সিন্ধু থেকে হিন্দু, না হিন্দু থেকে সিন্ধু
মূল লেখক- ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সিং।
(হিন্দি বই -ইতিহাস কা মুয়ায়না)
অনুবাদক- জগদীশচন্দ্র রায়
(বাংলা বই- ইতিহাসের দর্পণ)
ইতিহাসের পাতায় পড়ানো হয়, সিন্ধু থেকে হিন্দু
হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আমার লেখা বিষয়ঃ হিন্দু (HINDU)-তে পাবেন।https://roymulnivasi.blogspot.com/2014/07/hindu.html
আসুন তাহলে দেখে নিই আন্তর্জাতিক
ভাষাবিদ কী লিখেছেন।
ভারতে মূলনিবাসীদের আন্দোলনের প্রাচীন স্রোতধারা হচ্ছে ভাষাগত ধারনা। এই ধরনের বিজ্ঞান সম্মত ও সঠিক তথ্যের উপর নির্ভর করা ধারনাকে আর্যবাদী ঐতিহাসিক, ভাষাতত্ত্ববিদ এবং পুরাতত্ত্ববিদরা এই জন্যই একে তছ-নছ করছে, তাকি মূলনিবাসীদের অস্তিত্ত্বের স্বীকৃতি মূল থেকে নষ্ট হয়ে যায়। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশুরী।
বৈদিক যুগ চকাচোধ কা মারা।
ক্যা জানে ইতিহাস বেচারা?
বৈদিক যুগ চকচক করছে।
বাস্তবতা সম্পর্কে কী জানে ‘ইতিহাস’ বেচারা।।
আমরা বৈদিক যুগের ইতিহাসকেই চকচকে দেখতে পাই। কিন্তু বাস্তব ইতিহাস সেখানে লুপ্ত।
সুদীর্ঘকাল ধরে
অজ্ঞানতার কারাগারে বন্দি থাকা চেতনা, লক্ষবার
বোঝানোর পরও জাগরণের দৃষ্টিকোণ উন্মিলিত
হচ্ছে না যে, বেদের উত্থান ঘটেছে বৌদ্ধ
ধম্মের আবির্ভাবের পর।
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ওয়েবলেন (Veblen) ১৯ শতকের শেষ দিকে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Theory of Leisure classes” এর প্রথম প্রাগ্রাফে ভারতকে “ব্রাহ্মণ ভারত” বলে উল্লেখ করেছেন।
“সিন্ধু” সংস্কৃত শব্দ আর সংস্কৃত, সংস্কার করা ভাষা। আপনি বলুন সংস্কৃতে “সিন্ধু” শব্দের জন্য কোন শব্দের সংস্কার করা হয়েছে? এর স্পষ্ট উত্তর হচ্ছে, সংস্কৃতে “হিন্দু” শব্দের সংস্কার করে “সিন্ধু” বানানো হয়েছে।
ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজের প্রমাণের আধারে বলা যায়, “হিন্দু” হচ্ছে প্রাচীন শব্দ। “সিন্ধু” প্রাচীন শব্দ নয়। হিন্দুর প্রাচীনতম উল্লেখ খৃষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগের পারস্য রাজা দারা মহানের ঐতিহাসিক দলিলে পাওয়া যায়। কিন্তু “সিন্ধু” শব্দ প্রাচীন দলিলের মাথা থেকেই লুপ্ত হয়েগেছে।
অবশেষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, হিন্দুর সংস্কারিত বা মার্জিত রূপ সংস্কৃতে সিন্ধু। সেই জন্য হিন্দু থেকে সিন্ধুর বিকাশ হয়েছে। সিন্ধু থেকে হিন্দুর বিকাশ হয়নি। আপনারা উল্টা পড়বেন না। পড়াবেন না।
ঋকবেদের প্রধান নদী সিন্ধু। এই গ্রন্থে এই নদীর বার বার উল্লেখ আছে।
ঋকবেদকে প্রাচীন বলার জন্যই বলা হয় সিন্ধু থেকে হিন্দুর বিকাশ হয়েছে।
