Sunday 8 March 2020

// // Leave a Comment

Women's Day -নারী দিবসে কিছু কথা লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

নারী দিবসে কিছু কথা
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
     প্রবাদ আছে অধিকার কেউ কাউকে দেয়না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। ৮ মার্চ নারী দিবস। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস।
    প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে নারীকে মানবিক অধিকার থেকে  বঞ্চিত করা হয়েছে। তাকে শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ও ঘরের কাজের লোক হিসাবেই ধরে নেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রে নারীকে শুদ্রের স্থান দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ ‘নীচ্‌’ হিসাবে গণ্য   করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? প্রাচীনকালের কোনো একসময়ে মাতৃ প্রধান সমাজ ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সামাজিক প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেটা হয়েগেল পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।  
    প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের দিনে তো নারীর অনেক প্রগতি হয়েছে। সেটা কিভাবে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে? না কি এর জন্য কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে এই অধিকার পাওয়ার জন্য?
আমি প্রথমেই উল্লেখ করেছি, অধিকার কেউ কাউকে দেয়না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়।
তাহলে আসুন সে সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়া যাক- তার পূর্বে জানিয়ে দেই যে, কোনো সমাজ  ব্যবস্থা বা গোষ্ঠীর পরিবর্তন বা প্রগতির মূল হচ্ছে শিক্ষা। কারণ, শিক্ষা হচ্ছে সেই মশাল যেটা অনেক বাধাকে অতিক্রম করে সঠিক দিশা নির্দেশ করে। সন্তানের প্রথম শিক্ষিকা হচ্ছে-  ‘মা’। আবার শিক্ষা হচ্ছে মায়ের মতো। অর্থাৎ ‘মা’ হচ্ছে ‘শিক্ষা’, আর ‘শিক্ষা’ হচ্ছে ‘মা’। কিন্তু এই  ‘মা’কেই  ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থা অশিক্ষিত করে দূরে সরে রেখেছে। তাই সন্তান জন্ম নিয়েছে মানসিক পঙ্গু হয়ে। সেই সন্তানের মানসিক পঙ্গুত্ব থেকে মানসিক বিকাশের জন্য মহারাষ্ট্রে মহান সমাজ সংস্কারক-
 জ্যোতিরাও ফুলে ঘোষণ করলেন-    
  বিদ্যা বিনা মতি (বুদ্ধি) গেছে
মতি বিনা নিতি (আদর্শ) গেছে
এতো সব অনর্থ একমাত্র অবিদ্যার জন্য হয়েছে।  
সাবিত্রিবাই ফুলে-
 তিনি নিজের জীবন সঙ্গীনী সাবিত্রীবাই ফুলেকে শিক্ষিত করে তুললেন, আর তাঁকে গড়ে তুললেন নারী শিক্ষার প্রথম স্তম্ভ হিসাবে। ভারতের অনাবাদী জঙ্গলময় অশিক্ষার ভূমিতে প্রথমে স্ত্রী শিক্ষার চারা গাছ রোপন করেন। আর ধীরে ধীরে সেই শিক্ষার চারা গাছ বিশাল বটবৃক্ষের মত বিস্তারলাভ করে। অর্থাৎ প্রথম শিক্ষিকা হলেন- মাতা সাবিত্রীবাসি ফুলে। এই কাজে সহায়তা করলেন আর  একজন মহিয়সী- ফতিমা সেখ।  
  ভারতবর্ষে হাজার বছর ধরে শোষিত বঞ্চিত, আদিবাসী ও অতি পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে শিক্ষার আলো থেকে বহু যোজন দূরে সরিয়ে রেখেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থা। সেই শিক্ষার আলোকে তিনি এই বঞ্চিতদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। শিক্ষা গ্রহণের অধিকারকে হাজার বছর ধরে ষড়যন্ত্র করে বন্ধ করে রাখার ফলে জঞ্জালের পাহাড় জমে ছিল, সেই জঞ্জালকে এক ঝকটায় সরিয়ে দিয়ে তিনি শিক্ষার বীজ বপন করতে শুরু করেন।
হাজার বছর ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখা সর্ব শ্রেণীর স্ত্রীদের জন্য তিনি যখন এক ঝটকায় শিক্ষার দরজাকে লাথি মেরে উন্মুক্ত করে দেন; তখন শিক্ষার বন্ধ দরজা খোলার আওয়াজ শুনে পুনের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কান ফেটে যায়। তাদের কাছে বজ্রাঘাতের মত এই ঘটনা মনে হয়। তখন তারা অমানবিক সামন্ততাত্রিক প্রথার ঘুমন্ত সিংহ কে জাগিয়ে তোলে। তারা মাতা সাবিত্রী ফুলে ও মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলের উপর বিভিন্নভাবে প্রাণ নাশের চেষ্টা চালায়। কিন্তু শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা তাদের আন্দোলনকে থেমে যেতে দেননি।
বেগম রোকেয়া-
বেগম রোকেয়া রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় জন্মগ্রহণ করেও তিনি নারীর মর্যাদার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি বলেছেন-আমাদের অন্ধকারের রাখার জন্য পুরুষেরা ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলে প্রচার করেছে। এই ধর্ম গ্রন্থগুলো পুরুষদের দ্বারা রচিত বিধি ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়।
হরিচাঁদ ঠাকুরঃ-
     এই একই কথার সুর ধরে আমরা যদি বাংলার দিকে তাকাই সেখানে দেখতে পাই- পতিত পাবন হরিচাঁদ ঠাকুরের ভাষায় –
নারী পুরুষ পাবে সম অধিকার।।
সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার  
গুরুচাঁদ ঠাকুরঃ-
 হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র পিতার মতো শ্লোগান তুললেন-               
“খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই”।।  -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪৪
অর্থাৎ ‘খেতে না পাওয়ার অভাব থেকে অশিক্ষার অভাব আরো অনেক বড়। তাই খাদ্য কষ্টের যন্ত্রনা সহ্য করতে পারলেও শিক্ষা স্বরূপ খাদ্য থেকে যদি কেউ বঞ্চিত থাকে তাহলে সে যন্ত্রনা কারো একার নয়, সেটা দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রেও প্রগতির অন্তরায় স্বরূপ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানকে শিক্ষিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভিক্ষা করেও এই অশিক্ষার অন্ধকারকে দূর করতে হবে
 তিনি অবিদ্যাকে মারণ ব্যাধির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাই তিনি বলেছেন-
                           অজ্ঞান ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।
                            জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ।। গুরুচাঁদ চরিত পৃ.১৩৭
                            মাতা ভাল নাহি হ’লে পুত্রভাল নয়।
                            “মা’র গুণে ছা’ ভাল” লোকে তাই কয়।। গু.চ. ৩৬২
তিনি নারীদের শিক্ষার জন্য ‘শান্তি –সত্যভামা’ নামে স্কুল গড়ে তোলেন। সেখানে শুধু নারীর শিক্ষা নয়, নারীর সমাজ অধীকারের কথাও দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন।
                            বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
                            লোকে বলে “মা’র গুণে ভালো হয় ছাও।।”
তৎকালীন বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি ১৯১০ সালে বিধবা বিবাহ শুরু করেন। আর বাল্য বিবাহ বন্ধের নির্দেশ দেন। নারীকে সমান অধিকার দেওয়ার সঙ্গে তিনি নারী তথা সকল মানুষকে এক জাতি অর্থাৎ মানব জাতি বলে গণ্য করেছেন।

