
গণতন্ত্রের অর্থ যদি এই হয়, তাহলে আমরা কোন
তন্ত্রে আছি?
জগদীশচন্দ্র রায় (মুম্বাই)
২৬শে জানুয়ারী Republic Day অর্থাৎ গণতন্ত্র দিন। ‘গণ’ কথার অর্থ মানুষ। আর ‘তন্ত্র’ হচ্ছে শাসন ব্যবস্থা। জনগণের জন্য শাসন ব্যবস্থাই হচ্ছে 'গণতন্ত্র'।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘গণতন্ত্র’ কি বা কেমন? ‘গণতন্ত্র’ of the people, for
the people and by the people. অর্থাৎ জনগণের
শাসন, জনগণের জন্য শাসন, এবং জনগণের দ্বারা শাসন। এখানে রাজা (শাসক)
জনগণের মধ্য থেকেই জনগণ নির্বাচিত করেন। তাই Preamble of the constitution এ লেখা আছে- “আমি, ভারতের লোক। ভারতকে সম্পূর্ণ প্রভুত্ব সম্পন্ন, সমাজবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, লোকতান্ত্রিক, গণরাজ্য বানানোর জন্য
তথা আমাদের সমস্ত নাগরিকদেরকে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়, বিচার অভিব্যক্তি , বিশ্বাস, ধর্ম আর উপসনার স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমানতা প্রাপ্ত করার জন্য তথা
ঐ সব কিছুতে ব্যক্তির গরিমা আর রাষ্ট্রের একতা ও অখন্ডতা সুনিশ্চিত করার, বন্ধুতা বাড়ানোর জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে আমাদের এই সংবিধান সভায় আজ তারিখ
২৬শে নভেম্বর ১৯৪৯ দিন, এতদ্বারা এই সংবিধান
অঙ্গীকৃত অধিনিয়ম আর আত্ম সমর্পিত করছি।”
ভারতের তথাকথিত স্বাধীনতা
অর্জনের পর সংবিধানের Drafting committee এর Chairman
হন ড. আম্বেদকর। তাঁর সঙ্গে অন্য যাঁরা কমিটিতে ছিলেন, বিভিন্ন কারণে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকেন। তাই সব দায়িত্ব গিয়ে পড়ে
ড. আম্বেদকরের উপর।
সংবিধান
রচনা করার জন্য ড. আম্বেদকর ২২টি দেশের সংবিধান নিয়ে গবেষণা করে ভারতের উপযুক্ত
সারবস্তু নিয়ে সংবিধান রচনা করেন। কিন্তু যাঁরা আম্বেদকরকে কাজের জন্য মর্য্যাদা
দিতে চাননা, তাঁরা বলেন, আম্বেদকর বিদেশ থেকে ধার করে নিয়ে সংবিধান লিখেছেন। তাদের ভাষা এরকম- “ঝুলি ভরা ঋণ’’। অর্থাৎ সংবিধানটা বিদেশীদের থেকে নিয়ে লেখা
হয়েছে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- আপনারা যাঁরা অনেক বড় বিদ্যান হয়েছেন, নিশ্চয় পাঠ্য পুস্তক ও অন্যান্য Reference নিয়ে পড়ে পাশ করেছেন। তো ড. আম্বেদকর বিদেশী সংবিধান থেকে Reference নিয়ে নিজের দেশের উপযুক্ত করে লিখেছেন, তাতে ‘ধার করা’ হোল কি করে? আর যদি হয়, তাহলে আপনারা সবই ‘ধার’
না করে পাশ করেছেন কি করে?
একটা কথা, সংবিধান গ্রহণ করার ক্ষেত্রেতো বহু আলোচনা সমালোচনা করে সেটা গৃহীত হয়েছে। তো
তারা কি করে ‘ধার করা’ জিনিসের অনুমতি
দিলেন?
