Tuesday 21 March 2023

// // Leave a Comment

চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমীর দিন কার জন্মদিন? লেখক-ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সিংহ (বই-ইতিহাস কা মুআয়না) অনুবাদক – জগদীশচন্দ্র রায় (বই-ইতিহাসের পর্যালোচনা)

 


চৈত্র
মাসের শুক্ল অষ্টমীর দিন কার জন্মদিন? 

    ভারতের ইতিহাসে অনেক মনীষী ও দেবদেবীর জন্মদিন পালন করা হয়। কিন্তু যাঁর ইতিহাস ভারতের পতাকায় পত পত করছে, ভারতের মহান ঐতিহ্য হিসাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁর জন্ম দিন সরকারী ও বেসরকারী হিসাবে পালন করা হয় না বললেও চলে। কেন? 

আসুন তাঁর জন্মদিন সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক। (যে জাতি তার নিজের ইতিহাস জানে না সে জাতি তার ইতিহাস নির্মাণ করতে পারে না। আপনি যদি ইতিহাসের নির্মাণ করতে চান, তাহলে আপনার নিজের দেশ, জাতি ও সমাজের সঠিক ইতিহাসের জানা দরকার। তা না হলে গোলাম গোলামিতেই আনন্দ করবে।)

লেখক-ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সিং (বই-ইতিহাস কা মুআয়না)

অনুবাদক – জগদীশচন্দ্র রায় (বই-ইতিহাসের পর্যালোচনা পৃষ্ঠা ৪২ থেকে ৪৪)


 

   এখনো পর্যন্ত ইতিহাসের যতটা জ্ঞান অর্জন করা গেছে, তাতে দেখা যায় ভারতে যে জন্মদিন পালন করা হয় সেটার পরম্পরা মৌর্য শাসকরা প্রথমে শুরু করেছিলেন ভগবতশরণ উপাধ্যায়, স্ট্রেবো (অমেসিয়া, ৬৪ খৃ.পূর্ব- ১৯ খৃস্টাব্দ) একটা উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রত্যেক বছর তাঁর জন্মদিন বড় ধুমধামের সঙ্গে পালন করতেন (তথ্য- বৃহতর ভারত পৃ.৩৫-৩৬)      

    সম্রাট অশোকও তাঁর জন্ম উৎসব এইভাবে পালন করতেন ঐতিহাসিকরাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি এই বার্ষিক উৎসবের দিন  বছরে একবার বন্দীদের মুক্ত করার প্রথা শুরু করেছিলেন (তথ্যপ্রাচীন ভারত কা রাজনীতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসি, পৃ. ৩২১)

     অষ্টমীর দিনের প্রতি সম্রাট অশোকের বিশেষ সম্বন্ধ ছিল। এরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায় তিনি প্রত্যেক পক্ষের অষ্টমীর দিন বলদ, ছাগল, ভেড়া শুয়োর আর এই ধরনের অন্য জীবদের না মারার আদেশ জারি করেছিলেন ( তথ্যপাটলিপুত্র কী কথা, পৃ.১৫২)

    পাটলিপুত্রের যে বার্ষিক উৎসবের কথা চিনা পরিব্রাজ ফাহিউয়েন (৩৯৯-৪১১ খৃস্টাব্দ) অনেক  গর্বের সঙ্গে বর্নণা করেছেন এই উৎসব চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমীর দিন পালন করা হতো ফাহিউয়েন লিখেছেন, প্রত্যেক বছর ২০টি ড়ো সুসজ্জিত রথে বিশাল শোভাযাত্রা বের করা হতো এবং পরের মাসের অষ্টমীর দিন তা শহরে প্রদক্ষিণ করা তো এরকম আরো শোভাযাত্রা অন্যান্য শহরেও বের করা তো (প্রাচীন ভারত কা ইতিহাস, বি.ডি. মহাজন, পৃ.৪৬৩)     

       কোনো কোনো ঐতিহাসিক ফাহিউয়েনের উল্লেখ করা বার্ষিক উৎসবের তিথিকে বুঝতে ভুল করেছে বর্তমানের হিন্দি ক্যালেন্ডারের মাস গণনার প্রাণালীকে মাথায় রেখে বৈশাখ মাস মেনে নিন  কারণ বর্তমান দিনে বৈশাখ মাসই হিন্দি ক্যালেণ্ডারের দ্বিতীয় মাস      

    কিন্তু ফাহিউয়েন আজ থেকে ১৬০০ বছরে পূর্বে গুপ্তযুগে ভারতে এসেছিলেন ওই সময়ে বছরের প্রথম মাস ছিল ফাল্গুন আপনি ক্যালেন্ডার সংশোধন সমিতির (১৯৫৫ সাল) রিপোর্ট রীক্ষা করে দেখুন, সেখানে লেখা আছে, যে উৎসব ১৪০০ বর্ষ পূর্বে যে ঋতুতে পালন করা তো সেটা ২৩ দিন পিছনে চলে গেছে বর্তমানে বসন্তের সমাপ্তি চৈত্র মাসে হয় সেজন্য বছরের প্রথম দিনে চৈত্র শুক্ল প্রতিপদ হিসাবে পালিত হয়। বসন্তের সমাপ্তি প্রতি বছর ২০ মিনিট ২৪.৫৮ সেকেন্ড আগে হয়ে যায়সেজন্য ফাহিউয়েনের সময়ে বছরের প্রথম মাস ফাল্গুন ছিল আর দ্বিতীয় মাস চৈত্র ছিল   

    এই জন্য ফাহিউয়েন তাঁর যাত্রা বিবরণে যে বার্ষিক মহোৎসবের বর্ণনা করেছেন, সেটা চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে পালন করা অশোকাষ্টমী অশোকাষ্টমীর বিস্তৃত বিবরণ আমরা  কৃত্যরত্নাবলী, কুর্মপুরাণ ব্রত পরিচয়ে পাই (পুরাণকোশ, পৃ.৩৬)

