সমাজ
ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে সমাজের কোন উন্নতি করা কি সম্ভব?
লেখক – বাবাসাহবে ড. আম্বেদকর
( from Annihilation of
Caste)
যতক্ষণ আপনারা
সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন না করবেন, ততক্ষণ তেমন কোন উন্নতি করতে পারবেন না। আপনারা আপনাদের সম্প্রদায়ের লোকদের একত্রে
সমাবেশ করতে পারবেন না, কোনো আক্রমনের জন্য বা কোনো প্রতিরক্ষার জন্য
জাতি-ব্যবস্থার ভিতের উপর আপনারা কোনো কিছু নির্মাণ করতে পারবেন না। আপনারা রাষ্ট্রের নির্মাণ করতে পারবেন না।
আপনারা আদর্শ নীতিবোধ ও তৈরি করতে পারবেন না। জাতিব্যবস্থার ভিতের উপর আপনারা যা
কিছু নির্মাণ করুন না কেন সেটা ভেঙ্গে পড়বে। সেটা কখনও স্থায়ী হবে না।
এখন আর একটি প্রশ্নের বিচার- বিশ্লেষণ করতে
বাকি আছে। সেই প্রশ্নটি হল- হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় সংস্কার কিভাবে করা যায়?
জাতিপ্রথাকে কিভাবে ধ্বংস করা যায়? এটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই ধরনের মতামত করা হয়েছে যে, জাতব্যবস্থার সংস্কার
করতে হলে প্রথম পদক্ষেপ হল জাতের উপবিভাগগুলি (Sub-castes) সমাপ্ত করতে হবে। এই মতবাদের পিছিনে যুক্তি হল যে, আচার
ব্যবহার এবং মর্যাদাবোধের দিক দিয়ে বিভিন্ন জাতের চেয়ে একটি জাতের উপবিভাগগুলির
মধ্যে বেশি সাদৃশ্য আছে। আমি মনে করি, এটা একটা ভুল যুক্তি। দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণদের তুলনায় উত্তর ভারতের
এবং মধ্য ভারতের ব্রাহ্মণদের সামাজিক পদমর্যাদা নিম্নস্তরের। উত্তর এবং মধ্য
ভারতের ব্রাহ্মণরা শুধুমাত্র রান্না করা এবং জল আনার কাজ করে, অথচ দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণরা উচ্চ সামাজিক
মর্যাদা দখল করে আছে। অপরদিকে উত্তর ভারতের বৈশ্য ও কায়স্থরা এবং দক্ষিণ ভারতের
ব্রাহ্মণরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধিতে ও সামাজিক মর্যাদায় সমকক্ষ। আবার আহারের
ব্যাপারেও দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কাশ্মীর ও বাংলার ব্রাহ্মণদের কোন মিল নেই। দক্ষিণ ভারতের
ব্রাহ্মণরা নিরামিষাশী এবং কাশ্মীর ও বাংলার ব্রাহ্মণরা আমিষভোজী। আবার আহারের
ব্যাপারে দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ এবং গুজরাটী মারোয়ারী, বনিয়া এবং জৈন প্রভৃতি
অব্রাহ্মণদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মিল আছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, উত্তর ও
দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণদের মধ্যে ঘনিষ্ট সামাজিক মিলন ঘটানোর চেয়ে উত্তর ভারতের
কায়স্থ এবং দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় ও অব্রাহ্মণদের মধ্যে ঘনিষ্ট সামাজিক মিলন
সহজসাধ্য।
ধরুন, এক জাতির উপ-বিভাগগুলির মধ্যে ঘনিষ্ট
সামাজিক মিলন সম্ভব হলে এবং উপবিভাগগুলির বিলোপ সাধন হলে জাত ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে
যাবে, এর কি গ্যারান্টি আছে? অপর পক্ষে একটি জাতির উপবিভাগগুলির বিলুপ্তি হওয়ার
সাথে সাথে জাতিভেদ প্রথার বিলুপ্তি হওয়ার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং
দেখা যাচ্ছে যে, জাতের উপবিভাগের বিলুপ্তি ঘটানোর এই তত্ত্ব অবাস্তব এবং
অকার্যকারী।
