Thursday, 9 July 2020

// // Leave a Comment

“বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা হলে বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।” – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি


   
  “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা  হলে বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।” – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি

( লেখক – আমিনুল ইসলাম। ঢেকুয়া, মেদিনীপুর। প্রকাশ- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১.০৮.২০০০; বৃহষ্পতিবার।)

    শ্যামাপ্রসাদ সম্বন্ধে একপেশে চিঠিগুলি পড়ে (২/৮) কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি।  চিঠিগুলির মূল বক্তব্য হলঃ পাকিস্তানের হিংস্র কবল থেকে সমগ্র বাংলাকে বাঁচাতে ও হিন্দুদের  নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগের দাবি জানাতে বাধ্য হন। এটাই যদি বাংলা ভাগের কারণ হয় তা হলে ভারতের সীমানার মধ্যেও তো অখণ্ড বাংলা গড়তে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর অনুগামীরা। কেনই বা তাঁরা ভারতের মধ্যকার অখণ্ড বাংলারও বিভাজন চেয়েছিলেন? উত্তরটা জলের মতো পরিষ্কার- ভারতের মধ্যে থাকলেও মুসলিম প্রাধান্যযুক্ত অখণ্ড বাংলায় পূর্বের মতো হিন্দুদের আর একাধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই দেখা যায় ১৯৪৭ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির ঘোষণার দু’দিন পরেই শ্যামাপ্রসাদ বাংলার ছোটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি করলেন যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ করলে সাম্প্রদায়ক ভিত্তিতে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে। বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। (অমৃতবাজার পত্রিকা ২৪/২/১৯৪৭)। তখনকার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি কৃপালনী এই দাবি সমর্থন করলে শ্যামাপ্রসাদ বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন শুরু করলেন।

     ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন পরিকল্পনা ঘোষণা করলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে আরও জোরদার করলেন। তাঁরা বক্তৃতা দিয়ে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে বোঝাতে লাগলেন যে, হিন্দুরা বিপন্ন, বাংলা ভাগ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বাংলা পাকিস্তানে গেলে তো বটেই, স্বাধীন সার্বোভৌম হলেও, এমনকী ভারতে থাকলেও হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। সেই মতো তাঁরা বাংলার হিন্দুদের প্রভাবিত করতে লাগলেন। জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও প্রভাবিত হতে লাগলেন।

   এর পূর্বে সুরাবর্দি বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাব বাঙালির আত্মহত্যারই শামিল। বাঙালির উচিত হবে এক অখণ্ড ও অবিভক্ত, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলা গঠন। লিগের সম্পাদক আবুল হাশিম চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’- এর কথা উল্লেখ করে বলেন, “Let the Hindus and Muslims agree to C R Das’s formula of 50:50 enjoyment of political power and economic privileges, I appeal to the youths of Bengal in the name of her past traditions and glorious future to unite.” মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭- এর ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান-বিযুক্ত অখণ্ড বাংলার সম্বন্ধে জিন্নার বক্তব্য জানতে চাইলে জিন্না বললেন, I should be delighted. What is the use of Bengal without Calcutta? They had much better remained united and independent. I am sure that they would be on friendly terms with us. “অখণ্ড বাংলার প্রশ্নে শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ নেতারা সুরাবর্দি, হাশিম প্রমুখ নেতার সঙ্গে অখণ্ড বাংলার জন্যে ৬ দফা সূত্রের মধ্যে  সাম্প্রদায়িকতার ভুত খুঁজে পেলেন এবং এর তীব্র সমালোচনা করে বললেন, ‘Sovereign Bengal is a sugar-coated alternative to Pakistan.’

