Wednesday 6 July 2016

// // Leave a Comment

আলোর দিশারী মহাত্মা ভেগাই হালদার : জীবন ও কর্ম-লেখক : দিনেশচন্দ্র জয়ধর


আলোর দিশারী মহাত্মা ভেগাই হালদার : জীবন ও কর্ম-লেখক : দিনেশচন্দ্র জয়ধর 


এইবেলা ডেস্ক : পশ্চাদপদ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর  মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী সৈনিক,  কীর্তিমান পুরুষ, নিরক্ষর হয়েও যিনি কৃতবিদ্য, সারল্যের প্রতিমূর্তি, সাধক পুরুষ, স্বদেশের সেবায় নিবেদিত দেশপ্রেমিক, শ্রী শ্রী হরিনামামৃত ধারাপ্লুত ভক্তমনীষী আলোর দিশারী মহাত্মা ভেগাই হালদার(১৮৫৩-১৯৩৩)।
আজ ২১ আষাঢ়,  মহাত্মার আবির্ভাব ও তিরোভাব দিবস। এ উপলক্ষে মহাত্মা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আগৈলঝাড়া ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমিতে প্রতিবছর দিনব্যাপী কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। আজও সকাল ৯.০০ ঘটিকায় মহাত্মার সমাধিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, ১০.০০ ঘটিকায় স্মরণ শোভাযাত্রা, ১১.০০ ঘটিকায় " আলোর দিশারী মহাত্মা ভেগাই হালদারের কর্মময় জীবন ও আদর্শ " শীর্ষক আলোচনা সভা এবং দিনব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন মহোৎসব ও নরনারায়ণ সেবা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলাস্থিত ঐতিহ্যবাহী মানসী ফুল্লশ্রী বর্তমান সুজনকাঠি গ্রামে নমঃশূদ্র পরিবারে ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে, বাংলা ১২৬০  সালের ২১ আষাঢ় মহাত্মা ভেগাই হালদার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাধু জগন্নাথ হালদার, মাতা শ্যামতারা দেবী। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল রামনাথ,  কিন্তু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে জনৈক বৃদ্ধা ভেগা নামে সম্বোধন করায় ভেগাই নামেই সুপরিচিত হয়ে উঠেন। কিশোর বয়সে ছিলেন তিনি খুবই দুরন্ত ও ডানপিটে। অসমসাহসী ও অপরিমেয় শক্তির অধিকারী ছিলেন। কিশোর বয়সেই গোয়াইল গ্রামের স্বর্গীয় নদীরাম জয়ধরের কন্যা তারামণি' র সাথে শুভ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। পারিবারিক জীবনে ভেগাই হালদারের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল। পুত্রদ্বয় অশ্বিনীকুমার ও শ্রীদাম। কন্যা সরযুবালা। ভেগাই ছিলেন ভোজনরসিক,  প্রচণ্ড শক্তিমান পুরুষ,  কাজ করতে পারতেন প্রচুর। পুত্রের কিছু অসংলগ্ন কর্মে পিতা জগন্নাথ মর্মাহত হয়ে সংসার ত্যাগ করেন আর ফিরে আসেন নি।
একদিকে পিতা নিরুদ্দেশ অন্যদিকে বর্ণভেদ প্রথার যাঁতাকলে পিষ্ট অনুন্নত শ্রেণির কথা চিন্তা করছেন এবং মুক্তির পথ খুঁজছেন তিনি। এমনি এক সময়ে মানসী ফুল্লশ্রী গ্রামে এক হরিসভায় অবিসংবাদিত জননায়ক মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের সাহচর্যে আসেন। মর্মস্পর্শী ভাষায় অভিভাষণ প্রদান করলেন,  অমৃতধারাবর্ষী বাণী শ্রবণ করে ভেগাইর হৃদয় বিগলিত হল। অন্যদিকে আরেক মানবহিতৈষী, তিক্ষ্ণধী ব্যক্তিত্ব শিক্ষাপ্রদীপ কৈলাসচন্দ্র সেন মহোদয়ের সান্নিধ্যে এসে জীবনে পরিবর্তন সূচিত হয়। নিরুদ্দেশ পিতার সন্ধানে ভেগাই বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণ শেষে ওড়াকান্দিতে শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। 
শিক্ষাপ্রদীপ কৈলাশচন্দ্র সেনের নিকট শিক্ষামন্ত্রে দীক্ষা, সত্য, প্রেম, পবিত্রতার বাণী প্রচারক ধর্মপ্রাণ অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে ভগবদ্ভক্তির উন্মেষ এবং শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নিকট মহানামমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নবজন্ম লাভ করলেন।
দেশের সেবায় সাধু ভেগাই হালদার নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ১৯০৫ সালে  বরিশালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত হন। অশ্বিনীকুমার দত্তের বাসভবনের প্রাঙ্গণে সুপ্রাচীন তমালবৃক্ষ পাদমূলে প্রস্তরবেদিকায় দুই মহাত্মা উপবেশন করে দীর্ঘক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। আগৈলঝাড়ায় একটি বিদ্যালয় স্থাপন এবং দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ভগিনী নিবেদিতার সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে সেবাব্রতে অংশগ্রহণ করেন। কৃষকবন্ধু ভেগাই হালদারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে আগৈলঝাড়ায় রায়ত কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন খান বাহাদুর হাশেম আলী খান। পরিচালনা ছিলেন বাণীকণ্ঠ সেন,  মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এই সভায় যোগদান করেছিলেন ভারতবিখ্যাত পণ্ডিত ও কংগ্রেস নেতা মদনমোহন মালব্য এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগিনেয়ী প্রখ্যাত সমাজসেবিকা সরলা দেবী। আনন্দবাজার, অমৃতবাজার প্রভৃতি পত্রিকায় ভেগাই হালদারে নাম গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়।
