
‘ধম্মকে ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার
প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বহু পূর্ব থেকে। যার জন্য যে ভারত ভূমিতে এই ধম্মের উদ্ভব,
সেখান থেকেই আগে বিতাড়িত করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের অনেক অনেক লেখক সাহিত্যিককেও
দেখছি তাঁরা ‘বুদ্ধধর্ম’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। তাই তাদের উদ্দেশ্যে এই লেখা তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।
ধর্ম
কি? ধম্ম কি? এদুটোর মৌলিক পার্থক্য কি?
ধর্ম
ও ধম্মের উদ্দেশ্য কি? কি কি ধম্ম নয়?
(বাবা সাহেবের Buddha and
his Dhamma গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক সত্যরঞ্জন রায়। –এই বই
থেকে সমস্ত লেখা সংগৃহ করা হয়েছে।)
ধর্ম কি?
ধর্ম
সম্পর্কে ধারণার বিবর্তনের ইতিহাসঃ-
‘ধর্ম’
একটি অস্পষ্ট শব্দ। এর কোন নির্দিষ্ট অর্থ নেই। এই ‘ধর্ম’ শব্দ কিন্তু
একটাই। কিন্তু এর অর্থ অনেক। কারণ, ‘ধর্ম’ অনেকগুলি স্তরের মধ্য দিয়ে
অতিক্রম করছে। প্রতিটি স্তরের ধারণাকে বলা হয় ‘ধর্ম’।
যদিও একটি স্তরের ধর্মের ধারণার সঙ্গে অন্য স্তরের ধর্মের ধারণার সঙ্গে
মেলেনা। কারণ ধর্মের ধারণা কখনও
নির্দিষ্ট ছিলনা। যার ফলে যুগে যুগে ধর্ম সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে।
ধর্ম
সম্পর্কে প্রথম ধারণাঃ-
বিদ্যুৎ,
বৃষ্টি বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটলে আদিম মানুষ সেগুলোর কোন ব্যাখ্যা দিতে পারতনা।
প্রাকৃতিক কোন ঘটনাকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য ধর্মকে তখন বলা হ’ত জাদুবিদ্যা বা
ম্যাজিক। সুতরাং ধর্ম তখন এই জাদুবিদ্যার সঙ্গে অভিন্ন বলে গণ্য হ’ত।
ধর্ম
সম্পর্কে দ্বিতীয় ধরণাঃ-
এরপর
ধর্ম বিবর্তনের ইতিহাসে এল দ্বিতীয় স্তর। এই স্তরে ধর্ম মানুষের বিশ্বাস, আচার,
অনুষ্ঠান, প্রার্থনা ও যজ্ঞ ইত্যাদির সঙ্গে অভিন্নরূপে গণ্য হতে থাকে। যদিও ধর্ম
সম্পর্কে এই ধারণা ছিল আনুমানিক।
ধর্মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি শুরু হয় এই
বিশ্বাসের উপর ভর করে। সেটা হচ্ছে, এমন কোন একটি শক্তি আছে যার কারণেই প্রাকৃতিক
অবস্থার সৃষ্টি হয়; যেটাকে আদিম মানুষেরা জানত না বা বুঝতে পারেনি। ধর্মের এই
বিশ্বাসের স্তরে জাদুবিদ্যা তার গুরুত্ব হারায়।
এই যে যে, শক্তির উপর বিশ্বাসের ধারণা এটা
