Monday 13 July 2020

// // Leave a Comment

বাবাসাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠানো ও সাতটি ভোট পাওয়ার ইতিহাস লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়

বাবাসাহেকে সংবিধান সভায় পাঠানো ও সাতটি ভোট পাওয়ার ইতিহাস
লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়

    আমরা জানি, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও তাঁর সহযোগিদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে পৃথিবীর অস্টম আশ্চার্য হচ্ছে ১৯৪৬ সালে বাবাসাহবেকে সংবিধান প্রেরণের ইতিহাস। যেখানে কম করে পাঁচটি ভোটের প্রয়োজন ছিল আর হাতে মাত্র একটি ভোট ছিল সেখানে বাবাসাবে কীভাবে  সাতটি ভোট পান সেই ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের ‘মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ (দ্বিতীয় খণ্ড) পৃ. ৪২ থেকে আমরা জানতে পারি ড. আম্বেদকরকে যাঁরা ভোট দেন তাঁর হলেন-
 ১.  যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল; এম এল এ (বাখরগঞ্জ দক্ষিণ-পশ্চিম)
 ২. দ্বারিকনাথ বারুরী; এম এস এ (ফরিদপুর)
 ৩. গয়ানাথ বিশ্বাস; এম এল এ ময়মন সিংহ পশ্চিম)
 ৪. নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস; এম এল এ (রংপুর)
 ৫. ক্ষেত্রনাথ সিংহ; এম এস এ (রংপুর) উভয় রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত।
 ৬. মুকুন্দ বিহারী মল্লিক; এম এস এ (খুলনা)
 সপ্তম জনের নাম পাই চুনীলালা বিশ্বাস এর লেখা বই ‘দলিত জনের সামাজিক ইতিহাস’ বইতে। তিনি হলেন বীর বিরসা; এম এস এ (মুর্শিদাবাদ)।

     প্রথমেই এই সপ্তম ভোট দাতার সম্পর্কে জেনে নিতে চাই। কিন্তু তার আগে আমরা দেখতে চাই শ্রদ্ধেয় জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল কেন সপ্তম জনের নাম উল্লেখ করেনি।
জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল তাঁর বই ‘মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ও বাবা সাহবে আম্বেদকর’ -এর ১১৮/১১৯ পাতায় ‘কিছু কথা’ বিষয়ে লিখেছেন, ‘দিল্লী নিবাসী শ্রীচুনীলাল বিশ্বাস মহাশয়ের “ডঃ আম্বেদকরের অসামান্য বিজয়” এই শিরোনামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধকার লিখেছেন- “ঘটনাকাল ১৯৪৬ সালের জুন-জুলাই মাস। এ ইতিহাসের অনেক পার্শচরের মধ্যে আমার নিজেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে প্রবন্ধটি উত্তমপুরুষে লেখা হল”
   “সে সময় আমি ছিলাম নিখিলবঙ্গ তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারী তথা অখিল ভারত তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। পরবর্তীকালে বিখ্যাত স্পিকার শ্রীঅপূর্বলাল মজুমদার ছিলেন নিখিলবঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। (পৃষ্ঠা-৭৭)

    “নাগপুর অখিল ভারত তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের (দ্বিতীয় বার্ষিক) অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২৫, ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৬। উক্ত অধিবেশনের সংবাদ জাগরণ পত্রিকা ৪র্থ বর্ষ, ২০ ও ২১ সংখ্যা। ৪ঠা মাঘ, শনিবার, ১৩৫৩ সাল, ইংরাজী ১৮ জানুয়ারী ১৯৪৭। প্রকাশ পায় শ্রীচুনীলাল বিশ্বাস, অখিল ভারত তপশীলী ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। উক্ত সম্মেলন উপলক্ষে যে পুস্তক প্রকাশি হয়, (১৯৪৭) তাতে চুনীলাল বিশ্বাসকে প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক বলে উল্লেখ করা হয়, কোথাও প্রেসিডেন্ট বলে উল্লেখ নাই। কাজেই চুনীলাল বিশ্বাস নিজে-নিজেকে স্ব-ঘোষিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে উল্লেখ করায়, আমরা বিস্মিত হলাম।
   “ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ,” গ্রন্থের ১৭৬ পৃষ্ঠায় জগদীশচন্দ্র লিখেছেন, “তাঁহাকে (ডঃ আম্বেদকর) যে সকল এম. এল. এ. ভোট দিয়েছিলেন। গ্রন্থকার মাত্র ছয়টি ভোটদাতার নামের উল্লেখ করেছন। অথচ আমরা জানি ডঃ আম্বেদকর সাতটি প্রথম ভোট পেয়ে, প্রথম স্থানাধিকারীর গৌরব অর্জন করেছিলেন।------ সপ্তম ভোটদাতার নাম শ্রীবীরশা। ইনি ছিলেন কংগ্রেস দ্বারা মনোনীত এবং মুর্শিদাবাদ থেকে নির্বাচিত তপশীলী সদস্য। ভোটদানের ৩০ মিনিট পূর্বেও তাঁকে কেউ আমরা জানতাম না। (পৃ. ৭৯-৮০)
  “Assembly Proceedings, Official Report. Vol. LXX. 1946. Alphabetical List  of Members এবং The Indian year ‘Book & who’s. 1947. এর Page-91 Bengal Legislative Assembly- যে নির্বাচিত সদস্যদের তালিকা দেওয়া আছে, তাতে কোথাও শ্রীবীরশা এক নামটির উল্লেখ নাই।’

