Saturday 18 June 2016

// // Leave a Comment

শুদ্র না ব্রাহ্মণ ? লেখক - শিবরাম চক্রবর্তী


আন্দোলনকারীদের কাছে আশা করি এই লেখাটি অনেকটা উপকারে আসবে। এখানে এমন কিছু কথা তুলে ধরা হয়েছে যেগুলো বৌদ্ধিক দৃষ্টিকোন থেকে ভীষণ প্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয়েছে।

শুদ্র না ব্রাহ্মণ ? লেখক- শিবরাম চক্রবর্তী

(মস্কো বনাম পণ্ডচেরী থেকে সংগৃহিত)

     সমস্ত শূদ্রকে ব্রাহ্মণ বলে ঘোষণা করা হোক, এই মর্মের একটা প্রস্তাব সম্প্রতি হয়েছে।         এই প্রস্তাবে আমার আপত্তি। পৃথিবীর কোথায় একদল মানুষ আছে যারা নরখাদক, সেই কারণে পৃথিবীর কোথায় সব মানুষকে নরখাদক বলে ঘোষণা করা হোক—এই মতে আমি কিছুতেই সায় দিতে পারিনে। বরং আমার মতে, সম্ভব হলে, নরখাদকদেরই মানুষ করার পক্ষে চেষ্টা হওয়া উচিত

     ‘ইংরাজী’—এই শব্দটি উচ্চারণ করলে পৃথিবীর আজ যে-কোনো প্রান্তে যে-কেহসমঝদার লোক বুঝতে পারে যে, এই নামধেয় যে-জাতি, তারা বর্বরতার একটা সভ্যরকম রূপ দিতে পেরেছে, অত্যাচারকে শান্তি ও শৃঙ্খলার নামে চালাতে পেরেছে এবং শোষণের ফলে শোষিতের মনে অবিমিশ্র আনন্দ দান করতে পেরেছে—এইরকম অসাধারণ প্রয়োগনৈপুণ্য আছে বলেই পৃথিবীর তারা অষ্টম আশ্চর্য। বর্তমান যুগে ইংরেজ যা সম্ভব করেছে সেই -বস্তু অতিপ্রাচীন যুগেই আমাদের ব্রাহ্মণেরা সমাধান করেছিলেন। এজন্যে তাঁরাও কিছু কম যান না—পৃথিবীর আদিম আশ্বর্য তাঁরা

     শোষণের জন্যই শাসন—এই সনাতন মূলনীতির মূলাধার ব্রাহ্মণ। শোষণকে প্রচ্ছন্ন করতে হলে শাসনকে একটা আদর্শের নামে খাড়া করতে হয়, অতীতকালের ব্রাহ্মণরা ডিপ্লোমাসির এই গৃঢ়-তত্ত্ব ভাল করেই জানতেন। ভারত যে একদা সভ্য ছিল অর্থাৎ বর্বরতাকেও লজ্জা দিতে পেরেছে—সেকালের বামুনেরাই তার প্রমাণ

     ‘ও’ –এই একাদশ বর্ণকে অনুনাসিক সুরে উচ্চারণ করলে যে প্লুতস্বরের সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে সংস্পৰ্শ ঘটলে শূদ্রের বিষম দশা! তা যদি শূদ্রের কষ্ঠ থেকে বেরোয়, তাহলে তার জিভ কেটে ফেলতে হবে এবং যদি কানের ভেতরে ঢোকে তাহলে তার কর্ণকুহরে সীসে গলিয়ে ঢালার সুব্যবস্থা। বামুনদের সভ্যজনোচিত শাসন-নীতির এমন বহুতর দৃষ্টান্ত মনুসংহিতার পাতায় পাতায়। জলদস্যুদের যেসব বংশধর আধুনিকালে সভ্য হয়ে উঠেছে শাসন-নীতির দিক দিয়ে ‘দেব- বংশসস্তুত’ পৌরাণিক ব্রাহ্মণদের এখনো তারা লজ্জা দিতে পারেনি

