মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জীবন ও কর্ম
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
এই পৃথিবীতে
এমন অনেক মহামানব জন্ম গ্রহণ করছেন, যাঁরা দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ। যাঁদের
জীবনের ব্রতই মানুষের কল্যান করা। যদিও সেই মহামানবদের অবদানকে তাঁর দেশবাশি বা তাঁর
সমাজ অজ্ঞানতার কারণে স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ করে। তবে সেই মহামনবদের অবদানের সুফল
গ্রহণ করতে কখনো কুন্ঠাবোধ করেনা। এমনি এক মহামানব হচ্ছেন, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।
যিনি প্রথমেই ঘোষণা করছেন-
“ব্রাহ্মণের পদধূলি গ্রহণ এবং মন্দিরে প্রবেশের দ্বারা আপনাদের কোনও উপকার ও দুঃখ-কষ্ট
লাঘব হইবে না। কে আপনাদের দুঃখ-কষ্টের অবসান করিবে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে সমান অধিকার
প্রদান করিবে, তাহাই চিন্তা করিতে হইবে।”
-বই- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ২য় খন্ড। লেখকঃ- জগদীশচন্দ্র মন্ডল।
তিনি আরো বলেছেন,
“আত্মীয় ও বন্ধু যতই প্রিয় হউক জাতির বৃহত্তর স্বার্থ তদপেক্ষা প্রিয়তর-এ কথা সর্বদা
স্মরণে রাখিবেন। জাতীয় স্বার্থকে বলি দিয়া আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের খাতিরে যদি কেউ ভুল
পথে চালিত হন তবে তিনি জাতির ঘোরতর শত্রুতা করিবেন।”
-বই- মহাপ্রাণ
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ২য় খন্ড। লেখকঃ- জগদীশচন্দ্র মন্ডল। প্রৃষ্ঠা নং- ১৫৪
আর এই মহামানবকে
নিয়ে থিসিস করেছেন নাগপুরের ডঃ সঞ্জয় গাজভিয়ে। তিনি মহাপ্রাণ সম্পর্কে বলেছেন- “সাংবিধানিক ভারতের
নির্মাতা বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।”
আবার নাগপুর উনিভারসিটির অধ্যাপক
ডঃ প্রদীপ আগলাবে বলেছেন-
“বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সামাজিক রাজনৈতিক শৈক্ষনিক ধার্মিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনার জন্য ঐতিহাসিক আর ক্রান্তিকারী কাজ করেছেন; সেই মহান ক্রান্তিকারী কাজ করার জন্য যে মহামানব বাবাসাহেবকে সহযোগীতা করেছেন, সেই মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের আবদান খুব মহত্ত্বপূর্ণ । যদি মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের এই সহযোগীতা বাবাসাহেব না পেতেন, তাহলে তিনি সংবিধান তৈরী করতে পারতেন না । ঐতিহাসিক সত্য । আর বাবাসাহেব যদি সংবিধান সভায় যেতে না পারতেন তাহলে এই দেশের সংবিধান ব্রাহ্মণদের পক্ষেই লেখা হ’ত। তাই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আম্বেদকরী আন্দোলনে যে সহযোগীতা করেছেন এবং মূলনিবাসীদের উদ্ধারের জন্য যে কাজ করেছেন সেটা অসাধারণ কাজ।”
“বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সামাজিক রাজনৈতিক শৈক্ষনিক ধার্মিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনার জন্য ঐতিহাসিক আর ক্রান্তিকারী কাজ করেছেন; সেই মহান ক্রান্তিকারী কাজ করার জন্য যে মহামানব বাবাসাহেবকে সহযোগীতা করেছেন, সেই মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের আবদান খুব মহত্ত্বপূর্ণ । যদি মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের এই সহযোগীতা বাবাসাহেব না পেতেন, তাহলে তিনি সংবিধান তৈরী করতে পারতেন না । ঐতিহাসিক সত্য । আর বাবাসাহেব যদি সংবিধান সভায় যেতে না পারতেন তাহলে এই দেশের সংবিধান ব্রাহ্মণদের পক্ষেই লেখা হ’ত। তাই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আম্বেদকরী আন্দোলনে যে সহযোগীতা করেছেন এবং মূলনিবাসীদের উদ্ধারের জন্য যে কাজ করেছেন সেটা অসাধারণ কাজ।”
এই মহান ত্যাগীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করছি।
জন্ম ও শিক্ষাঃ- যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৌরনদী থানাধীন মৈস্তাকান্দি গ্রামের একদরিদ্র নমঃ পরিবারে, 1904 সালের 29 শে January. পিতা-রামদয়াল মন্ডল ও মাতা –সন্ধ্যারাণী মন্ডল। তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ ও সর্বকিনিশঠ সন্তান। তিনি বাল্যকালে খুবই দুরন্ত ছিলেন। আর বছর পর্যন্ত তাঁকে বিদ্যালয়ে পাঠানো সম্ভব হয়নি। একটু বেশী বয়সে লেখাপড়া শুরু করলেও তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। অল্পকালের মধ্যেই পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। 1924 সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
যোগেন্দ্রনাথের পিতার আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য তিনি তাঁকে কলেজে পড়াতে অসমর্থ হলে যোগেন্দ্রনাথের কাকা কলেজের খরচা বহন করেন, আর বরিশালের বি.এম. কলেজে ভর্তি হন এবং 1926 সালে কৃতিত্বের সহিত I.A. পাশ করেন। পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য তিনি ওখানকার নিবাসী প্রহ্লাদ চন্দ্র বাড়ৈ-এর দ্বিতীয় কন্যা কমলা বাড়ৈকে বিবাহ করেন। তারপর 1929 সালে ঐ কলেজ থেকে তিনি অঙ্ক ও সংস্কৃতে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে B.A. পাশ করেন।
তিনি M.A. পড়তে চাওয়ার কথা জানালে শ্বশুর মহাশয়ের তাঁর অসামর্থের কথা জানান। তখন যোগেন্দ্রনাথ মাত্র 11 টাকা সম্বল করে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ঢাকা যান। ঢাকায় পড়াশুনা না করতে পেরে তিনি কলকাতায় এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে ভর্তি হন এবং চাঁদসী চিকিৎসক প্যারীমোহন দাসের বাড়িতে লজিং থেকে ছাত্র পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করেন।এছাড়া পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি ছাপাখানায় প্রুফ সংশোধনের কাজ করতেন। 1934 সালের জুলাই মাসে তিনি সসম্মানে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 1936 সালের 25শে জুলাই আইনজীবি হসাবে বরিশাল সদর আদালতে যোগদান করেন। এই সময় তিনি দরিদ্র কৃষকদের অনেক মমলা কোনরূপ ফি না নিয়েই করে দেন।
