পুণা-চুক্তির আসল রহস্য ও উদ্দেশ্য
জগদীশচন্দ্র
রায়
২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২, ভারতের
ইতিহাসে বঞ্চিতদের কালা দিন। এই দিনে গান্ধিজি পিছিয়ে রাখা শ্রেণির অর্জিত দ্বৈত ভোটাধিকার হরণ করে রাজনৈতিক সংরক্ষণ থোপে দেন। প্রতি বছর এই দিনটি আসে। কিন্তু এই চুক্তির ফলে
বঞ্চিতদের কতটা ক্ষতি হয়েছে, সে ইতিহাস বর্তমানে প্রায়
বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। কিন্তু এই চুক্তির ফলে যে চামচাদের জন্ম হয়েছিল, তারা
বর্তমানে আরো বেশি শক্তিশালী গোলামে পরিণত হয়েছে। আসুন এই চুক্তি সম্পর্কে কয়েকটি
কথা যেনে নেওয়া যাক।
পুনা চুক্তির পূর্ব
ইতিহাসঃ-
১৯১৬ সালে বাবাসাহেব ড.
আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের সমস্যার সমাধান করার জন্য চেষ্টা শুরু করেন। তিনি
অস্পৃশ্যদের সমস্যার প্রতি ব্রিটিশদের মানসিকতা ও দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করার জন্য
চেষ্টা করেন। যার ফল স্বরূপ মন্টেংগু চেমসফোর্ড-এর যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সে
কমিটির রিপোর্ট অস্পৃশ্যদের সমস্যার কথা স্বীকার করে। শুধু স্বীকারই করেনি, বরং
আইন পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা করার প্রতিজ্ঞাও করা হয়।
১৯১৮ সালে যখন ‘সাউথ বরো কমিশন’ ভারতে আসে তখন বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর ঐ কমিশনকে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য দাবী ও অধিকারের জন্য লিখিত মেমোরান্ডাম দেন। ঐ মেমোরান্ডামে বাবা সাহেব, ‘স্বয়ং ওদের(অস্পৃশ্য) জন্য, স্বয়ং ওদের দ্বারা এবং স্বয়ং ওদের মাধ্যমে পৃথক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব’-এর দাবী জানান। ১৯১৯ সালে প্রথম ভারতীয় আইন (First India Act) তৈরি হয়। এই Act অনুসারে অস্পৃশ্যদের নির্বাচনে নমিনেশনের অধিকার অর্জিত হয়। ভারতের ইতিহাসে দু’হাজার বছর পরে বঞ্চিতদের নমিনেশনের অধিকার মেলে।
১৯২৩ সালে ‘সেক্রেটারী অফ স্টেট’ এ ‘মুডিম্যান’ কমিটি নিযুক্ত হয়। এই কমিটির বিশেষ উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা ছিল যে, প্রয়োজনানুসারে নিয়মের পরিবর্তন করে আর আইনের কোনপ্রকার পরিবর্তন না করে ১৯১৯ এর আইনের দ্বারা স্থাপিত সংবিধানের কতদূর পর্যন্ত বিস্তার করা যেতে পারে। এই কমিটি কিছু সুপারিশ করে আর বলে যে, আইন পরিষদে অস্পৃশ্য শ্রেণির প্রতিনিধিদের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। তখন ‘সেক্রেটারী অফ স্টেট’ এই সুপারিশ মেনে অস্পৃশ্য শ্রেণির জন্য নির্বাচনে আসন সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটায়।
১৯১৮ সালে যখন ‘সাউথ বরো কমিশন’ ভারতে আসে তখন বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর ঐ কমিশনকে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য দাবী ও অধিকারের জন্য লিখিত মেমোরান্ডাম দেন। ঐ মেমোরান্ডামে বাবা সাহেব, ‘স্বয়ং ওদের(অস্পৃশ্য) জন্য, স্বয়ং ওদের দ্বারা এবং স্বয়ং ওদের মাধ্যমে পৃথক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব’-এর দাবী জানান। ১৯১৯ সালে প্রথম ভারতীয় আইন (First India Act) তৈরি হয়। এই Act অনুসারে অস্পৃশ্যদের নির্বাচনে নমিনেশনের অধিকার অর্জিত হয়। ভারতের ইতিহাসে দু’হাজার বছর পরে বঞ্চিতদের নমিনেশনের অধিকার মেলে।
১৯২৩ সালে ‘সেক্রেটারী অফ স্টেট’ এ ‘মুডিম্যান’ কমিটি নিযুক্ত হয়। এই কমিটির বিশেষ উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা ছিল যে, প্রয়োজনানুসারে নিয়মের পরিবর্তন করে আর আইনের কোনপ্রকার পরিবর্তন না করে ১৯১৯ এর আইনের দ্বারা স্থাপিত সংবিধানের কতদূর পর্যন্ত বিস্তার করা যেতে পারে। এই কমিটি কিছু সুপারিশ করে আর বলে যে, আইন পরিষদে অস্পৃশ্য শ্রেণির প্রতিনিধিদের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। তখন ‘সেক্রেটারী অফ স্টেট’ এই সুপারিশ মেনে অস্পৃশ্য শ্রেণির জন্য নির্বাচনে আসন সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটায়।
সাইমন কমিশনের বিরোধীতা
কেন করেছিল কংগ্রেস ও গান্ধীজি?
