পুনর্জন্ম(Rebirth)
সম্পর্কে বুদ্ধের ব্যাখ্যা
অনেকে বলেন বুদ্ধ
পুনর্জন্মকে স্বীকার করেছেন। তবে সেই পুনর্জন্মের ব্যাখ্যা কি বৈদিকবাদের ধারায় ? না কি
অবৈদিকবাদের সনাতনী বিজ্ঞান ভাবনায়?
"এক অভিন্ন
অবৈদিক সনাতনী দর্শন বৌদ্ধ ও মতুয়া দর্শন"
-গ্রন্থের ২৮,২৯ ও ৩১ পৃষ্ঠা
থেকে সংগ্রহন করে এই আলোচনায় অগ্রসর হ'তে পারি।
আমরা প্রথমেই দেখতে পাই-তিনি লিখেছেন, "বুদ্ধ
আত্মাকে অস্বীকার করলেও একটা চেতনা প্রবাহকে স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ বুদ্ধের মতে
প্রাণী বা উদ্ভিদ দেহমাত্রেই একটা চেতনা প্রবাহ সর্বদাই জাগ্রত- যা পুনর্জন্মের
যেমন সহায়ক, তেমনি প্রাণী বা উদ্ভিদ শরীর প্রবাহে তা
বংশানুক্রমে সঞ্চারিত। তবে এই চেতনা প্রবাহটি একমাত্র প্রজনন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে
সঞ্চারিত হয়ে থাকে। তাই নতুনরূপে যে প্রাণী বা
উদ্ভিদকে পৃথিবীতে দেখা যায় সে হচ্ছে তার পূর্ব অস্তিত্বের ভাবপ্রবাহ অথবা
কর্ম প্রবাহের বর্তমান রূপ মাত্র। বুদ্ধের এই জন্মান্তরে কোন শাশ্বত বা নিত্য
আত্মা পুনরায় জন্মগ্রহণ করে না। তাই জীবন দীপকে, বুদ্ধ
প্রদীপের শিখার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, পৃথক
তেল আর পৃথক সলতে পোড়ানো আলো সারারাত জ্বলে থাকে প্রদীপের আলোর এক চিরন্তন অবস্থা
নয়, বরং পৃথক অস্তিত্বে প্রবাহমান।
যেমন, (১)
বৃক্ষের ক্ষেত্রে এমন অনেক বৃক্ষ দেখা যায় যাদের অসংখ্য শাখা থেকে নতুন নতুন
প্রাণবন্ত অসংখ্য বৃক্ষ উৎপন্ন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ঐ বৃক্ষের যদি নিদির্ষ্ট কোন
শাশ্বাত আত্মা থাকতো তবে কিন্তু তার অসংখ্য ডাল থেকে অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে পৃথক
অস্তিত্ব নিয়ে অসংখ্য প্রাণবন্ত বৃক্ষ উৎপন্ন হত না। তাই এখানে নতুন নতুন বৃক্ষগুলি
যেমন পৃথক অস্তিতের অধিকারী, তেমনি নির্দিষ্ট যে বৃক্ষটির
ডাল থেকে এই নতুন নতুন প্রাণবন্ত অসংখ্য বৃক্ষ উৎপন্ন, ঐ
বৃক্ষটিও কিন্তু শাশ্বাত বা নিত্য অস্তিত্বের অধিকারী নয়।
আবার (২)
প্রজাপতি জানে না তার ফেলে আসা মথের জীবন স্মৃতি; সে ভুলে যায় তার রেশমগুঁটির
মধ্যে আত্মবন্ধনময় সেই অন্ধকার জীবনের কথা। রঙীন পাখনা মেলে অনন্ত পুনর্জন্ম রহস্য
চরিতার্থে যখন সে ফুলে ফুলে গাছের সবুজ
পাতা খেয়ে ডালে ঘুরে বেড়ানো তার জীবন স্রোতের ফেলে আসা সেই অতীত অধ্যায়ের কথা।
অতএব মথ বা প্রজাপতি হলো একই জীবন সত্ত্বার পরিবর্তীত এক রূপ মাত্র। তাই
পর্যায়ক্রমে পুর্ণাঙ্গ প্রজাপতির প্রজননে চেতনা (মন বা বিজ্ঞান) প্রবাহ সঞ্চারণের
মধ্যদিয়ে ডিম থেকে মথ; মথ থেকে আবার পুর্ণাঙ্গ প্রজাপতির
জন্ম। এক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রজাপতি যেমন পৃথক অস্তিত্বের প্রবাহমান, তেমনি নির্দিষ্ট ঐ প্রজাপতিটিও শাশ্বাত বা নিত্য নয়।
বীজ ছাড়া গাছ জন্মায় না। যে বীজ আবার
প্রজননেরই ফসল। তেমনি প্রজনন ছাড়া জাতকেরও জন্ম হয় না। তাই প্রজননের মাধ্যমে চেতনা
(বিজ্ঞান বা মন) প্রবাহের সঞ্চারণের মধ্যদিয়ে পরবর্তী জীবন বা পরবর্তী মনের
