হিন্দু কোড বিল ও সংরক্ষণে মহাপ্রাণের অবদান
লেখক -জগদীশচন্দ্র রায়
(লেখাটি শেষ পর্যন্ত না পড়ে কেউ অভিমত প্রকাশ করবেন না আশা করি। এখানে দয়া করে কেউ বাবা সাহেব এবং মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করবেন না।)
আমরা প্রায় সকলেই জানি, হিন্দু কোড বিল ড. বাবাসাহেব আম্বদেকর প্রস্তুত করেছিলেন।
কিন্তু এই বিলের খসড়া সর্বপ্রথম কে প্রস্তুত করেছিলেন সেটা আমরা অনেকেই জানি না।
আসুন সেই আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
হিন্দু সমাজের মহিলাদের অধিকার নিয়ে ইংরেজরা বিভিন্ন সময় আইনের পরিবর্তন করেছে।
হিন্দুদের সর্বজনগ্রাহ্য নিশ্চিত কোনো গ্রন্থ না থাকার জন্য স্থান, কাল, পরিস্থিতি
এবং পরম্পরার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন নিয়ম প্রচলিত ছিল । ইংরেজ
শাসকরা ভারতীয় মহিলাদের মানবিক অধিকারকে আইনগত চেষ্টা চালিয়ে গেছে। যেমন-
১) জাতিগত অযোগ্যতা বিলোপ আইন – ১৮৫০
২) হিন্দু বিধবা আইন -১৮৫৬
৩) ভারতীয়দের উত্তরারিধার আইন- ১৯২৫
৪) স্থানীয় ধর্মান্তরিতদের বিবাহ-বিচ্ছেদ
আইন- ১৮৬৬
৫) সম্পত্তি হস্তান্তরণ
আইন-১৮৮২ সংশোধন-১৯২৯
৬) ভারতীয় প্রাপ্তবয়স্কতা আইন-১৮৭৫
৬) (১) ভারতীয় বিবাহবিচ্ছে আইন-১৮৮৯
৭) অভিভাবক ও সংরক্ষক আইন-১৮৯০
৮) সম্পত্তি হস্তান্তরণ (পরিপুরক) আইন-১৯১৪, ১৯১৬
আর ১৯২১
৯) হিন্দু অধ্যায়ন সুবিধা আইন- ১৯৩০
১০) হিন্দু মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার আইন- ১৯৩৭
হিন্দু আইন সংশোধন
ও সঙ্কলন করার কাজ বেশ কিছুদিন পূর্বে থেকেই চলে আসছিল ব্রিটিশদের করে দেওয়া কমিটির
মাধ্যমে। ১৯৪১ সালে স্যার বি.এন.রাও এই কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সারা
দেশে ঘুরে বিভিন্ন মতামত ঐ কমিটি সংগ্রহ করে। আর কমিটির রিপোর্ট জমা পড়ে
অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কাছে। উল্লেখিত আইনের সঙ্গে তার বিকাশের গতি প্রদানের জন্য ৪ নভেম্বর
১৯৪৬ সালে অন্তর্বর্তি সরকারের আইন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ
মন্ডল ‘হিন্দু কোড বিল’-এর খসড়া প্রস্তুত করেন এবং ১৯৪৬ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায়
পেশ করেন। বিলটি আইন সভায় পেশ করার
কয়েকদিনের মধ্যেই ভারত ভাগের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে যায়। তাই এই হিন্দু কোড
বিল নিয়ে মহাপ্রাণ আর কিছু করার সুযোগ পাননি।
দেশ বিভাগের নানা পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য হিন্দু কোড বিল
নিয়ে পার্লামেন্টে আর আলোচনা হয়নি। বিলটি পার্লামেন্টে থেকে যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ
বিভাগের ফলে খণ্ডিত ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী হন
বাবাসাহেব আম্বদেকর। সামাজিক বৈষম্য দূর করতে এবং নারীদের
অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাবাসাহেব আপ্রাণ
চেষ্টা করে গেছেন। আর সেই ক্ষেত্রে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কর্তৃক হিন্দু কোড বিলের খসড়া বাবাসাহেবের হাতে পড়ায় তাঁর কাজ অনেক সহজ হয়েছিল। সামাজিক সমতা ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য
একটি আইন সম্মত স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য বাবাসাহেব আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি মহান
দায়িত্ব পালন অবশ্যই করতেন। কিন্তু
হিন্দুকোড বিলের মতো একটি খসড়া পূর্ব থেকেই আইন সভায় ছিল, যেটা তৈরি করে অখণ্ড ভারতের
ব্রিটিশ আইনসভায় পেশ করেছিলেন
অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।
মহাপ্রাণের পেশ করা সেই হিন্দু কোড বিলটি মহান বাবাসাহেবের
হস্তগত হয়। তিনি মহাপ্রাণের রেখে যাওয়া খসড়া হিন্দুকোড
বিলটি বঞ্চিত জনতার মহান মুক্তিদূত বাবাসাহেব হাতে পড়লে তিনি সেটিকে আরো সুন্দর পরিমার্জিত ও সময় উপযোগী করে পার্লামেন্টে পেশ করেন। যেটি ঐতিহাসিক হিন্দুকোড বিল নামে খ্যাত।
এবার অনেকেই প্রশ্ন করতে
পারেন হিন্দুকোড বিলের খসড়া মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল
তৈরি করেছিলেন তার প্রমাণ কী? এবার সে বিষয়ে আসল তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি। অনুসন্ধানী পাঠকরা তথ্য যাচাই করে দেখতে
পারেন।
Sixth Legislative Assembly 1947, 3rd Session, Volume V - Pg
3327 Hindu Code Bill
HINDU CODE
The Honourable Mr. Jogendra Nath Mandal (Law Member): Sir, I move for leave to
introduce a Bill to amend and codify certain branches of the Hindu Law.