প্রথমে ছিল হিংসামূলক। পরবর্তীকালে মানুষের উপলবদ্ধি হয় যে, এই শক্তি তাদের জন্য শুভাকাঙ্ক্ষী
হ’তে পারে। তাই বিশ্বাস, আচার, অনুষ্ঠান ও যজ্ঞ ইত্যাদির দরকার মানে করে শুভাকাঙ্ক্ষী
শক্তিকে প্রসন্ন করার জন্য। আর হিংসাপরায়ণ শক্তির সঙ্গে আপস করার জন্য। পরবর্তীকালে
এই শক্তিকে নাম দেওয়া হয়-ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা।
ধর্ম
সম্পর্কে বিবর্তনের তৃতীয় ধারণাঃ-
ধর্ম সম্পর্কে বিবর্তনের তৃতীয় ধারণা হচ্ছে,
মানুষ মনে করে এই ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছে। আর ঈশ্বরই মানুষ সৃষ্টি করেছে। এরপর
মানুষের বিশ্বাস জন্মেছে আত্মা আছে এবং এই আত্মা স্বাশ্বত। এ জগতে মানুষের কৃত
কর্মের জন্য ঈশ্বরের নিকট মানুষ জবাবদিহি করতে বাধ্য।
সংক্ষিপ্তভাবে ধর্মের ধারণা সম্পর্কে
বিবর্তনমূলক ইতিহাস হচ্ছে এটা। তাহলে এখন ধর্মের অর্থ দাঁড়ায় ঈশ্বরে বিশ্বাস,
আত্মা বিশ্বাস, ঈশ্বরের উপাসনা, ভ্রমাত্মক আত্মাকে সঠিক পথে নিয়ে আসা্, আর
প্রার্থনা, অনুষ্ঠান, যজ্ঞ ইত্যাদির দ্বারা ঈশ্বরকে প্রসন্ন করা।
ধর্ম
এবং ধম্মের মৌলিক পার্থক্যঃ-
সাধারণত বলা হয় যে, ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তিগত
ব্যাপার। প্রত্যেকেরই ধর্মকে তার নিজের কাজে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। ধর্মকে সমাজ
জীবনে টেনে এনে কোনরূপ অংশ গ্রহণ করানো কারো উচিত নয়।
কিন্তু ধম্ম হচ্ছে এর বিপরীত। অর্থাৎ ধম্ম
হচ্ছে সামাজিক। ধম্ম সৎগূণান্বিত। এর অর্থ হল ধম্ম জীবনের প্রত্যেকটি
পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সঠিক সম্পর্ক।
তাহলে এটা থেকে পরিষ্কার হচ্ছে- কোন লোক যদি
একা থাকে, তাহলে তার ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু যখন দু’জন মানুষের মধ্যে
পর্স্পরের সম্পর্কের প্রয়োজন হয় তখন তাদের মধ্যে ধম্মের প্রয়োজন আবশ্যিক। আর এই
ধম্মের আবশ্যিকতাকে পছন্দ করুক বা না করুক, এই প্রয়োজন কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না।
অন্যভাবে বলা যায় সমাজ ধম্ম বিনা চলতে পারেনা।
ধম্মের মূল বিষয় বিরাজ করে মানুষের সঙ্গে
মানুষের সম্পর্কের মধ্যে। ধম্মের আসল লক্ষ্য হচ্ছে একটি মানুষকে শিক্ষা দেওয়া;
কিভাবে সে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা বা ব্যবহার করবে যাতে তারা সকলেই সুখী হয়।
ধম্ম
বলতে কি বোঝায়? ধম্মের প্রয়োজন কেন?
