Tuesday 23 June 2020

// // Leave a Comment

বাংলাভাগের বিরুদ্ধে সর্বাধিক ভোট হওয়া সত্ত্বেও কেন সেটা উপেক্ষা করা হলো? কার স্বার্থে? লেখক - জগদীশ রায়

বঙ্গীয় ব্যবস্থাপরিষদে বাংলাভাগের বিরুদ্ধে সর্বাধিক ভোট হওয়া সত্ত্বেও কেন সেটা উপেক্ষা করা হলো? কার স্বার্থে?

লেখক - জগদীশ রায় 

(মূল লেখা 'ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ' থেকে তুলে দিলাম)

    কেউ কেউ একথা বলেন যে, মুসলমানরা নাকি ভারত ভাগের জন্য দায়ী। আর অন্যদের কথা ছেড়ে দিলাম যারা মহাপ্রাণের কঠোর সংগ্রামের ফল ভোগ করছে, সেই বাংলার  বিশেষ করে নমঃরা বলে, ‘যোগেন মণ্ডল বাংলা ভাগ করেছে।’ আমাদের যে ইতিহাস লেখা হয়েছে যদি সেটা মিথ্যা কথা না বলে; তাহলে দেখাযাক, বাংলাভাগের জন্য কে বা কারা কতো খানি দায়ী। আমরা যদি অতিসামান্যভাবে পর্যালোচনা করি, দেখাযায়, যে কংগ্রেস স্বাধীনতা  আন্দোলন  করেছিল; সেই কংগ্রেসই প্রথমে গান্ধীর উপস্থিতিতে ১৯৪২ সালে ১৫ই জুন,  কংগ্রেসের অধিবেশনে দেশভাগের প্রস্তাব গৃহীত হয়। যখন এই সিদ্ধান্ত করা হলো  দেশভাগ করতে হবে। তখন মুসলিম লীগ দাবী করল দেশ যদি ভাগ  করতে হয়, তাহলে মুসলমানদের  জন্য স্বতন্ত্র দেশ দিতে হবে। বাংলার শ্যামাপ্রদাসাদ মুখার্জী বললেন দেশভাগ হোক না হোক আমরা বাংলাভাগ চাই। মাউন্ট ব্যাটেন ১৯৪৭  সালের ২ জুন নিজের বাড়িতে মিটিং ডাকলেন ভারতের সর্বাপেক্ষা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে। এই মিটিং এ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ডাক পেলেন- জওহরলাল নেহেরু,  সরদার  প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে মহম্মদ আলী জিন্না,   লিয়াকত  আলী, আব্দুররব নিস্তার আর সিখদের পক্ষ থেকে সরকার বলদেব সিং।    
    এই সাতজন মিলে দেশভাগ তথা বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তের জন্য মিটিং করছেন। এই মিটিং এ তফশিলি জাতির বড় নেতা ড. আম্বেদরকে বা মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকেও ডাকা হয়নি। 
