আমরা কোন
শিক্ষকের “শিক্ষক দিবস” পালন করবো?
লেখক-
জগদীশচন্দ্র রায়
(লেখাটি আমার বই চেতনার জাগরণ থেকে তুলে দিলাম)
যিনি শিক্ষা দেন তিনিই শিক্ষক বলে মনে করি।
তাই জন্মের পর থেকে আমৃত্যু আমরা যাঁদের কাছ থেকে শিখি তাঁরাই শিক্ষক। সেই
শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম হচ্ছেন ‘মা’। তারপরে পরিবার ও প্রতিবেশিরা। একটু
বড় হলে শুরু হয় পাঠ্যক্রম। সেই পাঠ্যক্রমের শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে হয়
বিদ্যালয়ে। পর্যায়ক্রমে চলে সেই শিক্ষা। সেখানে মূলত পাঠ্যক্রমের শিক্ষাই দেওয়া
হয়। তবে শিক্ষার মাধ্যমে চেতনার বিকাশ হয়, সেটাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। আর
সেই শিক্ষা শুধু পাঠ্যক্রম থেকেই পাওয়া যায় না। তার জন্য দরকার সামাজিক শিক্ষারও।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত not only education for earning but also
education for learning. অর্থাৎ শিক্ষা শুধু উপার্জনের মাধ্যম হওয়া উচিত
নয়; শিক্ষা বৌদ্ধিক বিকাশের জন্যও হওয়া উচিত।
যদিও সমাজে Education for Earning টাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে
উঠেছে। যারফলে এক একটা Certificate-ই হাতে পাওয়া যাচ্ছে
শিক্ষার মাপকাঠি হিসাবে। কিন্তু education for learning
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা জানি, সমাজে এমন বেশ কয়েক জন্য ব্যক্তি
আছেন, যাঁরা Certificate ধারী নন। কিন্তু মহান
বিদ্বান ব্যক্তি। যেমন প্রথমেই উঠে আসে মাতা সাবিত্রি ও
জ্যোতিরাও ফুলের নাম। যাঁরা জীবন পন করে ছিলেন, সমাজে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক
প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও একাধারে পুথিগত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক
শিক্ষা প্রদান করার জন্য। তাঁরা ঘোষণা করেন-
বিদ্যা বিনা মতি (বুদ্ধি) গেছে
মতি বিনা নিতি (আদর্শ) গেছে
নিতি বিনা গতি (দিশা) গেছে
গতি বিনা বিত্ত (সম্পত্তি) গেছে
বিত্ত বিনা শূদ্রের পতন হয়েছে
এতো সব অনর্থ একমাত্র অবিদ্যার জন্য হয়েছে।
এই একই কথার সুর ধরে আমরা
দেখতে পাই- পতিত পাবন হরিচাঁদ ঠাকুর স্বীয় পুত্রকে শিক্ষা দানের কাজ করার
জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন-
অনুন্নত জাতিমাঝে
শিক্ষা প্রচারিতে।
আজ্ঞা করেন হরিচাঁদ তারে বিধি মতে।। -গুরুচাদ চরিত- পৃঃ ১০১
এই পিতৃ আজ্ঞাকে শিরো ধার্য করে শিক্ষার অগ্রদূত গুরুচাঁদ ঠাকুর শ্লোগান তুললেন-
“খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ
নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই”।।
‘খেতে না পাওয়ার অভাব থেকে অশিক্ষার অভাব আরো অনেক বড়। তাই
খাদ্য কষ্টের যন্ত্রনা সহ্য করতে পারলেও শিক্ষা স্বরূপ খাদ্য থেকে যদি কেউ বঞ্চিত
থাকে তাহলে সে যন্ত্রনা কারো একার নয়, সেটা দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রেও প্রগতির
অন্তরায় স্বরূপ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানকে শিক্ষিত করতে হবে। প্রয়োজনে
ভিক্ষা করেও এই অশিক্ষার অন্ধকারকে দূর করতে হবে।’ তিনি
অবিদ্যাকে মারণ ব্যাধির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাই তিনি বলেছেন-
অজ্ঞান ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।
জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩৭
তিনি সব সমস্যা
থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে জানিয়েছেন যে,-
তাই বলিভাই
মুক্তি যদি চাই
বিদ্বান হইতে হবে।
পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ
চির সুখি হবে
ভবে।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩০
তিনি বিদ্যা অর্জনকে সমস্ত ধর্ম কর্মের ঊর্ধে
স্থান দিয়েছেন-
বিদ্যা
ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।