1937 সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে তিনি বাখরগঞ্জ উত্তর-পূর্ব নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রসী প্রার্থী জমিদার সরল দত্তকে বিপুর ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
স্কুল ও কলেজ জীবনে বর্ণবৈষ্যম্যের স্বীকারঃ-
(১) একদিন ক্লাশে এক ব্রাহ্মণ ছাত্রের পাশে যোগেন্দ্রনাথ বসলে, সেই দাম্ভিক ব্রাহ্মণ কুমার ঘৃণায় ভ্রুকুঞ্চিত করে তীব্র শ্লেষোক্তি করে, “এই নমঃর স্পর্ধা দেখছ; ও কিনা আমার পাশে এসে, গায়ে গা ঘেঁসে বসতে চায়!” বর্ণ হিন্দু ছাত্ররা একত্রে তার কথা সমর্থন করে বলে, “ঠিক বলেছিস, ওকে এখান থেকে সরিয়ে দাও।” সকলে মিলে যখন তাঁকে সরানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না, তিনি দৃঢ় কন্ঠে প্রতিবাদ করে বললেন, “আমি এখান থেকে এক চুলও নড়ব না। এ স্কুল শুধু তোমাদের জন্য নয়। এখানে সরাবই বসার অধিকার আছে।” কিশোর যোগেন্দ্রনাথ তখন থেকে এই রূঢ় সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হলেন।
(২) কলকাতার ব্রজমোহন কলেজে সরস্বতী পূজায় তফসিলী ছাত্রদের পূজাগৃহের বাইরে দাঁড়িয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হ’ত, যেটা সুদীর্ঘকাল ধরে চলছিল। যোগেন্দ্রনাথ এই বৈষ্যম্যের প্রতিবাদ করেন। তিনি একত্রে পুষ্পঞ্জালি দেওয়ার কথা বললে, বর্ণ হিন্দু ছাত্ররা তফসিলী ছাত্রদের সঙ্গে একত্রে পুষ্পাঞ্জলি দিতে রাজি হয় না। এই নিয়ে তিব্র বাক বিতন্ডা হয়। তখন দৃঢ়চেতা যোগেন্দ্রনাথ অনুন্নত শ্রেণীর ছাত্রদের নিয়ে ঐ কলেজের অন্যত্র পৃথক পূজার বন্দোবস্ত করেন।
(৩)একবার যোগেন্দ্রনাথের একজন কলেজের বন্ধু বরিশাল শহরে কালীবাড়ীর নাট মন্দিরে প্রবেশ করে দেবীর আরাধনা করলে কিছু সংখ্যক উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্ররোচনায় তাকে যথেষ্ঠ নিগ্রহ ভোগ করতে হয়। তাকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। এই ঘটনার কথা সেই ছাত্র বন্ধুটি যোগেন্দ্রনাথকে জানালে, তিনি ক্ষোভে, দুক্ষে ফেটে পড়েন। তিনি ঐ দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরান্দোলন করেন। সারা শহর জুড়ে একটা হুলস্থুল সাড়া পড়ে যায়। স্থানীয় নেতৃত্ববৃন্দও চিন্তিত হন। এই উপলক্ষে অনুন্নত সম্প্রদায়ের এক বিরাট সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় যোগেন্দ্রনাথকে দলপতি বানানো হয়। সেই সভায় তীব্রভাবে ঐ অত্যাচারের নিন্দা করা হয়। তিনি দৃঢ় কন্ঠে সমস্ত বর্ণ হিন্দুদেরকে বলেদেন যে, অনুন্নত সম্প্রদায়ও মানুষের মর্যাদা দাবি করে এবং সেই দাবি রক্ষার জন্য তারা প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্রঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষের আজ সাধারণ নাগরিকের অধিকার থেকে বঞ্চিত, অবনমিত, লাঞ্ছিত ও বিপর্যস্ত। তাই এই প্রতিকার অবশ্যই করতে হবে।
তখন বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে নেতৃবৃন্দ এই সমস্যার একটা সন্তোষজনক মীমাংসার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। এর পরে এই ধরণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য নেতৃবৃন্দ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করেন।
সমাজ কল্যানমূলক কাজঃ- তিনি আইনপাশ করে আইনজীবি হিসাবে দরিদ্র কৃষকদের অনেক মামলা বিনা পয়সায় করে দিতেন। M.L.A. হিসাবে তিনি নমঃ-অধ্যূষিত আগৈলঝাড়া গ্রামের ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমিকে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। উত্ত্র বরিশালের বিভিন্ন বিলের জল নিষ্কাশন, কলকাতায় তফসিলী জাতিভুক্ত পুলিশ কনস্টেবলদের আবাসস্থলের নির্মাণ, তফসিলী ছাত্রদের ৭তম শ্রেণীর পরিবর্তে ৪তুর্থ শ্রেণী থেকে বৃত্তি প্রদান, মফঃস্বল শহরের ছাত্রাবাসগুলিতে তফসিলী ছাত্রদের আসন সংরক্ষণ এবং উক্ত ছাত্রদের জন্য সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
আইন ব্যবসা ও জনসেবাঃ-
যোগেন্দ্রনাথ
বুঝলেন, দেশের সেবা এবং বিশেষ করে অনুন্নত সম্প্রদায়ের উন্নতি করা যখন তাঁর ‘একমাত্র
লক্ষ্য’, তখন সেই কাজকে বাস্তবায়িত করতে হলে দরকার সুযোগ ও সুবিধা। কিন্তু দেউ তাঁকে
স্বেচ্ছায় কোন সুযোগ-সুবিধা দেবেনা। তাই সে সব আদায় করার জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে, কি
করে এসব অর্জন করা যাবে তার উপায় বের করা। আর সেই উপায় হচ্ছে- দেশের শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে না পারলে
কোন জনকল্যানকর কাজই সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
শুধু বক্তৃতা দিয়ে সরকারের সমালোচনা কিছু চাঁদা সংগ্রহ করে দেশ ও দশের উন্নতি করা সম্ভব
নয়। তাই সর্ব প্রথমে দরকার শাসন ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ ও প্রভাব বিস্তার করে তার সম্পূর্ণ
সদ্বব্যবহার করা। তাই তিনি জনসেবাকমূলক কাজের প্রসার করার জন্য বরিশাল সদর আদালতে ১৯৩৬ সালের ২৫শে
জুলাই আইনজীবি হিসাবে যোগদান করেন।
নতুন আইনজীবি যোগেন্দ্রনাথের লক্ষ্য শুধুমাত্র
অর্থ উপার্জনই ছিল না। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল, জনসেবা করা, যতদূর সম্বব তিনি সততার
