ভীমা কোরেগাঁও ১৮১৮ এর ১লা জানুয়ারী বিজয় দিবস
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
এই ঘটনা ১৯০০ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা।
ভারতের অচ্ছুৎ জাতির মধ্যে এক জাতি হচ্ছে মাহার (তপশিলি) যাদের বিরুদ্ধে পেশোয়া
অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের পুনের ব্রাহ্মণরা ‘মার্শাল ল’ চালু করেছিল। সেটা হচ্ছে-
এই মাহারদের গলায় মটকা বা হাড়ি বেঁধে রাখতে হবে থুথু ফেলার জন্য, আর পিছনে ঝাড়ু বেঁধে
রাখতে হবে রাস্তা দিয়ে চলার পরে যেন পায়ের
দাগ মিশে যায় ঝাড়ুতে, তার জন্য। আসলে সম্রাট অশোকের সময়ে নাগবংশীরা যে প্রগতি করে
ছিল বৌদ্ধ ধম্মের মধ্য দিয়ে, তার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এই ‘মার্শাল ল’ লাগিয়েছিল
ব্রাহ্মণরা। তবে মাহার জাতি তাদের বীরত্বের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু যখন অধিকারতাহলে তোমাদের শাসনে আমাদের স্থান কি হবে?”(বিজ্ঞ পাঠকগণ
ভেবে দেখুন এই প্রশ্ন গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রশ্নের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কি না? সেই একই
প্রশ্ন যুদ্ধ শেষে আমাদের স্থান কি হবে? ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তখন যে কোন জাতি বিকলাঙ্গ হতে
পারে। মাহাররা নিজেদের হারিয়ে যাওয়া শৌর্য-বীর্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা করছিল, আর সেই সময় ইংরেজরা তাদের ক্ষমতা
প্রতিষ্ঠিত করার কাজে লিপ্ত ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে ইংরেজদের দৃষ্টি মাহারদের প্রতি
যায়। কারণ, মাহাররা তাদের কর্মকুশলতায় পারদর্শী ও বীর্যবান ছিল। ইংরেজরা বৃটিশ
সেনার জন্য মাহারদের প্রবেশাধিকার দেয়। মাহারদের ফৌজি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইংরেজদের পেশোয়া
ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা খর্ব করে বৃটিশ রাজ স্থাপন করার ইচ্ছা ছিল। পেশোয়াদের উপর
আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেয় ইংরেজরা। মাহারদের সেনাপতি সিদ্নাথ এই
খবর জানতে পারেন। তখন তিনি নিজে বাজিরাও পেশোয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। পেশোয়া
বাজিরাও-এর কাছে গিয়ে সিদ্নাথ বলেন,- “ইংরেজদের পক্ষ থেকে তোমাদের বিপক্ষে লড়াই করার জন্য আমাদের কোন
ইচ্ছা নেই। আর এসব আমি চাই ও না। যদি আমরা তোমাদের হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে
ইংরেজদেরকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি, আর যদি আমরা এটা বাস্তবে করতে পারি;
রাজাদের
সে সভায় তোমাদের স্থান নয়
তোমরাত’ শুধু
বাদ্য যন্ত্র।
যুদ্ধকালে প্রয়োজন
বাদ্য যন্ত্র আগণন
যুদ্ধ শেষে কে করে সন্ধান? -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩)
পেশোয়া
বাজিরাও, সিদ্নাথের এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। আর বলে,- “সুইয়ের অগ্রভাগে যতোটা ধুলিকণা লাগতে পারে, ততটা ধুলিকণাও তোমাদের মতো মাহারদের
জন্য দেওয়া হবেনা। তোমরা আমাদের পায়ের ধুলার মতো। আর
তোমরা ওই পায়ের ধুলা হয়েই থাকবে। চতুর্বর্ণ ব্যবস্থায় তোমাদের জন্য যে ব্যবস্থা
করা হয়েছে, তাতে সামান্যমাত্র পরিবর্তন হবেনা।
তোমারা যেমন নীচ্ আছো তেমনি নীচ্ই থাকবে।”
পেশোয়ার
জবাব শুনে সিদ্নাথের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। তখন তিনি বলেন,- “আমরা আজ পর্যন্ত
তোমাদের অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে এসেছি। কিন্তু আজ তোমরা নিজেরাই তোমাদের মৃত্যু
