বৌদ্ধ ধম্মের সার কথা
শান্তিরঞ্জন বিশ্বাস
(অদল বদল পত্রিকা- ১৫ই মে ২০১৩ সংখ্যা থেকে সংগৃহীত)
(চেন্নাইয়ের
এগমোসে মহাবোধী সংঘের আয়োজিত বুদ্ধের ২৫০১ তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে, ১৯৫৭ সালে
পেরিয়ার অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর সেদিনের ঐতিহাসিক ভাষণের আংশিক অনুবাদ নিম্নে দেওয়া
হল।)
আমরা কেন বুদ্ধের জন্মদিবস পালন করি?
বুদ্ধজয়ন্তী পালন করি? বুদ্ধজয়ন্তী বলতে কেবল বুদ্ধের একটি ছবি বা কোন
মূর্তির-কর্পূর, নারকেল ও খাদ্যবস্তু দিয়ে পুজো করাকে বুঝায় না। এর অর্থ আমরা
বুদ্ধের জীবন, সাধনা ও শিক্ষা থেকে কিছু শিখবার এবং তা নিজ নিজ জীবনে অনুসরণ করার
সিদ্ধান্ত নিই। নাস্তিক বলতে যদি যে বেদ, পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রকে অস্বীকার করে
তাকেই বুঝায় তবে আমিও (পেরিয়ার ই ভি রামস্বামী) একজন নাস্তিক। আর এরূপ ব্যক্তিই
বুদ্ধের উপর কিছু বলার উপযুক্ত, তাঁর কিছু বলার অধিকার আছে। অবশ্য বেদ শাস্ত্র, পুরাণে যে ব্যক্তি বিশ্বাস করেন তিনিও
চালাকি করে এরূপ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে পারেন। তিনি তো নিশ্চিন্তভাবে লোকজনকে ঠকানোর
উপায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং নিজেও একজন ভন্ড। তিনি যাদের শ্রদ্ধাভক্তি করেন সেইসব প্রাচীন ঋষি ও মহাত্মাদের মতই নিজেও যে
বুদ্ধের উপর বক্তৃতা করবেন- তা মোটেই বিচিত্র নয়।
তবে বুদ্ধ কিন্তু কোন ঋষি বা
মহাত্মা ছিলেন না। প্রকৃতপক্কে তিনি ঋষি মহাত্মাদের বিরোধিতাই করতেন। আর সেজন্য
আমরাই (Atheist/Rationalist) এখানে তাঁর
জন্মদিবস পালনে জমায়েত হয়েছি। বুদ্ধ যেমন কোন ঋষি বা মহাত্মা নন, তেমনি
বৌদ্ধমত বা বৌদ্ধধম্ম যে অর্থে ধর্ম শব্দকে সচরাচর ব্যবহার করা হয়-সে অর্থে কোন
ধর্মও (Religion) নয়। অনেকেই বৌদ্ধ ধম্মকে
ধর্ম বলে ভুল করেন। একটি ধর্ম অবশ্যই ঈশ্বরকেন্দ্রিক হবে। তাছাড়াও ধর্মের সঙ্গে
মোক্ষ, নরক, আত্মা, পরমাত্মা, পাপ, পূণ্য প্রভৃতিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর একটি বড়
ধর্ম (হিন্দু) হতে হলে তো একজনমাত্র দেবতায় চলবে না- বহু দেবতার প্রয়োজন। বিশ্বের
অন্যকোন দেশের ধর্মে ভারতের মত এত দেবদেবী নেই। আর
সেসব দেবদেবতার থাকবে পত্নী, উপপত্নী এবং সম্ভাব্য সমস্ত প্রকার মানবিক
সম্পর্কযুক্ত মানুষ। ভারতবাসী তো এরূপ ধর্মের সঙ্গেই স্বচ্ছন্দ, সুপরিচিত।
শুরুতেই বলতে হয়- বুদ্ধ
ঘোষণা করেছিলেন, ভগবানকে নিয়ে মানুষের বিব্রত হওয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষ কেবল
মানুষের জন্যই উদ্বিগ্ন থাকবেন। বুদ্ধ স্বর্গ নরকের কথাও বলেন নি। মানুষের পবিত্র
ও সৎ আচরণের উপরেই তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিতেন। জ্ঞান, যুক্তিনির্ভর
