Sunday 1 March 2020

// // Leave a Comment

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নারীর সার্বিক মুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখা সমাজের মহামানব ও মহীয়সী নারীদের অবদান। লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়



ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নারীর সার্বিক মুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখা সমাজের
মহামানব ও মহীয়সী নারীদের অবদান।
লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়
 ভূমিকাঃ- কবির ভাষায়, বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, অর্ধেক তার রচিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। আর পতিত পাবন হরিচাঁদের কথায়-
                          সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
                          নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।
    এই বিশ্বের সব কিছু গড়ার কারিগর হচ্ছে নারী ও পুরুষ। উভয়ের প্রচেষ্টা বিনা কোনো কিছু গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই নারী ও পুরুষ উভয়ে সমান। তবে প্রকৃত বিচার করলে সন্তান ধারনের ক্ষেত্রে নারী একমাত্র ক্ষমতাশালী। যেটা পুরুষের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
    কিন্তু প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিচার করলে দেখতে পাই- পূর্বে ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। সেখানে মা’ ই ছিল কর্তা। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ক্ষমতা চলে আসে পুরুষের কাছে। পুরুষ নিজের আধিপত্বকে বজায় রাখার জন্য শুরু করে নারীর সমস্ত অধিকারের হরণ। ফলে নারী হয়ে পড়ে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের মেশিন মাত্র। আর পুরুষের ইচ্ছা পূরণের যন্ত্র। সেখানে নারীকে মানুষের মর্যাদা থেকে নামিয়ে আনা হয় পশুর পর্যায়ে। নারীর প্রতি সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। শাস্ত্র লিখে নারীর সমস্ত অধিকারকে ক্ষুন্ন করেছে।
     পৃথিবী বিবর্তনশীল। তাই বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্যে নারীর সামাজিক বিবর্তনের জন্য কালের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই, অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। তারমধ্যে সমাজের পিছিয়ে পড়া মহিলাদের মুক্তির জন্য, তাদের সামাজিক অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য শুরু হয় সংগ্রাম। এই সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই-