     শোষণ-নীতির দিক দিয়েই পেরেছে কি? আমি বলি, আজ্ঞে না

     ইংরেজরা রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে জড়ীভূত করবার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু প্রায়ই তার জোড় ভাঙ্গে—তখন দ্বিধাগ্রস্ত দুই নীতির আপনা-আপনির মধ্যে ঠোকাঠুকি বেধে যায়। কিন্তু সেকালের ব্রাহ্মণ ধর্মনীতির সঙ্গে অর্থনীতির যে-সমন্বয় সাধন করে ছিলেন তা আজো অক্ষুন্ন রয়েছে—তারা সেই প্রাচীন যুগে যে শোষণ-যন্ত্রের স্থাপনা করে গেছেন তার যন্ত্রণাহীন চক্রতলে নিষ্পিষ্ট হতে আজো আপনা থেকেই লোক এগিয়ে আসে। সত্যি দিব্যদর্শন ছিল বইকি তাদের। কেননা, এই মানুষ- পেষা-কল চালিয়ে তাদের বংশধরেরা যে চিরকাল ধরে করে খাবে, এটা তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁদের দুরদৃষ্টির বলেই সেই সেদিন পর্যন্ত বামুনরা নিজেদের দূরদৃষ্টিকে ঠেকিয়ে এসেছে

     প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ট্যাকসো আদায়ের যে ‘শিডিউল’ তাঁরা সেকালে বেঁধে গেছেন একালে এমন কোনো অর্থনীতিক মাথাই নেই যে তার সমান একটা কিছু বানাতে পারে। বারো মাসে তের পার্বণ, নিত্য-নৈমিত্তির পূজাৰ্চনা, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, চন্দ্ৰ-সূৰ্য-গ্রহণ–এসব তো লেগেই রয়েছে—বরাবরে ব্যাপার। কিন্তু এসব উপলক্ষে পৌরহিত্য করবে কে? বামুন। দান করব কাকে?—বামুনকে। দানের বৈচিত্ৰই-বা-কতরকমের! সোনা-রূপো হাতী-ঘোড়া কাপড়-চোপড় বাসন কোসন থেকে শুরু করে কাহন কড়ি পর্যন্ত—যার যেমন সাধ—যথাসাধ্য!

     শুধু কি দান? তার সঙ্গে গণ্ডেপিণ্ডে ভোজন। নেহাৎ কম হলেও অন্তত ‘দোয়া-দশটিকে’ তো খাওয়াতে হবে? এবং ভোজনের সঙ্গে দক্ষিণটাও নগদ! অথচ দাতার পুলক ধরে না। অপাত্রে এই নির্বিচারদানের কোনো যুক্তি হয় না, কিন্তু দাতার মনে কোনটাই প্রশ্ন নেই। এই কায়মনোবাক্য দানের ফলে তাঁর অক্ষয় স্বৰ্গবাস কায়েম হচ্ছে! পোষণের ফলে তোষেণের সৃষ্টি করার অদ্ভূত এই প্রতিভা, আমি শুধু ভাবি, সে-যুগে এ-সম্ভব হলো কি করে? এ-যুগের ট্যাকসো আদায়ের একশো রকম কায়দার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়—কানুনের হেরফের থাকলেও কায়দায় এরা এতই অনুরূপ যে, মৌলিকতার দিক দিয়ে রূপের মিল অণুমাত্র হলেও লৌকিকতায় এরা সমগোত্র। ইতিহাসের মতো, সভ্যতাও কি খোল-নলচে বদলে বদলে আসে নাকি?

     এবং আরো বিস্ময় এই যে, আওরঙজেবের বহুপূর্বে জন্মগ্রহণ করেও মানুষের ওপর ট্যাকসো আদায়ের যে-বিধিনিষেধ তাঁরা বের করেছিলেন তা যেমন বিচিত্র, তেমনি অপূর্ব; এমন কি এ-বিষয়ে পরবতী আওরঙজেবকেও তাঁরা টেক্কা মেরে গেছেন। মনে করুন, কোনো ভাগ্যবান ভারতভূমিতে জন্মালেন। ছ’দিনের দিন তাঁর ষেটেরা পুজো, ছ’মাসে অন্নপ্রাশন, ছ’বছরের উপনয়ন, বিনিময় বংশানুক্রমে কানমলে কাঞ্চন মূল্য আদায়। বিনা ট্রেডমার্কেই এই ব্রহ্মের ব্যবসা বলে! তারপরে বিয়ে, তারপরে তাঁর বংশবৃদ্ধি এবং সর্বশেষে তাঁর শ্রাদ্ধ! —এর সব উপলক্ষেই বামুনদের ট্যাকসো দিতে হবে। এমনকি, মরেও খাজনা এড়িয়ে ফাঁকি দেবার যো নেই। অতি-বৃদ্ধ প্রপিতামহ যে একদা জন্মেছিলেন, তার জন্যে অতি-আধুনিক প্রপৌত্রকে প্রতিবছরে ট্যাকসো দিতে হয়। শ্রাদ্ধ গড়ায় অনেক দূ

