Tuesday, 19 April 2016

// // Leave a Comment

ভগবদ্‌গীতা সম্পর্কে প্রবন্ধঃ প্রতিবিপ্লবের দার্শনিক ব্যাখ্যা- ডঃ আম্বেদকর।


ভগবদ্‌গীতা সম্পর্কে প্রবন্ধঃ প্রতিবিপ্লবের দার্শনিক ব্যাখ্যা- ডঃ আম্বেদকর।
(আম্বদেকর রচনাবলী ৬ষ্ঠ খন্ড)
কৃষ্ণ এবং তার গীতা
ভগবদ্‌গীতা একটি ‘সুচসমাচার’ নয় এবং এর কোন বাণী থাকতে পারে না এবং কারো পক্ষে এর শরণাপন্ন হওয়া সম্পূর্ণ অর্থহীন। অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে যে যদি ভগদ্‌গীতা ‘সুসমাচার’ না হয় তবে তা কি? উত্তরে আমি বলব, তা ধর্মীয় গ্রন্থ বা দার্শনিক মতবাদ –এর কোনটিই নয়। ভগবদ্‌গীতা দর্শনের ভিত্তিতে কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় নিয়ম বিধিকে সুরক্ষা করে। সেই হিসাবে যদি কেহ একে ধর্মগ্রন্থ বা দর্শনশাস্ত্র বলেন তবে তিনি নিজে খুশি থাকতে পারেন কিন্তু মূলতঃ এটি তার কিছুই নয়। ধর্মকে রক্ষা করার জন্য তা দর্শনের বুলি আওড়ায়। (পৃষ্ঠা নং ৯)