১৯১৯ সালের First India Act- এ প্রস্তাবনা ছিল যে,
দশ বছর পরে এই আইনের
সমীক্ষা করা হবে। আর তার জন্য একটা কমিটি নিযুক্ত করতে হবে। তখন ঐ কমিটি সংবিধানের
আইনের (India Act) সমীক্ষা করে যেখানে যতটুকু পরিবর্তনের
প্রয়োজন মনে করবে তার জন্য প্রস্তাব করবে। আর এই আইনের প্রস্তাবনানুসারে ১৯২৮ সালে
স্যার জন সাইমনের অধ্যক্ষতায় একটি কমিশন নিযুক্ত করা হয়। যাকে ‘সাইমন
কমিশন’ বলা হয়। সাইমন কমিশনে মিশ্র প্রতিনিধি থাকবে ভারতীয়রা এরকম
আশা করেছিল। কিন্তু ঐ সময় ‘সেক্রেটারী অফ স্টেট ইন্ডিয়া’ ছিলেন
‘লর্ড বর্কনহেড।’
তিনি কমিশনের উপর ভারতীয়
প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করেন। তখন এই কমিশনকে কেবলমাত্র “সাংসদীয়
কমিশন” হিসাবে স্থাপন করা হয়। এর ফলে কংগ্রেসের মাধ্যমে সাইমন
কমিশনের তীব্র বিরোধীতা করা হয়। আসলে কংগ্রেস ও গান্ধীজির সাইমন কমিশনের বিরোধীতার
আসল কারণ ছিল, ১৯১৯ সালের First India Act অনুসারে ব্রিটিশ লোকেরা এখানকার পিছড়ে বর্গের লোকেদের যে
অধিকার দিয়ে ছিল, তার বিস্তার না হয়ে যায়।
যদিও কমিশনের বিরোধীতার কারণ হিসাবে জানায় যে,
‘এই কমিশনে ভারতীয়দের
প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি।’ আসলে হাতির দেখানোর দাঁত
আর খাওয়ার দাঁত আলাদা হয়। কারণ, কংগ্রেস ও গান্ধীজি মনে
করলেন যে, এই কমিশন পিছড়েদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ের সমাধানের চেষ্টা
করবেন। আর যদি এই লোকদের প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হয় তাহলে তো এরা আমাদের(গান্ধীজি ও
উচ্চবর্ণীয়দের) স্বাধীনতারও ভাগীদার হয়ে যাবে। কারণ, তাদের
স্বাধীনতার আন্দোলনতো সর্ব সাধরণের জন্য নয়। সেটা শুধুমাত্র উচ্চবর্ণীয়দের জন্য।
তাই কমিশনের বিরোধীতা। সাইমন কমিশন গান্ধীজির কাছে বিরোধীতার কারণ জানতে চাইলে তখন
গান্ধীজি জানান, ‘কমিশনে ভারতীয় প্রতিনিধি
নেওয়া হয়নি বলে এর বিরোধীতা করা হচ্ছে।’
তখন কমিশন জানান, এই
কমিশন স্ট্যাটুটরী কমিশন, সরকারী কমিশন। আর আপনাদের
লোকেরা তো সরকারী নয়। তাই এই কমিশনে বেসরকারী লোকেদের গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সরকার
আপনাদের কিছু সুবিধা দিতে চায়, সেখানে আপনাদের
প্রতিনিধিদের গ্রহণ করা কি করে সম্ভব?