     এই সাতজন একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কথা মাউন্ট ব্যাটেনকে বললেন যে, বাংলার এসেম্বলিতে যত মেম্বার আছেন, হিদু অধ্যুষিত  মেম্বারদের নিয়ে ও মুসলমান অধ্যুষিত  মেম্বারদের নিয়ে আলাদা আলাদা করে মিটিং করা হোক। সেই মিটিং এ যে সিদ্ধান্ত হবে সেটা মেনে নেওয়া হবে।
        ১৯৪৭ সালের বাংলার এসেম্বলিতে ২২৫ জন মেম্বার ছিলেন। যখন ভাগ করা হচ্ছে কোন কোন জেলায় হিন্দুরা আর কোন কোন জেলায় মুসলমানরা বেশি; সেখানে দেখা গেল  হিন্দু অধ্যুষিত জেলাগুলো হচ্ছে বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, হুগলি, হাওড়া, কলকাতা, ২৪ পরগনা, খুলনা, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং এই এগারোটি জেলা। এই এগারোটি জেলার এসেম্বলির সংখ্যা ৮০। এই ৮০ জনের ভিতরে ৫৪ জন হিন্দু আর মুসলমান ২১ জন। এংলো ইন্ডিয়ান ৪ জন। আর ১ জন ভারতীয় খ্রিষ্টান। মোট ৮০ জন। উক্ত ৫৪ জন হিন্দুর মধ্যে অ-কংগ্রেসী ভোটার ৫ জন। তাঁরা হলেন – ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী (হিন্দুমহাসভা), বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ স্যার উদয়চাঁদ মহতাব (স্বতন্ত্র), মুকুন্দবিহারী মল্লিক (স্বতন্ত্র), রতনলাল ব্রাহ্মণ, (কমিউনিষ্ট) এবং জ্যোতি বসু (কমিউনিষ্ট)।   
   ২১ জন মুসলমানের বিশিষ্টদের মধ্যে মিঃ এস. এইচ. সোহারাবর্দী (মূখ্যমন্ত্রী), মিঃ এম. এ. এই. ইস্‌পাহানী (মুসলিম লীগের কার্যকরী সমিটির সদস্য), মিঃ আবুল হুসের (সম্পাদক, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ), মিঃ আবদুর রহমান (সমবায় ও ত্রাণ দপ্তরের মন্ত্রী) এবং নবাব মুসারফ হোসেন।
     এই ১১ টি জেলার ৮০ জন এক জায়গায় বসলেন। নির্ধারিত হয়েছিল, হিন্দু শাসিত অঞ্চলের মিটিং এর অধ্যক্ষতা করবেন একজন হিন্দু আর মুসলমান শাসিত অঞ্চলের মিটিং এর অধ্যক্ষতা করবেন একজন মুসলমান। হিন্দুদের মিটিং এর অধ্যক্ষতা করেন বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদ মহতব।   
    হিন্দুপ্রধান অঞ্চলের প্রতিনিধিগণের সভায় বঙ্গবিভাগের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। উক্ত প্রস্তাবটি ৫৮-২১ ভোটে গৃহীত হয়। এই অংশের শাসনতন্ত্র প্রণনের উদ্দেশ্য বর্তমান গণপরিষদে যোগদানের প্রস্তাব ৫৮-২১ ভোটে গৃহীত হয়। একজন ভোট দেন না বা অনুপস্থিত ছিলেন।