Mr. President: The question is:
“That leave be
granted to introduce a Bill to amend and codify certain branches of the Hindu Law.”
The motion was adopted.
The Honourable
Mr. Jogendra Nath Mandal: Sir, I introduce the Bill. With your permission I
want to make mention of one other, point, as the Honourable Members of this
House might be interested to know what steps Government propose to take regarding
this Bill. Government propose to circulate the Bill by Executive Order for
eliciting public opinion, and on receipt of public opinion Government propose
to move a motion in the next Session of the Assembly for the reference of the
Bill to a Joint Committee of both the Houses o Legislature. I only wanted to
make this known to the Honourable Members of this House.
এই ঐতিহাসিক তথ্যের প্রমাণ হিসাবে তৎকালীন সংবিধান সভার অধ্যক্ষের দ্বারা সংবিধান
সভায় প্রশ্ন-উত্তরের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হল। হিন্দু কোড বিল পার্ট-২ এর বিবাহ এবং
ভরণপোষণ বিষয়ের উপর বিতর্কে Mr. Naziruddin Ahmed বলেন- “When the Bill was
prepared it was introduced by Mr. Jogendra Nath Mandal, the Minister of Law of
the Interim Government.” (Dr. Babasaheb Ambedkar Writing and Speches Vol 14
part-1 page-534) অর্থাৎ বিলটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন এটি অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এটি উপস্থাপন করেছিলেন।
Mr. Naziruddin Ahmad : I submit that the original Bill was
introduced by Mr. Jogendra Nath Mandal. It bears the printing date 1st, August
1946. This was the Bill which was sent to the Select Committee. A Bill printed
on 16th August 1948 is the Bill that came out of the Select Committee with the
report. (Vol -14, part-1, p- 450)
বিলটি গণপরিষদে পর্যালোচনার
সময় Mr. Naziruddin Ahmed অন্য সময় বলেন, “He (এখানে He বলতে মহান
বাবাসাহেব) pointed out with commandable througness the departures made in the
Final Bill from the Original Mr. Jogendra Nath Mondals Bill.” (তথ্য ঐ page number 467) অর্থাৎ তিনি (তিনি বলতে বাবা সাহেব আম্বেদকর) প্রশংসাতীত পুঙ্খানুপুঙ্খতার
সাথে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মূল বিল থেকে
চূড়ান্ত বিলের উপস্থাপনের কথা বলেছেন।
বিলটি
গণপরিষদে পর্যালোচনার সময় অন্য আর এক স্থানে Mr. Naziruddin বলেন, “It is easy for
anyone who has the patience to compare the original Bill presented by Mr. Jogendranath
Mandal to the House with the revised Bill to see the difference.” (তথ্য ঐ p-
466) অর্থাৎ যার ধৈর্য আছে তাঁর পক্ষে মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কর্তৃক হাউসে উপস্থাপিত মূল বিলটিকে সংশোধিত
বিলের সাথে তুলনা করা সহজ।)
স্পিকার বলেন, “মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল যে মূল বিলটি পেশ করেছিলেন তার পরিকল্পনা
ও বিষয়বস্তুতে ব্যাপক পার্থক্য করা হয়েছে।”(ক)
মি. নাজিরুদ্দিন সদস্যদের
সামনে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “অতএব মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল যে বিলটি পেশ করেছিলেন
তা ড. আম্বেদকর অনানুষ্ঠানিকভাবে (Informal) বিলে রুপান্তরিত করেছিলেন।(খ)
সরদার বি.
