ নং ১৭২)  

    তাহলে উপরোক্ত তথ্য থেকে মহাত্মা গান্ধী না বলে “মহাত্মা” নামক মহান শব্দটিকে বাদ দিয়ে গান্ধী নামের আগে মোল্লা, মৌলবি, হযরত এ আলম – কোন উপাধি দেওয়া যায় কি? পাঠকবর্গ  ভেবে দেখবেন। আর যে সব তপশিলী জাতি হকমন্ত্রী সভার মন্ত্রী, গান্ধীজিকে বিখ্যাত মুসলমান উপাধি দিতে চরম লজ্জাবোধ করে যোগেন মন্ডল, আম্বেদকরের সমালোচনা করেন তারা ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় শ্রেণির ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ্যবাদের সেবক, মনুবাদের বাহক এবং তপশিলী জাতির ক্যান্সার।  

       ১৯৩২ সালে ২৪শে সেপ্টেম্ব্র আম্বেদকর পুনাপ্যাক্ট চুক্তিতে সই করতে বাধ্য  হয়ে ছিলেন। ঐ সময় কালে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে গান্ধীর ভেক অনশনের ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তপশিলী সমাজের  উপর আক্রমন শুরু করে। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে এবং উত্তর প্রদেশে অস্পৃশ্য তপশিলী সমাজের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী গান্ধী এবং কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রে অস্পৃশ্য জনজাতির উপর ভয়াবহ আক্রমণ শুরু হয় এবং আম্বেদকরকে মেরে ফেলার চক্রান্ত হয়। আম্বেদকরের মৃত্যু ঘটলে ভারতের তপশিলী জাতির নেগৃত্ব দেবার বলিষ্ট নেতা থাকবে না। তপশিলীর অন্যান্য নেতাদের পরামর্শে অস্পৃশ্য তপশিলী জাতির দু’টি ভোটের অধিকারের দাবী থেকে আম্বেদকর সরে আসেন। অস্পৃশ্য জনজাতির দু’টি ভোটের সুকৌশলী সিদ্ধান্ত ছিল আম্বেদকরের মস্তিষ্ক প্রসূত। সেই কৌশল এবং তপশিলী জাতির মুক্তির পরিপন্থী পুনাপ্যাক্টে ব্রাহ্মণ্যবাদী খল নায়ক গান্ধী এবং মনুবাদের ষড়যন্ত্রে সই করতে বাধ্য হন। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে যোগেন মন্ডলও আম্বেদকরের মতো পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী লিকায়ত আলীর ষড়যন্ত্রের স্বীকার হলেন। পূর্ব পাকিস্থানের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা  করেন। যোগেন মন্ডলের পাকিস্থানী মুসলিম দেহ রক্ষী তাঁকে বলেন- “আপনি পশ্চিম পাকিস্থানে   থাকলে প্রাণে বাঁচবেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্থানে গেলে পাকিস্থান সরকার আপনাকে ষড়যন্ত্র করে মেরে দেবে।” এই গোপন তথ্য দেহরক্ষী যোগেন মন্ডলকে জানিয়ে দেবার পর জাতির স্বার্থে বেঁচে  থাকা  প্রয়োজন বোধ করে কৌশল করে তিনি পশ্চিম পাকিস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্থানে যাবার নাম করে   কলকাতা বিমান বন্দরে নেমে জান। ডাঃ বিধান রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ভারতে থেকে যান এবং পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন। পাকিস্থানী সরকার পরবর্তী কালে যোগেন মন্ডলের নিরাপত্তা দেওয়ার ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে পাকিস্থানের কারাগারে বন্দী করে রাখে এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ভারপ্রাপ্ত ঐ অফিসারের পুত্র পরবর্তী সময়ে TRUE FACTনামে গ্রন্থে সেকথা প্রকাশ করেন। পাকিস্থান সরকার বইটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে এবং পান্ডুলিপিসহ সমস্ত বই পুড়িয়ে দেয়। মৌখিকভাবে এটা প্রচলিত সত্য। বাস্তব না জেনে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল করাচী থেকে পূর্ব পাকিস্থানে  কেন গেলেন না – এই অজুহাতে তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়। আম্বদেকর যেমন তপশিলী জাতির ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন, যার ফল স্বরূপ “পুনাচুক্তি” করতে বাধ্য হয়েছিলেন; ঠিক তেমনই পূর্ব পাকিস্থানের হিন্দু তথা তপশিলী জাতির ভবিষ্যতের কথা ভেবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ভারতে থেকে যান। যার ফল স্বরূপ ১৯৫০ – ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব   পাকিস্থান থেকে আগত হিন্দুদের পুনর্বাসন আন্দোলনে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে বার বার জেলে যেতে হয়েছে। তপশিলী জাতির শিক্ষা ও চাকুরীর সংরক্ষণের বিরোধী ১৯৬৫ সালের লকুড় কমিশনের সুপারিশ বাতিল করে বাংলার নমঃশূদ্র, ধোবা, রাজবংশী, সুড়ী সহ সারা ভারতের তপশিলী জাতির শিক্ষা ও চাকুরীর সংরক্ষণের নিরাপত্তা দেন।  
     পূর্ব পাকিস্থানের হিন্দুদের উপর অত্যাচার প্রতিবাদে মিথ্যা ষড়যন্ত্র করে রাজদ্রোহী হিসাবে  জেলে বন্দী করে রাখা হয়। ১৯৬০-১৯৬৪ সালে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় কংগ্রেসী এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি তাঁকে দু’বার জেল বন্দী  করে রাখে। আন্দোলনের সময় কালে নমঃশূদ্র জাতির পি. আর. ঠাকুর ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের চক্রান্তের স্বীকার হয়ে যোগেন মন্ডলের উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল তপশিলী  উদ্বাস্তুদের যখন বাংলার বাইরে পুনর্বাসনের বিরোধিতা করে করেন। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল যখন তপশিলী উদ্বাস্তুদের  বাংলার বাইরে পুনর্বাসনের বিরোধিতা করে মেঘনাদ সাহার জমি জরিপের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে   বর্ধমান, হাওড়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ ও বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পুনর্বাসনের পক্ষে যোর আন্দোলন করছেন – তখন পি. আর. ঠাকুরকে দিয়ে বিপরীত মুখী বক্তব্য  রাখলেন বাংলার তপশিলী বিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজশক্তি। পি. আর. ঠাকুর ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজশক্তির ষড়যন্ত্র ধরতে পারলেন না। ব্যর্থ হ’ল বাঙালীদের বাংলায় পুনর্বাসনের আন্দোলন।

    যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল যাতে কোন দিনই বিধান সভা এবং লোকসভায় প্রবেশ করতে না পারেন তার জন্য বাম, কংগ্রেস, বর্ণবাদী হিন্দুমহাসভা সমস্ত রকম ষড়যন্ত্র করেছে। আর এই ষড়যন্ত্র  কার্যকরী হ’তে সাহায্য করেছে তপশিলী জাতির মণীন্দ্র বিশ্বাস, পি. আর. ঠাকুর এবং সবশেষে অপূর্বলাল মজুমদার। এই সব ক্ষুদ্র স্বার্থলোভীদের মাধ্যমে আর একদিকে আম্বেদকর  যাতে কেন্দ্র ও রাজ্যের আইন কক্ষে প্রবেশ করতে না পারে সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রাজনৈতিকভাবে সফল। কিন্তু যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আইন সভায় পৌঁছালে বাংলা সহ সারা ভারতবর্ষের তপশিলী জাতি, উপজাতির ভাগ্যটাই অন্যভাবে এগিয়ে যেত।    

     ড. বাবা সাহেব আম্বেদকরকে যেভাবে নির্বাচনে কারচুপি বা ষড়যন্ত্র করে হারানো হ’ত। যাতে আম্বেদকর কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের আইন সভায় ঢুকতে না পারে। কারণ, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে আম্বেদকর ছিল আতঙ্ক। তেমনিভাবে বাংলায়ও আম্বেদকরের মতো যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজশক্তির মহাআতঙ্ক। ১৯৫৭ সালের বিধান পরিষদের নির্বাচনে বনগাঁ মহাকুমার বনগাঁ সংরক্ষিত আসনে কংগ্রেসী প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে বিষয় চুড়ান্ত হয়। সৌজন্যে  ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কিন্তু কংগ্রেসী মনুবাদী নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে এবং ২৪পরগণা জেলার ব্রাহ্মণ্যবাদী পৃষ্ঠপোষক জীবন রতন ধরের প্রচেষ্টায় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কংগ্রেসী মনোনয়ন পেলেন না। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের অনুগত মনীন্দ্র ভূষণ বিশ্বাসকে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন  দেওয়া হ’ল মণীদ্র ভূষণ বিশ্বাস ব্যক্তি স্বার্থে ক্ষমতার লোভে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা  করল এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীর ষড়যন্ত্রে নিজে ব্রাহ্মণ্যবাদীর সেবকে পরিণত হ’ল। যার ফল স্বরূপ নির্বাচনে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল নির্দল প্রার্থী হয়েও ব্রাহ্মণ্য পদ সেবক মণীন্দ্র ভূষণ বিশ্বাসে নিকট  পরাজিত হলেন। তপশিলী জাতির চরম সর্বনাশ সাধিত হ’ল। আবার ১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল নদীয়া জেলার হাঁসখালি লোকসভা কেন্দ্রে এবং ২৪পরগণা জেলার বাগদা বিধান সভা কেন্দ্রে দু’টি জায়গায় নির্বাচনে দাড়ান। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কোনক্রোমেই যাতে জিতে আইন সভায় ঢুকতে না পারেন তার জন্য বাংলা এবং দিল্লীর ব্রাহ্মণ্যবাদী  কংগ্রেস সুগভীর চক্রান্ত করল। হাঁসখালি কেন্দ্রে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের বিরুদ্ধে পি. আর. ঠাকুর এবং বাগদায় মনীন্দ্রভূষণ বিশ্বাসকে কংগ্রেস প্রার্থী মনোনীত করল। পি.আর. ঠাকুর আর মণীন্দ্রভূষণকে সামনে রেখে কংগ্রেস ষড়যন্ত্র, ভয়, নির্বাচনে কারচুপি করে দু’টি কেন্দ্রেই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে হারিয়ে দিল। উদ্বাস্তু সহ তপশিলী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার যোদ্ধার পরাজয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদী শক্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আর এই ব্রাহ্মণ্য শক্তির ষড়যন্ত্রের সাফল্যের অর্ঘ স্বরুপ হ’ল মণীন্দ্রভূষণ বিশ্বাস ও পি. আর. ঠাকুর।  

    ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে আর. পি. আই. সমর্থিত এবং বাম কমিউনিস্ট সমর্থিত  বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রের এবং ঐ লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধান সভার ভোটের নিরিখে মোর্চার প্রার্থী হিসাবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ১৪১১৪১ ভোট পেয়ে জয়ী হবার কথা। কারণ, সাতটি বিধান সভার মধ্যে ৫টি বিধান সভায় আর. পি. আই., বাম-কমিউনিস্ট প্রার্থীরা জয় লাভ করে। সেখানে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ভোট পান মাত্র ৮৪৬৪৪ টি। আর ভোটের নিরিখে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের বিপক্ষে রনেন্দ্রনাথ সেনের পাবার কথা ৬৬৮৮৯ টি ভোট। কিন্তু বাম-কমিউনিস্ট পার্টির ষড়যন্ত্রে রনেন্দ্রনাথ সেন ১৪৩৮৮৯ টি ভোট পেয়ে জয় লাভ করে। আর এক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের নায়ক মেকি কমিউনিস্ট ধব্জাধারী প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, শান্তিময় ঘোষ – প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব। অর্থাৎ তপশিলী যোদ্ধা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, হিন্দু মহাসভা প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যশক্তি পরিচালিত রাজনৈতিক দল আইন সভায় ঢুকতে দিতে রাজী নয়।  কারণ, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মধ্যে বাবা সাহেব আম্বেদকরের ছায়া দেখে ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদী নেতৃত্বের রাজনৈতিক দল আতঙ্কিত ছিল। তাই যতদিন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বেঁচে ছিলেন সমস্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি সর্বক্ষণ তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত- ষড়যন্ত্র করেছে। সহযোগিতায় তপশিলী জাতির ব্রাহ্মণ্যবাদীর অনুগত সেবকগণ।