(বিজ্ঞান বা চেতনা) আবির্ভাব; যা পূর্বজীবন
বা পূর্বমনেরই এক নতুন রূপ মাত্র। আর
একারণেই শিশু জন্মের পর পরই কান্নার মাধ্যমে নিকটতমদের জানিয়ে দেয় তার জন্ম
মুহুর্তের অনুভূতির কথা। বন্য প্রাণী জন্মের পর পরই খুঁজে নেয় তার মায়ের দুধের
সন্ধান- যার সব কিছুই ঘটে পূর্ব মনের (বিজ্ঞান বা চেতনা) অর্থাৎ বীজ রূপে আগত
মনেরই (বিজ্ঞান বা চেতনা) প্রভাবে।
সন্তান প্রজনন মুহুর্তে মাতা-পিতার
তাৎক্ষণিক মনের (বিজ্ঞান বা চেতনা) কিছু অংশ জন্মগত সূত্রেই ঐ সন্তান পেয়ে থাকে।
যে মন বা চেতনা নিজস্ব আহারের সাহায্যেই উৎপন্ন হয়। তবে জন্মের পর কর্মানুযায়ী
ক্ষণে ক্ষণে সংস্কারের মধ্যদিয়ে মনের (বিজ্ঞান বা চেতনা) ধনাত্মক বা ঋণাত্মক উভয় প্রকার পরিবর্তনই ঘটে
থাকে। এরকম ক্ষেত্রে জন্মগত সূত্রে পূর্ব মনের কাছ থেকে পরবর্তী মনের কিছুটা
সংস্কার হয়ে থাকলেও জন্মের পরে পরবর্তী মন আবার ক্ষণে ক্ষণে সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্তীত
হয়ে থাকে বলে কম প্রতিভাধর বাবার ছেলেও বেশী প্রতিভাবান হতে পারে। বুদ্ধের এই
শিক্ষানুসারে চেতনা প্রবাহ বা চিত্ত প্রবাহের ধারাবাহিকতা এবং তার সংস্কার জন্মের
আগে থেকেই শুরু হয়ে মৃত্যুর পরেও তা বংশধরদের মধ্যে অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। যার
উৎপত্তি তৃষ্ণা থেকে;
যা কেবলমাত্র প্রজনন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই সম্পন্ন হয়ে থাকে;
এবং যা সর্বদাই বংশধারা অনুযায়ী প্রবাহিত। তাই তৃষ্ণার নিবৃত্তি
কল্পে প্রজনন প্রক্রিয়ার মধ্যমে চেতনা চ্যুতির ফলে নব নব জাতকের জন্মই হল চেতনা
প্রবাহের সঞ্চারণ। যাকে বুদ্ধ জন্মান্তর
বা পুনর্জন্ম (Rebirth) নামে অভিহিত করেছেন।"
এখানে আমরা আরো দেখতে পাই-
"বুদ্ধের এই চেতনা (বিজ্ঞান বা মন)
প্রবাহের সর্বদাই দুই বিদ্যামান- উৎপন্ন এবং লয়। যার মধ্যে থাকে না এক
মুহূর্তেরও ব্যবধান। একটির লয় হওয়া মুহূর্ত থেকেই উৎপন্ন হয় আর একটি। অর্থাৎ
একজন্মের অন্তিম বিজ্ঞানের (চেতনা বা মন) লয় হওয়া মাত্রই দ্বিতীয় জন্মের (Rebirth) প্রথম
বিজ্ঞান (চেতনা বা মন) মাথাতুলে দাঁড়ায়। যেমন, তৃষ্ণার
নিবৃত্তি কল্পে স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গমের অন্তিম মুহূর্তে চেতনা চ্যুতির
(বীর্যপাতের) মাধ্যমে এক জন্মের চেতনার (বিজ্ঞান বা মন) লয় হওয়া মাত্রই উঠে দাঁড়ায়
দ্বিতীয় জন্মের (Rebirth) চেতনা (বিজ্ঞান বা মন)।
যার মধ্যে থাকে না কোন মুহূর্তেরও ব্যবধান। তাই বুদ্ধের এই পুনর্জন্মে মৃত ব্যক্তি
কখনই পুনরায় জন্ম গ্রহন করে না। কেবলমাত্র প্রজননের মাধ্যমে সন্তান-সন্ততিরূপে তার
চেতনার (বিজ্ঞান বা মন) আবির্ভাবই হলো পুনর্জন্ম (Rebirth). অর্থাৎ তৃষ্ণার নিবৃত্তিকল্পে প্রজননের ফলে সন্তান-সন্ততিরূপে দ্বিতীয়
বিজ্ঞান বা চেতনার আবির্ভাবই পুনর্জন্ম(Rebirth)."
(তথ্য সুত্রঃ-
১। 'বৌদ্ধ দর্শন'- রাহুল
সাংকৃত্যায়ন, অনুবাদক-মলয় চট্টোপাধ্যায়।
২। 'The Buddha and His Dhamma'-Dr.
B. R. Ambedkar.)
0 comments:
Post a Comment