    ভগবদ্‌গীতা একটি দার্শনিক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে-সেটা হচ্ছে- কর্মযোগ। এর দ্বারা ধর্ম কর্মের অনুষ্ঠান করা বুঝায়, যেমন যজ্ঞকে বলা হয় মুক্তির পথ। গীতা সমস্ত যোগ বা মার্গের মধ্যে বারবার কর্মযোগেকে উচ্চস্থান দিয়ে থাকে। যে পদ্ধতিতে তা কর্মযোগকে রক্ষা করে তা হলো, যা এর উপর অন্ধবিশ্বাসাদি কুৎসিত আঁচিলের মত গজিয়ে উঠেছে তা দূরীভূত করা। অন্ধবিশ্বাস হলো আঁচিলরূপ অস্বাভাবিক মাংসপিন্ড। (পৃষ্ঠা নং ১০)
    প্রতিবিপ্লবের মতবাদ্গুলি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা গীতা কেন অনুভব করেছে? আমার নিকট উত্তরটি খুব প্রাঞ্জল। বৌদ্ধ ধর্মের আক্রমণ হ’তে ঐগুলিকে রক্ষা করার জন্যই  গীতার অভ্যুত্থান ঘটে। বুদ্ধ অহিংসার পুজারী শুধু তাই নয়। ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য বহু সংখ্যক লোক জীবনের পথ বলে এই মত গ্রহণ করেছিলেন এবং হিংসার প্রতি ঘৃণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বুদ্ধ চতুর্বর্ণের বিরুদ্ধে লোককে প্রবুদ্ধ এবং চতুর্বর্ণ মতবাদের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক কতকগুলি অপ্রীতিকর উপমা ব্যবহার করেছিলেন। তাতে চতুর্বর্ণের কাঠামো ভেঙে যায় এবং চতুর্বর্ণ নির্দেশিত বিধানগুলির ওলট পালট হয়ে যায়। শূদ্র এবং রমণীগণ সন্ন্যাসী হওয়ার অধিকার লাভ করে যা প্রতিবিপ্লবের দ্বারা অস্বীকার করা হয়। বুদ্ধ কর্মকান্ড এবং যজ্ঞকে হিংসাত্মক বলে তিব্রভাবে নিন্দা করেছেন। তিনি একে আরও একটি কারণে নিন্দা করেছেন যে, এর পিছনে ফায়দা লোটার একটি স্বার্থপর ইচ্ছা বলবত আছে।
    এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতি বিপ্লবকারীদের কি বলার আছে? বলতে পারেন এগুলি বেদের নির্দেশ, বেদ অভ্রান্ত অতএব তার মতবাদ প্রশ্নাতীত। যে যুগ সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল এবং সভ্য যুগ, সেই বৌদ্ধযুগে ভারত এরূপ তুচ্ছ স্বেচ্ছাচারী অযৌক্তিক এবং ভঙ্গুর মতবাদের উপর ভিত্তি করে কিরূপে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? (পৃষ্ঠা নং ১২)
গীতা কি বৌদ্ধধম্মের পূর্বে কার?
   (ক) ভগবদ্‌গীতা ব্রহ্ম-নির্বান বিষয়ে আলোচনা করেছে (ম্যাক্সমূলার মহাপরি-নির্বান সুত্ত, পৃঃ  ৬৩) অর্থাৎ ব্রহ্মলাভ করার পথ। ভগবদ্‌গীতা বলেছে নির্বান লাভ করার উপায়-(১) শ্রদ্ধা অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস, (২) ব্যবসায় অর্থাৎ স্থিরপ্রতিজ্ঞ, (৩) স্মৃতি অর্থাৎ অদ্ভীষ্টস্মরণ, (৪) সমাধি অর্থাৎ একান্তধ্যান, এবং (৫) প্রজ্ঞা অর্থাৎ অধ্যাত্মিক বা খাঁটি জ্ঞান। এই “নির্বাণ” মতবাদ গীতা কোথা  থেকে ধার করেছে? নিশ্চয়ই তা উপনিষদ থেকে ধার করা হয় নাই। কারণ উপনিষদে কোথাও নির্বান শব্দটির উল্লেখ করে নাই। সমস্ত ধারণাটি বৌদ্ধদের এবং বৌদ্ধধম্ম হতে  তা ধারপ্রাপ্ত। এ বিষয়ে যদি কারো কোন সন্দেহ থাকে তবে ভগবদ্‌গীতার এই ব্রহ্মনির্বানের সঙ্গে ‘মহাপরিনিব্বান সুত্তে’ সংকলিত নির্বাণ সম্পর্কে বৌদ্ধদের ধারণার সহিত তুলনা করতে পারেন। দেখা যাবে যে সেগুলি একই। ঘটনা এই নয় কি যে গীতা নির্বাণের পরিবর্তে-ব্রহ্ম-নির্বাণদের সম্পূর্ণ ধারণাটি ধার করেছে? এটা বৌদ্ধ ধম্ম থেকে চুরি করার অপবাদ মোচন ভিন্ন অন্য কোন কারণে নয়।
   (খ) অন্য একটি দৃষ্টান্ত গ্রহণ করা যাক। ৭ম অধ্যায়ের ১৩-২০ শ্লোকে কৃষ্ণের নিকট ‘প্রিয়’
