Monday 26 September 2016

// // Leave a Comment

প্রকৃতি ও সত্যের প্রতীক নবদুর্গা কলাবৌ লেকখঃ- কাশ্যপ


প্রকৃতি ও সত্যের প্রতীক নবদুর্গা কলাবৌ
লেকখঃ- কাশ্যপ
     ভারতের পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, আসাম রাজ্যে এবং বাংলাদেশে বাঙালির সব চেয়ে বড়ো      উৎসব শারদীয়া উৎসব বা দুর্গা পূজা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং একই সঙ্গে বাংলাভাগের ফলে ভারতের বিভিন্ন অবাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিরাও দুর্গাপূজা করে থাকে। কিন্তু দুর্গাপূজার প্রকৃত ইতিহাস সামান্য কিছু বাঙালি জানে। দুর্গাপূজা সর্ব প্রথম চালু হয় বাংলায়।  দুর্গাপূজা শুরু হয় আজ থেকে আনুমানিক ১২০০-১৩০০ বছর আগে।  
   ১২০০-১৩০০ বছর আগে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিলনা। ঐ সময়ের আগে বঙ্গ প্রদেশে প্রচলিত  ছিল প্রকৃতি ও সত্যের প্রতীক “নবদুর্গা বাকলাবৌ”-এর পূজার। যাঁরা দুর্গা পূজা করেন তাঁরা নবদুর্গা বা কলাবৌ-এর বিষয়টা একদম জানেন না।
     ‘নবদুর্গা’- আক্ষরিক বিশ্লেষণ হ’ল নব-মানে ‘নয়’ দুর্গা-মানে দুর্গতিনাশিনী বা বিপদ থেকে  রক্ষাকারী। আর্যরা বা ব্রাহ্মণবাদীরা ভারতবর্ষে আসবার পূর্বে ভারতীয় মূলনিবাসী তথা অনার্য বা ভারতের আদিবাসিন্দারা এমন ‘নয়’ রকম গাছের সংস্পর্শে এসেছিল যার মধ্যে নানান ধরণের গুণ ছিল। ঔষধীয় গুণ, খাদ্য গুণ ইত্যাদি। অনার্য ভারতীয়গণ ঐ নয় রকম গাছের পূজা করত দেবী দেবতা জ্ঞানে নয়, ‘উপকারী জিনিস’-এই হিসাবে। পরবর্বতীকালে বিদেশী আর্যরা  গাছের মধ্যে দেবত্ব বা দেবীত্বভাব আরোপিত করে । ভারতের মূলনিবাসী তথা অনার্য তকমা দেওয়া মানুরা,এই নয় রকম গাছের মধ্যে এই ঔষধীয় ও খাদ্য দুই গুণই পেয়েছিল। সেগুলি হ’ল-  
(১) কলা (২) কচু (৩) হলুদ (৪) জয়ন্তী (৫) অশোক (৬) বেল (৭) ডালিম (৮) মান (৯) ধান।  
কলাগাছ সহজে সংগ্রহ করা যায়। প্রতীক হিসাবে কলা গাছের আকৃতিও সুন্দর। তাই প্রাচীন ভারতীয় মানুষ সংঘবদ্ধভাবে ভক্তিভাবে নির্দিষ্ট স্থানে কলাগাছ রেখে এবং কলা গাছের নিচে বাকি ৮টি গাছের প্রতীকি নমুনা সাজিয়ে জ্ঞানী মানুষ তথা মুনিরা (ঋষিরা নয়) ঐ নয়টি গাছের গুণাবলী  সম্পর্কে মানুষকে উপদেশ দিতেন। এটিই ছিল প্রাচীন ভারতের নিয়মাবলী। বিশেষভাবে বাংলায়।
নয়টি গাছের এবং তার ফলের গুণাবলী-
(১) কলাঃ- (ক) কলা একটি পুষ্টিকর খাদ্য। (খ) পালাজ্বর বা দু’দিন অন্তর জ্বর –তার ঔষধ কলা।  (গ) যকৃত, অগ্ন্যাশয়, কিডনি ভাল রাখে কলা। (ঘ) ডিসেন্ট্রি রোগেরও ভাল ঔষধ কলা (ঙ)  মৃতবৎসা নারীর পক্ষে উপকারী কলা। (চ) শিশুর মাতৃ বিয়োগ হলে ঐ শিশুর মাতৃদুগ্ধের অভাব পূরণ করে কলা। (ছ) কলা আর তার দ্বিগুণ ওজনের ছাতু এক সঙ্গে মিশিয়ে খেলে স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায়। কলার এই অশেষ গুণের জন্য কলার অপর নাম ব্রাহ্মণী শক্তি। তাই আর্যপূর্ববর্তী ভারতীয়রা কলাকে সম্মান করতেন বা পূজা করতেন তার গুণাবলীর জন্য।  
(২) কচুঃ- কচুর খাদ্যগুণও যথেষ্ঠ। বিশেষ করে কিডনির পক্ষে ভীষণ ভাল।
(৩) হলুদঃ- হলুদ একটি ভাল মশলা। বিষক্রিয়া নাশকও বটে। কাঁচা হলুদ চর্ম রোগের ঔশধ। যেখানে অনেক লোক জড় হয় সেখানে রোগ ছড়াতে পারে। প্রাচীনবাংলায় তাই জড় হওয়া লোক বাড়িয়ে গিয়ে কাঁচা হলুদ বেঁটে গায়ে মাখত, যাতে রোগের জীবানু ধ্বংস হয়। অথবা সামাজিক উৎসবের আগে সবাই গায়ে কাঁচা হলুদ বাঁটা গায়ে মাখত। একই উদেশ্যে বিয়ের সময় ছেলে এবং  মেয়েকে কাঁচা হলুদ বেঁটে স্নান করান হয় ঐ রোগ মুক্তির জন্যই। যা বর্তমানে গাত্রহরিদ্রা নামে পরিচিত।
(৪) জয়ন্তীঃ- জয়ন্তী মূল ঔষধ তৈরীতে লাগে। জয়ন্তী ধবল কুষ্ঠের মহাঔষধ। সাত রকম কুষ্ঠের চার রকমের কুষ্ঠ জয়ন্তীর মূলেই সেরে যায়। তাই জয়ন্তী গাছকে মানুষ সম্মান জানাত বা পূজা করত।
(৫) অশোকঃ- যাকে হিন্দিতে বলে সীতা অশোক। এই অশোক হল সমস্ত স্ত্রী ব্যাধির মহাঔষধ অশোক গাছ থেকে মদ বা ঔষধ তৈরী হয় তাকে বলা হয় অশোকারিস্ট বা অশোক সিরাপ।
(৬) বেলঃ- কাঁচা বেল সমস্ত উদর বা পেটের রোগের সবচেয়ে ভাল ঔষধ। কাঁচা বেল পুড়িয়ে  খেতে হয়। একদম কচি বেল রোদে শুকিয়ে গুড়ো বা ছাতুর ন্যায় করে হাল্কা মধু দিয়ে খেতে হয়।  তাহলে দীর্ঘ দিনের আমাশয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বেলের অশেষ গুণের জন্য এর অপর নাম শ্রীফল।
(৭) ডালিমঃ- ডালিমের ছাল, শেকড় ও ফুল সমস্তই স্ত্রীরোগের খুব ভাল ঔষধ বর্তমানে ক্যানসার  আক্রান্তদের কেমো বা রে দেবার সময় বেশি করে ডালিম ফলের রস খেতে বলা হয়। ডালিমের এতই গুণ।
(৮) মানঃ- যাকে বলা হয় ওল। গরমের সময় এর খাদ্য গুণ শরীরকে ঠান্ডা রাখে। অত্যাধিক গরমে মানুষের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে; সেই সময় মান এর রস ঔষধের কাজ করে। তাই মান খাদ্য এবং ঔষধ দুই-ই।
(৯) ধানঃ- ধান থেকে চাল, চিড়া, খই সবটাই মানুষের বেঁচে থাকার উপাদান পাওয়া যায়।  প্রাচীনকালে ভাত পচিয়ে মদ তৈরী হ’ত যা থেকে নানা ধরনের ঔষধ তৈরী হ’ত।
      এই নয় রকমের গাছের বিশেষ গুণ থাকায় মানুষ এই গাছ গুলোকে শ্রদ্ধা করত। এই নয়টি গাছের একত্রিত নাম ছিল চন্ডিকা শক্তি। এই নয় রকমের গাছপালা-এর মধ্যে যে চন্ডিকা (শক্তিশালী) শক্তির অভিব্যক্তি তার মিলিত শক্তির নাম হল নবচন্ডী। আর এই নয় রকম গাছের মিলিত নাম হল নবপত্রিকা। আজ থেকে ১৩০০ বছর আগে বাংলায় এই নবপত্রিকার পূজাই প্রচলিত ছিল। কলাগাছকে কেন্দ্র করে বাকি আটটা গাছের প্রতীকি জড় করে পূজা করা হত।
    আজ থেকে বাংলায় ১৩০০ বছর আগে যখন কাল্পনিক দুর্গাপূজার প্রচলন হ’ল তখন কৌশল করে দুর্গাপূজাকে প্রচার প্রসারের জন্য গাছের ঔ নয়টি শক্তিকে নাম দেওয়া হল নবদুর্গা এবং দুর্গাপূজার সঙ্গে কাল্পনিক চরিত্র লক্ষ্মী, গনেশ, কার্তিক প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে নয় নয়টি গাছের মিলিত শক্তিকে কলাবৌ সাজিয়ে স্থান দেওয়া হল।
    লজ্জার বিষয় বাঙালী সমাজ দুর্গাপূজায় মেতে ওঠে; কিন্তু ঔ কলা ‘বৌ’ রূপী নবদুর্গার প্রকৃত ইতিহাস জানেনা। প্রকৃতি এবং সত্যের প্রতীক ঐ কলাবৌ বা নবদুর্গাই যে আসল। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ সবটাই কাল্পনিক এবং মিথ্যা। সত্যের পূজা না করে বাঙালী মিথ্যার পূজার করে চলেছে।
(সহায়ক গ্রন্থঃ ‘নমঃশিবায় শান্তায়’ -লেখক আন্দমূর্তি) 