ড. বাবাসাহেব আম্বেদকরঃ-
 নারীর প্রগতির জন্য সর্বদা সংগ্রাম করেছেন।
নারী ও শ্রমিকদের সুবিধাঃ- বাবা সাহবে হিন্দুকোড বিল বানিয়েছিলেন নারীদের সমমর্যাদার অধিকার দেওয়ার জন্য। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার সমান অধিকার, বিবাহিত পুরুষ এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে অন্য স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেনা। যদিও তখনকার সরকার সেটার মান্যতা দেয়নি। পরবর্তীতে সেটা চালু করা হয়। মহিলাদের মাতৃত্বকালী ছুটি, এবং প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ বাবা সাহেবের অবদান। তিনি যখন শ্রমসচিব (মন্ত্রী) তখন (১)কয়লা শ্রমিকদের নানা ধরনের সহায়তা প্রদান, (২) মহিলা শ্রমিকদের প্রসবকালীন ৩২৯দিন ছুটি, (৩) কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র, (৪) ৮ ঘণ্টা কাজের আইনী স্বীকৃতি, (৫) ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ, (৬) ন্যূনতম বেতন সহ নানা শ্রমিক  কল্যাণ আইন পাস ও কার্যকর করেন।
     এছাড়াও আরো অনেক মণীষী নারীর অধীকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। যেমন রাজা রাম মোহন রায়- নিজের বৌদির সতি হওয়া দেখে বিচলিত হয়ে যান। তারপর তিনি ইংরেজদের সহায়তায় সতীদাহ প্রথাকে আইন করে বন্ধ করতে সমর্থ হন।
   ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা (বিদ্যাসাগর)- তিনিও নারীর মর্যাদা নিয়ে সংগ্রাম করেন।
    এই মহান সংগ্রামীরা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেভাবে সংগ্রাম করেছেন, সেটা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশিষে সকলের জন্য। কিন্তু সমাজে সেটা খুবই কম উল্লেখ করা হয়। অনেকে তো বাবা সাহেবের নাম শুনলেও কেমন জাতিগত গন্ধ পায়। আর হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের এতোবড় অবদানের কথা হয়তো অনেকেই ইতিপূর্বে শোনেনি। এসব যে প্রকৃত শিক্ষার অভাবে হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।  
    আর বর্তমান দিনে নারী দিবস আর পাঁচটা অনুষ্ঠানের মতো হয়েছে। শুধু নাচ-গান ও খাওয়ার মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়েছে। যাঁরা এই অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি ব্রাত্য। এই ব্রাত্যতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে কিন্তু ফিরে পাওয়া অধিকার আবার হারিয়ে যাবার জন্য সময় লাগবেনা। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা  টিকে রাখার জন্য সব রকমের চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞাপনের জগতে নারীর শরীর প্রদর্শন এক পণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করে রাখার জন্য সংগ্রাম জারি রাখতে হবে।





0 comments:

Post a Comment