এবার আসি অন্য
প্রসঙ্গে-
সংবিধানের উদ্দেশ্য
ছিল সমতা সতন্ত্রতা বন্ধুতা ও ন্যায়। যার জন্য জাতীয় পতাকায় আশোক চক্র ও জাতীয়
প্রতীক অশোক স্তম্ভ রাখা হয়েছে। তবে ড. আম্বেদকর সংবিধান সংসদে পেশ করে তাঁর ভাষণে
বলেছিলেন- “সংবিধান যতই ভালো লেখা হোক না কেন, সেটা বাস্তবায়িত করার লোকেরা যদি ভাল না হয়; তাহলে এর গুরুত্ব নেই। আবার সংবিধান যতই খারাপ লেখা হোক না কেন, তাকে বাস্তবায়িত করার লোকেরা যদি ভাল হয়, তাহলে সেটা বেশ কার্যকরী হবে।”
যদিও আমরা দেখতে পাই- ড. আম্বেদকর জানিয়েছেন-“সংবিধানকে দেশের গণদেবতার মন্দির হিসাবে তৈরী করা হয়েছিল, কিন্তু গণদেবতা আসীন হওয়ার পূর্বেই মন্দিরের বেদীটি শয়তানেরা দখল করে নিয়েছে।” অর্থাৎ সংবিধান বাস্তবে রূপায়িত করা হয়নি সম্পূর্ণ ভাবে। যত্ সামান্যই করেছে
প্রবল চাপের মুখে।
আমরা দেখতে পাই সংবিধানের পূর্বে যে মনুস্মৃতি নামক সংবিধান অলিখিত ভাবে
লাগু ছিল জনগণের জন্য, সেটাই লাগু রাখার
প্রকৃয়া সর্বদা চলছে। সেনা বিভাগেও পূজাপাঠ ব্যতীত কোন কার্য করা হয়না। সেনা
বিভাগে ‘জয় ভারত’ এর পরিবর্তে ‘জয় হিন্দ’ বলা হয়।
আসলে মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ভারতবর্ষে মানুস্মৃতির
শাসন চলছে। আর এর মূল ভিত হচ্ছে ‘জাত-ব্যবস্থা’। জাত-ব্যবস্থাকে শাসক শ্রেণি উত্তোরোত্তর
মজবুত করে চলেছে।
তাই ‘গণতন্ত্র’,
সাংবিধানিকভাবে হলেও জনগণের কোন অধিকার আছে কি?। ড. আম্বদেকর বলেছিলেন-
“আমরা সংবিধানের মাধ্যমে শুধু
রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিষ্ঠা করতে
পেরেছি। আমাদের এই রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে
সামাজিক গণতন্ত্রে রূপান্তরিক করতে হবে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র কখনোই স্থায়ী হতে পারে
না যদি তার ভিতে (foundation/base) সামাজিক গণতন্ত্র না থাকে। সামাজিক গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে- স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব (Liberty, Equality, Fraternity) সাম্য কখন স্বাধীনতা থেকে বাদ দেওয়া যায় না, আবার স্বাধীনতাও কখনো সাম্য থেকে বাদ দেওয়া যায় না। সেইভাবে স্বাধীনতা এবং
সাম্য কখনো ভ্রাতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে আমি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা যেন ভারতীয় সমাজ জীবনে এই ত্রয়ীর মিলন না ঘটিয়ে দুটোকে সম্পুর্ণরূপে বাদ
দিয়েছি। ২৬শে জানুয়ারী ১৯৫০ তারিখে আমরা একটা অসংগতিপূর্ণ জীবনে (life of
contradiction) প্রবেশ করছি। রাজনৈতিক সাম্যকেই
শুধু সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে পেরেছি, কিন্তু সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে অসাম্যকে সংবিধানে মেনে নেওয়া হয়েছে।
রাজনীতিতে আমরা বিখ্যাত নীতি one man, one vote, and one value মেনে নিয়েছি। সমস্ত ভারতবাসী একজাতি। এই নীতিতে সমাজ জীবনে সৃষ্টি হবে ঐক্য।
এটা হওয়া খুবই কঠিন। কারণ, জাতব্যবস্থাটাই anti national, এই জাতব্যবস্থা মানুষকে মানুষদের থেকে পৃথক করে। কারণ, সেটা জাতিতে জাতিতে ঈর্ষা এবং বিতৃষ্ণার (antipathy) জন্ম দেয়।” আর আব্রাহাম লিংকন
বলেছিলেন-“একটা অট্টালিকার দেওয়ালে যদি ফাটল
ধরে যায়- সেটা বেশি দিন স্থায়ী হয় না”।
এখন ভারতের অপামর জনগণকেই
এগিয়ে আসতে হবে প্রকৃত গণতন্ত্র স্থাপন করার জন্য। যদিও ‘ভোটাধিকার’ কে ‘ভোট দান বা
মতদান’
বলে চালু করা হয়েছে। কোন অধিকার কি করে ‘দান’
হতে পারে? এই ‘গণতন্ত্র দিবসে’ যে সব অনুষ্ঠান হয়, সেখানেও সেই জাত ব্যবস্থার নিদর্শন দেখা যায়। যাঁর দ্বারা সংবিধান লিখিত হোল, তাঁকে কেউ স্মরণ করতে চাননা প্রায় ইচ্ছা করা। এমনকি যাঁরা ২৬শে জানুয়ারীর
অনুষ্ঠানে বাবা সাহেবের ফটো রাখতে চান, সেখানে তাদের
কঠোর সংঘর্ষ করতে হয়! এটা কি গণতন্ত্র?? এসব আপনাদেরই
জানতে হবে ও বুঝতে হবে। গণতন্ত্রের সঠিক অর্থ ও উদ্দেশে আজ সার্বিকভাবে encounter হয়ে যাচ্ছে। তাই যেদিন সঠিকভাবে জনগণ দ্বারা জনগণের জন্য জনগণই শাসন করবে
সেদিনই প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে আসবে। ফিরিয়ে
আনার জন্য আপনাদের সকলকে সহভাগী হতে হবে।
না হলে ওদিন বেশি দূর নয়; গোলামীর জঞ্জীরে আবদ্ধ
হওয়ার।
______________________________________
তথ্য সংগ্রহ ১)মানবতাবাদের অক্লান্ত যোদ্ধা –লেখক অধ্যাপক
জগদ্বন্ধু বিশ্বাস।
২) আম্বেদকর দর্শনে
গনতন্ত্র–
লেখক অধ্যাপক সত্যরঞ্জন রায়।
0 comments:
Post a Comment