বুদ্ধ
ধম্মের দুটো স্তম্ভ আছে। একটা প্রজ্ঞা অন্যটা করুণা। প্রজ্ঞা কি? প্রজ্ঞা হচ্ছে
পারস্পরিক বোঝাপড়া। করুণা কি? এবং কেন? করুণা হচ্ছে প্রেম বা ভালবাসা। কারণ, প্রেম
বা ভালবাসা ছাড়া সমাজে বেঁচে থাকা যায়না। আর সমৃদ্ধিও লাভ করা যায়না। এই প্রজ্ঞা ও
করুণাকে বলা হয় ধম্ম।
তাহলে
দেখা যাচ্ছে যে, ধম্মের সংজ্ঞা থেকে ধর্মের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ পৃথক। বুদ্ধ, ‘ধম্মে’র
এই যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটা কত প্রাচীন হলেও কতই না সেটা আধুনিক এবং কতইনা মৌলিক।
এটা কত প্রাসঙ্গিক ও কত সত্য। এই প্রজ্ঞা ও করুণার সংমিশ্রণই হচ্ছে বুদ্ধ ধম্ম। ধর্ম
এবং ধম্মের এটাই হচ্ছে পার্থক্য।
ধর্মের
উদ্দেশ্যে এবং ধম্মের উদ্দেশ্য।
বিশ্বের সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে? এই প্রশ্নের
ব্যাখ্যা হচ্ছে ধর্মের ব্যাপার। কিন্তু এই প্রশ্নের সঙ্গে ধম্মের কোন সম্পর্ক নেই।
ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই জগতের মূলোৎপত্তি ব্যাখ্যা করা। আর ধম্মের উদ্দেশ্য
হচ্ছে জগৎকে সঠিকভাবে সংস্কার করা।
নৈতিকতা
ও ধর্মঃ-
ধর্মের মধ্যে নৈতিকরার কোন স্থান নেই। কারণ,
ধর্মের বিষয়বস্তুর মধ্যে ঈশ্বর, আত্মা প্রার্থনা, পূজার্চনা, ধর্মীয় আচার পদ্ধতি,
ধর্মানুষ্ঠান এবং যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান থাকে।
কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের যেখানে সম্পর্ক
জড়িত থাকে শুধুমাত্র সেখানেই নৈতিকরার প্রশ্ন থাকে।
ধম্ম
ও নৈতিকতাঃ-
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ধম্মের মধ্যে নৈতিকতার
স্থান কোথায়? উত্তর হল-নৈতিকতাই হচ্ছে
ধম্ম। আর ধম্ম হচ্ছে নৈতিকতা। অন্যভাবে বলা যায়, ধম্মের মধ্যে নৈতিকতা
ঈশ্বরের স্থান গ্রহণ করে, যদিও ধম্ম অনুসারে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। ধম্মের
মধ্যে প্রার্থনা, তীর্থভ্রমন, ধম্মীয় আচার পদ্ধতি, ধম্মীয় অনুষ্ঠান বা
যজ্ঞানুষ্ঠান ইত্যাদির কোন প্রয়োজন হয়না।
তাই ধম্মের সার কথা হচ্ছে নৈতিকতা। নৈতিকতা ভিন্ন ধম্ম নেই। ধম্মে
নৈতিকতার উৎপত্তি হয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালবাসার সরাসরি প্রয়োজনের জন্য। এই
ভালবাসার জন্য ঈশ্বরের কোন অনুমোদনের দরকার হয়না। মানুষকে নীতিজ্ঞান সম্পন্ন হতে
হলে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। নিজের মঙ্গলের জন্যই মানুষ মানুষকে
ভালবাসবে। তবে শুধুমাত্র নৈতিকতা থাকলেই যথেষ্ট নয়। কারণ, নৈতিকতাকে
পবিত্র ও সঠিক হতে হবে।
ধম্ম
কি?
(১)
জীবনের পবিত্রতা রক্ষা করা হচ্ছে ধম্ম।
এই
পবিত্রতা তিন প্রকার।
(i)
শরীরের পবিত্রতা,- অর্থাৎ
চৌর্যবৃত্তি ও পাপাসক্ত জীবন-যাপন থেকে বিরত থাকা।
(ii)
বাচনিক পবিত্রতা,- মিথ্যা না বলা।
(iii) মনের
পবিত্রতা,- অর্থাৎ ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয় বাসনা, ব্যক্তিগত ঈর্ষাপরায়নতা ও ব্যক্তিগত
অলসতা থেকে বিরত থাকা।
(২)
জীবনে পূর্ণতা লাভ করার নাম ধম্ম।
তিন
প্রকারের পূর্ণতা আছে।
(i)
শারীরিক পূর্ণতা,- অর্থাৎ আশা
আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার পর স্বীও জীবনে মনের পূর্ণতাকে অনুভব করতে
হবে।
(ii)
বাক্য প্রয়োগে পূর্ণতা।
(iii) মানসিকতায়
বা মনের পূর্ণতা।
(৩)
নিব্বাণে সুস্থিত হয়ে বিরাজ করা ধম্ম।
নিব্বাণ
যেমন প্রকৃত শান্তি দিতে পারে, তেমন আর কোন কিছু পারেনা। বুদ্ধ যত রকম তত্ত্ব
দিয়েছে, তার মধ্যে নিব্বাণ তত্ত্বটি সর্ব শ্রেষ্ঠ।
নিব্বাণ
কিভাবে আমাদের শান্তি দিতে পারে?