এদিকে বাবাসাহেব আম্বেদকর ‘সাইমন কমিশন’কে স্বাগত জানানোর ফলে দেশের প্রচার মাধ্যম গান্ধীজির কথা শুনে বাবা সাহেবকে দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করে প্রচার চালায়।
এদিকে বাবাসাহেব আম্বেদকর ‘সাইমন কমিশন’কে স্বাগত জানানোর ফলে দেশের প্রচার মাধ্যম গান্ধীজির কথা শুনে বাবা সাহেবকে দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করে প্রচার চালায়।
১৯৩১ সালে লন্ডনে গোল
টেবিল (Round Table Conference):-
যাইহোক, এই
কমিশনের প্রতি তীব্র বিরোধীতার ফলে কমিশনের সুপারিশকে কার্যকরী করার পূর্বে ভারতীয়
প্রতিনিধিদের পরামর্শ গ্রহণ করার জন্য ১৯৩০,৩১ ও ৩২ ( The first Round Table Conference convened from 12 November 1930
to 19 January 1931) সালে লন্ডনে গোল টেবিল (Round Table
Conference) এর
আয়োজন করে। গান্ধীজি(১ম বৈঠক) ছাড়া বাকি সব নিমন্ত্রিত ভারতীয় প্রতিনিধি এই বৈঠকে
যোগদান করেন। বাবা সাহেব এই বৈঠকে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি ওখানে চারটি দাবী রাখেন।
(১)পৃথকনির্বাচনক্ষেত্র।(SeparateElectorates)
(২) নিজেদের লোককে নিজেরাই প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার। (Dwell Voting)
(৩)প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার। (AdultFranchies).
(২) নিজেদের লোককে নিজেরাই প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার। (Dwell Voting)
(৩)প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার। (AdultFranchies).
(৪) দেশ আঞ্চলিক ক্ষেত্রে তথা কেন্দ্রের আইন পরিষদে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের
অধিকার (Adequate
Representation).
যদিও জনসংখ্যার অনুপাতে
পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের অধিকারের বিষয়টি কেবলমাত্র তফশিলি জাতির জন্যই ছিলনা। বরং
যত সামাজিক জাতি সমূহ ছিল তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে অধিকার পাবে একথা বাবা সাহেবের
দাবীর পিছনে ছিল। শুধু আলাদা নির্বাচন এবং দু’বার ভোট দেওয়ার অধিকার
তফশিলি জাতির জন্য বিষয় ছিল। তবে গান্ধীজি সকল প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের
বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাও বলেছিলেন যে, “যদি ইংরেজরা ভারতের স্বাধীনতা দেয়,
আর তার বদলে অর্থাৎ ভারতের
স্বাধীনতার বদলে যদি অচ্ছুৎদের অধিকার দেয় তাহলে এই ধরণের স্বাধীনতা আমি চাইনা।”
১৭ই আগস্ট ১৯৩২ সালে
সাম্প্রদায়িক প্রশ্নসমূহের রায় বা Communal
Award ঘোষণা
করা হয়। গান্ধীজির কোন ধমকীই যখন ব্রিটিশ সরকার মানতে রাজি না হন, তখন
তিনি তাঁর জীবনের প্রধান অস্ত্রকে প্রয়োগ করেন অস্পৃশ্যদের অধিকারকে ছিনিয়ে নেবার
জন্য। ২০শে সেপ্টম্বর ১৯৩২ তিনি তাঁর অনশন শুরু করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর, বাবা
সাহেব দ্বারা লড়াই ঝগড়া করে পিছড়েবর্গের জন্য অর্জিত অধিকার গান্ধীজির অনশনের
দ্বারা ছিনিয়ে নেবার যে চুক্তি পুনাতে হয়েছিল’
সেটাই পুনা চুক্তি বা পুনা
প্যাক্ট।
এই চুক্তির মহত্তপূর্ণ
কিছু শর্তঃ-
(১)
সাধারণ নির্বাচন ক্ষেত্রে অস্পৃশ্য শ্রেণির জন্য আসন সংরক্ষিত করা হবে।
(২) এই আসন গুলির জন্য নির্বাচন; যৌথ নির্বাচক মন্ডলী দ্বারা নিম্নবর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে অনুষ্ঠিত হবেঃ-
