নারীর অধিকারের জন্য কারা সংগ্রাম করেছেন
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়।
আজ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
প্রথমেই বিদ্রোহী কবি
কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত বাণী দিয়ে শুরু করছি,
বিশ্বে যা কিছু
সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে
নারী,অর্ধেক তার নর।
নারীর অধিকারের জন্য নারীকে যেমন প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেই সঙ্গে অনেক পুরুষও সেই সংগ্রাম করে গেছেন। এক্ষেত্রে আমরা উল্লেখ করতে পারি- গৌতম (বাস্তবে গোতম) বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, বাবাসাহেব, পেরিয়ার ইত্যাদি। (আমি এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে শুধু কয়েকজনের সম্বন্ধে আলোচনা করছি)
হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরঃ-
আমরা হরি-গুরুচাঁদের দর্শনে দেখতে পাই-
“শুনেছি পিতার কাছে আমি বহুবার।
নারী ও পুরুষ পাবে সম অধিকার।।
সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।
আবার গুরুচাঁদ ঠাকুর
যখন শিক্ষার যে আন্দোলন শুরু করেন, সেই আন্দোলনের স্লোগান ছিল-
“খাও বা না খাও তা’তে দুঃখ নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই। (গুরুচাঁদ চরিত পৃষ্ঠা
১৪৪)
বালক বালিকা দোঁহে
পাঠশালে দাও।
লোকে বলে “মা’র গুণে ভাল
হয় ছা’ও।। -ঐ পৃঃ ৫২৯)
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলঃ-
আমরা দেখতে পাই মহাপ্রাণ
যোগেন্দ্রনাথও গুরুচাঁদ ঠাকুরের যোগ্য ভাবশিষ্য হিসাবে সমাজ কল্যাণকর কাজ করেগেছেন।
তিনি নারী শিক্ষার জন্য-
১৯৪৪ সালে নারী শিক্ষার উপর যোগেন্দ্রনাথ জোর দিয়ে বলেন, পুরুষেরা বেশিরভাগ
সময় কাজ কর্মে গৃহের বাইরে থাকে। সেজন্য তারা সন্তানদের পড়াশুনার দিকে লক্ষ্য দিতে
পারে না। সেজন্য নারী শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। (তথ্য সূত্রঃ- ক্যুইজ
অন- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, পৃ ১৮/১৯)
তিনি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নাজিমুদ্দিন খানের নিকল অবৈতনিক প্রাথমিক বালিকা
বিদ্যালয় স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিধান পরিষদে বিপুল ভোটে উক্ত বিলটি পাশ
হয়।
যোগেন্দ্রনাথে চেষ্টার ফলে নাজিমুদ্দিন সাহেবের মন্ত্রীসভায় তপশিলি ছাত্র-ছাত্রীদের
শিক্ষার জন্য ৮ম শ্রেণির পরিবর্তে ৪র্থ শ্রেণি থেকেই অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
১৯৪৪ সালে যোগেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বরিশালে
সন্তোষকুমারী তালুকদারের নেতৃত্বে একটি মহিলা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় যোগেন্দ্রনাথ
বলেছিলেন, মায়েরাই শিশুদের প্রথম শিক্ষায়ীত্রী। তাই তপশিলি সমাজাকে শিক্ষিত করতে
হলে নারী সমাজকে আগে শিক্ষাদান করা দরকার। প্রতিটি পরিবারের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে
হবে। (তথ্য সূত্রঃ- ক্যুইজ অন- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, পৃ
২২)