সঙ্গে আইন ব্যবস্থা শুরু করেন। দুস্থ দরিদ্র লোকেরা যাতে মামলা মোকদ্দমার কবলে পড়ে
সর্বশান্ত না হয়, সেদিকে তিনি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। দরিদ্র কৃষকদের মোকদ্দমা স্বেচ্ছায়
গ্রহণ করে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি সেই মোকদ্দমার সুরাহা করেদিতেন। শুধুমাত্র তাঁর নিজের
জীবন চালানোর জন্য নুনতম যতটা অর্থের প্রয়োজন সেটাই উপার্জন করতেন। আর বাকি সবটা দরিদ্র
জনগণের উপকারের জন্য তিনি জীবনের অন্যতম ব্রত বলে গ্রহণ করেন।
এর ফলে বরিশালের বারের উকিলদের মধ্যে অসন্তোষ
দেখা দেয়। তারা মনে করল, তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে কারো এরকম উদারতা দেখানো অত্যান্ত
ক্ষতিকর স্থাপিত হবে। তাদের মধ্যে একজন তো এটা বলেদিল যে, ‘এটা ব্যবসা ক্ষেত্রে দান
ছত্র নয়। দয়া-ধর্ম দেখাতে হলে অন্যত্র যাও, এখানে নয়। কারণ এটা আদালত।’ কিন্তু কর্তব্যপরায়ণ
ও করুনা মমতার দুর্লভ আধার যোগেন্দ্রনাথ গভীর চাচ্ছিল্যের সঙ্গে এ সব শ্লেষ বাক্য উপেক্ষা
করে চলেন।
এর ফলে তাঁর আয়ের পথ কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে ছিল।
কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা ও মহত্ব বিকাশের পথ প্রশস্থ হতে থাকে। দেখতে দেখতে তিনি অল্প
সময়ের মধ্যে তিনি জেলার মধ্যে একজন প্রবাভশালী ও জনপ্রিয় উকিল হয়ে ওঠেন। আর তাঁর খ্যাতি
ও জনপ্রিয়তার ফলে ঐ বছর তিনি লোকাল বোর্ডের নির্বাচণে জয়লাভ করেন। চারিদিকে একটা চাঞ্চল্য
ও উদ্দিপনার সৃষ্টি হয়।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে সারা দেশে নির্বাচনের
কাজ শুরু হয়। যোগেন্দ্রনাথ সবে বরিশালের আইন ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা
খুবই খারাপ চলছিল। তখন তিনি ৩৩ বছরের পূর্ণ বয়ষ্ক যোদ্ধা। বরিশালের বাখার গঞ্জের উত্তর-পূর্ব
অঞ্চলের নির্বাচন ক্ষেত্রটি তফশিলি জাতির জন্য
সংরক্ষিত ছিলনা। তাই এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মত আর্থিক সংগতি তাঁর ছিলনা।
তবে প্রবল ইচ্ছা অনেক সময় কঠিন সমস্যার সমাধান সূত্র বের করে দেয়। বরিশালের কয়েকজন
উকিল ও কয়েকজন সরকারী কর্মচারী যোগেন্দরনাথকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বাধ্য করেন। মনোনয়ন
পত্র জমা দেওয়ার ২৫০ টাকা কয়েক জন বন্ধু মিলে জমা দেন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে
রইলেন, কংগ্রেস প্রার্থী হচ্ছেন- সরল দত্ত। যিনি জেলা কংগ্রেসের সভাপতি এবং প্রভাবশালী
জমিদার এবং বাংলার অন্যতম বিখ্যাত জাতীয় নেতা অশ্বিনী কুমার দত্তের ভাইপো।
পয়সার অভাব ও সময়ের সল্পতার জন্য যোগেন্দ্রন্থ
তাঁর নির্বাচন এলাকার সব জায়গায় যেতে পারেন না। কিন্তু তিনি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করছেন যেনে মানুষের মনে এক আনন্দের হৈ চৈ বইতে শুরু করে। জাতি নির্বিশেষে বহুলোক তাঁকে
সমর্থন ও সহযোগীতা করেন। সকল যুবকর্মী ও ছাত্রবৃন্দ সকলেই বিনা অনুরোধে নিজের থেকে
যোগেন্দ্রনাথকে নির্বাচনে জয়ী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। যোগেন্দ্রনাথকে চেনেন
না, কোনদিন দেখেননি, এরকম বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও কর্মীরা নিজের নিজের অর্থ ব্যয় করে
যোগেন্দ্রনাথের নির্বাচনের কাজ করেছেন।
ভোটের দিন জমিদার সরল দত্তের লোকজন গন্ডগোল শুরু
করে। অনেক জায়গায় ভোটদাতাদের ভোট কেন্দ্রেই পৌঁছাতে দেয়নি। মারামারি হাঙ্গামার ফলে
অনেক ভোটার আহত হয়। কিন্তু তাতেও যোগেন্দ্রনাথের জয়কে রুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। সরকারীভাবে
6th Feb. 1937 ভোটের ফল প্রকাশ হয়।
রিটার্নিং অফিসার বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঘোষণা করেন, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাংলার
আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তখন জনতার মধ্যে খুশি ও আনন্দের ঢেউ বইতে শুরু হয়।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল সম্পর্কে বিভিন্ন বিদ্যজনের মতামতঃ-
ডঃ সঞ্জয় গাজভিয়েঃ- সাংবিধানিক ভারতের নির্মাতা বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ
মন্ডল।
ডঃ প্রদীপ আগলাবেঃ- বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সামাজিক রাজনৈতিক শৈক্ষনিক
ধার্মিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনার জন্য ঐতিহাসিক আর ক্রান্তিকারী কাজ করেছেন;
সেই মহান ক্রান্তিকারী কাজ করার জন্য যে মহামানব বাবাসাহেবকে সহযোগীতা করেছেন, সেই
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের আবদান খুব মহত্ত্বপূর্ণ। যদি মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের এই সহযোগীতা
বাবাসাহেব না পেতেন,
তাহলে তিনি সংবিধান তৈরী করতে পারতেন না। ঐতিহাসিক সত্য।
ডঃ প্রদীপ আগলাবেঃ- বাবাসাহেব
যদি সংবিধান সভায় যেতে না পারতেন তাহলে এই দেশের সংবিধান ব্রাহ্মণদের পক্ষেই লেখা হ’ত। তাই যোগেন্দ্রনাথ
মন্ডল আম্বেদকরী আন্দোলনে যে সহযোগীতা করেছেন এবং মূলনিবাসীদের উদ্ধারের জন্য যে
কাজ করেছেন সেটা অসাধারণ কাজ
ঊষাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ঃ- ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের স্থান সম্পর্কে নানা সনের মনে যে বিভ্রান্তি বা সংশয় দেখা যায় সেটা বহুলাংশে অজ্ঞতার কারণে। তাঁকে দেশ বিভাগের জন্যেও অংশতঃ দায়ী করা হয়। অথচ তাঁরমত কর্মযোগী দেশবৎসল, স্ব-সম্প্রদায়ের উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ নেতা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে কমই দেখা গেছে।