    উপরে জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল তাঁর বইতে যে কথা লিখেছেন, সে সম্পর্কে আমরা জানলাম। তাঁর শেষ বক্তব্য হচ্ছে, “শ্রীবীরশা এই নামটির উল্লেখ নাই।”
   পাঠকদের অনুরোধ করছি, জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের উল্লেখিত সুত্র The Indian year ‘Book & who’s. 1947. এর Page-91 Bengal Legislative Assembly. আপনারা google এ গিয়ে search করুন। আর ৯১ পাতায় গিয়ে একটু খুঁজে দেখুন; পাতাটির মাঝা মাঝিতে ডান দিকে আছে – Bir Birsha.
https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.11657/page/n137/mode/2up

   যেকোনো কারণেই হোক, জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের কাছে বিষয়টি ছুটে গেছে। আমি তাঁকে কোনো দোষ দিচ্ছি না। এই বিষয়ে আমাকে জানার জন্য সহযোগিতা করেছেন শ্রদ্ধেয় কানাই লাল বিশ্বাস (মুম্বাই)।

    তাহলে আমরা সপ্তম ভোটদাতা সম্পর্কে জানলাম। কিন্তু আমি এখানে থামতে চাই না। বীর  বীরশার বিষয় নিয়ে চুনীলাল বিশ্বাস তাঁর বইতে কী লিখেছেন সে বিষয়ে এবং চুনীলালের কী অবদান ছিল সে বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক- “আজকে যা লিখতে বসেছি তাহা ঠিক যেমন কোন প্রবন্ধ নহে, তেমনি কোন কাহিনীও নয়। ইহা ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। ইহা বাস্তবিক পক্ষে একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ, যদিও ইহা কোন রাজা বা রাজ্যের ইতিহাস নয়। ইহার নায়ক হচ্ছেন ড. ভীমরাও আম্বেদকর। ঘটনা কাল হল ১৯৪৬ সালের জুন-জুলাই মাস। এই ইতিহাসের অনেক পার্শ্বচরের মধ্যে আমার নিজেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে ইহা উত্তম পুরুষে লিখিত হল। তৎকালে আমি ছিলাম নিখিল বঙ্গ তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারী তথা অখিল ভারত তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। পরবর্তী কালের বিখ্যাত স্পীকার শ্রীঅপূর্বলাল মজুমদার ছিলেন নিখিল বঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট।
     “দুইটি কারণে আজকের লেখাটি লিখতে বসেছি। প্রথমত বাবাসাহেবের জন্মশতবার্ষিকীতে  তাঁহার জীবনের যে অধ্যায়টি লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে বা ঠিকমত ভাবে প্রকাশিত হয়  নাই, সে বিষয়ে আলোকপাত করা।

    “দ্বিতীয়ত প্রাধিকারী জীবনীকার শ্রীধনঞ্জয় কীর তাঁহার গ্রন্থ Dr. Ambedkar Life and Mission, পৃ. ৩৮২ তে এই অসামান্য বিজয়কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মত বিবৃত করে জনসাধারণের মধ্যে যে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করেছেন তাহা দূর করা। শ্রীকীরের মতে, “Dr. Ambedkar had no men in the Bombay Assembly to support his candidature, and so his name was put up through the Scheduled Castes representation in Bengal Assembly. These with the backing of Muslim League, he was elected to the Constituent Assembly.” এই মন্তব্য যে কতখানি ভ্রান্তিপূর্ণ তাহা একটু পরেই বিশ্লেষণ করে দেখানো হচ্ছে।

