Saturday 9 September 2017

// // Leave a Comment

যে জাতি তার ইতিহাস জানে না। সে জাতি তার ইতিহাস নির্মাণ করতে পারেনা। লেখক - জগদীশচন্দ্র রায়


যে জাতি তার ইতিহাস জানে না। 
সে জাতি তার ইতিহাস নির্মাণ করতে পারেনা।
লেখক - জগদীশচন্দ্র রায় 
আবার এটাও বলা হয় – গোলাম, গোলামীতেই আনন্দ উপভোগ করে। Slave enjoy for slavery. ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যাবস্থায় জাতিভেদ প্রথা হচ্ছে এই ব্যবস্থার প্রাণভোমরা। এই প্রাণভোমরাকে তারা কোন প্রকারে নষ্ট করতে চায় না। যার জন্য বাবা সাহেব  তাঁর Annihilation of Caste  এ বলেছেন- ধর্মনিরপেক্ষ ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে পার্থক্য করা অর্থহীন। তারা উভয়েই পরস্পরের  আত্মীয়। তাঁরা একই শরীরের দুটি বাহু। এক বাহুর অস্তিত্বের জন্য অন্য বাহু যুদ্ধ করতে বাধ্য।  (Is it reasonable to expect the secular Brahmins to take part in a movement directed against the priestly Brahmins? In my judgment, it is useless to make a distinction between the Secular Brahmins and Priestly Brahmins. Both are kith and kin. They are two arms to the same body and one bound to fight for the existence of the other.)
ব্রাহ্মণ্যবাদের আর একটি কৌশল হচ্ছে, যদি কোন অব্রাহ্মণ শত বাঁধা অতিক্রম করে উপরে উঠে আসে, তখন তাঁর এই উপরে উঠে আসার কারণ বা সহযোগীও ব্রাহ্মণ; এই কথা প্রচার করে দেয়। আবার যদি কোন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ্যবাদকে জীবনের প্রথম থেকে ত্যাগ করে তিনি নিজের জীবনকে দেশ ও সমাজের জন্য তুলে ধরনে, তখন এই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাঁকে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে ভিলেন বানিয়ে দেয়। আর এই নিজেদের ইতিহাস না জানা গোলামরা, গোলামীতে আনন্দ করা চামচারা এই ভিলেন বানানোর কাজে সর্বদা সহায়তা করতে থাকে। যার ফলে তারা তাদের প্রাপ্যও পেয়ে যায়।



   যে মানুষটা ঘোষণা করে বলেন, “যদি কেউ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারে যে, আমার জীবনের   বিনিময়ে  তফশিলিদের সার্বভৌম মুক্তি আসিবে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আমাকে নিক্ষেপ করিলে সে মুক্তি মেলে, তবে আমি দুর্বার আকাংঙ্খা লইয়া তাহাতেই ঝাঁপাইয়া পড়িব।”
যিনি আরো বলেছিলেন- “মৃত্যুর পরে যদি কেহ আমাকে স্মরণ করে তবে, এতসব উচ্চপদের অধিকারী হইয়াও আমি যে ধনী না হইয়া গরীব রহিয়াছি, এই বলিয়াই যেন স্মরণ করে- ইহাই আমার কাম্য। একটি নিপীড়িত গরীব সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্ম গ্রহণ করিয়া বহুবার উচ্চপদে  অধিষ্ঠিত হইয়াও আমি যে অসৎপথে উপার্জনের দ্বারা ধনী হই নাই, ইহা মানুষ উপলব্ধি করুক -এই কামনাই আমি করি।”  
যাঁর সম্পর্কে বিদগ্ধ ব্যক্তিরা বলেছেন-https://www.youtube.com/watch?v=r6-hAY_yTRI&t=7s
https://www.youtube.com/watch?v=4p5TYNvhRP4&t=995s
ডঃ প্রদীপ আগলাবেঃ- বাবাসাহেব যদি সংবিধান সভায় যেতে না পারতেন তাহলে এই দেশের সংবিধান ব্রাহ্মণদের পক্ষেই লেখা হ’ত । তাই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আম্বেদকরী আন্দোলনে যে সহযোগীতা করেছেন এবং মূলনিবাসীদের উদ্ধারের জন্য যে কাজ করেছেন সেটা অসাধারণ কাজ
ঊষাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ঃ- ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের স্থান সম্পর্কে নানা সনের মনে যে বিভ্রান্তি বা সংশয় দেখা যায় সেটা বহুলাংশে অজ্ঞতার কারণে তাঁকে দেশ বিভাগের জন্যেও অংশতঃ দায়ী করা হয় অথচ তাঁরমত কর্মযোগী দেশবৎসল, স্ব-সম্প্রদায়ের উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ নেতা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে কমই দেখা গেছে
কিরণ চন্দ্র ব্রহ্মঃ- ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেই চারিদিক হতে একটা চিৎকার প্রতিধ্বনিত হল যে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল দেশ ভাগ করেছেন, তাঁর মত সর্বনাশা লোক ভারতে আর কেউ নেই এই মিথ্যা দোষারোপকারীরা অশ্লীল ভাষায় তাঁকে অজস্র গাল দিয়েছে প্রকৃত পক্ষে ভারত ভাগে তাঁর কোন ভূমিকা ছিল না তবে এই কুৎসা রটনাকারীদের উদ্দেশ্য কি তাও প্রনিধান করা করা দরকার যারা এই মিথ্যা রটিয়েছে তারাও জানে ভারত ভাগে যোগেন্দ্রনাথের কোন ভূমিকাই ছিল না এবং তিনি দেশ ভাগের একান্ত বিরোধী ছিলেন এই কুৎসা রটনার কারণ আমাদের কাছে মোটেই দুর্বোধ্য নয় কারণ, এই দেশের নিপীড়িত মানুষের অন্তরে মহাপ্রাণ যে শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন সেটাকে নষ্ট করে দিয়ে সাধারণ মানুষের অন্তর থেকে তাঁকে চিরতরে মুছে দিতে পারলে তাঁর আজীবন সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেওয়া যায় এই ছিল কুৎসা রটনাকারীদের মূল উদ্দেশ্য  
আর তিনি তাঁর প্রতি অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন তাঁর জীবনের শেষ ভাষণে- দেশ ভাগের জন্য আমাকে দায়ী করা হয়। মন্ডল দেশ ভাগ করেছে। সে সম্বন্ধে বলি, দেশ ভাগের ব্যাপারে আমার কোন ক্ষমতা ছিল না।   কংগ্রেস কমিটি  ও মুসলিম লীগ উভয় পার্টির নেতাগণ মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বৃটিশ সরকারের কাছে স্বাধীনতার দাবী জানায়। বৃটিশ সরকার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয়ের দেশ ভাগের দাবী মেনে ভারত ও পাকিস্থানের জন্য পৃথকভাবে স্বাধীনতা দেয়। তাই ভারত ভাগ করে ভারত ও পাকিস্থান পৃথক রাষ্ট্র তৈরী হয়। তবুও দেশ ভাগের জন্য আমাকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয় কেন?
                                     - যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (জীবনের শেষ ভাষণ থেকে সংগ্রহীত)