     বণিকবৃত্তি বা ব্যবসা-বুদ্ধিতেই কি তাঁরা কম ছিলেন? এমন অপবাদ তাঁদের কোনো শক্র, এমন কি আমিও দিতে পারব না। বিনা পূজিতে লিমিটেড বা আনলিমিটেড কোম্পানি গড়ে যে-সব কারবার অতি পুরাণকালে তাঁরা ফেঁদে গেছেন, আজ অব্দি তার একটা দেউলে হয়নি, বরং লভ্যাংশে বেড়েই চলেছে দিন-দিন। এই গুরুগিরির ব্যবসাটাই কি কম ফলাও? কিঞ্চিৎ ব্রহ্মের ব্যবসা চলে! তীর্থ, মঠ, গুরু, আর মোহন্ত—এদের উপায়ের কাছে ফোর্ড-রকফেলার সাহেবের আয়ও কিছু না

     সভ্যতার দুটো দিক, একদিকে তার হীনবৃত্তি আর একদিকে তার উদ্ধৃত্তি। একদিকে সে বর্বর—নিজে বাঁচবার জন্য অপরকে মারতে তৈরি সে; বিধাতার দেওয়া দুটো হাত আলিঙ্গন করার পক্ষেই যথেষ্ট, অপরকে শাসন ও শোষণ করার জন্য তাই সে এখানে আরো ছটা হাত সৃষ্টি করে সেজেছে অক্টোপাশ; এখানে তার কুট চাল ও নখদন্ত-চালনা কখনো প্রচ্ছন্ন। ইউরোপীয় সভ্যতার এইদিকে আছে বার্কেনহেড, ডায়ার—এদের মতো লোকেরা

     কিন্তু সভ্যতার আরেকটা দিক আছে যেখানে তার উদ্ধৃত্তি, যেখানে তার ঐশ্চৰ্য, যেখানে সে অপরকে দিতে উন্মুখ, যেখানে সে অপরকে বাঁচালে ভাবে আমি বাঁচলুম, যেখানে অপরে অসম্পূর্ণ থাকলে তার নিজের পূর্ণতা নিরর্থক মনে হয়; যেখানে সে বলে, যেনাহং নামৃতাস্যাম্‌ তেনাহং কিম্‌ কুয্যাম্‌। ইউরোপীয় সভ্যতার এদিকটায় আছেন ইউরোপের দার্শনিকবৈজ্ঞানিক, শিল্পী-কবি-মনীষীরা। সভ্যতার এই অংশটাই অপরাংশকে অসম্পূর্ণতার লজ্জা, এ অগৌরব থেকে মোচন করে, তার ভারকেন্দ্র স্থির রাখে, সভ্যতাকে যাতে সভ্যতা বলেই সন্দেহ হয়—এমন বিভ্রম–রচনার চেষ্টা করে

     কিন্তু ব্রাহ্মণদের প্রাচীন সভ্যতায় আমরা কেবল প্রথম গোত্রেরই পরিচয় পাই—যেখানে সে আত্ম-প্রসাদের জন্য দু’হাত বাড়িয়ে কেবলি নিয়েছে; কিতু সেই ত্মপ্রসারের জন্য যেখানে দু’হাতে দিতে হয়, সভ্যতার সেই ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের দেখি অতি কদাচ। একেবারেই-যে দেখিনে তা নয়, কেননা বামুনদের মধ্যেও কখনো কখনো মনুষ জন্মাতে পারে