Read More

Sunday 25 September 2016

// // Leave a Comment

দুর্গাপূজার উৎপত্তি-সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার

দুর্গাপূজার উৎপত্তি
(সৌজন্যে- শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র সুধা। লেখক শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর।
সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার, পৃষ্ঠাসংখ্যা-868-870
       সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের জমিদার কুল্লভট্টের পুত্র কংস নারায়ণ প্রায় আট লক্ষ টাকা ব্যয়ে মহাধুমধামে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তারপর থেকেই ক্রমে ক্রমে বাংলার ঘরে ঘরে এই পূজার প্রচলন হয়েছে। এই জন্যই বলা হয় চণ্ডীর জন্ম বাংলাদেশে।
দুর্গা ও কালীর উদ্ভব সম্বন্ধে দুটি কথা
     মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে (সিন্ধু ও বেলুচিস্থানে) শিবকে দিয়ে হিন্দুর যাত্রা শুরু এবং পূর্বাঞ্চলে দুর্গা ও কালীকে দিয়ে তার শেষ।
     বাংলাদেশের নাটোর জেলার তাহেরপুর পরগনায় জমিদার কংসনারায়ণ (বাংলার বারো ভূঁইয়ার একজন, ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন) নিজের ক্ষমতা, আভিজাত্য ও ধনৈশ্বর্য জাহির করার উদ্দেশ্যে অভিনব কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার কুলগুরু তাকে দুর্গাপূজা করার প্রস্তাব করেন। এর আগে কেউ কখনও দুর্গার নাম শোনে নি। অতএব, লোকে তা মানবে কেনজমিদারের এ সন্দেহ ছিল। জনসাধারণ কর্তৃক মেনে নেবার দায়িত্ব নিয়ে কুলগুরু তাকে আশ্বস্ত করেন। কংসনারায়ণের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। কৃত্তিবাস ওঝার জন্মস্থান নদীয়া জেলার রাণাঘাট মহকুমার প্রায় এক ক্রোশ দক্ষিণ-পশ্চিমে স্থিত ফুলিয়া গ্রামে। কৃত্তিবাস আনুমানিক ১৪৪৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বেঁচে ছিলেন। কুলগুরু এই কৃত্তিবাসের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলায় রামায়ণ তর্জমা করান। সংস্কৃত রামায়ণে দুর্গার কোনই উল্লেখ নেই। সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করানোর সময় কৃত্তিবাসকে দিয়ে কংসনারায়ণের  কুলগুরু রামায়ণের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত করান যে, রাম অকালবোধন করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। বাংলার সাধারণ জনগণ সংস্কৃত জানে না, প্রায় নিরক্ষর। রামায়ণের দোহাই দিয়ে জমিদার কংসনারায়ণকে দিয়ে দুর্গাপূজা করিয়ে জনগণকে গ্রহণ করালো। তখনকার আমলে (আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে) নয় লক্ষ টাকার অধিক খরচ করে চোখ ধাঁধানো জাকজমকপূর্ণ পূজা প্রথম প্রচলন করা হয়। এত ব্যয়বহুল পূজায় পুরুত ঠাকুর কি বিরাট পরিমাণ দক্ষিণা পেয়েছিলেন পাঠক একবার অনুমান করুন । এ জন্যই দুর্গাপূজার আর এক নাম বড় পূজা। এ পূজা বাংলার বাইরে অবাঙালি হিন্দুর মধ্যে প্রচলন নেই বললেই চলে। যেখানে বাঙালি সেখানেই দুর্গাপূজা। বহু আদিবাসী এই দুর্গাপূজার সময় শোক পালন করে। তা হলে কি বলা অত্যুক্তি হবে যে, দুর্গার পিতা জমিদার কংসনারায়ণ, জন্মভূমি বাংলাদেশের নাটোর জেলার তাহেরপুর পরগণায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমাদ্ধের্ ?
     কেউ কেউ বলেন কৃত্তিবাসের জন্ম ১৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে, মাঘ মাসে, নদীয়ার শান্তিনগর থানার ফুলিয়া গ্রামে। কেউ বলেন বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার প্রেমতলীর নিকটে। ১২ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে শাস্ত্রীয় শিক্ষার জন্য যান রাজশাহীর বরেদ্রভূমিতে। তার পরে রাজানুগ্রহ লাভের জন্য গৌড়ের রাজা গণেশ (১৪১৫-১৪১৮)/সুলতান জালালুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪১৫-১৪১৮) এর দরবারে যান।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদি নাম ছিল শ্রী রাম পাঁচালি
     পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার সম্পাদিত কৃত্তিবাসী রামায়ণ ১৮০২-১৮০৩ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে প্রকাশিত হয় ১৮৩০-১৮৩৪ সালে। পরবর্তী চার শতাব্দীতে কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হয়। রামায়ণে কৃত্তিবাস দুর্গার অকালবোধন লিখিতভাবে আমদানী করলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, সেই সূত্রে ২০১৪ সালে দুর্গার বয়স হয় আনুমানিক ৫৬৪ বছর।
History & Origin of Durga Puja
-By Subhamoy Das, About.com Guide

The First Durga Puja in Bengal the first grand worship of Goddess Durga in recorded history is said to have beed celebrated in the lage 1500s. Folklores say the landlords or zamindar of Dinajpur and Malda initiated the first Durga Puja in Bengal. According to another source, Raja Kangshanarayan of Taherpur or Bhabananda Mazumdar of Nadiya organized the first Sharadiya or Autumn Durga Puja in Bengal in c1606.