অস্পৃশ্য শ্রেণির যে সব ভোটার সাধারণ নির্বাচক মন্ডলীতে তালিকাভুক্ত হবেন তাদের দ্বারা একটি পৃথক নির্বাচক মন্ডলী গঠিত হবে। উক্ত পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর প্রত্যেককে একটি করে ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তির ক্রমানুসারে অস্পৃশ্য শ্রেণির চার (৪) জন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন। এটাকে বলা হবে অস্পৃশ্য শ্রেণির প্রাথমিক নির্বাচন। এইভাবে নির্বাচিত চার জন্য প্রার্থীর মধ্যে একজন সাধারণ নির্বাচক মন্ডলী কর্তৃক চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবেন।
(৩) প্রাথমিক নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক আইন সভার জন্য নির্যাতিত শ্রেণির প্রার্থীদের প্যানেল তৈরী করার নিয়ম দশ (১০) বছর পরে শেষ হয়ে যাবে। ..ইত্যাদি ইত্যাদি।
(২) এই আসন গুলির জন্য নির্বাচন; যৌথ নির্বাচক মন্ডলী দ্বারা নিম্নবর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে অনুষ্ঠিত হবেঃ-
অস্পৃশ্য শ্রেণির যে সব ভোটার সাধারণ নির্বাচক মন্ডলীতে তালিকাভুক্ত হবেন তাদের দ্বারা একটি পৃথক নির্বাচক মন্ডলী গঠিত হবে। উক্ত পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর প্রত্যেককে একটি করে ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তির ক্রমানুসারে অস্পৃশ্য শ্রেণির চার (৪) জন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন। এটাকে বলা হবে অস্পৃশ্য শ্রেণির প্রাথমিক নির্বাচন। এইভাবে নির্বাচিত চার জন্য প্রার্থীর মধ্যে একজন সাধারণ নির্বাচক মন্ডলী কর্তৃক চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবেন।
(৩) প্রাথমিক নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক আইন সভার জন্য নির্যাতিত শ্রেণির প্রার্থীদের প্যানেল তৈরী করার নিয়ম দশ (১০) বছর পরে শেষ হয়ে যাবে। ..ইত্যাদি ইত্যাদি।
পুণাচুক্তির এই শর্তগুলো গান্ধীজি মেনে নিয়েছিলেন এবং এগুলি ভারত শাসন আইনে বিধিবদ্ধ করে কার্যকরী করা হয়। এখন আমরা দেখছি যে, যে চারটি দাবী সাম্প্রদায়িক নির্ণয় (Communal Award) এ মেনে নিয়েছিল, যার মধ্যে সব থেকে বেশি মহত্ত্বপূর্ণ ছিল পৃথক নির্বাচন প্রনালী এবং দুবার ভোট দেওয়ার অধিকার। এছাড়া প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার এবং পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের দাবীও ছিল। প্রথম দুটি মহত্ত্বপূর্ণ দাবীকে গান্ধীজি পুণা চুক্তির মাধ্যমে শেষ করে দেন। এর পরিবর্তে যৌথ নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হয়। যৌথ নির্বাচন পদ্ধতির ফলে পৃথক নির্বাচন ক্ষেত্রের অধিকার সমাপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু পুণাচুক্তিতে একটা বিষয় মেনে নিতে বাধ্য করেন ড. আম্বেদকর। যেটা হচ্ছে দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়েছে যে, যৌথ নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে কিন্তু প্রার্থীর নির্বাচন মাত্র একবার নয় বরং দু’বার হবে। তফশিলি জাতির প্রার্থী কে হবেন সেটা কংগ্রেস ঠিক করতে পারবে না। দু’বার প্রার্থীর নির্বাচন করার পিছনে বাবা সাহেব ড. আম্বেদকরের উদ্দেশ্য ছিল যে, প্রথম বার প্রার্থীর নির্বাচন, মুখ্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রার্থী কে হবেন সেটা নির্ণয় করা। প্রথমবারের নির্বাচনে যে কেউ প্রার্থী হতে পারতেন। কিন্তু ক্রমানুসারে যে চার জন সবথেকে বেশী ভোট পাবেন তারাই মুখ্য নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হতে পারবেন। বাবা সাহেব ড. আম্বেদকর দু’বার প্রার্থীদের নির্বাচন করার পদ্ধতিকে রেখে ছিলেন। আর