এস. মান শিখদের পক্ষ থেকে বিল সম্পর্কে বলেন, “ যদিও ড. আম্বেদকর মাননীয় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কর্তৃক প্রস্তুত
করা হিন্দু কোড বিলকে বিকশিত করার চেষ্টা করছেন তবুও এই বিলকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের
সন্তান (offspring) বলা হবে।”গ ( উপরের তিনটি তথ্য অর্থাৎ ক,খ, গ গ্রহণ করা হয়েছে- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জীবন
আউর বিচার- লেখক- শিলপ্রিয় বৌদ্ধ, পৃ. ৮০-৮১)
এবার আমরা
দেখে নেই ড. আম্বেদকর নিজেই তাঁর বিবৃতিতে বলেছিলেন, “Now I came to an important
circumstance to which I would like to make definite reference. The House will
remember that after the Bill was introduced in the House by Mr. Mandal – and it
was introduced after the Rau Committee’s investigation was complete- even then
Government promised that they would issue an executive circular to the various
provincial Governments and invite their opinion on the Bill as introduced. That
circular was also sent to Punjab.” (তথ্য ঐ- Vol-2, page – 1173) অর্থাৎ আমি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে এসেছি যা আমি
নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করতে চাই। হাউস মনে করবে যে বিলটি মি. মণ্ডল কর্তৃক উত্থাপন করা হয়েছিল। যেটি রাও কমিটির তদন্ত শেষ
হবার পর উত্থাপিত হয়েছিল। এরপর সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারকে
একটি কার্যনির্বাহক বিজ্ঞপ্তি জারি করবে এবং তাদের মতামতের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে।
উত্থাপন করা বিলের সার্কুলার পাঞ্জাবেও পাঠানো হয়েছিল।
পরিশেষে জানাই, ড. সঞ্জয় গাজভীয়ে, যিনি মহাপ্রাণ
ও বাবাসাহেবের উপর পি এইচডি করেছেন। তাঁর বইয়ের নাম “সাংবিধানিক ভারত কী নির্মাতা ড.
বাবাসাহেব আম্বেদকর ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।” তিনি কিছুদিন আগে এক লাইভ বক্তব্যে
জানিয়েছেন যে, “হিন্দু কোড বিলের জননী মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।”
উপরোক্ত রেফারেন্স
থেকে জানা যায় যে, “মন্ডলজি দ্বারা
প্রস্তুত করা তথা ড. আম্বেদকর দ্বারা সংশোধিত ও পরিবর্ধিত বিলের যে বিরোধ হয়েছিল
তার যথোপযুক্তভাবে ড. আম্বেদকর মোকাবিলা করেছিলেন। তিনি হিন্দু, শিখ, পার্সি, খ্রীষ্টান, মুসলমানদের জন্য
বুদ্ধিমত্তা পূর্ণ আইন সঙ্গত অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বিরোধিদের বোঝানোর চেষ্টা
করেছিলেন। তাঁর সেই প্রচেষ্টার ফলে ১৭ই নভেম্বর ১৯৪৭ সাল থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বর
১৯৫১ সাল পর্যন্ত হিন্দু কোড বিলটি নিয়ে
ড. আম্বেদকর তাঁর শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও অনেক ঝুঁকি নিয়েও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু
রক্ষণশীলরা ভারতীয় নারীদের অধিকারের হিন্দু কোডবিল গ্রহণ
করেনি। (তথ্য গ্রন্থ- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল জীবন আউর
বিচার, লেখক -শিলপ্রিয় বৌদ্ধ,
পৃষ্ঠা ৮০-৮১)
এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে
বাবা সাহেব যখন হিন্দু কোড বিল নিয়ে পার্লামেন্টে জোর লড়াই করছেন তখন কিন্তু
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় এবং
হিন্দু, বৌদ্ধদের সাংবিধানিকভাবে সংখ্যার
ভিত্তিতে সবকিছুতে সংরক্ষণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। সেই মর্মে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল
পাকিস্তানের সংবিধান লেখা সম্পূর্ণ করে জিন্নাসহ অনেককেই
দেখান এবং তাদের সঙ্গে অগ্রিম পরামর্শ করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কট্টর
ইসলাম মৌলবাদীরা মহাপ্রাণের তৈরি সংবিধান বৈধতা পেয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। জিন্না
থাকলে মহাপ্রাণের লিখিত সংবিধান বৈধতা পেয়ে যাবেই এই আশঙ্কায় পশ্চিম পাকিস্তানের
কট্টর ইসলাম মৌলবাদীরা জিন্নাকে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলে। শুধুমাত্র সংবিধান নয়
জিন্নার সর্ব ধর্মের প্রতি উদার মানসিকতা পশ্চিম পাকিস্তানের কট্টর ইসলাম ধর্মের
মৌলবাদীরা মেনে নিতে পারছিলেন না। জিন্না ছিলেন সংস্কারপন্থী। জিন্না একই সঙ্গে
মন্দির মসজিদ, গির্জা, এবং সমস্ত ধর্মের ধর্ম ব্যবসায়ীর ধর্ম গুরুদের বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি
জিন্না জীবনে কোনদিন নামাজ পর্যন্ত পড়েননি। আর কট্টর ইসলাম ধর্মের মৌলবাদীরা ছিল
ইসলাম ধর্মের সংস্কারের বিপক্ষে। যার পরিণতি
জিন্নার অকাল মৃত্যু। আর জিন্নার মৃত্যু মানে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের
হিন্দু সহ সমস্ত সংখ্যা লঘুদের জন্য সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের
পরিসমাপ্তি। যার পরিণতিতে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হিন্দুসহ সমস্ত সংখ্যা
লঘুদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের মুসলিম আগ্রাসন। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডলকেও মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র হলে মহাপ্রাণ ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার নাম করে
কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মহাপ্রাণ শেষ মূহুর্তে এ বিষয়ে
পরামর্শ করে নিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড.বিধান চন্দ্র রায়ের
সঙ্গে।
মহাপ্রাণ ১৯৫০ সালে ভারতে চলে
আসেন। তখন হিন্দু কোড বিল নিয়ে ভারতের আইনসভায় উত্তাল পরিস্থিতি। মহাপ্রাণ এতটাই
বাবা সাহেবকে সম্মান ও বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু কোড বিলের জোর লড়াইয়ের সময়
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল একবারও দাবি করেননি যে ঐ হিন্দু কোড বিলের খসড়া
তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। আর এক্ষেত্রেও আবার প্রমাণিত হল
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল উদারতা ও মহত্ত্ব। যার জন্য তাঁর আর এক নাম ‘মহাপ্রাণ’।
আমরা অনেকেই জানি ১৯৬৫ সালের লকুড়
কমিটির সুপারিশ বাতিল করতে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর
শরনাপন্ন হয়েছিলেন এবং কমিটির সুপারিশ বাতিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার
ফলশ্রুতিতে এখনও পর্যন্ত বাংলার নম:শুদ্র, রাজবংশী, ধোপা, সাহা(সুড়ি) সহ সারা ভারতের আরো পঁচিশটি সর্বমোট ঊনত্রিশটি জাতি সংরক্ষণ এর সুযোগ বা অধিকার ভোগ করে চলেছে।
কিন্তু এটাও আমাদের অনেকেরই জানা নেই ১৯৫৭ সালে
জহরলাল নেহরুর তথা কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা বৌদ্ধধম্মে
ধর্মান্তরিত তফশিলি সমাজকে সংরক্ষণ এর যাবতীয় সুযোগ থেকে
বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৬ সালে বাবা সাহেব প্রয়াত হন। তাই বৌদ্ধধম্ম গ্রহণকারী তফশিলি ও আদিবাসী সমাজের
মহাসংকটে তাদের হয়ে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেবার মতো কাউকে তাঁরা
খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বৌদ্ধধম্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিরভাগ ছিলেন
বাবাসাহেবের নিজের মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায়।
শেষ পর্যন্ত তফশিলী ও আদিবাসী অথচ বৌদ্ধধম্ম গ্রহকারীদের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের সুযোগ ধরে রাখতে মহাপ্রাণ
যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের শরনাপন্ন হন। মহাপ্রাণকে অনুরোধ করা হয়, ‘আপনি কিছু করুন।’
তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুকে চিঠি লেখেন। নেহেরুজি সেই চিঠির জবাবে জানালেন,
‘আমার ব্যক্তিগত কোনো অমত নেই। কিন্তু আমার মনে হয় সংবিধান এটা পারমিট করছে না।’
তখন নেহেরুর এই জবাবে যোগেন্দ্রনাথ জানান, “আপনি
হয়তো ভুলে গেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী আমি ছিলাম। কাজেই ভারতের সংবিধানে
কতটা আইনগত বাধা আছে বা সুযোগ আছে সেটা সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল। Caste is by birth
কাজেই এটার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই।” (জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের সাক্ষাৎর, বই- ইতিহাসে
প্রেক্ষাপটে মহাপ্রাণ, পৃষ্ঠা ৬২)
যোগেন্দ্রনাথ নেহেরুজিকে
আরো জানানা, “No where is our Constitution the terminology “Scheduled Castes,”
Has been defined except a reference to Article 341 which again refers to the
notification of the president specifying the castes which shall be deemed to be
Scheduled Castes for the purpose of this Constitution. There is no mention
anywhere that the communities to be included in the list Scheduled Castes shall
profess Hindu religion. Many I reiterate, religion was never taken to be
the criterion in this regard.