কিরণ চন্দ্র ব্রহ্মঃ- ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেই চারিদিক হতে একটা চিৎকার প্রতিধ্বনিত হল যে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল দেশ ভাগ করেছেন, তাঁর মত সর্বনাশা লোক ভারতে আর কেউ নেই। এই মিথ্যা দোষারোপকারীরা অশ্লীল ভাষায় তাঁকে অজস্র গাল দিয়েছে। প্রকৃত পক্ষে ভারত ভাগে তাঁর কোন ভূমিকা ছিল না। তবে এই কুৎসা রটনাকারীদের উদ্দেশ্য কি তাও প্রনিধান করা করা দরকার। যারা এই মিথ্যা রটিয়েছে তারাও জানে ভারত ভাগে যোগেন্দরনাথের কোন ভূমিকাই ছিল না এবং তিনি দেশ ভাগের একান্ত বিরোধী ছিলেন। এই কুৎসা রটনার কারণ আমাদের কাছে মোটেই দুর্বোধ্য নয়। কারণ, এই দেশের নিপীড়িত মানুষের অন্তরে মহাপ্রাণ যে শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন সেটাকে নষ্ট করে দিয়ে সাধারণ মানুষের অন্তর থেকে তাঁকে চিরতরে মুছে দিতে৩ পারলে তাঁর আজীবন সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেওয়া যায়। এই ছিল কুৎসা রটনাকারীদের মূল উদ্দেশ্য।
বাংলা বিভাজনের পক্ষে কংগ্রেস আর উচ্চবর্ণীয়রা কেন ছিল সেটা জানা খুব দরকার ।
প্রথম কারণঃ- বাংলা প্রান্তে মুসলিম এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর(বিশেষ করে
নমঃশুদ্র) লোকদের সংখ্যা সর্বাধিক ছিল । সেখানে মুসলিম লীগের সরকার ছিল। যদি বাংলার
বিভাজন না হয় তাহলে মুসলিম আর পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর সত্তা চিরস্থায়ী হবে। সেখানে উচ্চবর্ণীয়দের
কোন অধিকার থাকবে না ।
দ্বিতীয় কারণঃ- বাংলার খুলনা,
যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল এই এলাকা থেকে বাবা সাহেবকে নির্বাচিত করে সংবিধান সভায় পাঠানো হয় । তাই বাংলা বিভাজন করে বাবাসাহেব যে
ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেখান থেকে বাবাসাহেবের সদস্য পদ খারিজ করার উদ্দেশ্যে
বাংলা ভাগ করে ছিল ।
তৃতীয় কারণঃ- যে নমঃ(শুদ্র)রা
বাবাসাহেবকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত করে পাঠিয়েছেলেন তাদেরকে সাজা দেওয়ার জন্য যাতে
তারা আজীবন মুসলমানদের আধীন থাকে, এই শিক্ষা
দেওয়ার জন্য বাংলা ভাগ করেছিল ।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের বাংলা ভাগের বিরোধীতাঃ-
১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি। আওয়াজ তোলেন স্বাধীন যুক্ত বাংলার। তাঁর আন্দোলনের মূল ভাবনা ছিল, তফসিলী হিন্দু ও মুসলিম ঐক্য। সংখ্যা গরিষ্ঠতার বিচারে স্বাধীন যুক্ত বাংলায় সরকার গঠন করার মূল চাবিকাঠি থাকবে এদের হাতে। গঠিত হবে ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চ-বর্ণীয় শোষন মুক্ত একটি সার্বভৌম স্বাধীন বাংলা। আর এই ভাবনা ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শরৎচন্দ্র বসুরও।
এবার মহাপ্রান
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের অনন্য সাধারণ কর্মের মধ্যে তিনটি কাজের উল্লেখ করছি। যে কাজগুলি
সত্যিই অনন্য সাধারণ। সে কাজগুলি দ্বিতীয় বার আর কেউ করে দেখাতে পারেননি। আর পারবেন
কিনা সন্দেহ। সেই কাজগুলি হচ্ছে-
১. বাখারগঞ্জ
সাধারণ সিটে জয় লাভ।
২. সংবিধান সভায়
বি. আর. আম্বদেকরকে পাঠানো।
৩.১৯৬৫ সালের
বি.ন. লকুর কমিটির সুপারিশ রদ করে নমঃশুদ্র, সুড়ি, ধোবা ও রাজবংশীদেরকে Scheduled Caste এর মধ্যে অন্তর ভুক্ত রাখা।
গণপরিষদ ঘটনের প্রস্তুতিঃ-
ভারতের হাতে তাদের শাসন ক্ষমতা হস্থান্তর করার জন্য তিনজন শক্তিশালী মন্ত্রীকে ইংরেজ সরকার পাঠাতে বাধ্য হন। অনেক দিন ভারতে অবস্থান করে তাঁরা বিভিন্ন দলের নেতৃমন্ডলীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে থাকেন। এই সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতার দাবি খুব জোরদার হইয়া ওঠে। ভারতের শাসনভার কংগ্রেসের হাতে অর্পণ করার জন্য কংগ্রেস প্রবল দাবি তোলে। অপর দিকে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয় যে, কংগ্রেস ভারতের দশ কোটী মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে না। সুতরাং ভারতের শাসন ক্ষমতা কেমলমাত্র কংগ্রেসের হাতে অর্পণ করা যাবে না। কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে যখন এইরূপ বিতর্ক চলছে তখন ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রারম্ভিক আয়োজন হিসাবে একটি অস্থায়ী শাসন পরিষদ ও পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের জন্য একটি সর্বজন সম্মত গণপরিষদ গঠনের নির্দেশ ঘোষণা করে প্রতিনিধিদল বিলাতে ফিরে যান।
সারা ভারতে তফসিলী জাতির জন্য প্রাদেশিক আইন সভায় মোট একশ একান্নটি (১৫১) আসন সংরক্ষিত ছিল। বাংলার তফসিলী জাতি ফেডারেশন এই সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। যোগেন্দ্রনাথ নিজের তহবিল থেকেই তফসিলী জাতি ফেডারেশন এর কাজের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন। ফেডারেশনের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় বেশী সংখ্যক প্রার্থী দাঁড় করান সম্ভব হয় না। মাত্র পাঁচজন প্রার্থী ফেডারেশনের মনোনয়ন প্রাপ্ত হন। তাঁরা হলেন-১)কামিনী প্রসন্ন মজুমদার-ফরিদপুর, ২) মনোহর ঢালী-ফরিদপুর ৩) চন্দ্রমাধব সরকার-ঢাকা
৪) উপ্রন্দ্রনাথ মল্লিক-যশোহর ৫) যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল- বাখকরগঞ্জ উত্তর সাধারণ আসনএবং বাখরগঞ্জ দক্ষিন(সংরক্ষিত) আসন।