* দুর্গাপূজার উৎপত্তি ও বছরে ৩ বার কেন দুর্গা পূজা হয়
  এ প্রশ্নের উত্তরে আচার্য সুভাষ শাস্ত্রী তাঁর অমৃতালোকগ্রন্থের ১০৫ থেকে ১০৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন:-
     মূর্ত্তি পূজার পক্ষে প্রামাণ্য শাস্ত্রে কোন নির্দেশ নাই। তথাকথিত ব্রাহ্মণেরা দেব-দেবীর স্রষ্টা। কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে শ্রমজীবী কৃষকদের অর্থ সম্পদ শোষণ করা এবং জমিদারদের খেয়ালী মনের পূর্ণতা দানের জন্য কল্পিত পুঁথি রচনা করে দুর্গাপূজা সৃষ্টি করা হয়েছিল।

     ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজশাহী জেলার চলন বিলের পার্শ্বে জমিদার কংসনারায়ণ এর দ্বারা শরৎকালে প্রথম দুর্গাপূজা হয়েছিল। এই পূজার উৎপত্তির মহা তিন নায়ক হলেন (১) জমিদার কংসনারায়ণ, (২) তাঁর সভাপতি কৃত্তিবাস ওঝা, এবং (৩) তাঁর বংশের পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীকৃত্তিবাস ওঝা পয়ার ছন্দে গোঁজামিল দিয়ে কাল্পনিকভাবে মূল বাল্মিকী রামায়ণের নকল করে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করে দুর্গাপূজাঢুকিয়ে দেন। আর রমেশ শাস্ত্রী কঠোর চেষ্টা করে চণ্ডীপাঠের পুস্তক ও দুর্গাপূজার পদ্ধতি রচনা করেন। সেই সময় আট লক্ষ টাকা খরচ করে প্রথম দুর্গাপূজা হয় চলনবিলে। এই পূজার আয়োজন দেখে পাশের ভাতুরিয়া পরগণার জমিদার জগৎ নারায়ণ বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেন। তিনি খরচ করেন নয় লক্ষ টাকা। এই দুই জমিদারের নাম কেনা-বেচা এবং প্রভাব বিস্তারের জন্যই বাংলা এলাকায় দুর্গাপূজার উৎপত্তি ও প্রসার বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। মূল বাল্মীকি রামায়ণে কোন দেব-দেবী ও দুর্গাপূজার নামগন্ধ নেই। সুরথ রাজা দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে কাহিনী আছে তা অনৈতিহাসিক। ফলে সুরথ রাজার দুর্গাপূজাকরার ঘটনাও মিথ্যা। ফলে ভারতবর্ষের অন্য হিন্দু জনসমাজ দুর্গাপূজা করেন না একমাত্র বাঙালি জনসমাজ ছাড়া। সুরথ রাজা এবং রামচন্দ্র যদি দুর্গাপূজা করেই থাকেন তবে ভারতবর্ষের অন্য স্থানে এবং অযোধ্যায় দুর্গাপূজা নেই কেন? সমগ্র বাংলা এলাকা, আসাম এবং বিহারের কিছু অংশে দুর্গাপূজার বহুল প্রচলন কারণ বাঙালি যেখানে আছে সেখানেই  দুর্গাপূজারছড়াছড়ি। ভারতবর্ষের সংস্কৃত সাহিত্য, প্রামাণ্য পুস্তকসমূহ এবং হিন্দী সাহিত্যে দুর্গাপূজার কোন কথা নেই বলে তাঁদের আচরিত ধর্মে দুর্গাপূজার স্থান নেই। অথচ কৃষিপ্রধান বাংলা এলাকায় দুর্গাপূজা প্রচলন করে পুরোহিত এবং জমিদার নামক শোষকেরা। একটু ভেবে দেখুন এক বছরের মধ্যে তিন বার তিন ভাবে দুর্গাপূজার নামে কৃষি প্রধান শ্রমজীবী লোকদের শোষণ করা হয়। কৃষকেরা চৈত্র-বৈশাখ মাসে কঠোর পরিশ্রম করে আউশ ধান, পাট এবং আমন ধান রোপণ করেন। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে আউশ ধান এবং পাট কৃষকের ঘরে এলে এই সময় শরৎকালে দুর্গাপূজারবিধান দিয়ে কৃষকদের আউশ ধান এবং পাট বিক্রয়ের অর্থ শোষণ করা হয়। মাত্র কিছুদিন পরেই কার্তিক মাসে আবার কাত্যায়নীপূজা নাম দিয়ে আশ্বিন মাসে যে দুর্গাদেবী ও তার বাহিনীকে বিসর্জনদিয়ে ত্যাগ করা হলো বা মেরে ফেলা হলো সেই দুর্গাদেবীকে পুনরায় সাধারণ মানুষদের শোষণ করার জন্য আবার ডেকে আনা হলো ব্রাহ্মণদের মন্ত্রের জোরে। পুনরায় চলল ধর্মের নামে তথাকথিত শূদ্রদের অর্থ সম্পদ শোষণ। ফাল্গুন মাসে আমন ধান ও চৈতালী ফসলের টাকা শোষণ করার জন্য বাসন্তী পূজার নামে দুর্গাদেবী এবং তার বাহিনীকে ডেকে আনা হয় পুনরায় কৃষকদের সকল অর্থ সম্পদ বাসন্তীপূজার নামে শোষণ করার জন্য। ভেবে দেখুন এক মা দুর্গা ও তার সাথের সকলকে তথাকথিত পুরোহিতের দল তিনবার তিনভাবে ডেকে এনে সমাজকে শোষণ করছে। এ সকল ঘটনায় বুঝতে পারা যায় তথাকথিত দেব-দেবীরা পুরোহিতদের মন্ত্রের দাস। তারা দেব-দেবীকে ইচ্ছেমতো মন্ত্রের জোরে ডেকে আনে আবার ইচ্ছামত বিসর্জন দেয় বা মেরে ফেলে। কারণ একটাই তা হলো শূদ্র নাম দিয়ে বৃহৎ জনসমাজকে ধর্মের নামে শোষণ এবং শাসন করা। এমনিভাবে হরেক রকম দেব-দেবীর কাল্পনিক মূর্তি, পুরাণ, উপপুরাণ এবং অন্য বহু কাল্পনিক গাল-গল্পকে ধর্ম নাম দিয়ে অধর্মযুক্ত পুস্তক রচনা করে কৌশলে জনসমাজের উপর ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতের দল সমাজের উপর চালাচ্ছে শোষণ ও লুণ্ঠন।
Read More

Sunday 28 August 2016

// // Leave a Comment

ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ সম্পর্কে বাবা সাহেব আম্বেদকর

ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ সম্পর্কে 
বাবা সাহেব আম্বেদকর
      আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, যে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ আলাদা। অনেক ব্রাহ্মণই ব্রাহ্মণ্যবাদ-এর ধাজিয়া উড়িয়েছেন। অনেক ব্রাহ্মণ টেনে আনা হয় যে, তাঁরা মূলনিবাসী মহামানবদের সংগ্রামে  সহযোগীতা করেছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার আপনাদের কাছে একটি প্রশ্ন করছি, ক’জন ব্রাহ্মণ জাতিব্যবস্থা নির্মূল করার জন্য সংগ্রাম করেছেন? এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে আপনারা বলতে পারেন বর্তমানে অনেক ব্রাহ্মণতো তাঁদের পদবী মুছে দিয়ে পৈতে ফেলে দিয়ে মূলনিবাসীদের  আন্দোলনে সামিল হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। জানি, আমাদের মধ্যে পন্ডিতের অভাব হবে না ব্রাহ্মণদের ঢাল হয়ে সামনে আসার জন্য।   
    যাইহোক, এ বিষয়ে বাবা সাহেব তাঁর জাতব্যবস্থার বিলুপ্তি (Annihilation of Caste) বইয়ে জাত ব্যবস্থা ধ্বংসের পথ-নির্দেশের প্রশ্নটির উপর  বেশি গুরুত্ব দিয়ে তিনি  বলেছেন, “আমার মতে, এই কাজ করা প্রায় অসম্ভব। আপনারা হয়তঃ এটা জানতে চাইতে পারেন যে, আমি এরকম কেন বলছি? যেসব কারণগুলি আমার মনে এই বিশ্বাস তৈরী করেছে,  তার কয়েকটি আমি উল্লেখ করব, যেগুলোকে আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তার মধ্যে একটি   হল-  বিদ্বে ভাবনা (attitude of hostility)  ব্রাহ্মণরা   জাত ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চায় না।  বরং যারা এটা নষ্ট করার জন্য আন্দোলন করছে, তাদের বিরোধিতা করাই এদের কাজ। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সংস্করার এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংস্কার আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছে ব্রাহ্মণরা। কিন্তু জাত ব্যবস্থার নির্মূল করণ আন্দোলনের অংশগ্রহন  করার জন্য ব্রাহ্মণদের পাওয়া যায় না। জাত ব্যবস্থার বাঁধা ভাঙ্গতে সেনাবাহিনী গড়তে এগিয়ে আসে না।
      এরকম আশা করা যেতে পারে কি, ভবিষ্যতে  কোন ব্রাহ্মণ এই জাত ব্যবস্থা ধবংসের জন্য নেতৃত্ব করবেন? আমি বলছি- কখনও নয়। আপনারা জানতে জানতে চাইতে পারেন যে, এই পিছনে কারণ কি যার জন্য ব্রাহ্মণরা সমাজ সংস্কার থেকে দূরে সরে  থাকে? আপনারা হয়তঃ তর্ক করবেন যে, ব্রাহ্মণরা জানে যে, হিন্দু সমাজের ধ্বংসের কারণ হ’ল জাত-ব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষিত ও কৃষ্টিসম্পন্ন শ্রেণী হিসাবে তারা জাত ব্যবস্থার পরিনামের প্রতি উদাসীন থাকতে পারবে, এটা আশাকরা ঠিক নয়। আপনারা হয়তঃ এই তর্ক ও করতে পারেন যে, অনেক ধর্মনিরপেক্ষ ব্রাহ্মণ আছে। যদি পুরোহিত শ্রেনীর ব্রাহ্মণরা জাত ব্যবস্থা ভাঙতে না চায়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ ব্রাহ্মণরা জাতব্যবস্থার নির্মূল করতে চাইবে। এই সব যুক্তি-তর্ক শুনে বেশ যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। কিন্তু এই সব যুক্তি-তর্কের মধ্যে একটি কথা ভুলে যাওয়া হয়। সেটি হ’ল জাতব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটলে ব্রাহ্মণ জাতির খুব ক্ষতি হবে। এই সব তথ্যকে ধ্যান রেখে আমরা এই আশা করতে পারি কি, ব্রাহ্মণরা এই ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব করতে রাজি হবেন; যার পরিণাম হিসাবে ব্রাহ্মণ জাতির শক্তি এবং সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে? পুরোহিত ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ গ্রহন করতে ধর্মনিরপেক্ষ  ব্রাহ্মণদের পাওয়ার আশা করা যুক্তিযুক্ত হবে কি? আমার বিচারে, ধর্মনিরপেক্ষ ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিত শ্রেনীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে পার্থক্য করা অর্থহীন। তারা উভয়েই পরস্পরের আত্মীয়। তারা একই শরীরের দু’টি বাহু। এক বাহুর অস্তিত্বের জন্য অন্য বাহু যুদ্ধ করতে বাধ্য। (Is it reasonable to expect the secular Brahmins to take part in a movement directed against the priestly Brahmins? In my judgment, it is useless to make a distinction between the Secular Brahmins and Priestly Brahmins. Both are kith and kin. They are two arms to the same body and one bound to fight for the existence of the other.)” 
    হ্যাঁ, এখানে দেখলেন তো বাবা সাহেব বলেছেন, তাঁর বিচারে ধর্মনিরপেক্ষ ব্রাহ্মণ (যাঁদেরকে আমরা ব্রাহ্মণবাদের উর্ধে ধরতে পারি আমাদের পান্ডিত্য দিয়ে) আর পুরোহিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ (যাঁদেরকে আমরা ব্রাহ্মণ্যবাদকে পুষ্ট করা বা রক্ষাকারী বলতে পারি আমাদের পান্ডিত্য দিয়ে) এই দুই শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে পার্থক্য করা অর্থহীন। তাঁরা উভয়েই পরস্পরের আত্মীয়। তাঁরা একই  শরীরের দু’টি বাহু। এর পরে আর বলার কিছু থাকে কি? হ্যাঁ, আপনাদের কাছে অনেক কিছু বলার আছে, সেটা আমরা জানি। তা না হলে তো আপনাদের আধিপত্য এবং অন্য অনেক কিছু হাত ছাড়া হয়ে যাবেন। তাই নয় কি?      

    
Read More

Sunday 7 August 2016

// // Leave a Comment

সারা জগৎ দেবতার অধীন। দেবতা মন্ত্রের অধীন। মন্ত্র ব্রাহ্মণের অধীন


দেবাভিনাম্‌ জগত সর্বম্‌। মন্ত্রাংশিনাম্‌ তে দেবতা 
তম অন্ত্রাম্‌ ব্রাহ্মণাধিনাম। ব্রহ্মণাং নাম তে দেবতা ।। 
-এই মন্ত্রে আছে সারা জগৎ দেবতার অধীন। দেবতা মন্ত্রের অধীন। মন্ত্র ব্রাহ্মণের অধীন। (বুঝুন ঠেলা) reference- নিচে দেওয়া আছে হিন্দিতে।
প্রফেসর Vilas Kharat দ্বারা মারাঠীতে লেখা বই-এর হিন্দি তে অনুবাদ হয়েছে। সেই বইয়ের নাম হচ্ছে- ডাঃ বাবসাহব আম্বেদকর কি হত্যা কিসনে, ক্যাসে আউর ক্যিউ কি? বইয়ের 23 page এর থেকে সংগৃহীত।
Read More

Saturday 30 July 2016

// // Leave a Comment

ডাঃ সি, এস, মীডের সংক্ষিপ্ত জীবনী -লেখক_ শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর। সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার

ডাঃ সি, এস, মীডের সংক্ষিপ্ত জীবনী
  ডাঃ সিসিল সিলাস মীড,(১৮.১০.১৮৬৬  ১৭.৬.১৯৪০)
(সৌজন্যে- শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র সুধা। লেখক_ শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর। সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার, পৃষ্ঠাসংখ্যা-৩৪৩-৩৪৪)  
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই অক্টোবর তাঁর জন্ম হয়। তাঁর মৃত্যু হয় দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুন। তিনি ছিলেন ভারতের পূর্ব বাংলায় ব্যাপ্টিস্ট মেডিক্যাল মিশনারী। তাঁর পিতার নাম সিলাস মীড, যিনি এডিলেড শহরের ফ্লিন্ডার স্ট্রীট ব্যাপ্টিষ্ট চার্চে থাকতেন। এখানেই তিনি খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হন, অর্গান বাদক হয়ে যান এবং গীর্জার গায়ক দলের মাস্টার হয়ে যান। তিনি প্রিন্স আলফ্রেড কলেজ ও এডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বি. এ. পাশ করেন। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে এম.বি;বি.এস-এ স্বর্ণমেডাল পেয়ে পাশ করেন (এখানে স্মরণীয়, বাবাসাহেব ডঃ বি.আর. আম্বেদকর সেই ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দেই ১৪ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন।)

ডাঃ সুভাস চন্দ্র বিশ্বাস লিখিত অস্ট্রেলিয়ার ড. সি,এস,মীডের জীবন কাহিনীগ্রন্থের ৮ পৃষ্ঠার ড. সি.এস. মীডের জন্ম তারিখ লেখা আছে ১৬ অক্টোবর ১৮৬৬ খ্রিঃ।
* ২৯ বছর ৪ মাস বয়সে ২৪ ফেব্রয়ারি ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে Miss. Aliec Pappin-কে বিবাহ করেন। পৃঃ ১৮
* Miss. mead ১৯২৫ খ্রি. মারা যান (পৃষ্ঠা : ৩৭)।
* ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ওড়াকান্দি তথা ভারত ত্যাগ (পৃষ্ঠা: ৪৯- মীডের চিঠি)
* মৃত্যু ১৭ই জুন ১৯৪০ খ্রিঃ। মৃত্যুকালে বয়স ৭৪ বছর ৬ মাস ২১ দিন (পৃষ্ঠা ৩৯)
* ডাঃ সি. এস. মীডের বাড়ির ঠিকানা ৬৫, Finder Street, Near Victoria Square, Adelaide, Asutralia.
   ১৯০৬ সালে ওড়াকান্দি আমন্ত্রণ, ১৯০৬ সালে ফরিদপুরে।