এই প্রার্থীদের নির্বাচনের অধিকার জনগনের হাতেই রেখে ছিলেন। শেষ নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন সেটা আমাদের লোকেরাই নির্ণয় করবেন। পুণাচুক্তি নামক যে শয়তান ছিল, সেই শয়তানকে একশ শতাংশ (১০০ শতাংশ) না হলেও ৫০% (৫০ শতাংশ) কমজোর করার চেষ্টা ড. আম্বেদকর করেছিলেন। কিন্তু যখন ভারতে সংবিধান লাগু হয়, তখন কংগ্রেসের বেশি ক্ষমতা থাকার ফলে দুবার প্রার্থী নির্বাচনের পদ্ধতিকে শেষ করে দেয়। তখন থেকে নির্বাচন কেবলমাত্র একবারই হয়, আর প্রার্থী নির্বাচনের অধিকার জনগনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পার্টি হাইকমান্ডের কাছে যায়। কংগ্রেস, বিজেপি বা বামফ্রন্ট যেকোন দলেই পার্টি হাইকমান্ডের সামনে এখন আমাদের SC, ST, OBC এর লোকেরা কুকুরের মত লেজ নাড়তে থাকে। আর এই ধরনের লোকেদেরই আমাদের সমাজের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে দাঁড় করায়। দু’বার প্রার্থী নির্বাচনের অধিকার থাকলে এটা করা সম্ভব হোত না, কিন্তু আজ স্বাধীন (?) ভারতে কংগ্রেস পার্টি এটা করে ছেড়েছে।
তুলনামূলক বিশ্লেষণঃ-
পুণা চুক্তির তুলনামূলক
বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর নিজেই বলেছেনঃ “সাধারণভাবে
এটা প্রচার করা হয়েছে যে, পুণা চুক্তির ফলস্বরূপ
অস্পৃশ্যদেরকে সাম্প্রদায়িক নির্ণয় (Communal
Award) থেকে
বেশি সিট (আসন) দেওয়া হয়েছে। এটা সত্যি যে পুণাচুক্তির ফল স্বরূপ অস্পৃশ্যদের
১৫১ (একশো একান্ন) টি-আসন দেওয়া হয়েছে,
যেখানে Communal Award এর ফল স্বরূপ তারা ৭৮ (আঠাত্তর) টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু
সাম্প্রদায়িক নির্ণয়ের চেয়েও বেশি আসন দিলেও সাম্প্রদায়িক নির্ণয়ে অস্পৃশ্যদের
যে মৌলিক অধিকার দিয়েছিল তা তারা পুণা চুক্তির ফলে হারালেন। সাম্প্রদায়িক
নির্ণয় অস্পৃশ্যদের দুটি সুযোগ দিয়েছিল।
(১) অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সংরক্ষিত আসন, যে গুলি কেবলমাত্র অস্পৃশ্য প্রতিনিধিদের দ্বারা পূর্ণ করা হবে।
(১) অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সংরক্ষিত আসন, যে গুলি কেবলমাত্র অস্পৃশ্য প্রতিনিধিদের দ্বারা পূর্ণ করা হবে।
(২)
অস্পৃশ্যদের দুটি করে ভোট-একটি করে তাদের পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর ভোট, অন্যটি সাধারণ নির্বাচক মন্ডলীর ভোট।
পুণা-চুক্তি একদিকে সংরক্ষিত আসনের কোটা বাড়িয়ে দিল, অন্যদিকে দুটি ভোটের অধিকারকে হরণ করল। আসনের বাড়তি কোটা, দুটি ভোটের অধিকারের বিকল্প হতে পারেনা। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় প্রদত্ত দ্বিতীয় ভোটটি একটি অমূল্য সম্পদ। রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে এই ভোটটির মূল্য অপরিসীম। বিভিন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যদের শক্তি (১:১০) এক থেকে দশভাগ পর্যন্ত ছিল। এই শক্তি সাধারণ নির্বাচনের ভোটের ফলাফলের নির্ণায়ক না হলেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে কোন সাধারণ আসনের প্রার্থই তার নির্বাচন ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যদের অবহেলা করতে সাহসী হতে পারত না, কারণ তাকে জিততে হলে অস্পৃশ্যদের ভোটের উপর কিছুটা নির্ভর করতে হত। চুক্তিতে অস্পৃশ্যরা কিছু আসন বেশি পেলেও ঐটুকুই যা লাভ। বাটোয়ারার রায় কার্যকরী হলে কেবলমাত্র সংরক্ষিত আসনেই নয়, সমস্ত সাধারণ আসনের প্রতিনিধিরাও তাদের প্রতিনিধিত্ব করত। তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে পুণা-চুক্তির বাড়তি আসন দুটি ভোটের বিকল্প হিসাবে গণ্য হতে পারে না।