জাতিব্যবস্থা সমাপ্ত করার আর একটি পদ্ধতি
হচ্ছে- অসবর্ণদের মধ্যে একত্রে বসে খাওয়া-দাওয়া শুরু করা। কিন্তু আমার মতে অসবর্ণ ভোজন জাতব্যবস্থা নামক সামাজিক ব্যধির আসল ঔষধ নয়। অনেক জাতির মধ্যে অসবর্ণ ভোজনের
বাধা নেই। কিন্তু সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, অসবর্ণ ভোজন স্বজাতি প্রীতি এবং জাত চেতনাবোধ ধ্বংস
করতে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি
যে, ‘জাতিভেদ’ প্রথা নামক সামাজিক ব্যাধির খাঁটি ঔষধ হল ‘অসবর্ণ বিবাহ’। শুধুমাত্র রক্তের সংমিশ্রণই আত্মীয়তা বোধ সৃষ্টি
করতে পারে। যতক্ষণ বিভিন্ন জাতের মধ্যে আত্মীয়তা বোধ সৃষ্টি না
হবে, ততক্ষণ জাত ব্যবস্থা নির্মূল হবে না। জাত ব্যবস্থার মাধ্যমে একজাতের লোক অন্য
জাতের লোককে পর ভাবে। একমাত্র অসবর্ণ বিবাহের ফলে রক্তের মিশ্রণের দ্বারা ঘনিষ্ট
মিলনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতের মধ্যে আত্মীয়তাবোধ গড়ে উঠবে। হিন্দুর সামাজিক জীবনে
মিলনের পথ সৃষ্টি করতে অসবর্ণ বিবাহ একটি অপরিহার্য উপাদান। কোনো সমাজ যখন অন্যান্য বন্ধনের দ্বারা দৃঢ়ভাবে
সংযুক্ত হয়, তখন বিবাহ মানুষের একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু যে সমাজ সামাজিক মিলনের
জন্য কোনো বন্ধন নেই সেখানে বিবাহ সামাজিক
বন্ধন সৃষ্টি করতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। জাত ব্যবস্থা ভাঙার প্রকৃত প্রতিকার
হল অসবর্ণ বিবাহ। অসবর্ণ বিবাহ ছাড়া অন্য কিছু জাতিব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটাতে সক্ষম
হবেনা।(The real remedy
for breaking Caste is inter-marriage. Nothing else will serve as the solvent of
Caste.)
আপনাদের ‘জাতপাত তোড়ক মন্ডল’ অসবর্ণ বিবাহকে
উৎসাহ দিতে চায়। আমি এজন্য আভিনন্দন জানাই। জাত-ব্যবস্থাই
হিন্দু সামাজের দুরারোগ্য ব্যাধি।
জাতপাত তোড়ক মন্ডল হিন্দু সমাজের এই রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং হিন্দুদের
বলতে সক্ষম হয়েছে যে, হিন্দুদের মধ্যে দোষ-ত্রুটিগুলো কোথায়। মন্ডলের এই
সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য আমি তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। সামাজিক অত্যাচারের কাছে রাজনৈতিক অত্যাচার কিছুই নয়। যে
রাজনীতিবিদ সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান, তার চেয়ে যে
সমাজ-সংস্কারক সমাজের অন্যায় নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান- তিনি অনেক বেশি
সাহসী এবং বীর। প্রত্যেক জাতির সাধারণ
মানুষ যখন অধিক সংখ্যায় অসবর্ণ ভোজন এবং অসবর্ণ বিবাহ করতে রাজী হবে এবং তা অনুসরণ করবে
তখন জাত-ব্যবস্থার কঠিন বন্ধন খসে পড়তে
বাধ্য হবে- আপনাদের এই মতবাদ নির্ভুল।
আপনারা রোগের মূল কারণ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু
রোগ নিরাময়ের জন্য আপনাদের প্রতিবিধান কি ঠিক? আপনারা নিজেরাই নিজেদের কাছে এই
প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন। কি কারণে হিন্দুদের একটা বড় অংশ অসবর্ণ ভোজন ও অসবর্ণ বিবাহ
করে না? আপনাদের এই উদেশ্য জনপ্রিয় না হওয়ার কারণ কি? এই প্রশ্নের একটি মাত্র
উত্তর আছে; সেটা হ’ল, অসবর্ণ ভোজন এবং অসবর্ণ বিবাহ হিন্দুদের পবিত্র ধর্মমত ও
বিশ্বসের সম্পূর্ণ বিরোধী। জাত,