    “ইহা ছাড়া মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ -প্রথম খণ্ডের লেখক শ্রীজগদীশচন্দ্র মণ্ডল তাঁর গ্রন্থে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচনের জন্য ড. আম্বেদকরের বেঙ্গল লেজিস্‌সেটিভ কাউন্সিলের তফসিলী সদস্যদের দ্বারা নির্বাচন বিষয়টি বিশদভাবে লিখেছেন বটে, অনেক বিষয়ে অজ্ঞতার  পরিচয় দিয়েছেন। এ বিষয়ে আলোচনা করে প্রকৃত ইতিহাস লেখার দরকার আছে বলে মনে করি।

   “শ্রীধনঞ্জয় কীর মহাশয় লিখবার সময় বোধহয় ভুলে গিয়ে ছিলেন যে কেবল বোম্বাই-এর লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলই নয়- সারা ভারতবর্ষের কোনও লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিল থেকে যাতে ড. আম্বেদকর সংবিধান সভার সদস্য না হতে পারেন সে বিষয়ে কংগ্রেস অত্যন্ত বেশি সতর্ক ছিল। দেখা গেল কংগ্রেস সামান্য ব্যতিক্রম কেবলমাত্র বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিল ছাড়া ভারতের অবশিষ্ট সমস্ত লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচনী দ্বারাই ড. আম্বেদকরের বিরুদ্ধে অতি  নিপুন কঠোরতার সহিত রুদ্ধ করে দিয়েছে। সেই সব আইন পরিষদ থেকে নির্বাচিত হবার কোনও সম্ভাবনা নাই। দেখতে পেয়ে, অবশেষে তাঁহার সব আশার বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের দিকে ড. আম্বেদকর অগ্রসর হলেন। তাঁহার আশা  ছিল বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের ইয়োরোপীয় সদস্যদের ভোট তিনি পাবেন এবং তৎসহ বঙ্গীয় তফসিলী ফেডারেশনের একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ভোটটি পেয়ে সহজেই তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন। এই সম্ভাবনার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করবার জন্য ড. আম্বেদকর জুন মাসের শেষ দিকে কলিকাতায় আসিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিলের ইয়োরোপীয় সদস্যগণ ইতিমধ্যে স্থির করিয়া বসিলেন যে তাঁহারা সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচনে কোন অংশ যেমন গ্রহন করবেন না তেমনি কাউকে ভোটও দিবেন না। ড. আম্বেদকর তাঁর আশার শেষ দীপশিখাটিকে এইভাবে নির্বাপিত হতে দেখে অতিশয় হতাশা কাতর হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করিলেন।  
    “এই ভাবে নিরাশ হয়ে বাবাসাহেব ফিরে গেলেও নিরাশ হলনা কিন্তু বঙ্গীয় তফসিলী ফেডারেশন তথা নিখিল বঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের কর্মকর্তা ও কর্মীরা। তাঁহারা প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিলেন যে যেমন করেই হোক না কেন ড. আম্বেদকরকে বেঙ্গল কাউন্সিল থেকে সংবিধান  সভার সদস্য নির্বাচিত করাবেনই করাবেন।

   “শ্রী ধনঞ্জয় কীর মহাশয় লিখেছন যে মুসলিম লীগের সাহায্য (with baking of Muslim League) ড. আম্বেদকর বেঙ্গল থেকে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাহা কতদূর সত্য? বর্তমান কালের লেখকদের জানা না থাকলেও তখনকার দিনের লেখকদের একথা অবশ্যই জানা ছিল যে সে সময় দুই প্রকার নির্বাচনী প্রথার প্রচলন ছিল। কথা (১) মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন, তথা অবশিষ্টদের জন্য; (২) যুগ্ম-নির্বাচন প্রথা চালু ছিল। মুসলমানেরা কেবল মাত্র মুসলমানকে সদস্য নির্বাচনের জন্যই ভোট দিতে পারত, হিন্দু তফসিলী বা অপরাপর ধর্মের লোকদের ভোট দিতে পারতো না। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে ড. আম্বেদকর মুসলমান বা মুসলিম লীগের ভোটে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন নাই। মুসলিম লীগের সাহায্য বলতে যদি তিনি তাদের moral support অর্থাৎ নৈতিক সমর্থন ও সহানুভূতির কথা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলেও বলতে হবে যে কেবলমাত্র নৈতিক সমর্থন বা মৌখিক সহানুভূতির দ্বারা কাহাকেও নির্বাচিত করা যায় না। শুধু কথায় চিড়া ভিজান যায় কি? শ্রীধনঞ্জয় কীরের মত একজন প্রাধিকারী জীবনীকারের পক্ষে এই প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী মন্তব্য অবশ্যই নিন্দনীয়। তাহলে বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর সর্বাপেক্ষা বেশি প্রথম (ভোট ৭) ভোট (First preference vote) সাতটি পেয়ে বেঙ্গল থেকে কীভাবে সংবিধান সভায় সদস্য নির্বাচিত হলেন? সেই কথা বলব বলে আজ ঘটনার  চুয়াল্লিষ বৎসর পরে কালি-কলম নিয়ে বসেছি সাতের দশকে বয়স হওয়া সত্ত্বেও।