আমি যোগেন মন্ডল, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছি। এ জন্য আমাকে বহু কটুক্তি শুনতে হয়েছে। যেমন “বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যোগেন মন্ডলের ওকালতি।” আমি বুঝেছি বঙ্গ ভঙ্গ  হলে হিন্দু মুসলমান উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে অশিক্ষিত ও গরীব যারা সামান্য চাষ আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের ভাগ্যে চরম দূর্দশা নেমে আসবে। তখন কংগ্রেস ও কমিউনিষ্ট পার্টি বঙ্গ ভঙ্গ সমর্থন করে আমাকে গালমন্দ করেছেন।
                                    - যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (জীবনের শেষ ভাষণ থেকে সংগ্রহীত)  

     দেশ ভাগের পরে আমি পূর্বঙ্গে গেলাম কেন? ইহার উত্তর বহু জন সভায় বহুবার দিয়েছি। দেশ ভাগ যখন অবধারিত হয়ে গেল তখন আমার নেতা ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের সাথে আলোচনা করি এবং পরামর্শ নেই। তিনি বলেন, “মিঃ মন্ডল কংগ্রেস ও লীগের দেশ ভাগের প্রস্তাব বৃটিশ সরকার নেমে নিয়েছেন। আমাদের কথা শোনেননি। এক্ষেত্রে আমরা কি করতে পারি? কাজেই তুমি পূর্ব বঙ্গে যাও। দেখো পূর্ব বঙ্গে বহু অনুন্নত হিন্দু থেকে যেতে বাধ্য হবেন। তুমি গিয়ে তাদের সেবা করো।” তাই আমি পূর্ববঙ্গে যাই।
                                    - যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (জীবনের শেষ ভাষণ থেকে সংগ্রহীত)