     এবার দেখাযাক মুসলমান অধ্যুষিত ১৬টি জেলা হলো- চট্রগ্রাম, নোয়াখালি, ত্রিপুরা,  বাখরগঞ্জ, ঢাকা, ময়মনসিং, ফরিদপুর, যশোহর, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বগুড়া, দিনাজপুর, মালদা, পাবনা, রাজশাহী ও রংপুর। এই ১৬ টি জেলার এসেম্বলির সদস্য সংখ্যা ১৪৫ জন। এর মধ্যে মুসলিম ১০৩, হিন্দু ৪১, ভারতীয় খ্রিস্টান ১ জন। মোট ১৪৫ জন।    
    ৪১ জন হিন্দুর মধ্যে ৬ জন অ-কংগ্রেসী তফশিলী সদস্য, তারমধ্যে দুজন মন্ত্রী  দ্বারিকনাথ   বারুরী ও নগেন্দ্র নারায়ণ রায়। এছাড়া মহারাজা গিরিশচন্দ্র নন্দী, সতীশ চন্দ্র  চক্রবর্তী, ভোলানাথ বিশ্বাস, হারাণচন্দ্র বর্মণ (উভয় পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী), গয়ানাথ বিশ্বাস (ময়মন সিং) এবং একজন কমিউনিষ্ট সদস্য ছিলেন।
    মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠদের এলাকায় হিন্দু কিরণশঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (যথাক্রমে  কংগ্রেস এসেমব্লি পার্টির নেতা ও উপনেতা), নেলী সেনগুপ্ত এবং পি. আর. ঠাকুর (প্রমথরঞ্জন ঠাকুর)।  
    মুসলমানদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লিখিত মিঃ এ.কে. ফজলুল হক, মিঃ মহাম্মদ আলি (রাজস্ব মন্ত্রী), মিঃ নুরুল আমিন (স্পিকার), মিঃ আহম্মদ হোসেন (কৃষি মন্ত্রী), মিঃ সামসুদ্দীন আহম্মদ (শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী) অন্যতম।
   মুসলমান প্রধান জেলাগুলির হিন্দু ও মুসলমান সদস্যগণ মিঃনূরুল  আমিনের সভাপতিত্বে একটি পৃথক সভায় মিলিত হলেনমুসলমান প্রধান অঞ্চলের সসস্যগণের সভায় বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে ১০৬ জন ও পক্ষে ৩৪ জন  কংগেসী সদস্য ভোট প্রদান করেন। (৪ জন ভোট দানে বিরত থাকেন, আর ১ জন অর্থাৎ যোগেন্দ্রনাথ মন্ত্রী থাকার জন্য ভোট দিতে পারেন না।)  
  পশিমবঙ্গ ব্লকের দুইটি হিন্দু আসন, যথাক্রমে কলকাতা পূর্ব (সাধারণ) এবং জলপাইগুড়ি- শিলিগুড়ি সাধারণ (তফশিলি আসন দুটিকে ভোট থেকে বিরত রাখা হয়। তাছাড়া, বাখরগঞ্জ  দক্ষিণ- পশ্চিম সাধারণ ( তফশিলি) আসনটিকেও ভোট থেকে বিরত রাখা হয়।   
বাখরগঞ্জ দক্ষিন- পশ্চিম সাধারণ তফশিলি আসনটির নির্বাচিত সদস্য আমাদের যোগেন্দ্রনাথ। যোগেন্দ্রনাথকে এই ভোটাভোটিতে অংশ গ্রহণে বিরত রাখার কারণ যোগেন্দ্রনাথ তখন  অন্তর্বর্তী সরকারে আইনমন্ত্রী। সুতরাং ব্যবস্থা পরিষদের এই ভোটাভোটিতে তাঁর পক্ষে যোগদান করা আইনগত দিক থেকে বাধা ছিল। এতে প্রামণ হয় ভারত তথা বাঙলা ভাগের  ব্যাপারে যোগেন্দ্রনাথের কোনও মতামত গ্রহণ করা হয়নি।
     এই অংশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবার জন্য বর্তমান গণপরিষদে যোগদান করবে না, মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলির জন্য যে নতুন গণপরিষদ গঠিত হবে, সেই গণপরিষদে যোগদান  করবে তার একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলির জন্য যে নতুন গণপরিষদ গঠিত হবে, সেই গণপরিষদের যোগদানের প্রস্তাবের পক্ষে ১০৭ জন ও বিপক্ষে  ৩৪ জন ভোট প্রদান করায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। মুসলমান প্রধান সদস্যদের সভায় আর একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাহল উক্ত জেলাকে পূর্ববঙ্গ নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নিতে স্বীকৃত আছে। ১০৫-৩৪ ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এই অংশের কংগ্রেসী ৩৪ জন সদস্য প্রত্যকটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