     এই জন্য ব্রাহ্মণ-সভ্যতার একদিকে যেমন মনু, পরাশর পরশুরাম প্রভৃতিকে দেখিতে পাই—যারা দোর্দাণ্ড প্রতাপে দোহন করেছে, শাসন করেছে, নির্বিচারে হত্যা করেছে ও চক্রান্ত করেছে; তেমনি অপরদিকে বাল্মীকি ও বেদব্যাসের মতো অপরাজেয় স্রষ্টার সন্ধান পাইনে। এই জন্য সভ্যতার যে একাংশে বামুনের একচ্ছত্র, সেখানে তারা যা রেকর্ড রেখে গেছে, এ অবধি বহু বহু সভ্যজাতি প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেই রেকর্ডের রেখে গেছে, এ অবধি বহু বহু সভ্যজাতি প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেই রেকর্ডের কাছাকাছিও ঘেঁষতে পারেনি। ব্রাহ্মণ পরশুরামের সঙ্গে স্লেচ্ছ ডায়ারের তো তুলনাই চলে না, হত্যা-নৈপুণ্যে পরশুরামের কড়ে আঙুলের যোগ্যতাও ডায়ারের নেই

     ব্রাহ্মণ-সভ্যতাই যদি ভারতীয় সভ্যতার শেষ কথা হতো, তাহলে তেমন দুর্দিন পৃথিবীর আর কিছু ছিল না। ব্রাহ্মণপ্রাধান্য এড়িয়ে উঠতে না পারলেও তার সভ্যতাকে পেরিয়ে যা উঠেছিল, তাই হচ্ছে হিন্দু সভ্যতা—এই সভ্যতারই দিগ্‌ব্যাপ্ত কিরণের মধ্যে ব্রাহ্মণের কলঙ্কও অনেকটা শোভার মতোই দেখাচ্ছে। এই সভ্যতা অসলে ব্রাহ্মণেতর জাতির সৃষ্টি

     ব্রাহ্মণ-সভ্যতার দুটি পুঁজি, মনুর গতকাল আর পরশুরামের পরশু; পেনাল কোড আর রেগুলেশন লাঠি। কিন্তু হিন্দু সভ্যতার মধ্যেই আমরা পাই ভারতের দর্শন, কাব্য, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য—তার ঐশ্বর্যের সহস্রমুখী উৎসার! তার মধ্যেই আমরা পাই, দস্যু বাল্মীকির রামায়ণ, জেলেনীর ছেলে বেদব্যাসের মহাভারত। যে উপনিষদের গর্বে আমরা মশগুল তারও বেশির ভাগ ক্ষত্রিয়ের রচনা। আয়ুর্বেদ, রসয়ান ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য বিভাগেও অব্রাহ্মণেরই প্রতিভা!

     এই হিন্দুসভ্যতায় ব্রাহ্মণের দান অতি সামান্যই, বলতে গেলে ব্রাহ্মণের থেকে যতটা এ নিয়েছে,-বর্ণ-বিচার, স্পর্শদোষ আর ‘ন-স্ত্রীস্বাতন্ত্র্যমৰ্হতি’—তাই এর কলঙ্ক। ব্রাহ্মণের দ্বারা প্রভাবিত না হলে এ সভ্যতা আরো প্রাণবান, আরো বেগবান, আরো বীর্যবান হতে পারত-বিশ্ববিজয় করত এ সভ্যতা। ভারতীয় এই সভ্যতায় অনার্যের দান আছে, বৌদ্ধের দান আছে মুসলমানের দান আছে। এর স্রষ্টাদের মধ্যে এককালে ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য হয়ত ছিলেন, কিন্তু আজ তাঁদের পৃথক অস্তিত্ব নেই, বিপুল শুদ্ৰশক্তি আত্মসাৎ করেছে তাঁদের। শূদ্রের দ্বারাই এই সভ্যতার সৃষ্টি ও পুষ্টি, এজন্য আমি একে বলব শূদ্রসভ্যতা এবং এই জন্যই এ বিরাট, এই এর মাহাত্ম্য—ব্রাহ্মণসভ্যতার চেয়ে ঢের ঢের বড়—এই হিন্দুসভ্যতা। ব্রাহ্মণ না জন্মালেও এ হতো এবং ব্রাহ্মণ লোপ পেলেও এ থাকবে। বরং বামুনের প্রাধান্য লোপ পেলে এই সভ্যতার প্রাণশক্তি পূর্ণ-মুক্তি পাবে; বৌদ্ধ যুগে যেমন হয়েছিল তেমনি ভারতের অন্তর্নিহিত ঐশ্বৰ্য আবার সহস্ৰদলে আত্মপ্রকাশ করবে

     হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণের প্রভাব কী উপায়ে ঘোচানো যায় তাই আজকের সমস্যা। আজকের সমাজের ওপর আজকের বামুনদের, বামুন বলে কোনো প্রভাব আছে, এ আমি মনে করিনে। যে-ব্রাহ্মণ এখনো এর কাঁধে বসে কণ্ঠরোধ করে রয়েছে তা অতীতের কঙ্কালমূর্তি—তার কালকবল থেকে মুক্ত করা মানে কবল থেকে—একে অতীতের কবল থেকে বিমুক্ত করা। এবং এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির আর যে উপায়ই থাক, সমস্ত হিন্দুকে বামুন বলে ঘোষণা করা সে-উপায় নয়। কেননা প্রথমত তাতে সমস্ত হিন্দুরা তথামানুষের মানহানি; দ্বিতীয়ত, যে-বস্তুর বিলোপ বাঞ্ছনীয় এবং বস্তুত যা মরতে বসেছে তাকেই শুধু মর্যাদা দেওয়া নয়, জীইয়ে তোলা।

     তাই, ঘোষণা যদি করতেই হয়, অব্রাহ্মণনির্বিশেষে সবাইকে শূদ্রবলে ঘোষণা করাই ভাল, কেননা শুদ্র বামুনের চেয়ে মহত্তর জাত! ‘মহত্তর’ বললাম বলে কেউ যেন না মনে করেন যে, বামুনদের, জাত হিসেবে, অদৌ, আমি মহৎ বলে মনে করি। কিন্তু মহৎ বলে মানি আর নাই মানি, নিপুণ বলে তাঁদের আমি মানব। যে অশ্বমেধের ঘোড়া দ্বিগ্বিজয়ে বেরিয়েছিল, তার মুখে লাগাম লাগিয়ে তাকে ময়লা টানা গাড়ীর সঙ্গে বেঁধে দেওয়ার মধ্যে মহত্ত্ব না থাক, নৈপুণ্য যথেষ্টই। যে শূদ্র-ভারত একদা বৌদ্ধযুগে আপন আত্মার পূর্ণ প্রকাশকে ধরে রাখতে না পেরে, নিজের কুল ছাপিয়ে, অর্ধেক পৃথিবীর দেশ-দেশান্তর তার আদর্শের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিল, তাকেই আবার অন্ধুকূপের মধ্যে টেনে কোণঠাসা করে আনা এবং কেবল ইচ্ছামাত্র তার গতিরোধ নয়, ইচ্ছামতো তাকে দিয়ে ব্রাহ্মণের সমস্ত ময়লা টানানো সামান্য বাহাদুর নয়। মুষ্টিমেয় ইংরেজ যে-কৌশলে ত্ৰিশ কোটি ভারতবাসীকে শাসন করে, মুষ্টিমেয় বামুনের কেরামতি তার চেয়ে একটু ও কম নয়। ইংরেজের সম্মুখে আছে সঙ্গীন বন্দুক, কিন্তু বামুনের মুখে শুদ্ধ সংস্কৃত শ্লোক,—অশুদ্ধ হলেও কিন্তু যায় আসে না, নিছক বিসর্গের বুলেট দিয়ে যে সাম্রাজ্য আদিযুগ থেকে এ পর্যন্ত সে রক্ষা করেছে, ভূগোলের মধ্যে তার বিস্তার দেখা না গেলেও ভুলোকের দীর্ঘতম কালের ইতিহাসকে তা আচ্ছন্ন করে দীর্ঘতম কালের ইতিহাসকে তা আচ্ছন্ন করে রইল। মানুষের দুৰ্গতির এতদূর গতি আর হয় না

     এই জন্যই মনে হয় যে, ভারতের ইতিহাসের গতি বদলাতে হলে আগে বামুন্দের একটা বিধি করা দরকার। অমৃতসরে ডায়ার ভারতের লোককে কী করে বুকে হাঁটাতে পারল, ভাবতে গিয়ে আমরা চমৎকৃত হই। সরীসৃপকেই বুকে হাঁটানো যায়, মানুষকে না। যুগ-যুগান্তর ধরে যে-জাতি সূত্রগুচ্ছ দেখলেই বুক দিয়ে মাটি আশ্রয় করেছে, সঙ্গীন দেখলে সে যে আরো অনায়াসে তাই করবে এ তো আশ্চর্য কিছু নয়। কেননা, সঙ্গীন ব্ৰহ্মশাপের চেয়েও সঙ্গীন এবং তার গুঁতো সুতোর চেয়ে একটু শক্তই! বামুনকে কাঁধ থেকে নামাতে না পারলে এ জাত কোনোদিনই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। মনুর স্বত্ব লোপ না পেলে এদেশে মনুষ্যত্বের বিকাশ হওয়া অসম্ভব। সেটা হবে হাওয়ার কেল্লায় আকাশ-কুসুম