লোভ,
ক্রোধ এবং মোহ যদি দূর করা যায়, তাহলেই মানুষ আর দুর্ভাগ্য বা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেনা।
নিব্বাণ ভবিষ্যৎ জীবনে নয়, বর্তমান জীবনেই সম্ভব।
(৪)
আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করা ধম্ম। অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয়তগ আকাঙ্খা বা
বাসনা পরিত্যাগ করা।
(৫)
সমস্ত মিশ্রদ্রব্য অস্থায়ী একথা বিশ্বাস করা ধম্ম।
কোন প্রাণীর শরীর ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই
চারটি উপাদানের (সমানুপাতিক) মিশ্রনের ফলে
তৈরী হয়। যখন এই (সমানুপাতিক) মিশ্রন চারটি মৌল উপাদানে দ্রবীভূত হয়, তখনই সেই
বস্তুর (অর্থাৎ শরীরের) ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। এটাই হল মিশ্র অস্তিত্বের
অস্থায়িত্ব। প্রাণী বৃদ্ধি পাচ্ছে ( অর্থাৎ প্রাণী পরিবর্তিত হচ্ছে) এই সূত্র ধরে
কোন জীবন্ত প্রাণীর অস্থায়ীত্বকে সব চেয়ে ভালভাবে বর্ণনা করা যায়।
এই অর্থে অতীতের, কোন একটি মূহুর্তের
প্রাণী সেই মুহুর্তে ছিল, কিন্তু এই বর্তমান মুহুর্তে তার সেই অতীত মুহুর্তের প্রাণীটি আর নেই বা
ভবিষ্যতেও থাকবে না। আবার ভিবিষ্যৎ কোন এক মুহুর্তের কোন একটি প্রাণী তখন সেই
মুহুর্তে থাকবে, কিন্তু সেই মুহুর্ত থেকে পরের আর একটা মুহুর্ত পর্যন্ত সে প্রাণী একই রকম
থাকবেনা। বর্তমান মুহুর্তের কোন প্রাণী বর্তনাম মুহুর্তে আছে, কিন্তু
এই মুহুর্ত থেকে পরবর্তী ভবিষ্যতেও সেই প্রাণী থাকবেনা।
সংক্ষেপে বলা যায়, মানুষ (প্রাণী) সর্বদাই পরিবর্তিত
হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবনের কোন দুটো মুহুর্তে সে এক নয়।
(৬)
কর্ম হচ্ছে নৈতিকতা শৃঙ্খলা রক্ষা করার উপায়-একথা বিশ্বাস করা ধম্ম।
পার্থিব জগতে একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম আছে। এই
নিয়ম মেনেই একের পর একে ঋতু আসছে ও চলে যাচ্ছে। বীজ থেকে বৃক্ষ জন্মে, বৃক্ষ ফল
দান করে। আবার সেই ফল থেকে বীজ হয়।
এইভাবে মানব
সমাজেও নৈতিক শৃঙ্খলা আছে। আর সেই নৈতিক শৃঙ্খলা হচ্ছে কর্ম নিয়ম। আর এই
কর্ম অর্থ কাজ। আর বিপাক হচ্ছে- তার ফলাফল। নৈতিক শৃঙ্খল যদি মন্দ হয়,
তাহলে তার কারণ হচ্ছে মানুষ অকুশল কর্ম বা মন্দ কর্ম করেছে। আর যদি ভাল হয়, তার
কারণ হচ্ছে মানুষ কুশল কর্ম বা ভাল কাজ করেছে। বুদ্ধ একে কর্ম বিধান বলেছেন ।
অর্থাৎ কাজের ফলাফল কাজকে অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
কি
কি ধম্ম নয়।
(১)
অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করা ধম্ম নয়।
অলৌকিকতা
বর্জনের ক্ষেত্রে তিনটি উদ্দেশ্য আছে।
(i)
মানুষকে যুক্তির পথে পরিচালনা করা।