গণভোট কেন হলো না, হলে কী হতো?
    ‘এইভাবে বাংলাভাগ নির্ধারিত হল। যাঁরা এই ঐতিহাসিতক সিধান্ত গ্রহণ করে বাংলার অখণ্ড মানচিত্র বদলে দিলেন তাঁরা কি জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি ছিলেন? বাংলার ভবিষ্যত নির্ধারণে গণভোট করা হল না কেন? এপ্রিল মাসের শেষের দিকে যোগেন্দ্রনাথ একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, গণভোট করলে দেখা যাবে অধিকাংশ অমুসলমান বাংলাভাগের বিরুদ্ধে। (সুত্র-  The Statesman, 23 April,1947), ১৮ জুন শরৎচন্দ্র বসু গান্ধিকে চিঠি লিখে দাবি করলেনঃ “আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, যদি গণভোট করা হতো তাহলে হিন্দুরা বিপুল সংখ্যাধিক্যে বাংলা বিভাজনের বিরুদ্ধে ভোট দিতেন।” (সুত্র-Abul Hashim, In retrospection, p-161)গান্ধি, নেহেরু, প্যাটেলরা গণভোটে রাজি হলেন না কেন? কারণ,  গণভোট করলে তাঁদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবেনা। (তথ্য সংগৃহীত- বাংলা   ভাগ কেন হল? লেখক- নিকুঞ্জ বিহারী হাওলাদার পৃ.১১২) 
    কথায় বলে চোরের মার বড় গলা। যাদের ভোটে বাঙলা ভাগ হল, যার ফলে উভয় বাঙলার বিপুল সংখ্যক লোক তাদের পৈতৃক বাসস্থান হতে উৎখাত হলেন, স্বাধীন দেশে যারা পরিচিত হলে উদ্বাস্তু বলে, আজ তাদের ভাগ্য নিয়ে সারা রাজনৈতিক ফয়দা তুলছেন, সেই সকল স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা ও সমর্থকদের সঙ্গে সমসুরে সুর মিলিয়ে যোগেন্দ্রনাথের স্ব-জাতীয় কতিপয় স্বার্থান্বেষী উচ্চস্বরে চিৎকার করেন- বাঙলা ভাগের জন্য প্রধানত যোগেন্দ্রনাথই দায়ী। সরল প্রাণ বাঙালি এদের ক্ষমা করলেও ইতিহাস এদের ক্ষমা করবে না।
(তথ্য সংগ্রহ- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ৩য় খন্ড পৃঃ ১৪৭-১৫০ লেখক – জগদীশ চন্দ্র মন্ডল )
    আমরা কি দেখলাম, বাংলা ভাগের পক্ষে মোট প্রদত্ত ভোট (হিন্দুপ্রধান অঞ্চল ৫৮+  মুলসমান প্রধান অঞ্চন ৩৪) = ৯২ আর বাংলা ভাগের বিপক্ষে মোট প্রদত্ত ভোট (হিন্দুপ্রধান  অঞ্চল ২১ + মুসলমান প্রধান অঞ্চল ১০৬)= ১২৭। বাংলাভাগের বিপক্ষে বেশি ভোট পড়ল ১২৭-৯২= ৩৫টি।  এর পরও বাংলা ভাগ হলো কেন?    
    তাহলে আপনারাই বলুন বাংলা ভাগ কারা করলো? মুসলমানরা? যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল? না কি বর্ণহিন্দুরা? আমি যে কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম, যে দেশভাগ হোক না হোক বাংলাকে ভাগ করতে হবে। এবার মিলিয়ে নিন কে বা কারা এই বাংলাভাগের জন্য দায়ী?।
এই লেখার সমাপ্তি টানছি বাবা সাহেব ড. আম্বেদকরের একটি দুঃখজন ও বাস্তব উদ্ধৃতি দিয়ে-
    যোগেন্দ্রনাথকে ভুলতে বসেছে বাংলার নমঃশূদ্র সহ তফশিলি জাতির বুদ্ধিজীবীরা। এটাই Educated Scheduled Caste Culture. এই সকল শিক্ষিত তফশিলি বুদ্ধিজীবীদের সম্বেন্ধে ড. আম্বেদকর বলেন-
     “I do not have any danger from others, but I feel danger from our own people. There is some progress in education in our society. By acquiring education some people have reached to the higher positions. But these educated people have deceived (প্রতারিত) me. I was hoping from them that after acquiring high education they will serve the society. But what I am seeing is that a crowd of small and big clerks has gathered around, who are busy in filling their belly.” (তথ্য – মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৭-১৮)
------------
*বাংলাভাগের পক্ষে ও বিপক্ষে কাঁরা ভোট দিয়েছিলেন তাঁদের বিস্তারিত তথ্য পিডিএফ এ দেওয়া হল-http://www.mediafire.com/file/a9ws7w95kp7z7et/Bengal_Partition.PDF/file

0 comments:

Post a Comment