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপ্টিস্ট ইউনিয়ন পরিচালিত ফরিদপুর মিশনের চাকুরিতে যোগদান করেন ডাঃ সি.এস.মীড। তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে আগমন করেন। বৃহত্তর পাবনা ও ফরিদপুরে মেডিক্যাল মিশনারী হিসেবে কাজ করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে এ্যালিস পাপ্পিন নাম্নী অস্ট্রেলিয়ার প্রথম দিককার এক ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীকে বিয়ে করেন। তাঁদের ছিল দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটি শৈশবেই মারা যায়। ২ কন্যার নাম কুমারী ডরথী ও কুমারী মার্জ্জরী (পি.আর.ঠাকুরের আত্মচরিতপৃঃ ৫৬)। মীড সাহেব বাংলায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন এবং তিনি ছিলেন মুক্ত মাঠের ক্লান্তিহীন ধর্মপ্রচারক। তিনি স্থানীয় ভাষায় প্রচার পুস্তিকা ও ছন্দোবদ্ধ স্তব স্তোত্র ও ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করতেন। বঙ্গদেশে তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশন ফেডারেশনের সকল ক্রিয়া কর্মের চালিকা শক্তি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার সিডুল্ড কাস্ট নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণ পান ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে ডাঃ সি.এস.মীডের আগমন। কয়েকটি অস্ট্রেলীয় এবং ভারতীয় মিশনের কর্মীবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ নমঃশূদ্র কেন্দ্র ওড়াকান্দি গ্রামে যান এবং ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডাঃ সি.এস.মীডের নেতৃত্বে কর্মীবাহিনীও সেখানে যান। বহু বাধা পেরিয়ে ওড়াকান্দি গ্রামে ৫ বিঘা জমি অর্জন করেন এবং সেখানে মিশন , অনেক স্কুল, একটি দাতব্য চিকিৎসালয়, একটি বিধবা নিবাস, একটি চার্চ এবং তার কর্মীবাহিনীর আবাসন গৃহাদি তৈরি করেন। যদিও এসব করেও মিশনারীদের উচ্চাশার সব কিছু পূরণ করতে পারেন নি কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে বাংলার যে কোনো চার্চের চেয়ে ওড়াকান্দি চার্চের সদস্য সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এখানেই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্টগণ তাদের কাজকর্ম চালাতেননমঃশূদ্রদের মধ্যে কাজ করার জন্য ডাঃ সি.এস. মীডকে কাইজার-ই-হিন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
    স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ার কারণে তিনি ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে অবসরে যেতে বাধ্য হন। এবং অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে গিয়ে বাস করার সময়ে এডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের স্টাফ হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ব্যাপ্টিস্ট মিশনের দক্ষিণ অস্ট্রেলীয় সেক্রেটারী হিসেবে উদ্বুদ্ধকারী প্রচারক ও লেখক হিসেবে মিশনারী স্বার্থের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অগ্রগামী করে চলেন।
W.Barry লিখিত There Was A Man (Melbourne. Nd.)  GERARD B. BALL-এর বর্ণনা অনুযায়ী প্রাপ্ত। সাউথ ক্রস কলেজ, ২০০৪, ইলেক্ট্রনিক ভারসান এটি, Evangelical History Association O Australia and the author, 2004 Gi content.
প্রসঙ্গ ডাঃ সি.এস. মীড
ডাঃ সিসিল সিলাস মীড, সংক্ষেপে ডাঃ সি.এস.মীড, একজন অস্ট্রেলীয় মিশনারী ডাক্তার। ব্রিটিশ ভারতে তিনি এখানে এসেছিলেন ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে। শিক্ষা, চাকুরী, আত্মসম্মান এবং সামাজিক ন্যায়বিচার পেতে তিনি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে প্রভূত সাহায্য ও পথনির্দেশনা দান করেছিলেন। আজকাল অনেকে বলে থাকেন মিশনারীদের একমাত্র লক্ষ্য গরীব মানুষদের খ্রিষ্টান বানানো। কিন্তু কতজন নমঃশূদ্র খ্রিষ্টান হয়েছেন? তথাকথিত উচ্চবর্ণদের চেয়ে কম। তিনি এ রকম একজন মহান ব্যক্তি। মনেপ্রাণে একজন সত্যিকার খ্রিষ্টান ব্যাপ্টিস্ট। ভারতীয় সংস্কৃতির বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একটি সমাজকে প্রস্তুত করেছিলেন। শিক্ষিত সমাজ যাঁদের ত্যাগ করেছিল, শাসকেরা যাঁদের কথায় কর্ণপাত করেনি, তাঁদের দায়িত্ব তিনি নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। দুঃখজনক ব্যাপার হল এই উপমহাদেশের লোকেরা তাদের সমস্ত প্রচেষ্টার দ্বারা সেই সব মানুষদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের আন্দোলনের বদলে তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে কোণঠাসা করে রেখেছিল। এতে ভারত ধর্মীয় জাতবৈষম্যের দেশের তালিকায় নথিভুক্ত হয়ে গেছে।
Dr. C.S. Mead-এর জীবনী Walter Barry “There Was a man”. তাঁর মৃত্যুর ৫ বছর পরে লেখা।

সংক্ষিপ্ত সার
শিক্ষা, সঙ্গীত এবং খেলাধুলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডাঃ সিসিল সিলাস মীড অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় পুরস্কার প্রদানের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সার্জারীতে প্রথম সোনার মেডেল তিনিই পেয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে। তথাপি তিনটি ক্ষেত্রে নিশ্চিত উজ্জ্বল আশাপ্রদ জীবন ছেড়ে তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে একজন মিশনারী ডাক্তার হিসেবে পূর্ববঙ্গে (বর্তমানের বাংলাদেশে) চলে আসেন। তথাকথিত উচ্চজাতের মধ্যে ধর্মযাজকত্ব শেষে ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিয়ে স্ত্রী ও দুটি ছোট মেয়ে নিয়ে বঙ্গের গাঙ্গেয় বদ্বীপের জলাভূমিতে বসবাসরত সমাজবাহ্য নমঃশূদ্রদের মধ্যে বসবাস ও যাজকত্ব করার জন্য এলেন। তাঁদের জীবনে প্রচণ্ড পরিবর্তন আনার কারণে - বাস্তব এবং আধ্যাত্মিকভাবে - ভারতের ভাইস্‌রয় তাঁকে রূপার মেডেল দিয়ে পুরস্কৃত করেন।
    শ্রী সুভাষ বিশ্বাস লিখিত অস্ট্রেলিয়ার ডঃ সি. এস মীডের জীবন কাহিনীগ্রন্থের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠা ডঃ সি.এস মীডের বাড়ির ঠিকানা ও বর্ণনা।
    জন্ম - ১৬ই অক্টোবর ১৮৬৬, পিতা-সিলাস মীড M.A. LLB. ৫ আগস্ট ১৮৬১ প্রতিষ্ঠিত ফিল্ডার স্ট্রীট ব্যাপটিস্ট মিশনারির প্রথম ধর্মযাজক। বিবাহ- মিস স্টাপেলের সঙ্গে। মৃত্যু-১৭ই জুন ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর ৬ মাস ২১ দিন। মিসেস মীড মারা যান ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। মীডের ২ মেয়ে- বড় Miss Dorothy, ছোট মেয়ে মারজেরী, কোন ছেলে নেই - পৃষ্ঠা ২৩। ডাঃ মীডকে সাহায্য করতেন Mrs. Mead এবং Miss. Bertha Tuck, Miss Alice Pappin. এ্যালিস প্যাপিন সাউথ অস্ট্রেলিয়ার উইলিয়ামস্টোনে-এ জন্মগ্রহণ করেন - পৃষ্ঠা ১৯। ২৯ বছর ৪ মাস বয়সে ডাঃ মীড বিয়ে করেন ২৪ ফেব্রয়ারি ১৮৯৬-এ অন্ধ্র প্রদেশের Ongole-এ বসে, কোলকাতা থেকে ১৩৭০ কি. মি দক্ষিণে, মাদ্রাজ থেকে ২৯৩ কি. মি উত্তরে - পৃষ্ঠা ১৮। Octaober, ১৮৯৩-এ যখন মীড ফরিদপুরে এলেন তখন ফরিদপুর মিশনারি সেন্টারে ছিলেন Miss Arnold, Miss Gilbert, Miss Alice Pappin, Miss Parsous, Miss Tack & Miss Archer. ৮ বছর বয়সে C.S. Mead-কে প্রিন্স আলফ্রেড কলেজে ভর্তি করেন। ১৮৮২ সালে Scholarship১৮৮৭-তে B.A, ঐ সালেই এডিলেড মেডিকেল কলেজে ভর্তি, ১৮৮৯ সালে M.B; Ch. B ডিগ্রি লাভ।
M.B = Bachelor of Medicine; Ch. B=Chiruragiae Baccalaures (Bachelor of Surgery) 1st class Hons. ৩০ বছর মানুষের সেবার পর Dr. Mead নিজেই হাঁপানীতে আক্রান্ত- পৃষ্ঠা ৩২