(১) সাবিত্রি মাতা ফুলেঃ-
      সাবিত্রি মাতা ফুলের বাল্যকালেই বিবাহ হয়। কিন্তু জীবন সাথী, জ্যোতিরাও ফুলে তাঁকে ঘরে বসেই পাঠ দান করান। তিনি ধীরে ধীরে অক্ষর জ্ঞানের অধিকারী হন। পরবর্তীতে তিনি ব্রত গ্রহণ করেন সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে সমাজের নারীদের শিক্ষিত করে গোড়ে তুলতে হবে।
      জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রীকে প্রথমে শিক্ষিত করে তোলেন। আর 18 বছর বয়সে শিক্ষিকা রূপে ভারতের অনাবাদী জঙ্গলময় অশিক্ষার ভূমিতে প্রথমে স্ত্রী শিক্ষার চারা গাছ রোপন করেন। আর ধীরে ধীরে সেই শিক্ষার চারা গাছ বিশাল বটবৃক্ষের মত বিস্তারলাভ করে। তো এরকম বিদূষী মাতা সাবিত্রীর অতুলনীয় অবদানকে কেউ কি বিস্মৃত হতে পারে?
  ভারতবর্ষে হাজার বছর ধরে শোষিত বঞ্চিত, আদিবাসী ও অতি পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে শিক্ষার আলো থেকে বহু যোজন দূরে সরিয়ে রেখেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থা। সেই শিক্ষার আলোকে তিনি এই বঞ্চিতদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। শিক্ষা গ্রহণের অধিকারকে হাজার বছর ধরে ষড়যন্ত্র করে বন্ধ করে রাখার ফলে জঞ্জালের পাহাড় জমে ছিল, সেই জঞ্জালকে এক ঝকটায় সরিয়ে দিয়ে তিনি শিক্ষার বীজ বপন করতে শুরু করেন।
হাজার বছর ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখা সর্ব শ্রেণীর স্ত্রীদের জন্য তিনি যখন এক ঝটকায় শিক্ষার দরজাকে লাথি মেরে উন্মুক্ত করে দেন; তখন শিক্ষার বন্ধ দরজা খোলার আওয়াজ শুনে পুনের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কান ফেটে যায়। তাদের কাছে বজ্রাঘাতের মত এই ঘটনা মনে হয়। তখন তারা অমানবিক সামন্ততাত্রিক প্রথার ঘুমন্ত সিংহ কে জাগিয়ে তোলে। তারা মাতা সাবিত্রী ফুলে ও মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলের উপর বিভিন্নভাবে প্রাণ নাশের চেষ্টা চালায়।
    সাবিত্রী ও জ্যোতিরাও দ্বারা প্রজ্বলিও শিক্ষার জ্যোতিকে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা জ্যোতিরাও এর পিতা গোবিন্দ রাও কে ধমকী দিয়ে ভয় দেখিয়ে জ্যোতিরাও কে ঘর থেকে বের করার কাজে সফল হয়। ঘর ছাড়া হয়েও সাবিত্রী ও জ্যোতিরাও তাঁদের শিক্ষা প্রদানের কাজ চালিয়ে যান।
    মাতা সাবিত্রি যখন মহিলাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাইরে যেতেন, তখন তাঁর উপর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা গোবর ও পাথর ছুড়ে মারত। তাঁকে রাস্তায় চলার সময় বাঁধা সৃষ্টি করে উঁচু জাতির গুন্ডারা খারাপ খারাপ গালি দিত। এমনকি তাঁকে মেরে ফেলারও ধমকি দিত। মহিলাদের জন্য চালানো স্কুল বন্ধ করার চেষ্টা করত। সাবিত্রী এদের ধমকীতে যাতে ভয় পেয়ে ঘরে বসে যান, সেই চেষ্টা করত। এমনকি ব্রাহ্মণ্যবাদী অনেক নিয়ম তুলে নরকে যাওয়ার ভয়ও দেখাত। এরকমই এক বদমাশ প্রায় প্রতিদিনই সাবিত্রির পিছে পিছে এসে উত্যক্ত করত। একদিন তো ঐ বদমাশ হঠাৎ সাবিত্রীর রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়ায়। আর শারীরিকভাবে আক্রমন করে। তখন সাবিত্রি দুঃসাহস করে ঐ বদমাশকে থাপ্পড় লাগান। থাপ্পড় খেয়ে বদমাশ আর দ্বিতীয় বার সাবিত্রীর সামনে আসেনি।
     সাবিত্রি মাতার এই নারী শিক্ষার আন্দোলনের আর একজন সহযোগী ছিলেন ফতেমা শেখ। তিনি সাবিত্রি মাতার সঙ্গে সদাসর্বদা সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন।
 (২) হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরঃ-
     পতিত পাবন হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মের মধ্য দিয়ে কখনো নারী পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ রাখেননি। তিনি নিজে শিক্ষার আন্দোলন করতে না পারলেও স্বীয় পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপর সেই গুরুদায়িত্ব সপে যান।  
   গুরুচাঁদ ঠাকুর পিতৃ আজ্ঞাকে শিরোধার্য করে সমাজ জাগরণের জন্য সংগ্রাম শুরু করেন।

     শিক্ষার আন্দোলনঃ- গুরুচাঁদ ঠাকুর একাধারে যেমন ছিলেন প্রথাগত (একাডেমিক) শিক্ষার প্রসারের অগ্রদূত। তেমনি তিনি অন্য দিকে ছিলেন সামাজিক শিক্ষার ধারক ও বাহকঅর্থাৎ Education for earning and education for learning. গুধুমাত্র একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই সে প্রকৃত শিক্ষার অধিকারী হতে পারেনা; সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। তিনি চেয়েছিলেন শুধু পুথিগত শিক্ষায় নয়, সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত পূর্ণ মানুষ, কুসংস্কার মুক্ত মানুষন গড়ে তুলতে। শিক্ষার প্রসারের জন্য তাঁর শ্লোগান ছিল-
                         খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
                        ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই।।  -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪৪
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অশিক্ষা হচ্ছে মারণ রোগ। তার জন্য তিনি ঘোষণা করলেন, খেতে না পাওয়ার অভাব থেকে অশিক্ষার অভাব আরো অনেক বড়। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানদের শিক্ষিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভিক্ষা করেও অশিক্ষার অন্ধকারকে দূর করতে হবে।
বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে বলে “মা’র গুণে ভাল হয় ছা’ও।। (পৃঃ ৫২৯)
তিনি সকলের জন্য বিদ্যা অর্জনের উপর জোর দেন। আর গ্রামে গ্রামে পাঠশালা করার আহ্বান জানান। নারীকেও শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেন। কারণ, মা’ শিক্ষিত হলে সন্তানও শিক্ষিত হবে।
১৮৮০ (১২৮৭ বাংলা) সালে নভেম্বর মাসে অনুন্নত শ্রেণির জন্য ১ম পাঠশালা তৈরী করা হয়।
বিদ্যার কারণে দান দানের প্রধান।
বিদ্যাহীন নর দেখ পশুর সমান।। -গুরুচাঁদ চরিত -৫৩০
     যিনি বিদ্যা লাভ করেছেন, তিনি যদি অন্যকে সেই বিদ্যা দান করেন তাহলে সেই দানের ফলে দেশ, সমাজ ও জাতির প্রগতি হবে। সমস্ত বাঁধার অন্ধকার দূর হয়ে জ্ঞানের আলো ফুটে উঠবে। তিনি বিদ্যাহীন মানুষকে পশুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিক্ষিত হলে সমাজের অন্ধ ধর্মীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করা যাবে। গোলামী থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।
তিনি আরো বললনে-               কুসংস্কার আছে যত      দূর কর’ অবিরত
                                     বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে। গুরুচাঁদ চরিত পৃ.১১৯