রেখা টেনে দিয়েছো।”
এরপর
মাহাররা হাতিয়ার তুলে নেন। প্রতিজ্ঞা করেন এই উচ্চবর্ণীয় ভাবনাকে ধুলায় মিশিয়ে
দেওয়ার জন্য।
তিনি পেশোয়া
বাজিরাওকে বলেন,-“যুদ্ধের ভাষা আমাদের সঙ্গে করবে না। এই মাটিতে আমাদের জন্ম
হয়েছে। এই মাটিই আমাদের বড় করেছে। তাই এই মাটির লজ্জা আর লুন্ঠিত হতে দেবো না। নিজেদের
ন্যায্য অধিকার অর্জনের জন্য যুদ্ধ করা কোন পাপ কাজ নয়। এটাই যুদ্ধের অন্তিম
ঘোষোণা।”
এই ঘোষণা করে সিদ্নাথ ওখান থেকে চলে যান।
আসলে পেশোয়াদের অত্যাচারের ফলে মাহাররা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই স্বাভিমানী জীবন
যাপনের জন্যই তিনি যুদ্ধ করার রাস্তা বেঁছে নেন এমন সময় যখন মাহাররা বৃটিশ আর্মির
একটা অংশ ছিল। এমতো সময় পেশোয়াদের এই ঘৃণাজনক কথার ফলে মাহার সৈন্যদের রক্ত
টগবগিয়ে ওঠে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য।
বাবা সাহেব বলেন,-“যেখানে সহ্যক্ষমতা সমাপ্ত হয়ে যায়, ওখান
থেকেই ক্রান্তির জন্ম হয়।”
মাহার সেনারা
হাজার বছরের অপমান অন্যায় অত্যাচারের বদলা নেওয়ার জন্য পেশোয়া ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিউগল বাজিয়ে দেন।
আর আধুনিক ভারতে সমতামূলক নতুন সমাজ নির্মাণের নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়। ভীমা নদীর কুলে অবস্থিত কোরেগাঁও এর ঘটনা এটা (মহারাষ্ট্রের পুনেতে)। ১ জানুয়ারী ১৮১৮। ইংরেজদের
৫০০ মাহার সেনার ২৫০ জন ঘোড়ায় চড়ে, দুটো
কামান নিয়ে ক্যাপটেন স্টুয়ার্টনের নেতৃত্বে অগ্রসর হন। আর সামনে পেশোয়া
ব্রাহ্মণদের ২৫০০০ এর বেশি পদাতিক সেনা, আর ৩০০০ ঘোড়ায় চড়া সৈন্য। উভয় পক্ষ
মুখোমুখি হওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন স্টুয়ার তার সৈন্যদের নিয়ে ২৫ মাইল দুর্গম পথ পায়ে হেটে ১লা জানুয়ারী ১৮১৮ তারিখ
সকালবেলা কোরেগাঁও পৌঁছায়। সকল সৈন্যরা সূদীর্ঘ পথ হেটে আশার ফলে ক্লান্ত হয়ে
পড়েছিল। কিন্তু কোন রেষ্ট না নিয়েই যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়।
মাহার সেনার নেতৃত্ব রকনাথ, জকনাথ ও ভীখনাথ
করছিলেন। একদিন একরাত নিরন্তর এই যুদ্ধ চলে। আর দেখতে দেখতেই পেশোয়াদের ২৫০০০ সেনা
ধুয়ার মতো উড়ে যায়। ৫০০ মাহার সৈন্যদের সামনে পেশোয়া ব্রাহ্মণদের বিশাল
সৈন্যবাহিনী ধুলায় মিশে যায়। এই যুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষের ২৭৬ জন সৈন্য মারা যায়। এই
লড়াইয়ে কিভাবে বিজয় অর্জিত হয়েছিল সেটা সারা দুনিয়া তখন জেনেছিল।। আর ইতিহাস এই
ঘটনায় গৌরবান্বিত হয়। এই যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত সৈন্যদের শৌর্যকুশলতা বিশ্বের
ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করে; যেটা ভীমা কোরেগাঁও-এর এই ৭৫ ফুট উঁচু বিজয় স্তম্ভ সেই সহীদদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এই ক্রান্তি স্তম্ভ বা বিজয় স্তম্ভকে সেলুট করার জন্য বাবা সাহেব ড. আম্বেদকর প্রতিবছর ১লা
জানুয়ারী আসতেন।
২০১৮ সালের ১ জানুয়ারী এই বিজয় দিবসের ২০০
বছর পূর্ণ হয়েছে। এই গৌরবান্বিত ইতিহাস স্মরণ করার উদ্দেশ্য স্বাভিমান অন্তরের
থাকলে অসম লড়াইয়েও বিজয় প্রাপ্ত করা সম্ভব। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের ঘটনা তুলে ধরার কারণ, যারা
তোমাদের পিছিয়ে রেখেছে হাজার বছর ধরে, সেই গোলামির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য
স্বাভিমানী হয়ে সংগ্রামে লিপ্ত হও। বিজয় হবেই।
তথ্য সংগ্রহ- নিচে দেওয়া ভিডিও লিঙ্ক থেকে।
0 comments:
Post a Comment