প্রার্থী মনোনয়নের পূর্বেই যোগেন্দ্রনাথ, মুকুন্দ বিহারী মল্লিক মহাশয়ের সঙ্গে একটা আপোষ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছিলেন; যাতে তিনি ফেডারেশন মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনও স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় না করান। কিন্তু মল্লিক মহাশয় তাতে রাজি না হয়ে উত্তর ফরিদপুরের অধিবাসী জনৈক ব্যক্তিকে নির্বাচনে দাঁড় করান। তিনও ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। তিনি নির্বাচনে পরাজিত হন,কিন্তু সতের হাজার ভোট পান। তফসিলী জাতির এই প্রার্থীটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলে ফরিদপুর থেকে দু’জন ফেডারেশন প্রার্থীই যে নির্বাচনে জয়লাভ করতেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।কামিনী মজুমদার ও মনোহর ঢালী মহাশয়রা অল্প সংখ্যক ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। অপর দু’জন ফেডারেশনের প্রার্থীও অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। আর্থিক অসচ্ছলতা হেতু ব্যাপক প্রচার অভিযান চালান অসম্ভব হওয়ায় এই পরাজয় ঘটে। এদিকে বাখরগঞ্জের একটি সাধারণ ও একটি সংরক্ষিত কেন্দ্রে যোগেন্দ্রনাথের নির্বাচন পরিচালনা করতেই তাঁর সময়, সামর্থ ও অর্থ নিঃশেষ হয়ে যায়।
বাখারগঞ্জ উত্তর সাধারণ কেন্দ্রে যোগেন্দ্রনাথকে পরাজিত করার জন্য কংগ্রেস আগে থেকেই নানা রকম প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এই আসনেই তিনি ১৯৩৬-৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর বাসস্থান ও এই নির্বাচন কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। ঐ কেন্দ্রে বর্ণহিন্দুর ভোট সংখ্যা তফসিলী জাতির ভোট সংখ্যা থেকে অনেক বেশী। তবুও কংগ্রেস তাদের প্রার্থীর জয়লাভ সম্পর্কে আশান্বিত থাকতে পারেনি। তারা দরখাস্ত করে তাদের ভোট সংখ্যা বিশেষতঃ মহিলা ভোট সংখ্যা কয়েক হাজার বাড়িয়ে নেন। দরখাস্ত দাখিলের শেষ তারিখ গভীর রাত পর্যন্ত দু’-তিন জন গেজেটেড অফিসার দরখাস্তের ফর্মগুলিতে স্বাক্ষর করেন এবং সেগুলি গভীর রাত পর্যন্ত ইলেকশন অফিসে গ্রহণ করা হয়। এই ভাবে কয়েক হাজার ভোট তাঁরা বাড়িয়ে নেন।
বাখরগঞ্জ উত্তর সাধারণ কেন্দ্রের ভোট গণনার আগেই দক্ষিন সংরক্ষিত কেন্দ্রের ভোট গণনা হয়। যোগেন্দ্রনাথ বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঐ কেন্দ্রে জয়লাভ করেন। ভারতের নির্বাচন পর্ব সমাপ্ত হয়ে গেলে জানা গেল যে, একমাত্র যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলই ফেডারেশনের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। এমন কি সর্বভারতীয় তফসিলী জাতির অবিসংবাদী নেতা ডঃ আম্বেদকরও নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি।
যোগেন্দ্রনাথ যে সংরক্ষিত কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিল, সেটা পিরোজপুর ও পটুয়াখালী মহকুমার অন্তর্গন। পিরোজপুর মহকুমাটি নমঃ প্রধান মহকুমা। তবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের বাড়ি ঐ কেন্দ্রের বাইরে ছিল।
যোগেন্দ্রনাথ বাংলার আইনসভায় নির্বাচিত না হলে বাংলা থেকে ডঃ আম্বেদকরকে ভারতের গণপরিষদের জন্য সদস্য নির্বাচন করা কোনও ভাবেই সম্ভব হ’ত না। কারণ ভারতের অন্য কোন প্রদেশ থেকে তাঁকে নির্বাচিত করার সম্ভাবনা আদৌ ছিল না। তিনি যদি যোগেন্দ্রনাথের ঐকান্তিক চেষ্টায় গণপরিষদে নির্বাচিত হ’তে না পারতেন তাহলে গণপরিষদে সংখ্যালঘু সাব কমিটির চেয়ারম্যানও হ’ত পারতেন না। ফলে তফসিলী জাতির জন্য যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশীক আইন সভায় আসন সংরক্ষণ এবং সরকারী চাকরীতে তাদের জন্য সংরক্ষণ ও স্কুল কলেজে শিক্ষার জন্য অর্থ সাহায্য ইত্যাদি বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা ভারতের সংবিধানে করা হয়েছে তার কিছুই তফসিলী জাতির ভাগ্যে জুটনা। কারণ, মহামণীষী নেতা ডঃ আম্বদেকর ভারতের সংবিধানও রচনা করেছিলেন। সংবিধানে তফসিলী জাতির জন্য সকল প্রকার বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা ডঃ আম্বেদকরই করেছিলেন। কিন্তু এই সবকিছুর মূলে রয়েছে যোগেন্দরনাথের ত্যাগ ও অবদান; আর সেই যোগেন্দ্রনাথকে নির্বাচিত করেছিলেন পিরোজপুর ও পটুয়াখালি মহকুমার নমঃগণ। সুতরাং তাঁরা সমগ্র ভারতের তফসিলী জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাসঃ-
সমগ্র ভারতে তফসিলী জাতি ফেডারেশনের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র যোগেন্দ্রনাথের নির্বাচনে জয়লাভের কাহিনী বাস্তবিকই বিস্মকর। তাঁর বিরুদ্ধে সংরক্ষিত আসনে অনেক প্রার্থী ছিলেন। তারমধ্যে প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিলেন উপেন্দ্রনাথ এদবর। তিনি পিরোজপুরে ওকালতি করতেন এবং ১৯৩৭ সাল থেকে তখন পর্যন্ত ঐ কেন্দ্রের নির্বাচিত M.L.A. ছিলেন। আর সাধারণ আসনে প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের খ্যাতনামা নেতা সতীন্দ্রনাথ সেন। যোগেন্দ্রনাথের নিজস্ব নির্বাচন কেন্দ্র বাখরগঞ্জ উত্তর একটি মাত্র সাধারণ আসন বিশিষ্ট হওয়ায় সেখানে কংগ্রেসের প্রবল বিরধিতার বিরুদ্ধে যোগেন্দ্রনাথের নির্বাচিত হওয়ার ভরসা খুবই কম মনে করে পিরোজপুরের কয়েক জন সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি তাঁকে পিরোজপুর থেকে প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এদেঁর মধ্যে উল্যেখযোগ্য হচ্ছেন- আটঘরের মধুসূদন মন্ডল- সাব ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট, ডাঃ রোহিনী কুমার মন্ডল এবং পিরোজপুরের উকিল ও পরবর্তিকালে যোগেন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র জগদীশচন্দ্র মন্ডলের শ্বশুর রাজকুমার মন্ডল।