কুসংস্কার হচ্ছে সমাজের ক্ষতিকারক ভাইরাস। এই ভাইরাস থেকে প্রতি নিয়ত দূরে থাকতে হবে। আর তার জন্য ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে হবে।
নারী শিক্ষার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের বাড়িতেই ‘শান্তি-সত্যভামা’ নামে স্কুল গড়ে তোলেন।


(৩) বাবা সাহবে আম্বেদকরঃ-
বাবা সাহবে আম্বদেকর একজন সূর্য। সেই সূর্যকে পূর্ণ প্রকাশের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী ঘনকালো মেঘকে সরিয়ে তাঁকে সংবিধান সভায় প্রেরণ করেন বাংলার ‘আম্বেদকর’ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। যার অক্লান্ত সংগ্রামের ফলে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়। যদিও বাংলার মানুষ এই মহান মহামানবদ্বয়ের সংগ্রামের ফসল ‘সংরক্ষণ- representation’ কে তো  ভোগ করছে, কিন্তু যাদের জন্য এই মহার্ঘ তাদের আজও আপন করে নিতে পারেনি।
    অবদানঃ-  ড. আম্বেদকরের ভারতের বিকাশের ক্ষেত্রে যতোটা যোগদান আছে হয়তো অন্য কোনো রাজনেতার সেটা নেই। তিনি আধুনিক ভারতের নির্মাতা। তিনি সংবিধান রচনা সমিতির অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি এমন সংবিধান রচনা করেছেন, যেখানে সকল নাগরিক সমান অধিকারী, ধর্মনিরপেক্ষ। বাস্তবে তিনি স্বাধীন ভারতের ডি.এন.এ. রচনা করেছিলেন সংবিধানের মাধ্যমে।

  নারী ও শ্রমিকদের সুবিধাঃ- বাবা সাহবে হিন্দুকোড বিল বানিয়েছিলেন নারীদের সমমর্যাদার অধিকার দেওয়ার জন্য। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার সমান অধিকার, বিবাহিত পুরুষ এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে অন্য স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেনা। যদিও তখনকার সরকার সেটার মান্যতা দেয়নি। পরবর্তীতে সেটা চালু করা হয়। মহিলাদের মাতৃত্বকালী ছুটি, এবং প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ বাবা সাহেবের অবদান। তিনি যখন শ্রমসচিব (মন্ত্রী) তখন (১)কয়লা শ্রমিকদের নানা ধরনের সহায়তা প্রদান, (২) মহিলা শ্রমিকদের প্রসবকালীন ৩২৯দিন ছুটি, (৩) কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র, (৪) ৮ ঘণ্টা কাজের আইনী স্বীকৃতি, (৫) ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ, (৬) ন্যূনতম বেতন সহ নানা শ্রমিক  কল্যাণ আইন পাস ও কার্যকর করেন।
     উপরে উল্লেখিত এই মহামনীষী যেমন নারী মুক্তির সংগ্রাম করেছে, তেমনি আরো অনেকে কম বেশি এই কাজ করেছেন। তবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মুক্তির জন্য কিন্তু এনাদে অবদান অসামান্য।
   এই আলোচনা শুধু আলোচনার জন্য নয়। এই আলোচনা থেকে যদি নারী আপন অধিকার বুঝতে পারে ও নিজের জীবন ও সমাজ জীবনে এর প্রভাত স্থাপিত করতে পারে তবেই এই আলোচনা স্বার্থ হবে।


0 comments:

Post a Comment