তর্ক করার জন্য মেনে
নেওয়া যাক যে, পুণা-চুক্তির ফল স্বরূপ কিছু
আসন বেশি পাওয়া গেছে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন এটা এসে যায় যে এই অতিরিক্ত আসন কোন
উপকারে আসবে? সাধারণত ভোটাধিকার-এর
ব্যাপারে বলা হয় যে এটা রাজনৈতিক সুরক্ষার সাধন, কিন্তু
এটা বোঝা গেছে যে, অস্পৃশ্যদের বিষয়ে
কেবলমাত্র ভোট দেওয়ার অধিকারই সর্বাধিক নয়,
আশঙ্কা এটা ছিল যে, যদি
অস্পৃশ্যদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তি স্বয়ং অস্পৃশ্য না হন, তাহলে
তিনি মিথ্যা আচরণ করতে পারেন, আর এটাও হতে পারে যে, তিনি
অস্পৃশ্যদের প্রতি কোন আগ্রহই নেবেন না,
...পুণাচুক্তির
ফল স্বরূপ বেশি আসন প্রাপ্তি হয়েছে। কিন্তু সে সব আসনগুলো গোলামদের দ্বারা পূর্ণ
করা হয়েছে, যদি গোলামদের লাইন
লাগানোতে কোন লাভ হয়, তাহলে এটা বলা যেতে পারে
যে, পুণাচুক্তির ফলে লাভ হয়েছে।
কংগ্রেস, যেটা হিন্দুদের রাজনৈতিক
উপনাম। তাদের ক্ষমতা ছিল পুণাচুক্তির দ্বারা নির্ধারিত আসনের থেকে বেশি আসনের
সুবিধা অস্পৃশ্যদের দেওয়ার। সাধারণ আসনে নির্বাচনে লড়ার জন্য অস্পৃশ্য
প্রার্থীদের তারা সুযোগ করে দিতে পারত। আইনে এটা করার ক্ষেত্রেও কোন প্রতিবন্ধকতা
ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস এই ধরনের কিছুই করেনি। এতে বোঝা যায় যে, যদি
অস্পৃশ্যদের জন্য কোন আসনের সংরক্ষণ না হোত তাহলে হিন্দুরা কখনও এটা দেখার চেষ্টা
করত না যে, কোন অস্পৃশ্যকে আইন পরিষদের জন্য নির্বাচিত করা হোক।
(পরবর্তিতে বাস্তব উদাহরণঃ- গান্ধীজী এবং কংগ্রেস সংবিধান সভার নির্বাচনে একজনে
ও.বি.সি কেও প্রার্থী করেননি।)
পক্ষান্তরে যখন আসনের
সংরক্ষণ হয়, তখন হিন্দুরা সেই সংরক্ষিত
আসনের প্রভাবকে বিফল করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। আর তারা চেষ্টা করে
সংরক্ষিত আসনে এমন ধরণের অস্পৃশ্য দেওয়া হোক,
যে তাদের গোলাম হয়ে থাকতে
রাজি হবে।
রাজনৈতিক অধিকারের জন্য অস্পৃশ্যদের সংঘর্ষের দুঃখ জনক অধ্যায়ের এইভাবে অন্ত হয়। নির্দিধায় বলা যায় যে, এই সবের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী মিঃ গান্ধী। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার বিরোধিতা গান্ধীজি এই জন্য করেছিলেন যে, তাতে পৃথক নির্বাচক-মন্ডলীর ব্যবস্থা ছিল। যদি হিন্দুরা গান্ধীজির অনশন করার ফলে উদ্মাদ হয়ে না পড়ত তাহলে তারা বুঝত যে গান্ধীজির এই অনশন করা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় পৃথক নির্বাচক মন্ডলী ছাড়া সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রেরও ব্যবস্থা ছিল। অস্পৃশ্যদের দেওয়া দ্বিতীয় ভোটের প্রয়োগ, সাধারণ নির্বাচন ক্ষেত্রের উচ্চবণীয় হিন্দু প্রার্থী নির্বাচনে করা যেত। অবশ্যই এটা যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি ছিল। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা আর পুণাচুক্তির মধ্যে যে বিভেদ সেটা নির্বাচন ক্ষেত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে। দুটোর মধ্যেই সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে, দুটোর মধ্যে এটা ছিল যে, সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় পৃথক নির্বাচন ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ছিল যে উচ্চবর্ণীয় প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে অস্পৃশ্যরা তাদের উপর যেন প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু পুণা-চুক্তির যৌথ নির্বাচন ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ছিল যে, অস্পৃশ্য প্রার্থীর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিন্তু উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা যেন তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পাবে। দুটোর মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য হচ্ছে এটা।