ভাবনা চিন্তাই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। কোন ঋষি বলেছেন বা কোন মহাত্মা লিখেছেন
বলেই তাকে বিশ্বাস করা চলবে না। প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই উচিত যেকোন প্রস্তাব
বা প্রতিজ্ঞা নিজের জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বিচার বিবেচনা করা এবং প্রকৃত সত্যে উপনীত
হওয়া।
তাই বৌদ্ধমত কোন ধর্ম নয়- তাই তো
আমরা (নাস্তিকরা) বুদ্ধ জয়ন্তীতে আনন্দের সঙ্গে যোগদান করেছি।
আর্যরা ভারতে এসে দেশটাকে এক প্রিমিটিড্
(আদিম) ও বর্বরতার দেশে পরিণত করেন। ২৫০০ বছর আগে সেই বর্বরতার যুগে বুদ্ধ
জন্মেছিলেন। সেদিন এদেশে যে ধর্ম প্রচলিত ছিল- তিনি তার বিরুদ্ধে প্রচন্ডভাবে
লড়েছিলেন। বুদ্ধের প্রবর্তিত মতবাদ যে কতবড় মহৎ ও শক্তিশালী ছিল তাঁর মতবাদ
প্রচারের বিরুদ্ধে যে দারুণ বিরোধিতা ও প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটাই তার শ্রেষ্ঠ
প্রমাণ।
রামায়ণ তো বুদ্ধমতের কুৎসা
করেছে। বুদ্ধের শিক্ষামূকল উপদেশকে প্রতিরোধ করতেই পরবর্তিকালে রামায়ণের সঙ্গে
বৃহৎ অংশ সংযোজিত করা হয়েছে। নতুন করে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। বৈষ্ণব ও শৈব
শাস্ত্রাদি বুদ্ধকে উপহাস করতে, তাঁকে লোকচক্ষে হেয় করার জন্য কঠোর কষ্টও স্বীকার
করেছে। বৌদ্ধ ও জৈনদের ওই সব শাস্ত্রে নাস্তিক, দস্যু, হন্তারক এবং বৈদিক
যাগযজ্ঞের দুশমন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শিবের ভক্তরা প্রভু শিবের কাছে বৌদ্ধ
ধম্মাবলম্বীদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করার অনুমোদন ভিক্ষে করত।
বুদ্ধ বলতে সাধারণত কোন
ব্যক্তিকে বুঝায় না। বুদ্ধ মানে বুদ্ধি বা
Intelligence. যে ব্যক্তি তার বুদ্ধিকে ব্যবহার করেন তিনিই
বুদ্ধ। সব মানুষেরই বুদ্ধি আছে- কিন্তু যারা তা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগান তারাই বুদ্ধ হতে পারেন । সিদ্ধরও অনুরূপ
অর্থ। যিনি তার রিপু (Senses) দমন করতে পারেন তিনিই
সিদ্ধ। বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ভগবান বিষ্ণু, কিন্তু বৌদ্ধধম্মে
বুদ্দি বা Intellect ই তার কেন্দ্রবিন্দু। আজকাল নাস্তিক বলতে সাধারণতঃ যারা
ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস করেন – তাদের বুঝায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি
তাঁর বুদ্ধির প্রয়োগ করেন এবং যুক্তিসহ কিছুর বিচার বিবেচনা করেন তিনিই নাস্তিক।
যেসব ব্যক্তি ব্রাহ্মণ্যবাদের নিন্দা করেন, ধিক্কার দেন তারাও নাস্তিক। আবার যিনি
নিজে বিচারবুদ্ধি (Reason) র যথার্থ ও সঠিক
ব্যবহার করেন তিনিই তো বুদ্ধ।
“এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটান্নিকা”