--May I Point out
to you in this connection, that although the Sikhs do not subscribe to caste
system, the following four castes among the Sikhs viz Mazhabi, RAmdasi,
Kabirpanthi and Sikligar have been included in the President’s constitution
(Scheduled Castes) order 1950.78 (তথ্য – মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ৭ম খণ্ড, লেখক- জগদীশ
চন্দ্র মণ্ডল, পৃষ্ঠা ৭৯-৮৬)
এইভাবে আইনের বিভিন্ন ধারা
উল্লেখ করে জহরলাল নেহরুকে বৌদ্ধধম্মে ধর্মান্তরিতদের জন্য সংরক্ষণের পক্ষে চিঠি পত্রের মাধ্যমে জোর সওয়াল
করেন। মহাপ্রাণ জহরলাল নেহরু সঙ্গে তীব্র লড়াই করে বৌদ্ধদের সংরক্ষণের আওতায় রেখে দিতে সমর্থ হন। এখানেও যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল মহান, মহৎ প্রাণ যার আর এক নাম মহাপ্রাণ।
এখানেই মহাপ্রাণ এবং বাবা সাহেবের মহত্ব। আমরা প্রায় শুনতে পাই ৫০ থেকে ৫৬ এর মধ্যে বাবাসাহবে ও মহাপ্রাণের কোনো যোগাযোগ
ছিল না। কিন্তু এই দুই মহামানব আজীবন সমাজ কল্যাণ কর্মে হরিহর আত্মা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে
জানাই, ‘১৯৫৬ সালের শেষ দিকে পাটনায় ডাঃ রাম মনোহর লোহিয়ার নেতৃত্বে একটি সভা হয়।
যেখানে সমস্ত অবহেলিত নিপীড়িত শ্রণীকে একটি যৌথ ফোরামে এনে আম্বেদকরের নেতৃত্বে চালানো
হবে। যোগেন্দ্রনাথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দুর্ভাগ্য অসুস্থতার জন্য আম্বেদকর উপস্থিত হতে পারেননি। ১৯৫৬
সালের ৬ই ডিসেম্বর একটি বিষণ্ণ দিন। ডঃ আম্বেদকরের পরিনির্বাণে ভেঙে পড়েন যোগেন্দ্রনাথ।
পরবর্তী শোকসভায় তাঁর কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেছিল। ( তথ্য- জয় ভীম, লেখক- পীযুষে গায়েন, পৃষ্ঠা
১৮৬)। অথচ ইদানিং দেখতে পাই তথাকথিত আম্বেদকরবাদীদের একটা
বিরাট অংশ বিভিন্নভাবে মহাপ্রাণের ভুল ধরে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছেন।
আম্বেদকর ও মহাপ্রাণের দর্শন না বোঝা এই অতিশয় বহুজন আন্দোলন বোঝা পণ্ডিত বর্গের জন্য একটাই উপাধি “ধ্বংসাত্মক ভয়ংকর আম্বেদকরবাদী”। বেশ কয়েকজন তো
আগে পিছে না ভেবে বাবা সাহেবকে মুসলমান বিদ্বেষী তকমাও লাগিয়ে দিয়ে চলেছে এবং মহাপ্রাণকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এর বিষময় ফল
এবং ভবিষ্যত পরিণাম কী হতে পারে? উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। যারা মহাপ্রাণের রেখে যাওয়া
সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে তাঁরই বিপক্ষে কথা বলছে আর যাইহোক বাংলাসহ সারাভারতে তাদের মুখে বহুজন আন্দোলনের কথা মানায় কি?
এই ঐতিহাসিক তথ্যের প্রমাণ হিসাবে তৎকালীন সংবিধান সভার অধ্যক্ষের দ্বারা সংবিধান
সভায় প্রশ্ন-উত্তরের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হল। হিন্দু কোড বিল পার্ট-২ এর বিবাহ এবং
ভরণপোষণ বিষয়ের উপর বিতর্কে Mr. Naziruddin Ahmed বলেন- “When the Bill was
prepared it was introduced by Mr. Jogendra Nath Mandal, the Minister of Law of
the Interim Government.” (Dr. Babasaheb Ambedkar Writing and Speches Vol 14
part-1 page-534) অর্থাৎ বিলটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন এটি অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এটি উপস্থাপন করেছিলেন।
Mr. Naziruddin Ahmad : I submit that the original Bill was
introduced by Mr. Jogendra Nath Mandal. It bears the printing date 1st, August
1946. This was the Bill which was sent to the Select Committee. A Bill printed
on 16th August 1948 is the Bill that came out of the Select Committee with the
report. (Vol -14, part-1, p- 450)
বিলটি গণপরিষদে পর্যালোচনার
সময় Mr. Naziruddin Ahmed অন্য সময় বলেন, “He (এখানে He বলতে মহান
বাবাসাহেব) pointed out with commandable througness the departures made in the
Final Bill from the Original Mr. Jogendra Nath Mondals Bill.” (তথ্য ঐ page number 467) অর্থাৎ তিনি (তিনি বলতে বাবা সাহেব আম্বেদকর) প্রশংসাতীত পুঙ্খানুপুঙ্খতার
সাথে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মূল বিল থেকে
চূড়ান্ত বিলের উপস্থাপনের কথা বলেছেন।
বিলটি
গণপরিষদে পর্যালোচনার সময় অন্য আর এক স্থানে Mr. Naziruddin বলেন, “It is easy for
anyone who has the patience to compare the original Bill presented by Mr. Jogendranath
Mandal to the House with the revised Bill to see the difference.” (তথ্য ঐ p-
466) অর্থাৎ যার ধৈর্য আছে তাঁর পক্ষে মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কর্তৃক হাউসে উপস্থাপিত মূল বিলটিকে সংশোধিত
বিলের সাথে তুলনা করা সহজ।)
স্পিকার বলেন, “মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল যে মূল বিলটি পেশ করেছিলেন তার পরিকল্পনা
ও বিষয়বস্তুতে ব্যাপক পার্থক্য করা হয়েছে।”(ক)
মি. নাজিরুদ্দিন সদস্যদের
সামনে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “অতএব মি. যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল যে বিলটি পেশ করেছিলেন
তা ড. আম্বেদকর অনানুষ্ঠানিকভাবে (Informal) বিলে রুপান্তরিত করেছিলেন।(খ)
সরদার বি.