ইটের দেওয়াল বা কাঁটা তারের বেড়ার মত নিরেট বস্তু নয় যে সেটা ভেঙে ফেললে পথের সব
বাঁধা অপসারিত হবে। জাত হল একটি ধারনা, এটা একটা মানসিক অবস্থা। অতএব জাত-ব্যবস্থা
নষ্ট করার অর্থ কোনো নিরেট বস্তু ধ্বংস করা বুঝায় না। এর অর্থ বিচার পরিবর্তনের
সঙ্গে যুক্ত। জাতব্যবস্থার
ফলে মানুষ মানুষের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার করে। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, মিঃ গান্ধিসহ যে
সমস্ত সংস্কারকরা অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের কাজে নিযুক্ত আছেন, তাঁরা হয়তঃ বুঝতে পারেননি যে, জনগণের
সামাজিক আচরণগুলি শাস্ত্র নির্দেশিত নীতিগুলির প্রতি অবিচল বিশ্বাসের ফল।
শাস্ত্রের মাধ্যমে যেটা তাদের মনের মধ্যে গেথে দেওয়া হয়েছে। জনগণ শাস্ত্রের প্রতি
যতক্ষণ পবিত্র ভাব ও বিশ্বাস করা বন্ধ না
করবে, ততক্ষণ তারা তাদের আচরণের পরিবরতন করবেনা। কারণ যুগযুগ ধরে বংশ পরম্পরায়
শাস্ত্র নির্দেশিত আচরণ হিন্দুদের রক্তের সঙ্গে
মিশে গেছে। পিতামাতার কাছ থেকে অজ্ঞাতসারে সন্তানরাও ঐ আচরণবিধি মেনে চলছে। তাই
অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের প্রচেষ্টাগুলি বিশেষ ফলপ্রসু হয়নি। আর এর জন্য
আশ্চর্য হওয়ারও কোন কারণ নেই।
অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য সমাজ সংস্কারকরা
যে ভুল করছেন, আপনারাও সেই একই ভুল করছেন। অসবর্ণ ভোজন এবং অসবর্ণ বিবাহের জন্য
আন্দোলন করা বা হিন্দুদের সংগঠিত করা, কৃত্রিম উপায়ে জোর করে খাদ্য খাওয়ানোর মত।
প্রত্যেক নরনারীকে শাস্ত্র নির্দেশিত বিধির নাগপাশ থেকে মুক্ত করে দিন। শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে যে সব অনিষ্টকর ধারণাগুলি তাদের মনের
মধ্যে গেঁথে আছে, সেই সব ভক্তি-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, মনোবাভ, বিচারকে নির্মূল
করুন তখন দেখতে পারবেন যে, প্রত্যেক নরনারী অসবর্ণ ভোজন ও অসবর্ণ বিবাহ করতে
দ্বিধাবোধ করবে না। শাস্ত্র দ্বারা
প্রতিষ্ঠিত ক্ষতিকর ধারণাগুলি মাথা থেকে বেরিয়ে গেলে তখন দেখবেন আপনারা না বললেও
তারা অসবর্ণ ভোজন ও বিবাহের আয়োজন করবে।
কথার মার-প্যাঁচের সাহায্য নেওয়ার কোন
প্রয়োজন নেই। শাস্ত্রগুলি জাত মেনে চলতে বলেনি বা শাস্ত্র বাক্যগুলি জাত-ব্যবস্থা
সমর্থন করেনা, অথবা শাস্ত্রবাক্যের ব্যাকরণগত অর্থ বা তর্কশাস্ত্রের নিয়মগত
ব্যাখ্যা অনুসারে জাতিভেদ প্রথার জন্য শাস্ত্রগুলি দায়ী নয়, এরকম বাকচাতুরী করে
কোন লাভ হবে না। এখানে প্রধান বিচার্য বিষয় হল, সাধারণ মানুষ শাস্ত্রগুলির অর্থ
কিভাবে করেছে এবং বুঝেছে। গৌতম বুদ্ধ যেরকম বলিষ্ঠ পথ দেখিয়েছিলেন আপনাদেরও সেরকম
পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বুদ্ধ এবং গুরুনানকের মত আপনাদেরও শুধু শাস্ত্র
প্রত্যাখ্যান করলে চলবে না। শাস্ত্রের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে হবে।
হিন্দুদের একথা বলতে আপনাদের সাহস থাকা দরকার। হিন্দুধর্মের মধ্যেই ত্রুতি রয়েছে।
এই ধর্ম জাতব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। জাত খুব ভাল জিনিস এই ধারণাটি প্রত্যেক
হিন্দুর মনের মধ্যে গেথে দিয়েছে। হিন্দুদেরকে এসব কথা বলতে আপনারা সাহস দেখাবেন
কি?
0 comments:
Post a Comment