আছে, “বৌদ্ধমত বলতে এমন জিনিসকেই বুঝায় যা বুদ্ধি বা Intellect কে ব্যবহার করার আহ্বান জানায় এবং অন্ধ
বিশ্বাসকে বর্জন করে।” আজকাল বুদ্ধিকে
কদাচিৎ গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্কুল কলেজেও কদাচিৎ ছাত্র ছাত্রীদের বুদ্ধির প্রয়োগ
করতে বলা হয় বা কদাচিৎ ট্রাডিসন প্রতিক্রিয়া, কুসংস্কার প্রভৃতির আপত্তি করা হয়।
আর অল্প যে কয়জন যারা অবশ্যই বুদ্ধির প্রয়োগ করে তাদের ততক্ষণাত-ই নাস্তিক বলে
চিহ্নিত করা হয়- অথচ এরূপ নামকরণের প্রকৃতই কোন অর্থ হয় না।
বুদ্ধ নিজেও তো কাউকে
অন্ধভাবে তাঁর প্রচারিত ধম্মমত বিশ্বাস করতে বলেননি। তিনি তাঁদের নিজস্ব
বুদ্ধিবিবেচনামত বুদ্ধের কথা বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে যেটুকু তাদের কাছে যুক্তিসংগত
মনে হয় কেবল ততটুকুই গ্রহণ করতে বলেছেন।
২৫০০ বছর আগে বুদ্ধ জনগণের
মধ্যে তাঁর ধম্মমত প্রচার করেছিলেন, তখনকার লোকজনের পক্ষে যা উপযোগী ছিল। তখনতো
লোকজনের বিজ্ঞতা, জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। তখন তিনি যা বলেছিলেন তা তো আজ পুরোপুরি
সত্য, না-ও হতে পারে। পুরোপুরি আজ তা প্রযোজ্যও নয়। আর বুদ্ধের বাণী অক্ষরে অক্ষরে
আজ গ্রহণ করাও তো (পেরিয়ার) আমার মতে আস্তিক্যেরই একটা ধরণ।
বৌদ্ধমতে এটাও সত্য যে সময়ের সাথে সাথে জ্ঞানেরও
শ্রীবৃদ্ধি হয় এবং ওই অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখেই আমাদের ধ্যানধারণাও মানিয়ে নিতে
হবে। পুরানো ধ্যানধারণাকে শেষ কথা বলে আকড়ে থাকাটা তো বুদ্ধিমত্তার পশ্চাদপসরন
(গাধার মত) এর সামিল এবং তা যাবতীয় অগ্রগতিরই প্রতিবন্ধক।
পুরাণাদির ৭৫ শতাংশেরও বেশি
রচনা বুদ্ধের পরে লিখিত। বুদ্ধের যুক্তিসংত শিক্ষণীয় বিষয় প্রচার প্রতিরোধ করতে
পুরাণে একাধিক অবতার-তার মধ্যে প্রধান হলেন কৃষ্ণ-প্রমুখের গল্প ফাঁদা হল-যাতে
লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদেই আবার
আকৃষ্ট হয়। অলৌকিক কাহিনী এবং স্ত্রীলোকই চিরদিন লোকজনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ
করেছে,- আর কৃষ্ণের মহাকাব্য তো যৌনতা ও অশ্লীলতায় ভরপুর। এ সঙ্গেই আবার যুক্ত করা
হল-দেবত্ব এবং বহুপরে আবার গীতা লেখা হয় এবং তা মহাভারতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল।
সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন হল- দেবদেবীগণ কেন
চরিত্রহীণ? ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর-হিন্দুর তিন অগ্রগণ্য দেবতাদের কাহিনী তো সব
অশ্লীলতা, যৌনতা, নৃশংসতা ও অবৈধ যৌনসংগমে ভরা। এইসব দেবদেবীকে মাথায় করে রেখে একই
সঙ্গে বুদ্ধের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও প্রশংসা করা একেবারেই অর্থহীন, এর দ্বারা অর্থবহ