 কে এই সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে- যার জ্ঞান আছে, বা যে কর্ম অনুশীলন করে, বা যে ভক্ত, এই তিনের মধ্যে কে কৃষ্ণের প্রিয়। কৃষ্ণ বলেছে- ভক্তই তার নিকট প্রিয়- কিন্তু আরও কিছু যুক্ত করেছেন যে তার অবশ্যই ভক্তের চিহ্ন থাকতে হবে। খাঁটি ভক্তের চিহ্ন কি? কৃষ্ণের মতে একজন খাঁটি ভক্ত অনুশীলন করে- (১) মৈত্রী অর্থাৎ দয়ায় অনুরাগ; (২) করুণা অর্থাৎ সহানুভূতি’ (৩) মুদিতা অর্থাৎ সহানুভূতির আনন্দ; এবং (৪) উপেক্ষা অর্থাৎ নির্লিপ্ত। খাঁটি ভক্তের এই গূণাবলী ভগবদ্‌গীতা কোথা থেকে ধার করেছে? বৌদ্ধ ধম্মেই এর মূল। যারা এর প্রমাণ পেতে চান তারা মহাপদন সুত্ত’ এবং তেবিজ্জ সুত্ত –এর তুলনা করতে পারেন। সেখানে বুদ্ধ কেন কারো পক্ষে হৃদয়ের অনুশীলনের জন্য ভাবনার (মানসিক ভাব) লালন পালন প্রয়োজন তা শিক্ষা দিয়েছেন। এই তুলনা দেখাবে যে সমগ্র মতবাদটি বৌদ্ধ মতবাদ থেকে সংগৃহীত, এমন কি শব্দগুলিও।
    (গ) তৃতীয় অপর একটি দৃষ্টান্ত পরখ করা যাক। ১৮শ অধ্যায়ে ভগবদ্‌গীতা ক্ষেত্র এবং ক্ষেত্রজ্ঞ সম্পর্কে আলোচনা করেছে। ৭-১১শ শ্লোকে নিম্নে উল্লিখিত ভাষায় কৃষ্ণ উল্লেখ করেছেন জ্ঞান এবং অজ্ঞানতা কিঃ-   অহংকারশূন্যতা (বিনয়), ভান-বিরহিতা, আঘাত বা ক্ষতি না করার ভাব, ক্ষমা, সোজা পথে চলা (সততা), গুরুর প্রতি ভক্তি, পবিত্রতা, একনিষ্ঠতা, আআত্মসংযত, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি, আত্মশ্লাঘাহীনতা, দুর্ভোগ এবং হীনজন্ম সম্পর্কিত চিন্তা, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধি, অনাসক্তি, পুত্র, স্ত্রী বা গৃহ সম্পর্কে নিজেকে সনাক্ত না করা, গ্রাহ্য-অগ্রাহ্য উভয়ের উপস্থিতিতে সম মনোভাবাপন্ন থাকা, আমার প্রতি স্থিরবিশ্বাস এবং ধ্যান, শান্তিপূর্ণ আমোদ অবলম্বন (নির্জনে একাগ্রতা, ধ্যান), পার্থিব মানব সমাজের প্রতি অণীহা, আত্মজ্ঞানের অবিরাম প্রয়োগ, তত্ত্বজ্ঞানের সঠিক তাৎপর্য গ্রহণ এবং অনুভব করণ (সাংখ্য দর্শন)- এই সকলকে বলা হয় জ্ঞান এবং ইহার বিপরীতগুলিই অজ্ঞান।”
    বুদ্ধের বাণী সম্পর্কে যারা কিছুমাত্র অবগত তারা কি কেহ অস্বীকার করতে পারেন যে বৌদ্ধধম্মের মূল মতবাদ থেকে এই অংশতির প্রতিটি শব্দ গ্রহণ করা হয় নাই?
     (ঘ) ১৩শ অধ্যায়ের ৫, ৬, ১৮, ১৯ শ্লোকে গীতা অনেক শিরোনামে কর্মের রূপক ব্যাখ্যা দিয়েছে- (১) জ্ঞান (ত্যাগ), (২) দান, (৩) তপ (৪) খ্যাদ্য, এবং (৫) স্বধ্যায় (বৈদিক পাঠ)। পুরাতন ধারণা এই নূতন ব্যাখ্যার মূল কি? বুদ্ধ ‘মজ্জহিনা নিকায়’ ১/২৮৬ সুত্ত, ১৬শ-এ যা বলেছেন তার সঙ্গে তুলনা করলে কেহ কি সন্দেহ করতে পারেন যে কৃষ্ণ ১৭ অধ্যায়ের ৫, ৬, ১৮, ১৯ শ্লোকে যা বলেছেন তা বুদ্ধের শব্দের অবিকল প্রতিফলন নয়?
     এগুলি মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমি নির্বাচন করেছি যা মতবাদ সম্পর্কে অধিক প্রয়োজনীয়। যারা এ বিষয়কে অনুসরণ করতে কৌতূহলী –তারা তেলাং প্রদত্ত ভগবদ্‌গীতার সংস্করণের পাদটীকায় গীতা এবং বৌদ্ধ ধম্মের সাদৃশ্যের উল্লেখ দেখতে সমর্থ হবে যে কি বহুল পরিমানে ভগবদগীতা বৌদ্ধ মতবাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ এবং কি পরিমানে বৌদ্ধধম্ম হতে তার মতবাদ ধার করেছে। সংক্ষেপে বলা যায় ভগবদ্‌গীতা সুচিন্তিতভাবে বৌদ্ধ সুত্তের আদর্শের গঠিত হয়েছে বলে মনে হয়। বৌদ্ধ সুত্তগুলি হল, সংলাপ, ভগবদ্‌গীতাও তাই। বুদ্ধের ধম্ম নারী এবং শূদ্রের মুক্তি আনে। কৃষ্ণও নারী এবং শূদ্রের মুক্তি দানের জন্য এগিয়ে আসেন, বৌদ্ধগণ বলেন-‘আমি আমাকে বুদ্ধে, ধম্মে এবং সংঘে সমর্পণ করি।’ কৃষ্ণও বলেন-‘সকল ধর্ম’ পরিত্যাগ করে আমার শরণাপন্ন হও’ এর চেয়ে কাছাকাছি আর কি তুলনা থাকতে পারে যা বৌদ্ধধম্ম এবং ভগবদ্‌গীতার মধ্যে আছে। (পৃঃ ১৮ থেকে ২০)
------------------------------------------------------
   


0 comments:

Post a Comment