    ১৯০৫ সালে যাঁরা কার্জন পরিকল্পিত বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন, মাত্র ৪২ বছরের ব্যবধানে সেই শ্রেণীর মানুষেরা বাংলা ভাগের আন্দোলন শুরু করেন। তবে দু-একজন মুসলিম নেতা ১৯৪৭-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন   কারণ তাতে তাঁদের প্রভাবের ক্ষেত্র কমে যাবে। কিন্তু দু’একজন বাদে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা একজোট হয়ে বাংলার প্রায় সব হিন্দু নেতা বঙ্গভঙ্গের জন্য লাগাতার আন্দোলন করেছেন। কারণ ১৯৪৭ সালে বাংলার রাজনীতিতে মুললমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা অখণ্ড থাকলে সেখানে হিন্দুদের প্রাধান্যের কোনও রকম সম্ভাবনা নেই। তাঁরা বুঝেছিলেন সে অখণ্ড বাংলা যদি ভারতের মধ্যেও থাকে, তা হলেও সেখানে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে। মন্ত্রিসভার প্রধান একজন মুসলমানই হবেন। এ বিষয়টা হিন্দু নেতাদের একেবারেই অপছন্দ ছিল। তাই ‘হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায়’ বদ্ধপরিকর থাকতে শ্যামাপ্রসাদ ও অন্যান্য হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের দৃঢ় সমর্থক হয়ে পড়েন এবং অখণ্ড বাংলা মেনে নিতে পারেননি।

     জয়া চ্যাটার্জি তাঁর ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গ্রন্থে বাংলার জাগরণের সুফলভোগী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বাঙালির ধর্মীয় তথা ভদ্র সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ এবং বাংলাভাগের নাটকীয় কাহিনীতে এই শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা ও বহুবিস্মৃত কীর্তির ধর্মীয় চরিত্র উদ্ঘাটন করেছেন ও একই সঙ্গে এই শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থের অসংকোচ পরিপোষণার বহু দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছেন। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এই শ্রেণীরা নিজেদের সাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে ঢেকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল এবং বাংলাভাগের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

    শ্যামাপ্রসাদের হিন্দুভক্তি ছিল বর্ণহিন্দুদের জন্য, এলিট হিন্দুদের জন্য, বিত্তশালী হিন্দুদের জন্য। যুক্তবাংলার মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সমান অধিকার দেওয়ার বিষয়ে তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল। তিনি মনে করতেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই শিক্ষা, সংস্কৃতি, মেধা ও কর্মদক্ষতায় শ্রেষ্ঠ। তাই শাসন করার ও সমাজে আধিপত্য করার একমাত্র অধিকারী হচ্ছে উচ্চবর্ণের মানুষেরা। তিনি মনে করতেন, “মুসলিম প্রাধান্য বজায় থাকিবার অর্থ বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির উচ্ছেদ। ইসলামে ধর্মান্তরিত একদল নিচু জাতির হিন্দুকে (মুসলমানদের) সন্তুষ্ট করিবার জন্য সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিতে সে ক্ষেত্রে বলি দিতে হইবে।” (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পেপার্স)।

     শ্যামাপ্রসাদ ব্যক্তিগতভাবে সৎ, পণ্ডিত ও আদর্শবাদী হলেও তাঁর সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা ও বাংলাভাগের প্রশ্নে তাঁর সাম্প্রদায়িক ভূমিকা কী করে অস্বীকার করা যায়? যাঁরা শ্যামাপ্রসাদকে পশিমবঙ্গ সৃষ্টির কৃতিত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের জানা প্রয়োজন শ্যামাপ্রসাদ নিজেই পরে আক্ষেপ করেছিলেন বাংলা ভাগ করার জন্য। ১৯৫২ সালে নদিয়ার চাকদহে এক জনসভায় তিনি বলেন,      “বাংলাভাগের জন্য মানুষের (উদ্বাস্তুদের) এত কষ্ট হবে এ যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা হলে  বাংলাভাগ চাইতাম না। এখন মনে হচ্ছে যোগেনবাবুরা বাংলাভাগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তা সঠিক ছিল।”
------------------

0 comments:

Post a Comment