কিছুই লাভ সম্ভব নয়। মানুষের চেহারা প্রাপ্ত মানুষের সুখদুঃখ, পাপপুণ্য,
মানুষেরই লালসা, ভোগসহ এবং কীভাবে কেউ দেবতা হতে পারেন? যেসব ব্যক্তি এদের বর্জন
করে চলেন- তারা নিজেরাই তো এক একজন বুদ্ধ।
ঐতিহাসিক কারণেই হিন্দুদের
বুদ্ধকে গ্রহন করতে হয়েছে। তাঁকে বিষ্ণুর অবতার জ্ঞানে পূজোও করা হচ্ছে। একই সঙ্গে
বৌদ্ধগণের উপর নির্যাতন, নিগ্রহ, তাদের বৌদ্ধবিহারের অগ্নিদাহের কাহিনী তথা তাদের
ধম্মসত্তাকে দমন করার ঐতিহাসিক প্রমাণেরও কোন অভাব নেই। বহু বৌদ্ধ ধম্মাবলম্বীকে
তো সমুদ্রে ভাসিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এত কান্ড করেও কিন্তু বুদ্ধের স্মৃতিকে
হিন্দুমন থেকে কখনই মুছে ফেলতে পারে নি।
বৌদ্ধ ধম্মকে শৈব ধর্ম ও বৈষ্ণব
ধর্মের একটি উপশ্রেণী করবার চেষ্টা করেও কিন্তু বৌদ্ধ ধম্মকে হিন্দু ভারত থেকে
নিশ্চিহ্নি বা বিলুপ্ত করা যায়নি।
এখন ভারত সরকারের পক্ষেও
বুদ্ধকে অবহেলা করা, ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বুদ্ধের ধম্মশিক্ষাকে সরকারি অনুমোদন
দেওয়া হয়েছে-যদিও হিন্দুধর্মের দক্ষিণ ও বামহস্ত-শৈবধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্মকে বাদ
দেওয়া হয়েছে। সারনাথের অশোকস্তম্ভ তো জাতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে গৃহীত
হয়েছে। আর তা সামরিক অফিসারদের কাঁধে মন্ত্রীদের গাড়ীর অগ্রভাগে এবং পোষ্টকার্ডের
আদর্শরূপে শোভাবর্ধন করছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই বুদ্ধজয়ন্তী জাতীয়
ছুটির দিন বলেও ঘোষিত হয়েছে।
এই যে হিন্দুধর্মের নিদর্শনের
অনুপযুক্ততার জন্য তা পরিহার এবং বৌদ্ধ নিদর্শনের ও বুদ্ধের বাণীর গ্রহণ- এসবই তো
ভারতের ইতিহাসের এক বিপ্লবাত্মক মোড় ফেরার সামিল। আজ তাই বুদ্ধবাণীর প্রচার হচ্ছে –
বৌদ্ধধম্মে ধর্মান্তর দিন দিন বাড়ছে; আর হিন্দুত্ববাদীরা হাত কামড়াচ্ছেন।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রমাণ
করেছেন আজকের বহু হিন্দুমন্দিরই এক সময় বৌদ্ধবিহার ছিল। শ্রীরঙ্গম্, কাঞ্জীপুরম,
তিরুপতি প্রভৃতি একসময় বৌদ্ধবিহারই ছিল। এমন কি তারা বুদ্ধগয়ায়ও অনুপ্রবেশ
করেছে। আর তাতে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হিন্দুর হিংস্র দেবতাদের পূজো দেওয়া হচ্ছে।
হিন্দুর মূর্তিপূজা, কুসংস্কার সবইতো বুদ্ধ পরিত্যাজ্য মনে করেছেন এবং বর্জনও
করেছেন!
বৌদ্ধমতের প্রেম, মৈত্রী,
সাম্য, মুক্তির সঙ্গে হিন্দুদের হিংস্রতার তুলনা কোথায়? সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা-
হিন্দুর প্রতিটি দেবদেবীই অস্ত্রসজ্জিত আর তাদের যারা পূজো দেওয়ার ভান করেন- তারাই
বিশ্বের অন্যতম কাপুরুষ ও নীবীর্য জাতি।
___________________________________
0 comments:
Post a Comment