১৯৪৬ সালে অন্তর্বর্তি সরকারের আইন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল নারীর অধিকারের উদ্দেশ্যে ‘হিন্দু কোড বিল’-এর খসড়া প্রস্তুত করেন এবং ১৯৪৬ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় পেশ করেন।
মাতা সাবিত্রি ফুলে ও মহাত্মা
জ্যোতিরাও ফুলেঃ-
মাতা
সাবিত্রি প্রথম মহিলা যিনি সকল শ্রেণীর মহিলাদের জন্য শিক্ষা চালু করেছিলেন। এই
শিক্ষার নেত্রী মাতা সাবিত্রি শুধু ভারতের প্রথম অধ্যাপিকাই নন,
তিনি সমগ্র সমাজের জন্য এক আদর্শ ও প্রেরণা
স্রোত, বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক,
জাগৃতিকারক, আর ভারতের স্ত্রী আন্দোলনের প্রবর্তকও।
হাজার বছর ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখা
সর্ব শ্রেণীর স্ত্রীদের জন্য তিনি যখন এক ঝটকায় শিক্ষার দরজাকে লাথি মেরে উন্মুক্ত
করে দেন; তখন শিক্ষার বন্ধ দরজা
খোলার আওয়াজ শুনে পুনের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কান ফেটে যায়। তাদের কাছে বজ্রাঘাতের মত
এই ঘটনা মনে হয়। তখন তারা অমানবিক সামন্ততাত্রিক প্রথার ঘুমন্ত সিংহ কে জাগিয়ে
তোলে। তারা মাতা সাবিত্রী ফুলে ও মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলের উপর বিভিন্নভাবে প্রাণ নাশের
চেষ্টা চালায়।
সাবিত্রী ও জ্যোতিরাও দ্বারা প্রজ্বলিও
শিক্ষার জ্যোতিকে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা জ্যোতিরাও এর পিতা গোবিন্দ
রাও কে ধমকী দিয়ে ভয় দেখিয়ে জ্যোতিরাও কে ঘর থেকে বের করার কাজে সফল হয়। ঘর ছাড়া
হয়েও সাবিত্রী ও জ্যোতিরাও তাঁদের শিক্ষা প্রদানের কাজ চালিয়ে যান।
মাতা সাবিত্রি যখন মহিলাদের লেখাপড়া শেখানোর
জন্য বাইরে যেতেন, তখন তাঁর উপর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা গোবর ও পাথর ছুড়ে মারত। তাঁকে রাস্তায় চলার সময়
বাঁধা সৃষ্টি করে উঁচু জাতির গুন্ডারা খারাপ খারাপ গালি দিত। এমনকি তাঁকে মেরে
ফেলারও ধমকি দিত। মহিলাদের জন্য চালানো স্কুল বন্ধ করার চেষ্টা করত। সাবিত্রী এদের
ধমকীতে যাতে ভয় পেয়ে ঘরে বসে যান, সেই চেষ্টা করত। এমনকি ব্রাহ্মণ্যবাদী অনেক নিয়ম তুলে নরকে
যাওয়ার ভয়ও দেখাত। এরকমই এক বদমাশ প্রায় প্রতিদিনই সাবিত্রির পিছে পিছে এসে
উত্যক্ত করত। একদিন তো ঐ বদমাশ হঠাৎ সাবিত্রীর রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়ায়। আর
শারীরিকভাবে আক্রমন করে। তখন সাবিত্রি দুঃসাহস করে ঐ বদমাশকে থাপ্পড় লাগান। থাপ্পড়
খেয়ে বদমাশ আর দ্বিতীয় বার সাবিত্রীর সামনে আসেনি।
উপসংহারঃ-
দুঃখে বিষয় এই মহামানবদের নারীর অধিকারের জন্য
সংগ্রামের ফলে আজ সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে নারীদের যেভাবে প্রগতি হয়েছে সেই তুলনায় বেশিরভাগ
নারী এই অধিকারের ইতিহাস জানেন না বা জানতে চান না। সব কিছু আজ কেমন যেন ফর্মালিটিতে
এসে দাঁড়িয়েছে। যার জন্য একদিকে এক নারীর পুড়িয়ে মারার ঘটনা নিয়ে এক শ্রেণির নারীরা
হোলী উৎসবে মেতে ওঠে ও নারী দিবসের নারীদের অধিকারের জন্য চিৎকার করে। অন্য এক শ্রেণির
নারীরা অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে, দারিদ্রতার জালায় ছটফট করে। কী বিচিত্রতা!
0 comments:
Post a Comment