     এ জাতির প্রাণশক্তির সে সহস্র ধারায় উচ্ছলিত হয়ে ওঠে না, তার কারণ, সামান্য সঙ্কীর্ণ পথেও আপনাকে প্রকাশ করবার সুযোগ তার নেই—এইজন্যই কোনোদিনই তার নিজেকে জানা ও নিজেকে পাওয়া হলো না। পৃথিবীর কাছেও সে অচেনা থেকে গেল। মনের সহিত মনের সংস্পর্শ ও সংঘর্ষের ফলেই চেতনার ভাণ্ডারে শক্তির সঞ্চয় সম্পূর্ণ হতে থাকে—সেই শক্তির সাহায্যেই মানুষ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বা সমাজের ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে বা ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে ব্যক্ত করতে পারে। আমাদের সমাজের মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবার সব কটা পথই রুদ্ধ

     আমরা নারীকে বলি দেবী, তাকে সমকক্ষ মানুষ বলে ভাবতে পারিনে। অবশ্য নারীকে আমরা নিখুঁত রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে সবরকম আপদ-বিপদের আঁচ থেকে রক্ষা করেই চলি, কিন্তু আগে খোঁড়া করে রেখে তারপর তাকে মাথায় করে বয়ে নিয়ে বেড়ানোয় দাক্ষিণ্য প্রকাশ পায়  না। বিধাতার দেওয়া পা থেকে বঞ্চিত করে কাঁধের ওপর স্থান দিয়ে ভাবতে পারি যে তাকে উচ্চপদ দিলুম, কিন্তু দুনিয়ার দরবারে সে পদচ্যুতই রয়ে গেল। মাঝে থেকে আমাদের পা দু’টোয় বিপদ এই হলো যে, তারা মনে করে স্থিরভাবে বহন করাই তাদের কাজ, চলা তাদের নয়।  

     আমরা মানুষকে দরিদ্র করে রাখি এবং সেই দরিদ্রকে ডেকে বলি, তুমি নারায়ণ; সেটা তাকে স্রেফ উপহাস! তার দরিদ্র দূর করার চেষ্টা আমাদের নয়- সেটা বজায় রাখাই কায়েমী নারায়ণ সেবার অঙ্গ বলে বোধ হয়আমরা মুখে বলি সৰ্ব্বং ঋল্বিদং ব্রহ্ম; কিন্তু বিশেষ এক শ্রেণীর মানুষের ছায়া মাড়ালেও আমাদের নাইতে লাগে। তারা যে বামুনের তুল্যই মানুষ, এ কথা আমরা ভাবতেই পারিনে। মানুষমাত্রেই ব্রহ্ম, সে ঠিক; কিন্তু তাই বলে কি তারা ঐ বামুনের সমান? ব্রাহ্মণ যেন ব্রহ্মের ও বড়!

     এইভাবে নারীর সঙ্গে পুরুষের, নিম্নস্তরের সঙ্গে উচ্চস্তরের, মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলার অর্থগত, সমাজগত ও ধর্মগত হাজারো রকমের বাধা। অথচ চিত্তের সঙ্গে যদি সহজ না হয়, অবাধ না হয়, বিচিত্র না হয়, তবে আমাদের সম্পূর্ণতাই বা আসবে কোন পথে, সার্থকতাই বা পাব কোন ফাঁকিতে? মিলনের রহস্যই যে পুথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্য, দেবার ও পাবার ঐ একটিমাত্রই তো প্রণালী

     এ যুগের সবচেয়ে বড় সমস্যা মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের পথ খুলে দেওয়া, চওড়া করা সভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করেছে এরই ওপর। রাষ্ট্রনীতিক দিক দিয়ে, আর্থনীতিক দিক দিয়ে,–নানা আদর্শে ও নানানভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টাই আজকের কাজ। এইজন্যই যে-কারণে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে আমরা চাই সকলের ধনসাম্য, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সকলের সমানাধিকার, সেই কারণেই সামাজিক ক্ষেত্রে চাই সকলের একীকরণ। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন যাতে সহজ ও সুন্দর হয়, আমাদের সকল চেষ্টার মূলে সেই প্রেরণা