পিরোজপুর মহকুমায় অসংখ্য উপযুক্ত প্রার্থী আছেন- এটা মনে করে যোগেন্দ্রনাথ প্রথমদিকে উপরোক্ত হিতৈষীগণের অনুরোধে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। পরে উক্ত ব্যক্তিদের অনুরোধে তিনি প্রার্থী হতে সম্মত হন। যোগেন্দ্রনাথ ছাড়া আরও আরজন প্রার্থী ঐ সংরক্ষিত আসনে ননোনয়ন পত্র দাখিল করেন। বিকালে সভা বসে। প্রার্থী উপেন্দ্রনাথ এদবর যোগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বদন্দ্বিতা করবেন। সভায় স্থির হ’ল যে, অন্য সকলে যোগেন্দ্রনাথের অনুকূলে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু চারজন প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেন না। তা সত্বেও মোট পাঁচজন প্রার্থী থেকে গেল। এর ফলে তফসিলী প্রার্থীদের মধ্যে একটা প্রাথমিক নির্বাচন হবে। একটা সংরক্ষিত আসনে চারজনের বেশি প্রার্থী থাকলে একটা প্রাথমিক নির্বাচন হয়। আর প্রাপ্ত ভোট সংখ্যানুসারে প্রথম চারজনকে শেষ(ফাইনাল) নির্বাচন প্রার্থী রাখা হ’ত এবং বাকী ক’জনের প্রার্থীপদ বাতিল হয়ে যেত। সেই সময় এই রকম নিয়ম ছিল। এইভাবে ১৯৪৬ সালের ২৪ জানুয়ারী প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং ২৮ জানুয়ারী পিরোজপুর পটুয়াখালী কেন্দ্রের প্রাথমিক নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায় যোগেন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী উপেন্দ্রনাথ এদবর অপেক্ষা প্রায় তিনগুণ বেশী ভোট পেয়েছেন।
প্রাথমিক নির্বাচনের ফল দেখে উপেন্দ্রবাবু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কংগ্রেস পক্ষ থেকে তাঁকে সম্ভাব্য আর্থিক ও অন্যবিধ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তিনি আর সেটা করলেন না। পরাজিত নদমুল্লার কামিনী কুমার সমাদ্দার, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, উপেন্দ্রনাথ এদবর, ক্ষেত্রমোহন মাঝি এবং অগ্নিকুমার মন্ডলের বিরুদ্ধে ১৮৮২ সাসের দশম আইনের ২৬৩ ধারামতে মামলা করেন।
চারজনের মধ্যে একমাত্র যোগেন্দ্রনাথই মামলা কন্টেস্ট করেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে একটা হল তাঁর বাসস্থান পিরোজপুর পটুয়াখালি কেন্দ্রের মধ্যে নয়। যদিও যোগেন্দ্রনাথ এই মামলায় জয়ী হন।
লকুড়ক মিটির সুপারিশের প্রতিবাদে যোগেন্দ্রনাথ
১৯৬৫
সালের একটি ঘটনা পশ্চিম বঙ্গে তফসিলী সমাজের মধ্যে দারুণ সোরগোল সৃষ্টি করেছিল। ভারত সরকার ষাটের দশকে তফসিলী জাতির
তালিকার রদবদল সম্পর্কে একটা কমিটি নিয়োগ করেছিল। উক্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন স্যার বি.এন.লকুড়, আই.সি.এস.। উক্ত কমিটি ১৯৬৫(25th Aug.1965) সালের মাঝামাঝি পঃবঙ্গের তফসিলী জাতির তালিকা থেকে ৪টি
জাতিকে বাদ দেবার সুপারিশ করে। উক্ত চারটি জাতি হল -নমঃশুদ্র,রাজবংশী,শুঁড়ি ও ধোবা।
এখানে একথা উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত কমিটি কর্তৃক পঃবঙ্গ থেকে মাত্র দু’জন ব্যক্তির মতামত গ্রহন করা হয়। এই দু’জন হলেন পঃবঙ্গ ডিপ্রেসড্ ক্লাসেস লীগের পক্ষ থেকে শ্রীযোগেশচন্দ্র বিশ্বাস এবং উক্তসংস্থার অন্যতমসদস্য তিলজলার শ্রীকালীচরনদাস। এই সুপারিশের প্রতিবাদে কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে তফসিলী সম্প্রদায় সমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন মন্ত্রী মুকুন্দবিহারী মল্লিক ।এই সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় যে, এই সুপারিশ যাতে পার্লামেন্টে গৃহীত না হয় , তজ্জন্য ভারতের প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে ডেপুটেশন দেওয়া একান্ত প্রয়োজন । যেহেতু যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এক সময় দিল্লীর অন্তর্বতী মন্ত্রী সভার আইন মন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে ডেপুটেশনের নেতৃত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। তাঁকে সহায়তা করার জন্য তাঁর সঙ্গী হলেন তৎকালীন পঃবঙ্গের দুই এম.এল.এ. মহানন্দ হালদার ও অপূর্বলাল মজুমদার এবং কলিকাতা হাইকোটের্র এ্যাডভোকেট রমেশচন্দ্র মন্ডল। দিল্লীতে পৌঁছে প্রথমে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ফোনে সময় নির্ধারণ করে প্রধান মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান । এই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন কেবলমাত্র এ্যাডভোকেট রমেশচন্দ্র মন্ডল। কারণ দিল্লী পৌঁছাবার পর অপূর্বলাল মজুমদার ও মহানন্দ হালদার যোগেন্দ্রনাথের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রেখেছিলেন বলে জানা য়ায় না ।লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে যোগেন্দ্রনাথ এই কথাটি হৃদয়ঙ্গম করান যে, নমঃমুদ্র সম্প্রদায় প্রধানতঃ পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী ছিল এবং তারা ছিল কৃষিজীবী। ভারত ভাগ হওয়ার পর তারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসে ।ফলে আজ তারা প্রায় সকলেই পঃবঙ্গে খেত-মজুর বা দিনমজুরে পরিনত হয়েছে ।