যদি কেউ বলে যে, হিন্দু থেকে সিন্ধুর বিকাশ হয়েছে; তাহলে তো ঋকবেদ অনেক পরের প্রমাণিত হয়ে যাবে। সেজন্য বেদবাদী লোকেরা এই কথার বিরোধিতা করে।
ড. বচ্চন সিংহ লিখেছেন যে, আশ্চর্যের কিছু নেই, আর্যরা হিন্দুকে সিন্ধু করে দিয়েছে।
আশ্চর্য এ জন্যও নয় যে, ‘সিন্ধু’ গুপ্তযুগের পূর্বে কোনো শিলালিপির রেকর্ডে পাওয়াই যায় না।
এখন আপনি ঋকবেদের সময় ঠিক করে নিন।
আর্য
ভাষার ১৫০০
বছরের ইতিহাসে পালি, প্রাকৃত
এবং অপভ্রংশ সংস্কৃতের তৎসম শব্দে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। যদিও আধুনিক আর্য ভাষাতে সংস্কৃতের তৎসম শব্দ প্রচুর পরিণামে পাওয়া যায়।
যদি আপনার
ভাষার ইতিহাস সঠিক হয়, তবে সংস্কৃত শব্দগুলি বেশিরভাগ
পালিতে,
তার থেকে কম প্রাকৃতে, তার থেকে কম
অপভ্রংশে এবং সব থেকে কম আধুনিক ভাষায় হওয়া উচিত ছিল।
‘হিনহু’ থেকে ‘হিন্দু’ আর হিন্দু
থেকে ‘সিন্ধু’র বিকাশ হয়েছে।
সাধারণত উন্নয়ন হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষেত্রে-এমনকি ভাষার
ক্ষেত্রেও। প্রাণী জগতের মতোই ধীরে ধীরে বিবর্তন হয়েছে- এককোষী
(প্রোটোজোয়া বা অ্যামিবা) সাধারণ কোষ থেকে বহুকোষী জীবে।
ডারউইনের তত্ব নিয়ে ভাষা চলবে, না কি কলিযুগের তত্ত্বকে নিয়ে চলবে? ভাষাবিদরা
কলিযুগের তত্ত্বে আটকে পড়ে বলেছেন যে
সত্যযুগের মতো সংস্কৃত উত্তম এবং
কলিযুগের মতো অপভ্রংশও কলুষিত, তাই তার পতন হয়েছে। সারা বিশ্বে
ভাষা এগিয়ে চলেছে, কিন্তু জানি না
কীভাবে ভারতে সংস্কৃতের পর অবক্ষয়িত (অপভ্রংশ)
ভাষার যুগ এল? অপভ্রংশ হল ধর্মক্ষেত্রের শব্দাবলী আর সংস্কৃতকে একটি প্রাচীন ভাষা হিসেবে প্রমাণ করার জন্য এটা একটা
হাতিয়ার। অপভ্রংশের প্রথম ব্যবহারকারী হলেন পতঞ্জলির মতো মানুষ। তাই হিন্দুকে সিন্ধুর অপভ্রংশ বলা হচ্ছে উল্টো পথে।
সোজা পথ হচ্ছে ‘হিন্দু’র বিকাশ হচ্ছে
সিন্ধু। এটি ধ্বনিতত্ত্ব (ফোনেটিক্স)
থেকে বোঝা যায়। মানুষের বাকযন্ত্র সুদীর্ঘকাল পরে ধ্বনির সঠিক উচ্চারণ করার জন্য অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ধ্বনির সঠিক উচ্চারণের জন্য জিহ্বা
হয়তো হাজার বছর ধরে সঠিক স্থানকে (তালু, মুর্ধা ইত্যাদি) স্পর্শ
করার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছে।
“স” (সিন্ধু)
শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত জিহ্বা দ্বারা উচ্চারিত হতে পারে, যেখানে
“হ” (হিন্দু)
উচ্চারণে জিহ্বার প্রয়োজন নেই। “হ” সরল ধ্বনি। সেজন্য পুরানো
ভাবনা বাচক শব্দে প্রায়ই “হ” থাকে। যেমন- আহ, ওহ, আহা, হাই, হা-হা, হু
ইত্যাদি। যদি জিহ্বার প্রশিক্ষণকে শব্দ বিকাশের ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তবে
প্রাকৃত শব্দ হিনহু থেকে
