দুর্গাপূজার
উৎপত্তি
(সৌজন্যে- শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র সুধা। লেখক শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর।
সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার, পৃষ্ঠাসংখ্যা-868-870
সম্রাট
আকবরের রাজত্বকালে ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের জমিদার কুল্লভট্টের
পুত্র কংস নারায়ণ প্রায় আট লক্ষ টাকা ব্যয়ে মহাধুমধামে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তারপর
থেকেই ক্রমে ক্রমে বাংলার ঘরে ঘরে এই পূজার প্রচলন হয়েছে। এই জন্যই বলা হয় চণ্ডীর
জন্ম বাংলাদেশে।
দুর্গা ও কালীর উদ্ভব সম্বন্ধে দুটি কথা
মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় উপমহাদেশের
পশ্চিমাঞ্চলে (সিন্ধু ও বেলুচিস্থানে) শিবকে দিয়ে হিন্দুর যাত্রা শুরু এবং
পূর্বাঞ্চলে দুর্গা ও কালীকে দিয়ে তার শেষ।
বাংলাদেশের নাটোর জেলার তাহেরপুর পরগনায়
জমিদার কংসনারায়ণ (বাংলার বারো ভূঁইয়ার একজন, ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন)
নিজের ক্ষমতা, আভিজাত্য ও ধনৈশ্বর্য জাহির করার
উদ্দেশ্যে অভিনব কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার কুলগুরু তাকে দুর্গাপূজা করার
প্রস্তাব করেন। ‘এর আগে কেউ কখনও
দুর্গার নাম শোনে নি। অতএব, লোকে তা মানবে কেন’ জমিদারের এ সন্দেহ ছিল। জনসাধারণ কর্তৃক মেনে নেবার দায়িত্ব
নিয়ে কুলগুরু তাকে আশ্বস্ত করেন। কংসনারায়ণের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা।
কৃত্তিবাস ওঝার জন্মস্থান নদীয়া জেলার রাণাঘাট মহকুমার প্রায় এক ক্রোশ
দক্ষিণ-পশ্চিমে স্থিত ফুলিয়া গ্রামে। কৃত্তিবাস আনুমানিক ১৪৪৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি
বেঁচে ছিলেন। কুলগুরু এই কৃত্তিবাসের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলায় রামায়ণ তর্জমা
করান। সংস্কৃত রামায়ণে দুর্গার কোনই উল্লেখ নেই। সংস্কৃত থেকে বাংলায়
অনুবাদ করানোর সময় কৃত্তিবাসকে দিয়ে কংসনারায়ণের কুলগুরু রামায়ণের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত করান যে, রাম অকালবোধন করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। বাংলার সাধারণ জনগণ
সংস্কৃত জানে না, প্রায় নিরক্ষর।
রামায়ণের দোহাই দিয়ে জমিদার কংসনারায়ণকে দিয়ে দুর্গাপূজা করিয়ে জনগণকে গ্রহণ
করালো। তখনকার আমলে (আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে) নয় লক্ষ টাকার অধিক
খরচ করে চোখ ধাঁধানো জাকজমকপূর্ণ পূজা প্রথম প্রচলন করা হয়। এত ব্যয়বহুল পূজায়
পুরুত ঠাকুর কি বিরাট পরিমাণ দক্ষিণা পেয়েছিলেন পাঠক একবার অনুমান করুন । এ জন্যই
দুর্গাপূজার আর এক নাম বড় পূজা। এ পূজা বাংলার বাইরে অবাঙালি হিন্দুর মধ্যে প্রচলন
নেই বললেই চলে। যেখানে বাঙালি সেখানেই দুর্গাপূজা। বহু আদিবাসী এই দুর্গাপূজার সময়
শোক পালন করে। তা হলে কি বলা অত্যুক্তি হবে যে, দুর্গার পিতা জমিদার কংসনারায়ণ, জন্মভূমি বাংলাদেশের নাটোর জেলার তাহেরপুর পরগণায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমাদ্ধের্ ?