তাদের মধ্যে কিছু কিছু তপসিলী ছাত্র বৃত্তি পেয়ে কিছুটা লেখা পড়া শিখেছে এবং সংরক্ষণের সুযোগে দু’চার জনে সরকারী চাকুরী পেয়ে কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করছে । পঃবঙ্গে তাদের জনসংখা ৩০-৪০ লক্ষের মত । সুতরাং তাদের যদি তফসিলী জাতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়, তবে তাদের ভবিষ্যৎ চিরকালের মত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে এবং তফসিলী ছাত্রবৃত্তির সাহায্যে তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা লাভের যেটুকু সুযোগ বর্তমানে রয়েছে তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এর পর তিনি শুঁড়ীদের কথা বললেন যে, তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হল দেশী মদ তৈরী করা ও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রকার মদের ব্যবসা করা। এদের মধ্যে হয়তো কেউ মদের ব্যবসা করে অর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করলেও সামগ্রিকভাবে এরা দরিদ্র এবং শিক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত পশ্চাদপদ। এরা যদি তফসিলী তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, তবে শিক্ষালাভ ও সরকারী চাকরী পেয়ে ভবিষ্যতে তাদের উন্নতিলাভের কোন সম্ভাবনা থাকবেনা। রাজবংশীরা পঃবঙ্গে বৃহত্তম তফসিলী সম্প্রদায়। চাষবাস ও মাছ ধরা তাদের প্রধান জীবিকা। তারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং অধিকাংশই নিরক্ষর। তাদের অবস্থা যে শোচনীয় তা নিজের চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না। ধোবাদের অবস্থাও তদ্রুপ। পঃবঙ্গে এই সব সম্প্রদায় সমূহের প্রকৃত জনসংখ্যা ৬০-৭০ লক্ষের মত হবে। এদের তফসিলী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া অত্যন্ত অমানবিক কাজ হবে। যোগেন্দ্রনাথ একথাও জানিয়ে দিলেন যে, নমঃশুদ্র সহ এই সব সম্প্রদায় সমূহের মানুষেরা লকুড় কমিটির এই রিপোর্টে যার পর নাই হতাশা গ্রস্ত এবং উত্তেজিত। লকুড় কমিটি এই সমস্ত সম্প্রদায়ের যে সব সামাজিক সংগঠন আছে,তাদের সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগ না করে বা তাদের মতামত না শুনেই কিভাবে এরূপ সুপারিশ করলেন ,তাতে তারা দারুনভাবে ক্ষুব্ধ। পঃবঙ্গে এ নিয়ে যে ভাবে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে, তাতে যদি সত্বর এই সুপারিশ রদ করা না হয়, তাহলে পঃবঙ্গে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ঘটে যেতে পারে। প্রধান মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যোগেন্দ্রনাথের বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে, লকুড় কমিটির সুপারিশ যাতে কারযকরী না হয়, তা তিনি অবশ্যই দেখবেন। প্রধান মন্ত্রীর আশ্বাস পেয়েও যোগেন্দ্রনাথ পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলেন না। তিনি তখনকার রাষ্ট্রপতি সর্ব্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেন। ঐ দিনই রাষ্ট্রপতি রাত্রে একটি ডিনার পার্টিতে ডেকেছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথকে ডিনার পার্টিতে নিমন্ত্রণ জানালেন এবং বললেন, যোগেন্দ্রনাথ ডিনার পার্টিতে এলে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি তার সঙ্গে কথা বলবেন ।সন্ধ্যা বেলা যোগেন্দ্রনাথকে ডিনার পার্টিতে নিয়ে যাবার জন্য রাষ্ট্রপতি গাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। যোগেন্দ্রনাথ রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছালেই তিনি তাঁর সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন। রাষ্ট্রপতি জানালেন যে, পাকিস্থানে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে যোগেন্দ্রনাথের প্রসংশনীয় ভূমিকার কথা তিনি অবগত আছেন। তিনি যোগেন্দ্রনাথের বক্তব্য শুনলেন এবং লকুড় কমিটির সুপারিশ যাতে কারযকরী না হয় তজ্জন্য যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে কথাদেন। যোগেন্দ্রনাথের এই ভূমিকার কথা কলকাতা পৌঁছে গেলে যোগেন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দেবার জন্যে কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে একটি জনসভা আহ্বান করা হয়। সেখানে যোগেন্দ্রনাথ, প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ দেন। যোগেন্দ্রনাথ এম.পি. বা এম.এল.এ. না হয়েও এই চারটি সম্প্রদায়ের জন্য যে কাজ করেছিলেন, পঃবঙ্গে তফসিলী সংরক্ষিত আসনের ৮/১০ জন এম.এল.এ. থাকা সত্বেও তারা কিছুই করতে সমর্থ হন নি। এই সম্বর্ধনা সভায় নমঃশুদ্র, রাজবংশী, শুঁড়ি, ধোবা সহ সমস্ত তফসিলী জাতির পক্ষ থেকে যোগেন্দ্রনাথের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় ।
এখানে একথা উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত কমিটি কর্তৃক পঃবঙ্গ থেকে মাত্র দু’জন ব্যক্তির মতামত গ্রহন করা হয়। এই দু’জন হলেন পঃবঙ্গ ডিপ্রেসড্ ক্লাসেস লীগের পক্ষ থেকে শ্রীযোগেশচন্দ্র বিশ্বাস এবং উক্তসংস্থার অন্যতমসদস্য তিলজলার শ্রীকালীচরনদাস। এই সুপারিশের প্রতিবাদে কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে তফসিলী সম্প্রদায় সমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন মন্ত্রী মুকুন্দবিহারী মল্লিক ।এই সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় যে, এই সুপারিশ যাতে পার্লামেন্টে গৃহীত না হয় , তজ্জন্য ভারতের প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে ডেপুটেশন দেওয়া একান্ত প্রয়োজন । যেহেতু যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এক সময় দিল্লীর অন্তর্বতী মন্ত্রী সভার আইন মন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে ডেপুটেশনের নেতৃত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। তাঁকে সহায়তা করার জন্য তাঁর সঙ্গী হলেন তৎকালীন পঃবঙ্গের দুই এম.এল.