      পি. আর. ঠাকুরের সঙ্গে  দলবদ্ধভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি ১১বার কথা বলবার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৯০ সালের জানুয়ারী মাসে ঠাকুর নগরের আত্মীয়তার সুযোগে খুব সকালে পি. আর. ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ঐ সাক্ষাৎকারে পি. আর. ঠাকুরকে দু’টি প্রশ্ন করি। তিনি খুব সংক্ষেপে তার উত্তর দেন-
(১) আপনার জীবনের সব থেক বড় সাফল্য কী?
পি. আর. ঠাকুরঃ- মতুয়া মহাসংঘের মাধ্যমে নমঃশূদ্র তথা পূর্ব বঙ্গ থেকে আগত মতুয়াদের সংঘবদ্ধ একত্রিত করতে পারা।
(২) আপনার জীবনের সব থেকে বড় ব্যর্থতা কী?
পি. আর. ঠাকুরঃ- কংগ্রেসের চক্রান্ত – ষড়যন্ত্র বুঝতে না পেরে যোগেন মন্ডলের বিরোধিতা করা।
আমি আরও একটি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পি. আর. ঠাকুর অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন এবং নিজের থেকে বলেন,- যে কংগ্রেস আমি করতাম সেই কংগ্রেস আমাদের ছিলনা, আমি পরে বুঝেছি। বাংলার এখন যে বামপন্থী এটাও আমাদের নয়। আমাদের সমাজের যারা বামপন্থী করছে তারা পরে বুঝবে ওটাও আমাদের নয়।
    এখনকার মতো মোবাইল বা রেকর্ডের সুযোগ থাকলে সমস্ত কিছু রেকর্ড করে রাখতে  পারতাম। আমার সঙ্গে পি. আর. ঠাকুরের যে বাক্যালাপ হয়েছিল তাহা চরমভাবে সত্য, তা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক। ভারতবর্ষের বর্তমান পতিস্থিতিতে আমার উপলব্ধি, ব্রাহ্মণ্যবাদী কোন রাজনৈতিক দল এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীর পৃষ্ঠপোষকতায় কোন তপশিলী জাতির নামে কোনো রাজনৈতিক দল কোনোটাই আমাদের মঙ্গলের জন্য নয়।   

     যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মৃত্যু নিয়েও রয়েছে নানারকম সন্দেহ। আর এই সন্দেহটা অবাস্তব নয়। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে নির্বাচনে হারাবার জন্য ১৯৬৮ সালে তাঁরই হাতে গড়া অপূর্বলালা মজুমদারই হন বাগদার তপশিলী বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁরই বিরোধী প্রার্থী ফরওয়ার্ড ব্লকের। পরিকল্পিতভাবে ১৯৬৮ সালের ৫ই অক্টোবর যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের উপর আক্রমন, খাদ্য পরিবেষণ। শেষ পরিণতি  ১৯৬৮ সালের ৫ই অক্টোবরের বনগাঁ বোর্ডের পুলে অসুস্থ হয়ে পড়া এবং শেষ পরিণাম মৃত্যু। তপশিলী সমাজেরও মৃত্যু ঘন্টা বেজে গেল।  
                                 _______________________
সহায়ক তথ্য গ্রন্থঃ- ১) মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ। লেখক – জগদীশচন্দ্র মন্ডল ২) বঞ্চিত জনতার মুক্তি যোদ্ধা ড. আম্বেদকর। লেখক- রঞ্জিত কুমার সিকদার। 

  

0 comments:

Post a Comment