   “ছাত্র আন্দোলন যে যুগান্তর ঘটাতে পারে সে কথা আজ কাহারও অবিশ্বাস করবার উপায় নাই। ------চল্লিশের দশকে নিখিল বঙ্গ তফসিলী ছাত্র ফেডারেশন তখনকার দিনে বাংলা তথা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এক প্রমুখ ভূমিকা গ্রহণ করে ছিল। সে সময় আমি নিখিল বঙ্গ তফসিলী  ছাত্র ফেডারেশনের যেমন ছিলাম জেনারেল সেক্রেটারী তেমনি ছিলাম নিখিল ভারত তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। আমাকে বিভিন্ন সময়ে হিল্লী-দিল্লি করতে হয়েছিল।

    “মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ গ্রন্থের ১৭৬ পৃষ্ঠায় জগদীশচন্দ্র ---- মাত্র ছয়টি ভোটদাতার নামের উল্লেখ করিয়াছিলেন। অথচ আমরা জানি ড. আম্বেদকর সাতটি প্রথম ভোট পেয়ে প্রথম স্থানাধিকারীর গৌরব পেয়েছিলেন। ---- আমি এই সপ্তম ভোট দাতার নাম জানাচ্ছি। তিনি হলেন শ্রীবীরশা। ইনি কংগ্রেসের দ্বারা মনোনীত এবং মুর্শিদাবাদ থেকে তফসিলী সদস্য। ভোট দানের  ৩০ (তিরিশ) মিনিট পূর্বেও তাঁহাকে কেহই আমরা জানিতামও না চিনিতামও না। সেই কারণে পূর্বে তাঁহার সহিত যোগাযোগ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই।

    “১৯৪৬ সালের ১৮ই জুলাই প্রাতঃ (৯-৩০) সাড়ে নয়টা পর্যন্ত শ্রীবীরশাকে চেনা তো দূরের   কথা তাঁর নামটা পর্যন্ত আমরা কেহই জানিতাম না। সে দিন নিখিল বঙ্গ তফসিলী ছাত্র ফেডারেশনের অনেক কর্মী সহ আমি ও অপূর্বলাল সদলবলে বেঙ্গল লেজিস্‌লেটিভ কাউন্সিল  ভবনের প্রাঙ্গনে, করিডরে বা আশেপাশে উপস্থিত। ভোট গ্রহণ শুরু হবে বেলা দশটায় কাউন্সিল ভবনের একটি করিডরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। তখন সাড়ে নয়টা বাজে। এমন সময় অতি সাধারণ জামা কাপড় পরিহিত নিরীহ গোছের এক ব্যক্তিকে দেখলাম সদস্যদের হাজিরা রেজিস্টারে নাম সই করতে। তড়িৎ তাঁহার সামনে উপস্থিত হয়ে ভাববাচ্যে জানতে চাইলাম তিনি হরিজন কিনা। তিনি হরিজন একথা স্বীকার করায় আমি অতি সংক্ষেপে কিন্তু অত্যন্ত দরদভরা আন্তরিকতার  সুরে তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম ড. আম্বেদকরকে তাঁহার প্রথম ভোটটি দিতে। তিনি, আমি, আমরা এবং ড. আম্বেদকর যে একই অস্পৃশ্য জাতির এবং আমাদের উদ্ধারের জন্যই যে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচন করে তাঁহাকে পাঠান একান্ত প্রয়োজন এই সব কথা অতি আন্তরিকতার সুরে শ্রীবীরশাকে বুঝাইয়া দিলাম। তাঁহার সহিত কথা বলার সময় আমাদের একান্ত নৈকট্য ও একাত্মতা স্থাপনের জন্য অতি আপন সম্মোধন তুমি, তোমরা তোমাকে ইত্যাদি ব্যবহার  করেছিলাম। কাউন্সিল হলে তাঁহার প্রবেশ করবার মুখেই আমাদের এইরূপ আন্তরিকতাপূর্ণ দরদী সুরের আবেদনে তিনি এতই প্রভাবিত হয়ে পড়লেন যে তৎক্ষণাৎ তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি তাঁহার প্রথম ভোটটি অবশ্যই ড. আম্বেদকরকে দিবেন। তিনি তাঁহার প্রতিশ্রুতি  মতই ভোট দিয়েছিলেন। ইহাই হইল ড. আম্বেদকরকে দেওয়া সপ্তম প্রথম ভোটের ইতিহাস।” (‘দলিত জনের সামাজিক ইতিহাস’ বিষয়- স্মৃতিচারণ ড. আম্বেদকরের অসামান্য বিজয় তথ্য  পৃ.৬৩-৬৮) http://www.mediafire.com/file/rweo0pm3d7wh5w1/দলিত_জনের_সামাজিক_ইতিহাস_-চুনীলাল_বিশ্বাস.PDF  