এ. মহানন্দ হালদার ও অপূর্বলাল মজুমদার এবং কলিকাতা হাইকোটের্র এ্যাডভোকেট রমেশচন্দ্র মন্ডল। দিল্লীতে পৌঁছে প্রথমে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ফোনে সময় নির্ধারণ করে প্রধান মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান । এই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন কেবলমাত্র এ্যাডভোকেট রমেশচন্দ্র মন্ডল। কারণ দিল্লী পৌঁছাবার পর অপূর্বলাল মজুমদার ও মহানন্দ হালদার যোগেন্দ্রনাথের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রেখেছিলেন বলে জানা য়ায় না ।লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে যোগেন্দ্রনাথ এই কথাটি হৃদয়ঙ্গম করান যে, নমঃমুদ্র সম্প্রদায় প্রধানতঃ পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী ছিল এবং তারা ছিল কৃষিজীবী। ভারত ভাগ হওয়ার পর তারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসে ।ফলে আজ তারা প্রায় সকলেই পঃবঙ্গে খেত-মজুর বা দিনমজুরে পরিনত হয়েছে ।তাদের মধ্যে কিছু কিছু তপসিলী ছাত্র বৃত্তি পেয়ে কিছুটা লেখা পড়া শিখেছে এবং সংরক্ষণের সুযোগে দু’চার জনে সরকারী চাকুরী পেয়ে কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করছে । পঃবঙ্গে তাদের জনসংখা ৩০-৪০ লক্ষের মত । সুতরাং তাদের যদি তফসিলী জাতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়, তবে তাদের ভবিষ্যৎ চিরকালের মত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে এবং তফসিলী ছাত্রবৃত্তির সাহায্যে তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা লাভের যেটুকু সুযোগ বর্তমানে রয়েছে তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এর পর তিনি শুঁড়ীদের কথা বললেন যে, তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হল দেশী মদ তৈরী করা ও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রকার মদের ব্যবসা করা। এদের মধ্যে হয়তো কেউ মদের ব্যবসা করে অর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করলেও সামগ্রিকভাবে এরা দরিদ্র এবং শিক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত পশ্চাদপদ। এরা যদি তফসিলী তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, তবে শিক্ষালাভ ও সরকারী চাকরী পেয়ে ভবিষ্যতে তাদের উন্নতিলাভের কোন সম্ভাবনা থাকবেনা। রাজবংশীরা পঃবঙ্গে বৃহত্তম তফসিলী সম্প্রদায়। চাষবাস ও মাছ ধরা তাদের প্রধান জীবিকা। তারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং অধিকাংশই নিরক্ষর। তাদের অবস্থা যে শোচনীয় তা নিজের চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না। ধোবাদের অবস্থাও তদ্রুপ। পঃবঙ্গে এই সব সম্প্রদায় সমূহের প্রকৃত জনসংখ্যা ৬০-৭০ লক্ষের মত হবে। এদের তফসিলী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া অত্যন্ত অমানবিক কাজ হবে। যোগেন্দ্রনাথ একথাও জানিয়ে দিলেন যে, নমঃশুদ্র সহ এই সব সম্প্রদায় সমূহের মানুষেরা লকুড় কমিটির এই রিপোর্টে যার পর নাই হতাশা গ্রস্ত এবং উত্তেজিত। লকুড় কমিটি এই সমস্ত সম্প্রদায়ের যে সব সামাজিক সংগঠন আছে,তাদের সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগ না করে বা তাদের মতামত না শুনেই কিভাবে এরূপ সুপারিশ করলেন ,তাতে তারা দারুনভাবে ক্ষুব্ধ। পঃবঙ্গে এ নিয়ে যে ভাবে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে, তাতে যদি সত্বর এই সুপারিশ রদ করা না হয়, তাহলে পঃবঙ্গে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ঘটে যেতে পারে। প্রধান মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যোগেন্দ্রনাথের বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে, লকুড় কমিটির সুপারিশ যাতে কারযকরী না হয়, তা তিনি অবশ্যই দেখবেন। প্রধান মন্ত্রীর আশ্বাস পেয়েও যোগেন্দ্রনাথ পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলেন না। তিনি তখনকার রাষ্ট্রপতি সর্ব্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেন। ঐ দিনই রাষ্ট্রপতি রাত্রে একটি ডিনার পার্টিতে ডেকেছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথকে ডিনার পার্টিতে নিমন্ত্রণ জানালেন এবং বললেন, যোগেন্দ্রনাথ ডিনার পার্টিতে এলে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি তার সঙ্গে কথা বলবেন ।সন্ধ্যা বেলা যোগেন্দ্রনাথকে ডিনার পার্টিতে নিয়ে যাবার জন্য রাষ্ট্রপতি গাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। যোগেন্দ্রনাথ রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছালেই তিনি তাঁর সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন। রাষ্ট্রপতি জানালেন যে, পাকিস্থানে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে যোগেন্দ্রনাথের প্রসংশনীয় ভূমিকার কথা তিনি অবগত আছেন। তিনি যোগেন্দ্রনাথের বক্তব্য শুনলেন এবং লকুড় কমিটির সুপারিশ যাতে কারযকরী না হয় তজ্জন্য যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে কথাদেন। যোগেন্দ্রনাথের এই ভূমিকার কথা কলকাতা পৌঁছে গেলে যোগেন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দেবার জন্যে কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে একটি জনসভা আহ্বান করা হয়। সেখানে যোগেন্দ্রনাথ, প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ দেন। যোগেন্দ্রনাথ এম.পি. বা এম.এল.এ. না হয়েও এই চারটি সম্প্রদায়ের জন্য যে কাজ করেছিলেন, পঃবঙ্গে তফসিলী সংরক্ষিত আসনের ৮/১০ জন এম.এল.এ. থাকা সত্বেও তারা কিছুই করতে সমর্থ হন নি। এই সম্বর্ধনা সভায় নমঃশুদ্র, রাজবংশী, শুঁড়ি, ধোবা সহ সমস্ত তফসিলী জাতির পক্ষ থেকে যোগেন্দ্রনাথের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় ।
0 comments:
Post a Comment