বিদ্যাধর্ম,
বিদ্যাকর্ম, অন্য সব ছার।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১০৮
তিনি এখানে থেমে জাননি। তাঁর
এই শিক্ষা-আন্দোলনে নারীশিক্ষা পেয়েছিল অগ্রাধিকার। তাই
তিনি বলেন-
মাতা ভাল নাহি হ’লে পুত্রভাল নয়।
“মা’র গুণে ছা’ ভাল” লোকে তাই কয়।।
গু.চ. ৩৬২
তিনি নারীদের শিক্ষার জন্য ‘শান্তি সত্যভামা’ নামে স্কুল
গড়ে তোলেন। সেখানে শুধু নারীর শিক্ষা নয়, নারীর সমাজিক অধিকারের
কথাও দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন।
শুনেছি পিতার কাছে আমি বহুবার
নারী পুরুষ পাবে সম অধিকার।।
সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।।
গুরুচাঁদ ঠাকুর শুধু এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মধ্যেই সীমিত
থাকেননি। সঙ্গে সামাজিক শিক্ষারও প্রসার
ঘটান তিনি। তাই তিনি কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
কুসংস্কার আছে যত
দূর কর’ অবিরত
বিদ্যা
শিক্ষা কর ঘরে ঘরে। -গুরুচাঁদ
চরিত পৃ.১১৯
তবে তিনি
বিদ্যা অর্জনকে সকল শক্তির মূল হিসাবে মেনে নিয়ে জানিয়েছেন-
বুদ্ধি
আছে যার শকতি তাহার
দেহ-বল কিছু
নয়।
বিদ্যা
দেয় বুদ্ধি চিত্তে আনে শুদ্ধি
তাতে বুদ্ধি
বৃদ্ধি হয়।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১২৯
এই মহান শিক্ষা বিদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের
উদ্যোগে গঠিত স্কুল সংখ্যাটা আমরা বর্তমান দশম শ্রেনির ‘স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ’
–বইতে দেখতে পাই- ‘তাঁর উদ্যোগে ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।’
কিন্ত এই মহান শিক্ষাবিদকে আমরা কয়জনে জানি?
প্রশ্ন আসে কেন জানি না?
এখানেও কি লুকিয়ে আছে সেই জাতিগত সমীকরণ?
এরকম
আরো অনেক মহামনীষী আছেন যাঁরা শিক্ষার জন্য জীবন পণ করেছেন। যেমন আমরা দেখে পাই মহারাষ্টের গাড়্গে মহারাজ। যিনি
একজন থামস্ আপ অর্থাৎ আঙ্গুঠা ছাপ ব্যক্তি হয়েও ঘোষণ করেন- “ভগবানের জন্য খরচা
করোনা। ঐ পয়সা শিক্ষার জন্য ব্যয় কর। পয়সা মন্দিরে না দিয়ে কোন ছাত্র-ছাত্রীকে
দাও। ভক্তির প্রচার ভালো নয়। শিক্ষার প্রসার অতি ভালো।”
আর
মহান পণ্ডিত বাবা সাহেবকে কে না জানেন? কিন্তু তাকেও জাতিগত সমীকরণে গণ্ডিতে
সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যাকে আধুনিক ভারতের সাংবিধানিক ভারত নির্মাতা বলা হয়েছে।
বিশ্ব যাকে Symbol of Knowledge বলেছেন। সেই
বাবাসাহেব শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন যে,- দুটাকা উপার্জন করলে এক টাকা দিয়ে পেটের ক্ষুদা
মিটানোর জন্য খাবার কিনে খাও। আর এক টাকা দিয়ে বই কিনে সন্তানদেরকে শিক্ষিত কর। তিনি
বলেছেন, শিক্ষা হচ্ছে বাঘিনীর দুধ। এই দুধ পান করলে সব কিছুতে তেজদীপ্ত হওয়া যায়। তিনি
আরো বলেছেন, আমাকে মূর্তির মধ্যে পাবেনা। আমাকে পাবে বইয়ের মধ্যে। তাই বই পড়ো।
তাঁর শ্লোগান- শিক্ষিত হও সংগঠিত হও সংঘর্ষ কর।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে এই মহান শিক্ষাবিদদের ‘শিক্ষক দিবস’-এ স্মরণ করবো না কি যিনি অন্যের থিসিস চুরি করে নিজের বলে চালিয়ে ছিলেন তাঁকে স্মরণ করবো? নির্ণয় আপনাদেরই গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে প্রথাগত শিক্ষক দিবস পালন হবে। আর যাঁরা প্রকৃত ‘শিক্ষক’। যাঁরা সমাজের জন্য জীবনকে বাজি রেখে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন, তাঁরা এই দিবসে অন্ধকারেই থেকে যাবেন!
__________________
(তথ্য সংগ্রহ-
১) শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত – মহানন্দ হালদার
আমার লেখা-
২) গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলন
৩) গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজ সংস্কার ও মুক্তির দিশা)
ভিডিওটি অবশ্যই দেখবেন-
0 comments:
Post a Comment