     কিন্তু সূত্রের দর বাড়িয়ে সবাইকে সূত্রধর বানিয়ে দিলেই এই একীকরণ সম্ভব হবে না, কেননা সাম্যের প্রতীক ব্রাহ্মণ নয়, সে হচ্ছে ভেদের মূর্তি। সবাইকে শূদ্ৰত্বের মর্যাদা দিয়ে বরং সেটা সম্ভব। ব্রাহ্মণের অতীত কলঙ্কিত এবং ভবিষ্যৎ শূন্যাকার—তার প্রাণশক্তি নিঃশেষিত, তার আদর্শের ক্ষেত্র এতই সঙ্কীর্ণ যে, সেখানে কেবল তাদেরই ধরে, ধরিত্রীর সমস্ত মানুষের ঢোকার পথ আর সেখানে নেই। এই ভারতের স্রষ্টা শুদ্র, এর আদিম অধিবাসী শূদ্র, এর সভ্যতা শুদ্রসভ্যতা। ব্রাহ্মণের দিন ফুরিয়ে এসেছে, বামুনের আগেও এই ভারতে শূদ্র ছিল বরং শ্রদ্রই পরে থাকবে; কেননা এর প্রাণশক্তি প্রচুর—অফুরন্ত এর সম্ভাবনা। ব্রাহ্মণ হিন্দু সমাজের মাথা নয়, তার টিকিমাত্র, পৌরাণিক দুশ্চিহ্ন লোপ পেলে তার একমাত্র ক্ষত এই হবে যে, তাকে ভয়ঙ্কর আধুনিক দেখাবে

     কেউ হয়ত ভেবেই আকুল হবেন, বামুন যদি গেল তবে ব্রহ্মচর্চা করবে কে! একদল লোক ব্রাহ্মসেবা, আরেক দল শক্তি সেবা এবং তৃতীয় দল পদসেবা করলে তবেই না হবে আদর্শ সমাজ। কিন্তু আহা, আজকের মানুষ যে সম্পূর্ণ হতে চায়, —ব্রহ্মবিদের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের শৌর্য, বৈশ্যের ঐশ্চৰ্য, শূদ্রের শ্রম—সবাতেই যে চায় সমান অধিকার— ভাগাভাগি হিসেবে আধখানা মানুষ হয়ে তার সুখ নেই। মনুষ্যত্বের পূর্ণতার জন্য যদি ব্রহ্মচর্চার প্রয়োজন থাকে, তাহলে সে প্রয়োজন প্রত্যেক মানুষের—কোনো বিশেষ শ্রেণীর ওপর তার বরাত দেওয়া যায় না। দিলে যা হয় তা ব্রহ্মচর্চা নয়, ব্রহ্মচর্চড়ি— কেননা এই জিনিষই একজনে পাকিয়ে সকলের পাতে পরিবেশন করতে পারে

     কেবল বিভিন্ন জাতির সভ্যতা আত্মসাৎ করেই হিন্দুসভ্যতা বিরাট হয়নি, বিভিন্ন জাতির রক্তের সঙ্গে ও এর মিশ্রণ ঘটেছিল। অনার্য, শক, হুণ, দ্রাবিড়ের সঙ্গে যথেষ্ট আর্যরক্ত মিলিত হয়ে হিন্দুর দেহ গড়েছে, বৌদ্ধ যুগের তো কথাই নেই, অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক, কৌলীন্য প্রথার ফলে বামুনের সঙ্গেও এই শূদ্র-রক্তের নেপথ্য-মিলন ঘটেছে। অদূর ভবিষ্যতে মুসলমান ও খৃষ্টানকে আত্মসাৎ করে এই শূদ্রসভ্যতা আরো মহত্তর হবে। মিলনের পথে, মহিমার পথে আপনাকে সম্পূর্ণ করবে। অচলায়তন ভেঙে মুক্তিপথ রচনার দায়িত্ব তার। ভারতের সভ্যতা বিপ্রবর্ণ নয়, শূদ্রবর্ণ ভারতের ভবিষ্যৎ ও তাই

_____________________________________  









Read More