এস. মান শিখদের পক্ষ থেকে বিল সম্পর্কে বলেন, “ যদিও ড. আম্বেদকর মাননীয় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কর্তৃক প্রস্তুত
করা হিন্দু কোড বিলকে বিকশিত করার চেষ্টা করছেন তবুও এই বিলকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের
সন্তান (offspring) বলা হবে।”গ ( উপরের তিনটি তথ্য অর্থাৎ ক,খ, গ গ্রহণ করা হয়েছে- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জীবন
আউর বিচার- লেখক- শিলপ্রিয় বৌদ্ধ, পৃ. ৮০-৮১)
এবার আমরা
দেখে নেই ড. আম্বেদকর নিজেই তাঁর বিবৃতিতে বলেছিলেন, “Now I came to an important
circumstance to which I would like to make definite reference. The House will
remember that after the Bill was introduced in the House by Mr. Mandal – and it
was introduced after the Rau Committee’s investigation was complete- even then
Government promised that they would issue an executive circular to the various
provincial Governments and invite their opinion on the Bill as introduced. That
circular was also sent to Punjab.” (তথ্য ঐ- Vol-2, page – 1173) অর্থাৎ আমি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে এসেছি যা আমি
নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করতে চাই। হাউস মনে করবে যে বিলটি মি. মণ্ডল কর্তৃক উত্থাপন করা হয়েছিল। যেটি রাও কমিটির তদন্ত শেষ
হবার পর উত্থাপিত হয়েছিল। এরপর সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারকে
একটি কার্যনির্বাহক বিজ্ঞপ্তি জারি করবে এবং তাদের মতামতের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে।
উত্থাপন করা বিলের সার্কুলার পাঞ্জাবেও পাঠানো হয়েছিল।
পরিশেষে জানাই, ড. সঞ্জয় গাজভীয়ে, যিনি মহাপ্রাণ
ও বাবাসাহেবের উপর পি এইচডি করেছেন। তাঁর বইয়ের নাম “সাংবিধানিক ভারত কী নির্মাতা ড.
বাবাসাহেব আম্বেদকর ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।” তিনি কিছুদিন আগে এক লাইভ বক্তব্যে
জানিয়েছেন যে, “হিন্দু কোড বিলের জননী মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।”
উপরোক্ত রেফারেন্স
থেকে জানা যায় যে, “মন্ডলজি দ্বারা
প্রস্তুত করা তথা ড. আম্বেদকর দ্বারা সংশোধিত ও পরিবর্ধিত বিলের যে বিরোধ হয়েছিল
তার যথোপযুক্তভাবে ড. আম্বেদকর মোকাবিলা করেছিলেন। তিনি হিন্দু, শিখ, পার্সি, খ্রীষ্টান, মুসলমানদের জন্য
বুদ্ধিমত্তা পূর্ণ আইন সঙ্গত অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বিরোধিদের বোঝানোর চেষ্টা
করেছিলেন। তাঁর সেই প্রচেষ্টার ফলে ১৭ই নভেম্বর ১৯৪৭ সাল থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বর
১৯৫১ সাল পর্যন্ত হিন্দু কোড বিলটি নিয়ে
ড. আম্বেদকর তাঁর শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও অনেক ঝুঁকি নিয়েও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু
রক্ষণশীলরা ভারতীয় নারীদের অধিকারের হিন্দু কোডবিল গ্রহণ
করেনি। (তথ্য গ্রন্থ- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল জীবন আউর
বিচার, লেখক -শিলপ্রিয় বৌদ্ধ,
পৃষ্ঠা ৮০-৮১)
এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে
বাবা সাহেব যখন হিন্দু কোড বিল নিয়ে পার্লামেন্টে জোর লড়াই করছেন তখন কিন্তু
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় এবং
হিন্দু, বৌদ্ধদের সাংবিধানিকভাবে সংখ্যার
ভিত্তিতে সবকিছুতে সংরক্ষণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। সেই মর্মে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল
পাকিস্তানের সংবিধান লেখা সম্পূর্ণ করে জিন্নাসহ অনেককেই
দেখান এবং তাদের সঙ্গে অগ্রিম পরামর্শ করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কট্টর
ইসলাম মৌলবাদীরা মহাপ্রাণের তৈরি সংবিধান বৈধতা পেয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। জিন্না
থাকলে মহাপ্রাণের লিখিত সংবিধান বৈধতা পেয়ে যাবেই এই আশঙ্কায় পশ্চিম পাকিস্তানের
কট্টর ইসলাম মৌলবাদীরা জিন্নাকে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলে। শুধুমাত্র সংবিধান নয়
জিন্নার সর্ব ধর্মের প্রতি উদার মানসিকতা পশ্চিম পাকিস্তানের কট্টর ইসলাম ধর্মের
মৌলবাদীরা মেনে নিতে পারছিলেন না। জিন্না ছিলেন সংস্কারপন্থী। জিন্না একই সঙ্গে
মন্দির মসজিদ, গির্জা, এবং সমস্ত ধর্মের ধর্ম ব্যবসায়ীর ধর্ম গুরুদের বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি
জিন্না জীবনে কোনদিন নামাজ পর্যন্ত পড়েননি। আর কট্টর ইসলাম ধর্মের মৌলবাদীরা ছিল
ইসলাম ধর্মের সংস্কারের বিপক্ষে। যার পরিণতি
জিন্নার অকাল মৃত্যু। আর জিন্নার মৃত্যু মানে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের
হিন্দু সহ সমস্ত সংখ্যা লঘুদের জন্য সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের
পরিসমাপ্তি। যার পরিণতিতে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হিন্দুসহ সমস্ত সংখ্যা
লঘুদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের মুসলিম আগ্রাসন। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডলকেও মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র হলে মহাপ্রাণ ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার নাম করে
কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মহাপ্রাণ শেষ মূহুর্তে এ বিষয়ে
পরামর্শ করে নিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড.বিধান চন্দ্র রায়ের
সঙ্গে।
মহাপ্রাণ ১৯৫০ সালে ভারতে চলে
আসেন। তখন হিন্দু কোড বিল নিয়ে ভারতের আইনসভায় উত্তাল পরিস্থিতি। মহাপ্রাণ এতটাই
বাবা সাহেবকে সম্মান ও বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু কোড বিলের জোর লড়াইয়ের সময়
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল একবারও দাবি করেননি যে ঐ হিন্দু কোড বিলের খসড়া
তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। আর এক্ষেত্রেও আবার প্রমাণিত হল
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল উদারতা ও মহত্ত্ব। যার জন্য তাঁর আর এক নাম ‘মহাপ্রাণ’।
আমরা অনেকেই জানি ১৯৬৫ সালের লকুড়
কমিটির সুপারিশ বাতিল করতে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর
শরনাপন্ন হয়েছিলেন এবং কমিটির সুপারিশ বাতিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার
ফলশ্রুতিতে এখনও পর্যন্ত বাংলার নম:শুদ্র, রাজবংশী, ধোপা, সাহা(সুড়ি) সহ সারা ভারতের আরো পঁচিশটি সর্বমোট ঊনত্রিশটি জাতি সংরক্ষণ এর সুযোগ বা অধিকার ভোগ করে চলেছে।
কিন্তু এটাও আমাদের অনেকেরই জানা নেই ১৯৫৭ সালে
জহরলাল নেহরুর তথা কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা বৌদ্ধধম্মে
ধর্মান্তরিত তফশিলি সমাজকে সংরক্ষণ এর যাবতীয় সুযোগ থেকে
বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৬ সালে বাবা সাহেব প্রয়াত হন। তাই বৌদ্ধধম্ম গ্রহণকারী তফশিলি ও আদিবাসী সমাজের
মহাসংকটে তাদের হয়ে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেবার মতো কাউকে তাঁরা
খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বৌদ্ধধম্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিরভাগ ছিলেন
বাবাসাহেবের নিজের মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায়।
শেষ পর্যন্ত তফশিলী ও আদিবাসী অথচ বৌদ্ধধম্ম গ্রহকারীদের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের সুযোগ ধরে রাখতে মহাপ্রাণ
যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের শরনাপন্ন হন। মহাপ্রাণকে অনুরোধ করা হয়, ‘আপনি কিছু করুন।’
তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুকে চিঠি লেখেন। নেহেরুজি সেই চিঠির জবাবে জানালেন,
‘আমার ব্যক্তিগত কোনো অমত নেই। কিন্তু আমার মনে হয় সংবিধান এটা পারমিট করছে না।’
তখন নেহেরুর এই জবাবে যোগেন্দ্রনাথ জানান, “আপনি
হয়তো ভুলে গেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী আমি ছিলাম। কাজেই ভারতের সংবিধানে
কতটা আইনগত বাধা আছে বা সুযোগ আছে সেটা সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল। Caste is by birth
কাজেই এটার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই।” (জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলের সাক্ষাৎর, বই- ইতিহাসে
প্রেক্ষাপটে মহাপ্রাণ, পৃষ্ঠা ৬২)
যোগেন্দ্রনাথ নেহেরুজিকে
আরো জানানা, “No where is our Constitution the terminology “Scheduled Castes,”
Has been defined except a reference to Article 341 which again refers to the
notification of the president specifying the castes which shall be deemed to be
Scheduled Castes for the purpose of this Constitution. There is no mention
anywhere that the communities to be included in the list Scheduled Castes shall
profess Hindu religion. Many I reiterate, religion was never taken to be
the criterion in this regard.