    আমরা বাবাসাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠানোর সপ্তম ভোট প্রাপ্তি সম্পর্কে জানলাম। যেটা নিয়ে বিভিন্ন সংশয় ছিল। 
Read More

Thursday 9 July 2020

// // Leave a Comment

“বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা হলে বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।” – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি


   
  “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা  হলে বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।” – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি

( লেখক – আমিনুল ইসলাম। ঢেকুয়া, মেদিনীপুর। প্রকাশ- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১.০৮.২০০০; বৃহষ্পতিবার।)

    শ্যামাপ্রসাদ সম্বন্ধে একপেশে চিঠিগুলি পড়ে (২/৮) কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি।  চিঠিগুলির মূল বক্তব্য হলঃ পাকিস্তানের হিংস্র কবল থেকে সমগ্র বাংলাকে বাঁচাতে ও হিন্দুদের  নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগের দাবি জানাতে বাধ্য হন। এটাই যদি বাংলা ভাগের কারণ হয় তা হলে ভারতের সীমানার মধ্যেও তো অখণ্ড বাংলা গড়তে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর অনুগামীরা। কেনই বা তাঁরা ভারতের মধ্যকার অখণ্ড বাংলারও বিভাজন চেয়েছিলেন? উত্তরটা জলের মতো পরিষ্কার- ভারতের মধ্যে থাকলেও মুসলিম প্রাধান্যযুক্ত অখণ্ড বাংলায় পূর্বের মতো হিন্দুদের আর একাধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই দেখা যায় ১৯৪৭ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির ঘোষণার দু’দিন পরেই শ্যামাপ্রসাদ বাংলার ছোটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করলেন যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলে সাম্প্রদায়ক ভিত্তিতে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে। বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। (অমৃতবাজার পত্রিকা ২৪/২/১৯৪৭)। তখনকার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি কৃপালনী এই দাবি সমর্থন করলে শ্যামাপ্রসাদ বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন শুরু করলেন।

     ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন পরিকল্পনা ঘোষণা করলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে আরও জোরদার করলেন। তাঁরা বক্তৃতা দিয়ে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে বোঝাতে লাগলেন যে, হিন্দুরা বিপন্ন, বাংলা ভাগ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বাংলা পাকিস্তানে গেলে তো বটেই, স্বাধীন সার্বোভৌম হলেও, এমনকী ভারতে থাকলেও হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। সেই মতো তাঁরা বাংলার হিন্দুদের প্রভাবিত করতে লাগলেন। জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও প্রভাবিত হতে লাগলেন।

   এর পূর্বে সুরাবর্দি বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাব বাঙালির আত্মহত্যারই শামিল। বাঙালির উচিত হবে এক অখণ্ড ও অবিভক্ত, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলা গঠন। লিগের সম্পাদক আবুল হাশিম চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’- এর কথা উল্লেখ করে বলেন, “Let the Hindus and Muslims agree to C R Das’s formula of 50:50 enjoyment of political power and economic privileges, I appeal to the youths of Bengal in the name of her past traditions and glorious future to unite.” মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭- এর ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান-বিযুক্ত অখণ্ড বাংলার সম্বন্ধে জিন্নার বক্তব্য জানতে চাইলে জিন্না বললেন, I should be delighted. What is the use of Bengal without Calcutta? They had much better remained united and independent. I am sure that they would be on friendly terms with us. “অখণ্ড বাংলার প্রশ্নে শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ নেতারা সুরাবর্দি, হাশিম প্রমুখ নেতার সঙ্গে অখণ্ড বাংলার জন্যে ৬ দফা সূত্রের মধ্যে  সাম্প্রদায়িকতার ভুত খুঁজে পেলেন এবং এর তীব্র সমালোচনা করে বললেন, ‘Sovereign Bengal is a sugar-coated alternative to Pakistan.’