     কিন্তু অশোকাষ্টমীর পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে অশোকবৃক্ষের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখন আপনি অশোক বৃক্ষ আর সম্রাট অশোকের মধ্যে সম্বন্ধের পরীক্ষা করার জন্য বৌদ্ধ গ্রন্থ দিব্যাবদান পড়ুন  তাতে লেখা আছে যে, নামের মিলের জন্য অশোকগাছটি সম্রাট অশোকের কাছে খুব প্রিয় ছিল। আবার হাজারী প্রসাদ দ্বিবেদীর চম্বরধারণী যক্ষিণী কথা মনে করুন যিনি অশোক গাছের চারা নিয়ে মথুরা জাদুঘরে দাঁড়িয়ে আছেন।      

      এর ফলে প্রমাণিত হয় যে, চৈত্র শুক্লাষ্টমীকে পালন করা বাৎসরিক উৎসব অশোকাষ্টমী মূলত সম্রাট অশোকের জন্মদিনযেটাকে পুরাণ লেখকেরা সচেতনভাবে সম্রাট অশোককে গায়েব করে দিয়ে শুধুমাত্র অশোক গাছ যুক্ত করেছেন।    

    বুদ্ধ, মহাবীর আর অশোক ইত্যাদির সময়ে তো মার্চ, এপ্রিল, মে ইত্যাদি মাসের জন্মই হয়নি আপনি যেটা মনে করছেন যে, অশোকের জন্মদিন ১৪ এপ্রিল, এটাতো ভুল ধারনা এটি একটি কাকতালীয় ঘটনা যে ২০১৬ সালে চৈত্র শুক্লাষ্টমী অর্থাৎ অশোকাষ্টমী ১৪ এপ্রিল পড়েছিল পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০১৭ তে অন্য কোনো তারিখে পড়েছিলঅশোকাষ্টমী ইংরেজি সময় গণনার উপর নয় বরং চন্দ্রকাল গণনার উপর ভিত্তি করে হয়    

    আপনি জেনে থাকবেন যে, সমগ্র ভারত এবং ভারতের বাইরেও সম্রাট অশোকের শিলালিপির রেকর্ড অনেক পাওয়া গেছে কিন্তু পাটলিপুত্রে সম্রাট অশোকের একটা শিলালিপিও পাওয়া যায়নি তাহলে ঐতিহাসিকরা কেন বলেন না যে, পাটলিপুত্র সম্রাট অশোকের রাজধানী ছিল না প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না আর মুছে ফেললেও মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে থাকে।

    স্ট্রাবো লিখেছেন যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর জন্মদিনে দরবারে নিজের চুল ধোয়াতেনপ্রতি বছর যেটার পুনরাবৃত্তি হত এবং খুব আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হত         


    আপনি জেনে থাকবেন যে, জন্মদিন পালনের পরমপরা মৌর্যরা চালু করেছিল এই ছবিটি সাঁচি স্তূপের পূর্ব দিকের সর্বনিম্ন বান্দেরিতে খোদাই করা আছে। ভাস্কর্যগুলি অশোকের মাত্র পঞ্চাশ-পচাত্তর বছর পরে তৈরি করা হয়েছে সম্রাট অশোক হাতির থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর সামনে একজন ছোট ব্যক্তি এবং উভয় পাশে একটি চম্বরধারনীয়া রয়েছে।  তার বাঁদিকে চম্বরধারানীর পিছনে রানীকে দেখা যাচ্ছে।     

    এই দৃশ্য অশোকাষ্টমীর      

 

   ইতিহাসবিদদের জানা উচিত, এমন সব সত্য মানুষের মৌখিক পরম্পরায় জীবন্ত আছে, যেটাকে বিকৃত করে লিখলেই ইতিহাস হয় নাসম্রাট অশোকের অশোকাষ্টমীকে চৈত্র শুক্লাষ্টমী হিসাবে পালন করা ওই ধরনের বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে একটা 

    রামের জন্ম হয়েছিল রামনবমীতে এবং সীতার জন্ম হয়েছিল জানকী নবমীতে, আপনি এসব জানেনতাই এসব উপলক্ষে ছুটিও রয়েছে। আপনি জানেন না যে সম্রাট অশোকের জন্ম অশোকাষ্টমীতে হয়েছিল। আপনার যদি এই জ্ঞান না থাকে তবে আপনার দুর্বলতা আছে।

     ভারতের মানুষ হাজার বছর ধরে অশোকাষ্টমী উদযাপন করে আসছে।  অশোকাষ্টমীর উল্লেখ তো এক ডজন বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। আপনার আর কি প্রমাণ চাই? অশোকাষ্টামী দিন কে জন্মগ্রহণ  করেছিলেন? সম্রাট অশোকইতো জন্মগ্রহণ করেছিলেন না কি অন্য কেউ? পুরাণেতো লেখা আছে যে, অশোকাষ্টমীর দিন অশোক বৃক্ষের পূজা হয় তাহলে এই দিন কি অশোক বৃক্ষের জন্ম হয়েছিল? এরকম হতে পারে না  

     আবার এটা বলবেন না যে, একাধিক অশোক ছিলেন ভারতের ইতিহাস শুধুমাত্র একজন অশোকের জন্য গৌরবান্বিত তিনি হচ্ছেন সম্রাট আশোক মৌর্য অশোকাষ্টমী অবশ্যই সম্রাট অশোকের জন্ম তিথি এই উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করার জন্য বিহার সরকারকে অনেক অভিনন্দন।

 

0 comments:

Post a Comment