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে চিরকালের জন্য ওড়াকান্দি ত্যাগ- গুরুচাঁদকে চিঠি পৃষ্ঠা ৪০।
Read More

Saturday 23 July 2016

// // Leave a Comment

শ্রীশ্রী হরিচাঁদ কে কে কে ? ? ? -কালিদাস বারুরী


শ্রীশ্রী হরিচাঁদ কে ?
-কালিদাস বারুরী
     ইংরাজী ১৮১২ সনের ১১ই মার্চ পৃথিবীতে একটি জ্যোতিষ্কের জন্ম হল। খানা-খন্দ-বিল-বাওড় ঝুপড়ির ভিতরে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর উজ্জল দীপ্তি। হাজার বছরের অন্ধতমস কারারুদ্ধ ঘৃণিত দাস  জীবনে লাগল দীপ্তি ছটা কালরাত্রির ঘোর কাটিয়ে অজ্ঞানতার জড়তা সরিয়ে আলোর তলায় জড় হতে লাগল মানুষ। জাত পাতের যাতাকলে পিষ্ট মানুষ শিকল ছিড়ে অচ্ছতের বাঁধন কেটে ছুটে এলকাতারে কাতারে মানুষ জ্যোতিষ্কের আকর্ষণে। জ্যোতিষ্কের স্পর্শে অন্ধ পেল আলোর সন্ধান, মুক পেল বাকশক্তি, নিরক্ষর পেল বর্ণমালা আদর্শলিপি। আপামর মানুষ পেল সহস্রাব্দের ঘৃণা লাঞ্ছনা, শোষণ দাসত্ব গোলামীর হাত থেকে মুক্তির স্বাদ। জ্যোতিষ্ক সকলকে সস্নেহে ধর্ম দিলেন, কর্ম দিলেন, বিদ্যা দিলেন, ধন মান যশ দিলেন। দিলেন সামাজিক মর্যাদা। দিলেন অদম্য সাহস আর বীরত্বের শিরস্ত্রাণ।
      কে এই যাদুকর জ্যোতিষ্ক ?
      যার যাদুবিদ্যায় তেত্রিশ কোটি দেবতার সিংহাসন টলমল। কার অঙ্গুলি হেলনে দেবতাদির জন্মদাতা ফন্দিবাজ শোষক দলক বিধি বিধান প্রবর্তক সুতোধারী চামচেদের কঠিন গেড়ো ফসকা গেড়োয় ভূপতিত হয়। কে কে এই যাদুকর জ্যোতিষ্ক ?
যাঁর যাদুতে দন্ডমুন্ডের কর্তা সমাজ পতিদের কঠোর ডান্ডা ঠান্ডাঘরে জমা পড়ে। যিনি বেদবিধি,  কল্পিত মূর্তিপূজা, তন্ত্ৰ-মন্ত্রতিলক, দেব-দেবী, ঘট-পট বাম পদে ঠেলে দিয়ে মুক্ত কষ্ঠে এদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। অস্ত্র নয়, মন্ত্র নয়, তন্ত্র নয় অথচ বিনা রক্তপাতে বিনা যুদ্ধে উদ্ধার করলেন কোটি কোটি মানুষকে। কে কে কে এই অভয়ানন্দ জ্যোতিষ্ক ?
      এই জ্যোতিষ্কই যুগনায়ক বহুজন সমাজের মুক্তিসূর্য শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ। প্ৰেম-জ্ঞান-সাম্য-স্বাধীনতা দীপ্ত জ্যোতি বিকিরণকারী মহাজন হরিচাঁদ। হীনমন্য,দলক মনুর মেরুদন্ড ভঙ্গকারী পতিত পাবন শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ। ফুসমস্তরী দৈব দাসত্বের ঐশ্বরীক শৃঙ্খল ভেঙ্গে হরিচাঁদ দিলেন নতুন ধর্ম। নতুন  মত ও পথ। তিনি বললেন -যে ঈশ্বর মানুষকে বঞ্চনা করেছে, ঘৃণা করেছে - বর্ণবর্মে বিভাজন  করেছে, শিক্ষা ও ধর্মাচরণ থেকে দূরে ঠেলে রেখেছে, প্রতিপদে অপমানের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে, সেই ঈশ্বরকে আমি মানি না। তার পূজাও করি না। ফুৎকারে অস্বীকার করলেন হিন্দুত্ববাদীদের যাবতীয় মেকী ধর্মাচার, শৌচাচার। অস্বীকার করলেন হিন্দুধর্মের পক্ষপাতদুষ্ট সমস্ত দেব দেবী। বাণী দিলেনঃ- পূর্ণ আমি সর্বময় অপূর্ণের পিতা। সাধনা আমার কন্যা আমি জন্মদাতা।
আমিই ভগবান - আমিই পূর্ণ অবতার। সাধনা (স্ত্রীলিঙ্গ)-র আমি জন্ম দিয়েছি। আমাকে সাধনা কর আমাকে ভজনা কর। আমি তোমাদের সব দিতে এসেছি।
                       রাম-কৃষ্ণ বুদ্ধ - যীশু কিংবা গৌরাঙ্গ।
                      আমাকে সাধনা করে, পেতে মম সঙ্গ।
    নিজের পরিচয়ে নিজেই উজ্জ্বল আলোর মত পরিস্কার করে দিলেন পূৰ্ণব্রহ্ম হরিচাঁদ। মতুয়ারা কি সত্য সত্যই হরিচাঁদের স্বরূপ বুঝেছে? কৃষ্ণ মন্ত্র নয়, রাধা মন্ত্র নয়, রা-স্বাও নয়। মন্ত্র দিলেন  নিজ নাম হরিবোল-হরিবোলএতেই মুক্তি, এতেই মোক্ষ, এতেই জীবনের বিকাশ, শক্তি ও চেতনা। কেবল হরিচাদের নামকীর্তন। ধর্ম দিলেন মতুয়া ধর্ম। বাণী দিলেন –
কোথায় ব্রাহ্মণ দেখো কোথায় বৈষ্ণব।
                            স্বার্থবশে অর্থ লোভী যত ভন্ড সব।
                            স্বাৰ্থ শূন্য নামে মত্ত মতুয়ার গণ।
                           ভিন্ন সম্প্রদায় রূপে হইবে কীর্তন।।
- মতুয়া ধর্মের অনুগামীদের বিধি বিধান ও ধর্মাচরণ পদ্ধতি ও দয়াধীশ দরবেশ শ্রীহরি দিলেন - দীক্ষা নাই করিবে না তীর্থ পর্যটন
মুক্তি স্পৃহা শূন্য নাই সাধন ভজন।।
                             যাগ-যজ্ঞ, তন্ত্র - মন্ত্র, দীক্ষা
                             কোন কিছুর নাহি প্রয়োজন।
                            হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বজন।........
মালা টেপা ফোঁটা কাঁটা জল ফেলা নাই।
                           হাতে কাম মুখে নাম, মন খোলা চাই।
                           বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
                           অন্য তন্ত্র - মন্ত্র এরা বাম পদে ঠেলে।
                           সহজ গার্হস্থ্য ধর্ম সর্বধর্ম সার,
                          গৃহীকে মিলাবে মুক্তি শ্রীহরি আমার
    অর্থাৎ প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় বিধানীয় আচার অনুষ্ঠান যাগযজ্ঞ, মালা টেপা ফোঁটা কাঁটা কোন কিছুর   প্রয়োজন নেই। তিনি বললেন, দায় দায়িত্ব, কর্তব্য সেবা ধর্ম ফাঁকি দিয়ে একক মুক্তি সর্বস্ব গুহা সন্ন্যাসী, জঙ্গল সন্ন্যাসী নাহি প্রয়োজন। তিনি, সহজ গার্হস্থ্য ধর্মপালনী সন্ন্যাসী হবার বিধান  দিলেন। তিনি গার্হস্থ্য ধর্মকে সর্ব ধর্ম সার বলে মুক্ত এবং মুক্তির সুমহান রথ ও পথের দিশা দিলেন।
     কবি রসরাজ প্রভুর মুখ নিঃসৃত রোমহর্ষক বাণী লিখলেন। লিখলেন, হরিপ্রেমী মতুয়া ভক্তদের শুদ্ধ বুদ্ধ চরিত্র গঠন ও অধ্যাত্মবাদের চরম চেতনাদীপ্ত ঐশী শক্তির আত্মদীপ প্রজ্জলনী আচরণের কথা।
                          নাহি চেনে দেব দেবী ঘট-পট কিংবা ছবি।
                          জানে, মনে প্রাণে শুধু হরিচাঁদে।।
                          জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
                          ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্ৰষ্টা।।
 হরিচাঁদ নামরূপ কোরামিন ট্যাবলেট সেবন করেই জেগে উঠল
মৃতপ্রায় জাতি। 
                          পরম উদার এই হরিনাম মন্ত্র।
গুপ্ত মন্ত্র নহে ইহাত স্বচ্ছ স্পষ্ট শান্ত।।...
                           হরিনাম মন্ত্র বিনা, সব মন্ত্র ফাঁকি।।
হরিচাঁদ ঠাকুর কুকুরের উচ্ছিষ্ঠ খেতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু মানতে রাজি ছিলেন না হিন্দুধর্মের ভেদাভেদ ব্যবস্থার মেকি শুদ্ধাচারপবিত্র অপবিত্রতার নিয়ম কানুন। নিরালম্ব ও স্বাবলম্বী ছিলেন তিনি। মতুয়াধিপতি শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ সত্যদ্রষ্টা ত্রিকালজ্ঞ সর্বদশী হরিচাঁদ। 