    ১৯০৫ সালে যাঁরা কার্জন পরিকল্পিত বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন, মাত্র ৪২ বছরের ব্যবধানে সেই শ্রেণীর মানুষেরা বাংলা ভাগের আন্দোলন শুরু করেন। তবে দু-একজন মুসলিম নেতা ১৯৪৭-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন   কারণ তাতে তাঁদের প্রভাবের ক্ষেত্র কমে যাবে। কিন্তু দু’একজন বাদে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা একজোট হয়ে বাংলার প্রায় সব হিন্দু নেতা বঙ্গভঙ্গের জন্য লাগাতার আন্দোলন করেছেন। কারণ ১৯৪৭ সালে বাংলার রাজনীতিতে মুললমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা অখণ্ড থাকলে সেখানে হিন্দুদের প্রাধান্যের কোনও রকম সম্ভাবনা নেই। তাঁরা বুঝেছিলেন সে অখণ্ড বাংলা যদি ভারতের মধ্যেও থাকে, তা হলেও সেখানে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে। মন্ত্রিসভার প্রধান একজন মুসলমানই হবেন। এ বিষয়টা হিন্দু নেতাদের একেবারেই অপছন্দ ছিল। তাই ‘হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায়’ বদ্ধপরিকর থাকতে শ্যামাপ্রসাদ ও অন্যান্য হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের দৃঢ় সমর্থক হয়ে পড়েন এবং অখণ্ড বাংলা মেনে নিতে পারেননি।

     জয়া চ্যাটার্জি তাঁর ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গ্রন্থে বাংলার জাগরণের সুফলভোগী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বাঙালির ধর্মীয় তথা ভদ্র সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ এবং বাংলাভাগের নাটকীয় কাহিনীতে এই শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা ও বহুবিস্মৃত কীর্তির ধর্মীয় চরিত্র উদ্ঘাটন করেছেন ও একই সঙ্গে এই শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থের অসংকোচ পরিপোষণার বহু দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছেন। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এই শ্রেণীরা নিজেদের সাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে ঢেকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল এবং বাংলাভাগের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

    শ্যামাপ্রসাদের হিন্দুভক্তি ছিল বর্ণহিন্দুদের জন্য, এলিট হিন্দুদের জন্য, বিত্তশালী হিন্দুদের জন্য। যুক্তবাংলার মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সমান অধিকার দেওয়ার বিষয়ে তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল। তিনি মনে করতেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই শিক্ষা, সংস্কৃতি, মেধা ও কর্মদক্ষতায় শ্রেষ্ঠ। তাই শাসন করার ও সমাজে আধিপত্য করার একমাত্র অধিকারী হচ্ছে উচ্চবর্ণের মানুষেরা। তিনি মনে করতেন, “মুসলিম প্রাধান্য বজায় থাকিবার অর্থ বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির উচ্ছেদ। ইসলামে ধর্মান্তরিত একদল নিচু জাতির হিন্দুকে (মুসলমানদের) সন্তুষ্ট করিবার জন্য সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিতে সে ক্ষেত্রে বলি দিতে হইবে।” (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পেপার্স)।

     শ্যামাপ্রসাদ ব্যক্তিগতভাবে সৎ, পণ্ডিত ও আদর্শবাদী হলেও তাঁর সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা ও বাংলাভাগের প্রশ্নে তাঁর সাম্প্রদায়িক ভূমিকা কী করে অস্বীকার করা যায়? যাঁরা শ্যামাপ্রসাদকে পশিমবঙ্গ সৃষ্টির কৃতিত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের জানা প্রয়োজন শ্যামাপ্রসাদ নিজেই পরে আক্ষেপ করেছিলেন বাংলা ভাগ করার জন্য। ১৯৫২ সালে নদিয়ার চাকদহে এক জনসভায় তিনি বলেন,      “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা হলে  বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।”
------------------

Read More