কেউ কেউ বলেন কৃত্তিবাসের জন্ম ১৪৪০
খ্রিষ্টাব্দে, মাঘ মাসে, নদীয়ার শান্তিনগর থানার ফুলিয়া গ্রামে। কেউ বলেন বাংলাদেশের
রাজশাহী জেলার প্রেমতলীর নিকটে। ১২ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে শাস্ত্রীয়
শিক্ষার জন্য যান রাজশাহীর বরেদ্রভূমিতে। তার পরে রাজানুগ্রহ লাভের জন্য গৌড়ের
রাজা গণেশ (১৪১৫-১৪১৮)/সুলতান জালালুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪১৫-১৪১৮) এর দরবারে যান।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদি নাম ছিল ‘শ্রী রাম পাঁচালি’
পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ। শ্রীরামপুর মিশন
প্রেস থেকে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার সম্পাদিত কৃত্তিবাসী রামায়ণ ১৮০২-১৮০৩ সালে
প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে প্রকাশিত হয় ১৮৩০-১৮৩৪ সালে। পরবর্তী চার শতাব্দীতে
কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হয়। রামায়ণে কৃত্তিবাস দুর্গার
অকালবোধন লিখিতভাবে আমদানী করলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, সেই সূত্রে ২০১৪ সালে দুর্গার বয়স হয় আনুমানিক ৫৬৪ বছর।
History
& Origin of Durga Puja
-By
Subhamoy Das, About.com Guide
The First
Durga Puja in Bengal the first grand worship of Goddess Durga in recorded
history is said to have beed celebrated in the lage 1500s. Folklores say
the landlords or zamindar of Dinajpur and Malda initiated
the first Durga Puja in Bengal. According to another source, Raja
Kangshanarayan of Taherpur or Bhabananda Mazumdar of Nadiya organized the
first Sharadiya or Autumn Durga Puja in Bengal in c1606.
* দুর্গাপূজার উৎপত্তি ও বছরে ৩ বার কেন দুর্গা পূজা হয়
এ প্রশ্নের উত্তরে আচার্য সুভাষ
শাস্ত্রী তাঁর “অমৃতালোক” গ্রন্থের ১০৫ থেকে ১০৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন:-
মূর্ত্তি পূজার পক্ষে প্রামাণ্য শাস্ত্রে
কোন নির্দেশ নাই। তথাকথিত ব্রাহ্মণেরা দেব-দেবীর স্রষ্টা। কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে
শ্রমজীবী কৃষকদের অর্থ সম্পদ শোষণ করা এবং জমিদারদের খেয়ালী মনের পূর্ণতা দানের
জন্য কল্পিত পুঁথি রচনা করে “দুর্গাপূজা” সৃষ্টি করা হয়েছিল।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজশাহী
জেলার চলন বিলের পার্শ্বে জমিদার কংসনারায়ণ এর দ্বারা শরৎকালে প্রথম
দুর্গাপূজা হয়েছিল। এই পূজার উৎপত্তির মহা তিন নায়ক হলেন (১) জমিদার কংসনারায়ণ, (২) তাঁর সভাপতি কৃত্তিবাস ওঝা, এবং (৩) তাঁর বংশের পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী। কৃত্তিবাস ওঝা পয়ার ছন্দে গোঁজামিল দিয়ে কাল্পনিকভাবে মূল
বাল্মিকী রামায়ণের নকল করে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করে ‘দুর্গাপূজা’ ঢুকিয়ে দেন। আর রমেশ শাস্ত্রী কঠোর চেষ্টা করে
চণ্ডীপাঠের পুস্তক ও দুর্গাপূজার পদ্ধতি রচনা করেন। সেই সময় আট লক্ষ টাকা খরচ করে প্রথম দুর্গাপূজা হয় চলনবিলে। এই পূজার আয়োজন