     হিন্দুর ভগবান রামচন্দ্র অন্যায় ভাবে কাপুরুষের মত ধ্যান মগ্ন সৎচরিত্রবান শম্ভুকের শিরচ্ছেদ করেছে। ছলনার আশ্রয় নিয়ে বালীকে বধ করেছেবীর মেঘনাদ ও রাবণকে নোংরা ছলচাতুরি করে হত্যা করেছে। শ্রীকৃষ্ণ শূদ্রপাপীদের বিনাশ করার জন্য এবং সাধু ব্রাহ্মণ বাণিয়া পূণ্যবানদের রক্ষার জন্য বার বার যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। কৃষ্ণের ছল চাতুরীর কথা লিখে শেষ করা যাবে না। ব্রাহ্মণ কুমার অশ্বথামা পাঞ্চালীর পাঁচ শিশুপুত্রকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছে। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে এমন কীর্তি কাহিনী পাপ নয় বরং পূণ্যের।
      কিন্তু দলিত রাজ হরিচাঁদ কোনদিন অস্ত্র স্পর্শ করেন নি। হিংসা দ্বেষ মিথ্যাচার ছলনা কূটনীতি এবং বিভেদনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। বরং এইসব বদগুণে পরিপুষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে  তাঁর ছিল আপোষহীন মুক্তি সংগ্রাম ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ও বিধিবিধান অনুযায়ী অস্পৃশ্য চন্ডাল হরিচাঁদ ছিলেন সর্বনিম্নস্তরের ঘৃণিত মানুষ। তাঁর মানব হিসাবে কোন স্বীকৃতি ছিল না। ধর্মাচরণের অধিকার ছিল না। মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। শিক্ষার  অধিকার ছিল না। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদীদের ত্রিসীমানার বাইরে রাখা হয়েছিল শ্রীহরিকে। প্রশ্ন এখানেই - এ হেন অবস্থার  প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ প্রবর্তিত মতুয়া ধর্ম হিন্দুধর্ম বা তার লেজুড় হয় কি করে ? প্রেমই তো ধর্ম। ঈশ্বর প্রেমময় জগদীশ্বর। কমই ধর্ম। ঈশ্বর অনন্ত কর্মময় সঞ্চালক। ধর্মই জ্ঞান, সত্য আর সত্যই তো ঈশ্বর। একমাত্র ঈশ্বরই তো পূর্ণ স্বাধীন। মতুয়া ধর্মের তাত্ত্বিক
তত্ত্ব এইসকল অবস্থার এককিভবন অর্থাৎ প্রেম কর্মজ্ঞান স্বাধীনতার তত্ত্ব কথা। কিন্তু হিন্দু ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি, অপ্রেম, ভেদাভেদপূর্ণ।
     দাসত্বের আগল ভেঙ্গে হরিচাঁদের মতুয়া  ধর্ম প্রেম বন্যায় ভাসিয়ে গলাগলি, মাখামাখি,  মেশামেশি করে ঐক্যবদ্ধ হল বাঙলার মানুষ।
স্বাৰ্থত্যাগী প্রেমোন্মত্ত ভাবের পাগল।......
                           মেয়ে পুরুষেতে বসি একপাতে খায়।
                           মেয়েদের এটো খায় পদধূলা লয়।।
 যে যুগে কুলীনের দল শত শত বিবাহ করে যৌন সুখ ও আত্মসুখে মশগুল সেই যুগে গার্হস্থ্য ধর্মের এই বলিষ্ঠ প্রকাশ সমাজ বিপ্লবের মহান কীর্তি। আর এই কীর্তির মহাজন মহাজ্যোর্তিময় শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ তাঁর ধর্মের নাম ‘মতুয়া ধর্ম’
প্রেম অনুরাগে সব ভকত জুটিল।
মতুয়া বলিয়া দেশে ঘোষণা হইল।।
 হিন্দু বলে ঘোষণা হয় নাই। ব্রাহ্মণ, কায়স্ত, বৈদ্য, শূদ্র , হাড়িমুচি-ভোম বলেও ঘোষণা হয় নাই। হরিচাঁদ প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মানুরাগীরা ‘মতুয়ানামে পরিচিত হল আর এখনও তাঁরা পথে ঘাটে সংবাদে অনুষ্ঠানে পোষ্টারে মেলায় নেতা নেত্রীর মুখে ‘মতুয়া’ নামেই খ্যাত। তা সত্বেও মতুয়ারা    হিন্দুত্ববাদী আচরণের দুৰ্গন্ধ শরীর থেকে বুয়ে ফেলতে পারে নাই। দাসত্বের অমাবস্যার রাত এখনও কাটল না। এরা কি মতুয়া? না মতুয়া নামের কলঙ্ক? যৌবনে তার কন্তে ধ্বনিত হল  তথাগতের মহান বাণী আত্মদীপ ভব।
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য
যশোবন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ
মহাচীন জাপানেতে যত জাতি রয়,
বৌদ্ধনীতি মানে তাঁরা বীর পরিচয়।
বৌদ্ধধর্মে মুক্তিমন্ত্র তাঁরা সব পায়
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তলে ভারত ঘুমায়।।’
  মৃতসঞ্জীবনী সুধা দিলেন  মতুয়ানাথ হরিচাঁদ। শোনালেন স্বাধীনতার মন্ত্র। যুদ্ধের নিশান লালঝান্ডা সঙ্গে শান্তির প্রতীক সাদা বর্ডার। রণডঙ্কা আর শিঙ্গা বাজিয়ে হুঙ্কার দিলেন করুণাঘন শ্রীহরি সিদ্ধ মহাপুরুষ হরিচাঁদের প্রেম প্রক্ষালনে উত্তাল তরঙ্গায়িত পতিত জনসমাজের ভগ্ন হৃদয়ে প্লাবিত হল হারানো আত্মসচেতনতা এবং ঘটল আত্মনির্ভরতার  অজেয় শক্তির স্ফুরণ। সংঘবদ্ধ হল সমাজ। অসহায় ব্রাহ্মণ সমাজ হয়ে পড়ল নীরব, বিক্ষুব্ধ দর্শক। শুরু হল বঙ্গের চন্ডাল বিপ্লব। বেদ-বিধি, শৌচাচার, স্নানাহ্নিক-সন্ধ্যাহিক, তন্ত্ৰ-মন্ত্র, মালাটেপা, ঘট-পট, দেব-দেবী, মূর্তিপূজা, তীর্থযাত্রা, গুরুগিরি সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে পচাপুকুরে ঘৃণায় নিক্ষেপ করলেন হরিচাঁদ।‘হরিবোল’ সম্বল করে ডঙ্কা বাজিয়ে বিজয় নিশান উড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ মতুয়া সংঘ শক্তির প্রতাপের সামনে ব্রাহ্মণ সমাজের ব্রহ্ম তেজ লুপ্ত হল বঙ্গের মাটিতে। গলার সুতো ছিড়ে অক্ষয় চক্রবতীর বন্য জীবন ধন্য হল হরিচরণ বরণ করে। বিনা রক্তপাতে মানবতাবাদী ধর্ম বিপ্লব ঘটিয়ে পরমপুরুষ হরিচাঁদ বিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ শিরঃচুড়ামণি ৷        সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও সম মর্যাদার দাবিতে কাবাবদের (কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য) বিরুদ্ধে মহাবিপ্লবের রণডঙ্কা বেজে উঠল ঐক্যবদ্ধ সংগঠিত চন্ডালদের গণ-আন্দোলন। ১৮৭২ সাল। ধর্মের দোহাই দিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ, মৌরুসিপাট্টার ব্যভিচারী আত্মসুখ চিরস্থায়ী করার নামে শঠতা, প্রবঞ্চনা, হীনমন্যতা সৃষ্টিকারী  কাবাবদের একচ্ছত্র কায়েমী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অগ্নিবান ছুঁড়লেন মতুয়াধীশ চন্ডালাধিপতি হরিচাঁদ, সঙ্গে বালক উত্তর পুরুষ শিষ্য ও সন্তান রাজর্ষি গুরুচাঁদ। গুরুচাঁদ মিটিং করলেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রামে গ্রামে জানিয়ে দেওয়া হল।