রাজনৈতিক অধিকারের জন্য অস্পৃশ্যদের সংঘর্ষের দুঃখ জনক অধ্যায়ের এইভাবে অন্ত হয়। নির্দিধায় বলা যায় যে, এই সবের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী মিঃ গান্ধী। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার বিরোধিতা গান্ধীজি এই জন্য করেছিলেন যে, তাতে পৃথক নির্বাচক-মন্ডলীর ব্যবস্থা ছিল। যদি হিন্দুরা গান্ধীজির অনশন করার ফলে উদ্মাদ হয়ে না পড়ত তাহলে তারা বুঝত যে গান্ধীজির এই অনশন করা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় পৃথক নির্বাচক মন্ডলী ছাড়া সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রেরও ব্যবস্থা ছিল। অস্পৃশ্যদের দেওয়া দ্বিতীয় ভোটের প্রয়োগ, সাধারণ নির্বাচন ক্ষেত্রের উচ্চবণীয় হিন্দু প্রার্থী নির্বাচনে করা যেত। অবশ্যই এটা যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি ছিল। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা আর পুণাচুক্তির মধ্যে যে বিভেদ সেটা নির্বাচন ক্ষেত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে। দুটোর মধ্যেই সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে, দুটোর মধ্যে এটা ছিল যে, সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় পৃথক নির্বাচন ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ছিল যে উচ্চবর্ণীয় প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে অস্পৃশ্যরা তাদের উপর যেন প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু পুণা-চুক্তির যৌথ নির্বাচন ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ছিল যে, অস্পৃশ্য প্রার্থীর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিন্তু উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা যেন তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পাবে। দুটোর মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য হচ্ছে এটা।
অস্পৃশ্যদের
শুভাকাঙ্কাখী কোনটা চাইবেন? তিনি সাম্প্রদায়িক
বাটোয়ারায় সংযুক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রকে সমর্থন করবেন, নাকি
পুণাচুক্তির যৌথ নির্বাচন ক্ষেত্রকে সমর্থন করবেন? অবশ্যই
অস্পৃশ্যদের প্রকৃত উদ্ধার এটাতে আছে যদি হিন্দুদেরকে অস্পৃশ্যদের ভোটের উপর
নির্ভরশীল করা যায়। সেটা সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় ছিল। কিন্তু অস্পৃশ্যদের
হিন্দুদের ভোটের উপর নির্ভরশীল করে দেওয়া যাতে অস্পৃশ্যরা হিন্দুদের গোলাম হয়ে
যায়। গোলাম তো অস্পৃশ্যরা প্রথম থেকেই আছে। পুণা-চুক্তির এটাই হচ্ছে আসল রহস্য।
সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার উদ্দেশ্য ছিল,
অস্পৃশ্যদেরকে হিন্দুদের
শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্য। আর পুণা-চুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে অস্পৃশ্যদেরকে
হিন্দুদের অধীন করে রাখার।
তথ্য সংগ্রহ – পুনা চুক্তির দুষ্পরিনাম। লেখক – ওয়ামন মেশ্রাম
0 comments:
Post a Comment