গ্রামে গ্রামে মুষ্টি ভিক্ষা করে অনুন্নত নমঃশুদ্র ও মুসলমান সমাজের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিস্তারে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। ১৯১৮ সালে বরিশালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা করেন। পরবর্তীকর দেশবন্ধুর কলকাতার বাসায় মহাত্মা দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা  শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সাথেও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর আনুকুল্যেই ১৯১৯ সালে আগৈলঝাড়া এম. ই. স্কুল ( মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়)স্থাপন করেছিলেন। ১৯২৬ সালে হাই ইংলিশ স্কুল ( উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়)  হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। মহাত্মা ভেগাইর অনুরোধে বিদ্যালয়ের ভূমি দান করেছিলেন  রামচরণ বাড়ৈ,  তাঁর ভ্রাতাদের বংশধরগণ এবং স্বর্গীয় দীনবন্ধু হালদার। মহাত্মা বিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের বলতেন,  " তুই কী হবি?  " কেউ কেউ উত্তর দিত - আমি ব্যারিস্টার হব, আমি ম্যাজিস্ট্রেট হব,  আমি শিক্ষক হব ইত্যাদি। ভেগাই বলতেন,  " হ্যাঁ,  আশা বড় করবি ; সব না হইলেও অর্ধেক হয়।  " মহাত্মা গ্রামে ঘুরে ঘুরে ছাত্র সংগ্রহ করতেন এবং অবহেলিত কৃষক সন্তানদের শিক্ষা অর্জনে উৎসাহ দিতেন। দরিদ্র মেধাবি ছাত্রদের বিদ্যালয়ে রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। ছাত্রদের পড়াশুনার খোঁজখবর নিতেন। মাঝেমধ্যে ছাত্রদের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন এবং অভিভাবকদের সাথে লেখা-পড়া সম্পর্কে আলোচনা করতেন। তিনি ছিলেন হরিনাম শ্রবণাকাঙ্ক্ষী পুরুষ।  কানে আঙ্গুল দিয়ে শিশুদের বলতেন,  " তোরা হরি নাম করিস না,  আমি শুনতে পারি না।  " এতে শিশুরা বেশি করে হরি নাম করত এবং তাঁর পিছনে ঘুরত। পরে সকল শিশুকে বাতাসা বিতরণ করতেন। 
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে অনুদার, অসূয়াপরায়ন,  পরশ্রীকাতর ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ, শূদ্র সম্প্রদায়ের লোকদের ষড়যন্ত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আগৈলঝাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল করে। মহাত্মা বজ্রপাত তুল্য আঘাত পেলেন। তফশিলী জাতির কর্ণধার মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানালেন। মহাপ্রাণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয় স্থায়ী মঞ্জুরী লাভ করে। যা মহাত্মা অবলোকন করতে পারেন নি।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ২১ আষাঢ় আগৈলঝাড়া বাজারে অবস্থিত গৃহেই ছিলেন মহাত্মা।  সেদিন ছিল হাটবার,  সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্তমিত প্রায়,  তখন ঘটল অভূতপূর্ব ঘটনা। মহাত্মার প্রিয় লাল বর্ণ ষাঁড় জনতার ভিতর দিয়ে প্রিয় মানুষটির শয্যার সম্মুখে স্থিরভাবে দাঁড়াল এবং দুই চোখ হতে জল নিঃসৃত হচ্ছিল। এমনি সময়ে যখন সূর্য অস্তমিত প্রায় রক্তরশ্মি দেখা যাচ্ছিল তখনই আলোর দিশারী মহাত্মা ভেগাই হালদার দুই চোখ নিমীলিত করলেন। পরবর্তী দিবসে মহাত্মার শবদেহ সুসজ্জিত করে আগৈলঝাড়া থেকে গৈলা পর্যন্ত অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে শবযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।  আকাশে-বাতাসে 'হরিবোল ' ধ্বনিতে মুখরিত  মহাত্মা ভেগাই ' আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে ' যেখানে শাশ্বত সুন্দর চির বিরাজমান,  সেখানে সচ্চিদানন্দের সান্নিধ্যে মহাপ্রয়াণ করলেন।
মহাত্মার পরলোকগমনের পরে বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি  দেশবরেণ্য নেতা মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মহোদয়ের সভাপতিত্বে বিদ্যালয় অঙ্গণে এক বিরাট শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় আগৈলঝাড়া ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমি। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল শিক্ষার্থী বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করে পুনরায় বিদ্যালয়ের স্থায়ী মঞ্জুরী আনয়ন করেন।
চিরঅবহেলিত, অনগ্রসর নমঃশূদ্র ও মুসলমান সমাজের শিক্ষার আলোকবর্তিকা জ্বালালেন যিনি,  সেই মহোত্তম পুরুষের আবির্ভাব ও তিরোভাব দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। মহাত্মার আদর্শে আলোকিত হোক মানবসমাজ।
তথ্যসূত্র :  " আলোর দিশারী মহাত্মা ভেগাই হালদার " - বিনোদবিহারী জয়ধর।
এইবেলাডটকম/এএস
http://eibela.com/article/%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE-%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%3A-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE

0 comments:

Post a Comment