(ii)
মানুষকে মুক্ত করা যাতে সে সত্যের
অন্বেষণ করতে পারে।
(iii) কুসংস্কারের
সবচেয়ে শক্তিশালী উৎসটি অপসারিত করা।
(২)
ঈশ্বরে বিশ্বাস মূলত ধম্মের অংশ নয়।
এ
জগৎ বিবর্তনবাদের ফল। কেউ তাকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং কল্পনার উপর নির্ভরশীল কোন
কিছুকে ধম্ম গ্রহণ করেনা। পুরোহিত হচ্ছে অশুভশক্তির প্রতীক। কারণ, সে কুসংস্কার
সৃষ্টি করে।
(৩)
ব্রহ্মের সঙ্গে মিলনের উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম, মিথ্যা ধম্ম।
বুদ্ধ বলতেন, কোন কিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করার
পূর্বে তাকে অবশ্যই সঠিক যুক্তি-তথ্য দিয়ে প্রমান করতে হবে। অদৃশ্য বস্তু যদি
কোনরূপ দৃশ্যমান রূপে প্রকাশ না পায় তাহলে সেটা বাস্তব নয়। বিদ্যুৎ আলো দান করে।
আমরা আলো দেখে বিদ্যুতের বাস্তবতা স্বীকার করি। যদিও বিদ্যুৎ অদৃশ্য। অদৃশ্য ব্রহ্মা তাহলে কি উৎপাদন করেন?
তিনি কি দৃশ্যমান কোন ফল উৎপাদন করেন? উত্তর না। তাহলে ব্রহ্মা হচ্ছে
কল্পনাপ্রসূত।
(8)
আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস ধম্ম নয়।
যার অস্তিত্ব আছে তা কিন্তু আত্মা নয়, তা
হচ্ছে মন। মন আত্মার কল্পনা থেকে স্বতন্ত্র। আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অঙ্গ। ঈশ্বরের বিশ্বাস যতখানি কুসংস্কারের উৎস, আত্মার অস্তিত্বে
বিশ্বাসও ততখানি কুসংস্কারের উৎস। প্রকৃত পক্ষে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের চেয়েও ভয়ংকর।
কারণ, এটা শুধুমাত্র পুরোহিত শ্রেণীর জন্ম দেয়না, এটা কেবল সমস্ত কুসংস্কারের মূল
উৎস নয়, এটা পুরোহিত সম্প্রদায়ের হাতে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের উপর
নিয়ন্ত্রণ চালানোর ক্ষমতা দান করে।
স্বতন্ত্র একটি সত্ত্বারূপে আত্মার
অস্তিত্বের বিরোধী মতবাদকে বুদ্ধ নাম দিয়েছেন-‘রূপ’। আর অনুভূতিশীল
বা বস্তুর সমষ্টিগত নামকে বলেছেন-‘নামরূপ’। বুদ্ধের
বিশ্লেষণ অনুসারে অনুভূতিশীল প্রাণী হচ্ছে
একটি মিশ্র বস্তু, যার মধ্যে রয়েছে ভৌতিক উপাদান এবং কিছু মানসিক উপাদান। যেগুলিকে
বলা হয়-‘খন্ড’। রূপখন্ড প্রধানত এই ভৌতিক উপাদানে
গঠিত। সেই ভৌতিক উপাদান হচ্ছে ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ। এই উপাদানগুলি শরীর
বা রূপ সৃষ্টি করে। রূপখন্ড ছাড়া আরো একটি বস্তু আছে। যার নাম হচ্ছে ‘নামখন্ড’। এই
নামখন্ড অনুভূতিশীল প্রাণী সৃষ্টি করে। এই নামখন্ডকে বলা হয় ‘চেতনাশক্তি’। চেতনা
শক্তি হচ্ছে অনুভূতিশীল প্রাণীর মূল কেন্দ্র। ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চারটি
উপাদানের আনুপাতিক মিলনের ফলশ্রুতি হচ্ছে-‘চেতনা’।