দেখে পাশের ভাতুরিয়া পরগণার জমিদার জগৎ নারায়ণ বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেন। তিনি
খরচ করেন নয় লক্ষ টাকা। এই দুই জমিদারের নাম কেনা-বেচা এবং প্রভাব বিস্তারের জন্যই
বাংলা এলাকায় দুর্গাপূজার উৎপত্তি ও প্রসার বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। মূল
বাল্মীকি রামায়ণে কোন দেব-দেবী ও দুর্গাপূজার নামগন্ধ নেই। সুরথ রাজা
দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে কাহিনী আছে তা অনৈতিহাসিক। ফলে
সুরথ রাজার ‘দুর্গাপূজা’ করার ঘটনাও মিথ্যা। ফলে ভারতবর্ষের অন্য হিন্দু জনসমাজ দুর্গাপূজা করেন না একমাত্র বাঙালি জনসমাজ
ছাড়া। সুরথ রাজা এবং রামচন্দ্র যদি দুর্গাপূজা করেই থাকেন তবে ভারতবর্ষের অন্য
স্থানে এবং অযোধ্যায় দুর্গাপূজা নেই কেন? সমগ্র বাংলা এলাকা, আসাম এবং বিহারের
কিছু অংশে দুর্গাপূজার বহুল প্রচলন কারণ বাঙালি যেখানে আছে সেখানেই ‘দুর্গাপূজার’ ছড়াছড়ি। ভারতবর্ষের সংস্কৃত সাহিত্য, প্রামাণ্য পুস্তকসমূহ এবং হিন্দী সাহিত্যে দুর্গাপূজার কোন
কথা নেই বলে তাঁদের আচরিত ধর্মে দুর্গাপূজার স্থান নেই। অথচ কৃষিপ্রধান বাংলা
এলাকায় দুর্গাপূজা প্রচলন করে পুরোহিত এবং জমিদার নামক শোষকেরা। একটু ভেবে দেখুন
এক বছরের মধ্যে তিন বার তিন ভাবে দুর্গাপূজার নামে কৃষি প্রধান শ্রমজীবী লোকদের
শোষণ করা হয়। কৃষকেরা চৈত্র-বৈশাখ মাসে কঠোর পরিশ্রম করে আউশ ধান, পাট এবং আমন ধান রোপণ করেন। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে আউশ ধান
এবং পাট কৃষকের ঘরে এলে এই সময় শরৎকালে ‘দুর্গাপূজার’ বিধান দিয়ে কৃষকদের আউশ ধান এবং পাট বিক্রয়ের অর্থ শোষণ করা
হয়। মাত্র কিছুদিন পরেই কার্তিক মাসে আবার ‘কাত্যায়নী’ পূজা নাম দিয়ে
আশ্বিন মাসে যে দুর্গাদেবী ও তার বাহিনীকে ‘বিসর্জন’ দিয়ে ত্যাগ করা হলো বা মেরে ফেলা হলো সেই দুর্গাদেবীকে
পুনরায় সাধারণ মানুষদের শোষণ করার জন্য আবার ডেকে আনা হলো ব্রাহ্মণদের মন্ত্রের
জোরে। পুনরায় চলল ধর্মের নামে তথাকথিত শূদ্রদের অর্থ সম্পদ শোষণ। ফাল্গুন মাসে আমন
ধান ও চৈতালী ফসলের টাকা শোষণ করার জন্য ‘বাসন্তী’ পূজার নামে
দুর্গাদেবী এবং তার বাহিনীকে ডেকে আনা হয় পুনরায় কৃষকদের সকল অর্থ সম্পদ ‘বাসন্তী’ পূজার নামে শোষণ
করার জন্য। ভেবে দেখুন এক মা দুর্গা ও তার সাথের সকলকে তথাকথিত পুরোহিতের দল
তিনবার তিনভাবে ডেকে এনে সমাজকে শোষণ করছে। এ সকল ঘটনায় বুঝতে পারা যায় তথাকথিত
দেব-দেবীরা পুরোহিতদের মন্ত্রের দাস। তারা দেব-দেবীকে ইচ্ছেমতো মন্ত্রের জোরে ডেকে
আনে আবার ইচ্ছামত বিসর্জন দেয় বা মেরে ফেলে। কারণ একটাই তা হলো শূদ্র নাম দিয়ে
বৃহৎ জনসমাজকে ধর্মের নামে শোষণ এবং শাসন করা। এমনিভাবে হরেক রকম দেব-দেবীর
কাল্পনিক মূর্তি, পুরাণ, উপপুরাণ এবং অন্য বহু কাল্পনিক গাল-গল্পকে ধর্ম নাম দিয়ে
অধর্মযুক্ত পুস্তক রচনা করে কৌশলে জনসমাজের উপর ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতের দল সমাজের
উপর চালাচ্ছে শোষণ ও লুণ্ঠন।
0 comments:
Post a Comment