হিন্দু এবং হিন্দু থেকে সিন্ধুতে বিবর্তিত হবে।
এটি শিশুদের
মধ্যে শব্দ বিকাশের প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যায়। শিশুরা প্রথমে সহজ শব্দ এবং পরে
জটিল শব্দ শেখে।
শিশুদের
প্রথমে ঠোঁট দিয়ে বলা শব্দগুলো
শেখানো হয়। যেমন- মা, মামা, পাপা, বাবা ইত্যাদি। তাকে
ঋগ্বেদের স্তোত্র শেখালে সে বলতে পারবে না। সে ধীরে ধীরে জটিল শব্দ উচ্চারণ করতে
শিখবে। একইভাবে
আদিম সমাজের একজন মানুষ প্রথমে হিনহু কথা বলবে, তারপর সে
হিন্দু বলবে এবং তারপর সে সিন্ধু বলবে। ভাষার উৎপত্তির স্বর-তত্ত্ব ইচ্ছা মতো তৈরি হয়নি, একটা নিয়মের
মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে।
এটাকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ
থেকেও বুঝতে পারা যায়। মূল স্বরবর্ণ (অ, ই,
উ) সরল কোষযুক্ত। ক, ত, প -এর থেকে বেশি কোষযুক্ত।
ঘ, ধ, ভ বহুকোষী। ঋ, ক্ষ, জ্ঞ জটিল কোষের। ভাষায় ধ্বনির বিকাশ ঘটেছে সরল কোষ থেকে জটিল কোষে।
প্রাকৃত শব্দ হিনহু যদি জীবের বিকাশের মতো কম কোষযুক্ত হয়, তবে হিনহু তার চেয়ে বেশি কোষযুক্ত এবং সিন্ধু তার চেয়ে জটিল কোষযুক্ত শব্দ। হিনহুর পূর্বে সরল কোষীয় শব্দ থেকে থাকতেও পারে, যেটা আমরা জানি না।
‘হিন্দু’ একটি সাধারণ কোষযুক্ত শব্দ, এটাকে এভাবে
ভাবুন। ‘হিন্দু’ একটি
বহুকোষী শব্দ আর ‘সিন্ধু’
একটি জটিল কোষযুক্ত শব্দ।
কোষ হল
জীববিজ্ঞানের কোষ।
শব্দগুলো
সরল কোষ থেকে জটিল কোষে পরিভ্রমণ করেছে।
তাই হিনহু
থেকে হিন্দু এবং হিন্দু থেকে সিন্ধু বিবর্তিত হয়েছে।
‘স’-এর উচ্চারণ
শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত জিহ্বা দ্বারা করা যায়, কিন্তু ‘হ’-এর
উচ্চারণে বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না।
তাই আবেগপূর্ণ অনুভূতির শব্দে ‘হ’ প্রায়ই থাকে, যেমন
-আহ, ওহ, আহা, হা-হা, হু
ইত্যাদি।
জিহ্বাকে
যদি শব্দের বিকাশের সাক্ষী ধরা হয়, তবে ‘হিন্দ’ থেকে ‘সিন্ধ’-এর বিকাশ সম্ভব। ‘সিন্ধ’ থেকে ‘হিন্দ’ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অবশেষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, ‘হিন্দ’ থেকে ‘সিন্ধ’ গঠিত হয়েছিল। ‘সিন্ধ’ থেকে ‘হিন্দ’ সৃষ্টি হয়নি।
আপনি যদি একবার মিথ্যা বলে দেন, তাকে প্রমাণ করার জন্য অনেকবার মিথ্যা বলতে হবে।
আপনি একবার
মিথ্যা বলেছেন যে সংস্কৃত ভারতের প্রাচীনতম ভাষা। এখন এটা
প্রমাণ করার জন্য আপনি আরেকটি মিথ্যা বলছেন যে,
কোন ভাষা জটিলতা থেকে সরলতার দিকে যায়। কারণ সংস্কৃত একটি জটিল ভাষা এবং আপনি
বলেছেন যে এটি প্রাচীনতম ভাষা।
প্রাচীনকালের
সমাজ ছিল সরল আর সরল সমাজের ভাষা সরল হয়। মহাশয়, আপনিতো
প্রাচীনকালের সরল সমাজের ভাষাকে জটিল বলে বর্ণনা করছেন।
0 comments:
Post a Comment