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, আর ১৯৫০ সালে পুনরায় ভারতে আসি। আমি পাকিস্থানে করাচি থাকাকালীন পূর্ব বঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হল। ঢাকা ত্রিপুরা নোয়াখালী খুলনা ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় হিন্দুদের উপর চরম অত্যাচার খুন হত্যাকান্ড চলতে লাগল। অসহায় হিন্দুরা আমাকে বহু চিঠিপত্র টেলিগ্রাম করাচিতে পাঠাতে লাগল। পাক সরকার কৌশলগত ভাবে আমাকে জানতে দেয়নি। যখনই আমি জানতে পারলাম তখনই পূর্ববঙ্গে ছুটে গিয়ে অসহায় হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছি। দাঙ্গা বিদ্ধস্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে বহু জনসভা করে বক্তৃতা দিয়ে তাদের শান্তনা দিয়েছি। আমার অনেক বক্তৃতার অংশই  শাসকগোষ্ঠির কাছে দেশোদ্রহিতার রূপ নিয়েছিল। আমি করাচি পৌঁছানোর আগেই আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্টের পাহাড় জমে গেছে।
   ইত্যাদি বহু ঘটনার পরে যখন বুঝতে পারলাম পাকিস্থানে হিন্দুদের বসবাস নিরাপদ নহে। পাকিস্থান থেকে সংখ্যালঘুদের কল্যানের জন্য যত দাবিই করেছি, পাক সরকার তা মানেনি। কথা দিয়েও কথা রাখেনি। যে হিন্দুদের কল্যানের জন্য পাকিস্থানে গিয়েছি তাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিকার করতে না পারলে সেখানে থাকা উচিত হবে না বিবেচনা করেই ভারতে চলে আসি। ভারতে এসে অল্প কয়েকদিন পরেই আমার সমস্ত অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে পাক সরকার প্রধান মঃ লিয়াকৎ আলীর কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। সমস্ত হিন্দু ভাইদের ভারতে আসার আহ্বান জানিয়েছি। আমার পদত্যাগ পত্রের কপি বাংলা ইংরাজী বহু সংবাদ পত্রেই প্রকাশিত হয়েছে।
     আমি ভারতে আসার পরেও তিন বছর ভারত ও পাকিস্থানের যাতায়াতের দরজা খোলা ছিল। কেন এখনও পূর্ব বঙ্গে হিন্দুরা রয়েছেন? ইহার কারণ ঐ উক্ত একই বঙ্গভঙ্গের অভিশাপ।
                                                - যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (জীবনের শেষ ভাষণ থেকে সংগ্রহীত)

আমাকে “যোগেন আলী মোল্লা” খেতাব নিতে হয়েছে। লীগ মন্ত্রী সভায় হিন্দু মন্ত্রীও ছিলেন, যেমন ফজলুল হক মন্ত্রী সভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন। তাকে বলা হত “শ্যামাহক মন্ত্রী সভা”। তারা কেউই মোল্লা পদবীতে ভূষিত হননি কেন?- যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (জীবনের শেষ ভাষণ থেকে সংগ্রহীত)  
আমি চার চার বার মন্ত্রী হয়েও জনহিতকর কাজ ছাড়া নিজের জন্য কিছু করিনি। এক ভদ্রলোক সৌজন্য বশতঃ থাকার জন্য আমাকে একটা ঘর দিয়েছেন। সামান্য একটা এম. এল. এ. হলেই ধন্য হব মনে করিনা। জনহিতকর কর্মই আমার জীবনের ব্রত। কিছু ক্ষমতা না পেলে কিছু করা যায় না।
                                           - যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (জীবনের শেষ ভাষণ থেকে সংগ্রহীত)

অনেকের মনে একটি ভ্রান্ত ধারণা দানা বেধে রয়েছে যে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জীবনে গুরুচাঁদ ঠাকুরের কোনো প্রভাব ছিল না। সত্যানুসন্ধানী গবেষক- গুরুচাঁদ  ঠাকুরের হাতে গড়া এবং তাঁর অন্যতম পার্ষদ ভীষ্মদেব দাসের সঙ্গে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের নিবিড় রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রমাণের মধ্যদিয়ে এই ভ্রান্ত ধারণার নিরসন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
      -অস্পৃশ্য জনজাতির মুক্তি-সূর্য মহাপ্রাণ যোগেন্দরনাথ মন্ডল –লেখক- মনি মোহন বৈরাগী।  পৃঃ ৭/৮

যে মহান ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন কাজের মধ্যে আমি সর্বাধিক গুরুত্ব দেই দু’টো কাজকে; যে কাজ দু’টো বিশেষ করে দেশের পিছিয়ে রাখা সকল মানুষের উদ্ধারের জন্য তিনি করেছেন সেই কাজ হচ্ছে-
 (১) ডা. বাবা সাহেব আম্বদেকরকে সংবিধান সভায় পাঠানো।
(২) লকুর কমিটির রিপোর্টকে কার্যকরী হতে না দিয়ে সমগ্র নমঃশূদ্র, দাস, রাজবংশী ও সুড়ি বা সাহাদের তফশিলিদের মধ্যে রাখা।
কিন্তু এই কাজটি দু’টিই সব থেকে বাহ্মণ্যবাদীদের চক্ষুশূল করে তোলে মহাপ্রাণকে। যে গ্লানি আজও মুছে দেবার জন্য সেভাবে এগিয়ে আসেনি তাঁর উপকার ভোগীরা। উল্টা তাঁর প্রতি গ্লানির কথাকে অন্ধের মতো প্রচার করে চলেছে। আর গোলামীতে আনন্দ উপভোক করছে।
    তবে যেদিন সত্যি সত্যি এই মহান ত্যাগীর জীবনাদর্শ ও কর্মকে যেনে তাঁর প্রতি এই গ্লানির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে তাঁর প্রকৃত উত্তরসূরিরা সেদিন আর এক নতুন আলো জ্বলবে। যে আলোর নাম হবে মহাপ্রাণের আলো। (মহাপ্রাণের জন্মদিন ২৯ শে জানুয়ারী ১৯০৪ এবং মহাপরিনির্বাণ ৫ অক্টোবর ১৯৬৮ উপলক্ষে এই লেখা)

  


0 comments:

Post a Comment