বুদ্ধ
বলেছেন, যেখানে রূপ বা কায়া আছে সেখানেই তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে চেতনা বর্তমান।
একবার যদি চেতনাশক্তি উৎপন্ন হয় তাহলে
মানুষ একটি অনুভূতি সম্পন্ন প্রাণীতে পরিনত হবে। সুতরাং চেতনাশক্তি মানব
জীবনে সর্বপ্রধান বস্তু।
(৫)
যাগ-যজ্ঞে বিশ্বাস করা ধম্ম নয়।
(৬)
কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ধম্ম নয়।
(৭)
ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা ধম্ম নয়।
বুদ্ধ ছিলেন সকলের জন্য শিক্ষার প্রবল
সমর্থক। তাছাড়া তিনি জ্ঞান সম্পর্কে যতটা চিন্তিত ছিলেন, তার থেকে বেশি চিন্তিত
ছিলেন জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে। তিনি চাইতেন জ্ঞানবান ব্যক্তির অবশ্যই শীল
(Virtue) থাকতে হবে। শীল বিনা জ্ঞান অত্যন্ত ভয়ংকর। তিনি বলতেন, অনেক বিদ্যা অর্জন করতে না পারলেও চলবে।
কিন্তু শীলবান হতে হবে। কারণ, আচরণ অর্থাৎ শীল হচ্ছে প্রথম এবং প্রধান বিষয়।
মানুষ যদি কখনও অনেক বেশি জানতে পারে,
কিন্তু তার সেই জ্ঞান যদি তার জীবনে আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ না পায় ক্ষমতার দম্ভ
থেকে তাকে মুক্তি না দেয়, যে ক্ষমতা তাকে কেবল ধ্বংসের দিকে চালনা করে, তাহলে সেই
জ্ঞান থেকে কি উপকার সে পাবে?
কোন ব্যক্তি যদি হাজার খানেক স্তবক বার বার
আবৃত্তি করতে পারে, কিন্তু তার প্রকৃত অর্থ যদি না বোঝে, তাহলে তার সেই না বুঝে
বার বার আবৃত্তি করার তাৎপর্য, ভালভাবে বুঝে একটিমাত্র ছত্র আবৃত্তি করার সমকক্ষও
হয়না। কারণ, শব্দের গুঢ় অর্থ ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারলে এবং শ্রবন করালে তা মানুষের
চিন্তা-ভাবনাকে সংযত রাখতে সক্ষম।
(৮)
ধর্মগ্রন্থ অভ্রান্ত-একথা বিশ্বাস করা ধম্ম নয়।
ব্রাহ্মণরা ঘোষণা করেছিল বেদ শুধুমাত্র
পবিত্র ধর্মগ্রন্থই নয়। কর্তৃত্বের প্রশ্নে বেদ শেষ কথা। বেদ অভ্রান্ত।
বুদ্ধ,
ব্রাহ্মণদের এই দাবির সম্পূর্ণ বিরোধী
ছিলেন। তিনি বেদকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে স্বীকার করেননি।
স্বীকার করেননি বেদের অভ্রান্ততাকে। তিনি বেদ সম্পর্কে বলেছেন,- “বেদ হচ্ছে
জলশূন্য মরুভূমি, পথশূন্য এক মহারণ্য। বস্তুত সেখানে মৃত্যু অবধারিত। কোন
বুদ্ধিপ্রসূত নীতিগত তৃষ্ণা নিয়ে বেদের দ্বারস্থ হতে পারেনা এবং আশাও করতে পারেনা
যে, তার সেই তৃষ্ণা নিবারণ হবে।”
বেদের
অভ্রান্ততা সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, “এ জগতে কোন কিছু অভ্রান্ত নয়। প্রত্যকটি
বস্তুই পরীক্ষা নিরীক্ষার অধীন।” এক্ষেত্রে মনেকরি, বুদ্ধ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ
বাণী এখানে দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে, “তোমরা যা শুনবে তাই বিশ্বাস করবে না।
কেবল লোক পরম্পরায় যা চলে আসছে তা কখনো বিনা যুক্তিতে গ্রহণ করবে না। সাধারনত যে
বার্তা রটে, তা বিশ্বাস করবেনা। যা ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে, তার দ্বারাও চালিত
হবেনা। যুক্তির সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম কূট তর্কে মুগ্ধ হবেনা। তর্কশাস্ত্রের
সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্মা কৌশলেও নয়। শুধু বহিরঙ্গের রূপ দেখে ভুলবেনা। মনোরম বিশ্বাস ও
অভিমত হলেই তার প্রতি আস্থা পোষণ করবেনা। বাইরের দিক থেকে খাতি মনে হলেও তা
স্বীকার করবেনা। মুনি বা ঋষি অথবা কোন পূজ্য ব্যক্তি হলেই তার কথা মেনে চলবে, তাও
নয়।”
তিনি আরো বলেছেন, “কারো কাছে
কতৃত্বমূলক শিক্ষা গ্রহণের পূর্বে তোমরা কখনো মনে করবেনা এগুলি ধর্মগ্রন্থে আছে,
অতএব তোমাদের কাছে গ্রহণ যোগ্য। কোন বিশ্বাস ও অভিমত যদি কোন গুরুজনদের দ্বারা
প্রচারিত হয়, তবুও তাকে স্বীকার করে নেবে তা নয়। যে ধর্ম বিশ্বাস ও মতাদর্শ তোমরা
শিক্ষা করতে চাও, আগে বিবেচনা করে দেখ তা স্বাস্থকর, না অস্বাস্থকর; তা প্রশংসনীয়,
না নিন্দনীয়; তা শুভ অস্তিত্বের দিকে, না অশুভ অস্থত্বের দিকে চালনা করে।
শুধুমাত্র এসব যুক্তি বিচার করেই কোন ব্যক্তির পক্ষে অন্য কারোর কাছ থেকে শিক্ষা
গ্রহণ করা উচিত।”
এতক্ষণ
ধর্ম এবং ধম্ম সম্পর্কে বলতে গেলে সংক্ষিপ্তভাবেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আপনাদের সিদ্ধান্ত জানান কোনটা সঠিক। এবিষয়ে আমার
মতামত একটা উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরতে চাই।
সেটা হচ্ছে Reservation বা সংরক্ষণের criteria (নির্ণায়ক) বা শর্ত ছিল– যারা সামাজিকভাবে ও
ধর্মীয়ভাবে শোষিত; যাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়; যাদের সঙ্গে অস্পৃশ্যের মত
ব্যবহার করা হয়। জঙ্গলে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। ইত্যাদি। তারা সংরক্ষণের সুবিধা
গ্রহণ করতে পারবে। এখানে কিন্তু কোন আর্থিক ভিত্তিতে সংরক্ষণ নির্ধারণ করা হয়নি।
কিন্তু বর্তমানে সংরক্ষণের প্রচার করা হচ্ছে
আর্থিক ভিত্তি ও মেরিট ভিত্তি করে। যেটা সংরক্ষণের নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এই
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই যে, ধর্মের ধারণাকে ধম্মের ধারণার সঙ্গে
গুলিয়ে দিয়ে এর ভিত্তিকে নষ্ট করা হচ্ছে। এবার আপনারা ভেবে দেখুন কোনটা সঠিক।
__________________________________
আমি আপানার সঙ্গে একমত
ReplyDelete