--May I Point out
to you in this connection, that although the Sikhs do not subscribe to caste
system, the following four castes among the Sikhs viz Mazhabi, RAmdasi,
Kabirpanthi and Sikligar have been included in the President’s constitution
(Scheduled Castes) order 1950.78 (তথ্য – মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ৭ম খণ্ড, লেখক- জগদীশ
চন্দ্র মণ্ডল, পৃষ্ঠা ৭৯-৮৬)
এইভাবে আইনের বিভিন্ন ধারা
উল্লেখ করে জহরলাল নেহরুকে বৌদ্ধধম্মে ধর্মান্তরিতদের জন্য সংরক্ষণের পক্ষে চিঠি পত্রের মাধ্যমে জোর সওয়াল
করেন। মহাপ্রাণ জহরলাল নেহরু সঙ্গে তীব্র লড়াই করে বৌদ্ধদের সংরক্ষণের আওতায় রেখে দিতে সমর্থ হন। এখানেও যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল মহান, মহৎ প্রাণ যার আর এক নাম মহাপ্রাণ।
এখানেই মহাপ্রাণ এবং বাবা সাহেবের মহত্ব। আমরা প্রায় শুনতে পাই ৫০ থেকে ৫৬ এর মধ্যে বাবাসাহবে ও মহাপ্রাণের কোনো যোগাযোগ
ছিল না। কিন্তু এই দুই মহামানব আজীবন সমাজ কল্যাণ কর্মে হরিহর আত্মা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে
জানাই, ‘১৯৫৬ সালের শেষ দিকে পাটনায় ডাঃ রাম মনোহর লোহিয়ার নেতৃত্বে একটি সভা হয়।
যেখানে সমস্ত অবহেলিত নিপীড়িত শ্রণীকে একটি যৌথ ফোরামে এনে আম্বেদকরের নেতৃত্বে চালানো
হবে। যোগেন্দ্রনাথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দুর্ভাগ্য অসুস্থতার জন্য আম্বেদকর উপস্থিত হতে পারেননি। ১৯৫৬
সালের ৬ই ডিসেম্বর একটি বিষণ্ণ দিন। ডঃ আম্বেদকরের পরিনির্বাণে ভেঙে পড়েন যোগেন্দ্রনাথ।
পরবর্তী শোকসভায় তাঁর কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেছিল। ( তথ্য- জয় ভীম, লেখক- পীযুষে গায়েন, পৃষ্ঠা
১৮৬)। অথচ ইদানিং দেখতে পাই তথাকথিত আম্বেদকরবাদীদের একটা
বিরাট অংশ বিভিন্নভাবে মহাপ্রাণের ভুল ধরে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছেন।
আম্বেদকর ও মহাপ্রাণের দর্শন না বোঝা এই অতিশয় বহুজন আন্দোলন বোঝা পণ্ডিত বর্গের জন্য একটাই উপাধি “ধ্বংসাত্মক ভয়ংকর আম্বেদকরবাদী”। বেশ কয়েকজন তো
আগে পিছে না ভেবে বাবা সাহেবকে মুসলমান বিদ্বেষী তকমাও লাগিয়ে দিয়ে চলেছে এবং মহাপ্রাণকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এর বিষময় ফল
এবং ভবিষ্যত পরিণাম কী হতে পারে? উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। যারা মহাপ্রাণের রেখে যাওয়া
সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে তাঁরই বিপক্ষে কথা বলছে আর যাইহোক বাংলাসহ সারাভারতে তাদের মুখে বহুজন আন্দোলনের কথা মানায় কি?
0 comments:
Post a Comment