১) রমণীরা দ্রব্যসামগ্রী বেচতে আর হাটে বাজারে যাবে না।
২) স্বজাতি ভিন্ন অন্য কোন জাতের বাড়ি কাজ করবে না।
 ৩) ব্রাহ্মেণেতর কোন হিন্দু জাতির রান্না গ্রহণ করবে না।
 ৪) কেউ হাসপাতাল এবং জেলখানার নোংরা পরিস্কার করবে না যে পর্যন্ত কর্মীদের সরকারী বেতন ও মর্যাদা না দেবে।
      এতেই আগুনের অগ্নিবলয় দাউ দাউ করে জুলে উঠল। আমগ্রাম, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনার চন্ডালরা অগ্নিতেজে জলে উঠল। ভারতবর্ষের প্রথম ট্রেড ইউনিয়নের মুভমেন্টের সূত্রপাত এবং প্রথম স্ট্রাইক বা হরতাল। হাস্পাতার চত্তর আর জেলখানা নরক কুন্ডে ভরে গেল। গুরুচাঁদ ব্যর্থ হননি। তাঁর দাবী মেনে ইংরেজ সরকার-এর ফরিদপুর ডি.এম. ১৯৭৩ সনে লিখলেন “......... Like Hospital, Jail and dust become too dirt and blowing serious bad smell. So complete was the strike that the fields…….. untilled the houses untouched, and not a chandal in the service of Hindu or Mohmandun or a chandal woman was seen in any market. ব্যর্থ হয়নি দলিলদের প্রথম গণ আন্দোলন। লাল নিশানের তলে তীব্র শক্তিতে উল্লফন দিল শতাব্দীর ঘুমন্ত চন্ডাল সমাজ, অনেকে বলে থাকেন, চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব আন্দোলনই বাঙালি জীবনে প্রথম রেনেসাঁস। আসলে চৈতন্যদেবের প্রচেষ্টায় একটাআধ্যাত্মিক গণতন্ত্র তৈরী হয়েছিল সত্য। সেখানেও হিন্দুত্ববাদী দৈব শক্তির প্রভাব বর্তমান। শ্রীশ্রী জগন্নাথ এবং শ্রীকৃষ্ণের যাবতীয় দৈব দোহায়ী কল্প জগতের আধ্যাত্মবাদ পরিপুষ্ট এই বৈষ্ণবীয় আচার অনুষ্ঠান। শ্রীচঈতন্য সাধারণ মানুষের অর্থনঈতিক ও শিক্ষার দিকে কোন দৃষ্টিপাত করেন নি। ইহকাল, পরকাল, পুর্নজন্ম, স্বর্গ, নরক, বিগত জীবনের কর্মফল ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের মৌলিক দিকগুলি ও বৈষ্ণব ধর্মকারবাদিদের বিভীষিকাময় এক কল্পলোকের মোহজালে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে এর থেকে বিরিয়ে আসা শিক্ষিত জনের পক্ষেও কঠিন।  
    কিন্তু, সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ আশা আকাঙ্খা আনন্দ বেদনার বাস্তব সমাধান ও বিশ্বাসের ভিত্তিই হল মতুয়া তত্ত্বদর্শন। মতুয়াধৰ্ম বাহিক আড়ম্বর পূর্ণ ধর্মাচারে আবদ্ধ না থেকে মানুষের বাস্তব মানবিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যথার্থ মানবীয় ধর্ম আখ্যায়িত করেছ। অবাস্তব পুত্তলিকা জড়পদার্থ পূজার ধর্মাচরণে মতুয়া ধর্ম আদৌ বিশ্বাসী নয়। বৃহৎ মানুষের উন্নয়নমূলক সাধনাই মতুয়া ধর্মের শ্রেষ্ঠ সাধনা।
“গৃহস্থ্য আশ্রম ধন্য ভূতলে নরের জন্য
                             সবতীর্থ সর্ব পূণ্য গৃহাশ্রমে রয়।
  গৃহীকে আশ্রয় করি, জীব রহে দেহ ধরি,
গৃহাশ্রম সর্বোত্তম সেই হেতু কয়
শ্রীশ্রী ঠাকুর হরিচাঁদ আবার বললেন-
ঠাকুর কহেন বাছা, ধর্ম কৰ্ম্ম সার।
                              সর্বধর্ম হতে শ্রেষ্ঠ পর উপকার।
     কে এই হরিচাঁদ? যিনি এখন থেকে পৌনে দুশ বছর পূর্বে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন-সমাজের পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
 নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।। তাই, শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর মতুয়া ধর্মই বাঙালি  জনমানসে প্রথম রেনেসাঁস এনেছিলেন। ব্যবসাভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্ম ফুসমন্তরে মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক গড়ে দেয় কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবধান বজায় রাখে। সেবাদাসী, দেবদাসী, প্রসাদী দাসী এসব হিন্দু ধর্মের অঙ্গ। মতুয়া ধর্ম এর চরম বিরোধী।
     এরই প্রেক্ষাপটে প্রমাণ করে, মতুয়াধর্ম স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন ধর্ম। অন্য কোন ধর্মের উৎস থেকে মতুয়া ধর্মের জন্ম হয়নি। বিশেষ করে ফাদারলেস হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক কেউ নয়, এর  জন্মের কোন সাচ্চা ইতিহাস নাই। মতুয়া ধর্ম কোনক্রমেই হিন্দু ধর্মের লেজুড় নয়। মতুয়া ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জনক পূৰ্ণব্রহ্ম হরিচাঁদ-মাতা শান্তিদেবী। মতুয়াদের দুটি গোত্র, হরিচাঁদ গোত্র এবং  গুরুচাঁদ গোত্র।
জয় হরিচাঁদ-জয় গুরুচাঁদ
--------------------------------------------------------

   
Read More