প্রকৃতি ও
সত্যের প্রতীক নবদুর্গা কলাবৌ
লেকখঃ- কাশ্যপ
ভারতের পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, আসাম রাজ্যে
এবং বাংলাদেশে বাঙালির সব চেয়ে বড়ো উৎসব
শারদীয়া উৎসব বা দুর্গা পূজা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং একই সঙ্গে বাংলাভাগের ফলে
ভারতের বিভিন্ন অবাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিরাও দুর্গাপূজা করে থাকে।
কিন্তু দুর্গাপূজার প্রকৃত ইতিহাস সামান্য কিছু বাঙালি জানে। দুর্গাপূজা সর্ব
প্রথম চালু হয় বাংলায়। দুর্গাপূজা শুরু হয়
আজ থেকে আনুমানিক ১২০০-১৩০০ বছর আগে।
১২০০-১৩০০ বছর আগে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিলনা।
ঐ সময়ের আগে বঙ্গ প্রদেশে প্রচলিত ছিল
প্রকৃতি ও সত্যের প্রতীক “নবদুর্গা বাকলাবৌ”-এর পূজার। যাঁরা দুর্গা পূজা
করেন তাঁরা নবদুর্গা বা কলাবৌ-এর বিষয়টা একদম জানেন না।
‘নবদুর্গা’- আক্ষরিক
বিশ্লেষণ হ’ল নব-মানে ‘নয়’ দুর্গা-মানে দুর্গতিনাশিনী বা বিপদ থেকে রক্ষাকারী। আর্যরা বা ব্রাহ্মণবাদীরা
ভারতবর্ষে আসবার পূর্বে ভারতীয় মূলনিবাসী তথা অনার্য বা ভারতের আদিবাসিন্দারা এমন ‘নয়’
রকম গাছের সংস্পর্শে এসেছিল যার মধ্যে নানান ধরণের গুণ ছিল। ঔষধীয় গুণ, খাদ্য গুণ
ইত্যাদি। অনার্য ভারতীয়গণ ঐ নয় রকম গাছের পূজা করত দেবী দেবতা জ্ঞানে নয়, ‘উপকারী
জিনিস’-এই হিসাবে। পরবর্বতীকালে বিদেশী আর্যরা গাছের মধ্যে দেবত্ব বা দেবীত্বভাব আরোপিত করে । ভারতের
মূলনিবাসী তথা অনার্য তকমা দেওয়া মানুরা,এই নয় রকম গাছের মধ্যে এই ঔষধীয় ও খাদ্য
দুই গুণই পেয়েছিল। সেগুলি হ’ল-
(১) কলা (২)
কচু (৩) হলুদ (৪) জয়ন্তী (৫) অশোক (৬) বেল (৭) ডালিম (৮) মান (৯) ধান।
কলাগাছ সহজে
সংগ্রহ করা যায়। প্রতীক হিসাবে কলা গাছের আকৃতিও সুন্দর। তাই প্রাচীন ভারতীয় মানুষ
সংঘবদ্ধভাবে ভক্তিভাবে নির্দিষ্ট স্থানে কলাগাছ রেখে এবং কলা গাছের নিচে বাকি ৮টি
গাছের প্রতীকি নমুনা সাজিয়ে জ্ঞানী মানুষ তথা মুনিরা (ঋষিরা নয়) ঐ নয়টি গাছের
গুণাবলী সম্পর্কে মানুষকে উপদেশ দিতেন।
এটিই ছিল প্রাচীন ভারতের নিয়মাবলী। বিশেষভাবে বাংলায়।
নয়টি গাছের
এবং তার ফলের গুণাবলী-
(১) কলাঃ-
(ক) কলা একটি পুষ্টিকর খাদ্য। (খ) পালাজ্বর বা দু’দিন অন্তর জ্বর –তার ঔষধ কলা। (গ) যকৃত, অগ্ন্যাশয়, কিডনি ভাল রাখে কলা। (ঘ)
ডিসেন্ট্রি রোগেরও ভাল ঔষধ কলা (ঙ) মৃতবৎসা
নারীর পক্ষে উপকারী কলা। (চ) শিশুর মাতৃ বিয়োগ হলে ঐ শিশুর মাতৃদুগ্ধের অভাব পূরণ
করে কলা। (ছ) কলা আর তার দ্বিগুণ ওজনের ছাতু এক সঙ্গে মিশিয়ে খেলে স্বাস্থ্য ও
সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায়। কলার এই অশেষ গুণের জন্য কলার অপর নাম ব্রাহ্মণী শক্তি।
তাই আর্যপূর্ববর্তী ভারতীয়রা কলাকে সম্মান করতেন বা পূজা করতেন তার গুণাবলীর জন্য।
(২) কচুঃ-
কচুর খাদ্যগুণও যথেষ্ঠ। বিশেষ করে কিডনির পক্ষে ভীষণ ভাল।
(৩) হলুদঃ-
হলুদ একটি ভাল মশলা। বিষক্রিয়া নাশকও বটে। কাঁচা হলুদ চর্ম রোগের ঔশধ। যেখানে অনেক
লোক জড় হয় সেখানে রোগ ছড়াতে পারে। প্রাচীনবাংলায় তাই জড় হওয়া লোক বাড়িয়ে গিয়ে
কাঁচা হলুদ বেঁটে গায়ে মাখত, যাতে রোগের জীবানু ধ্বংস হয়। অথবা সামাজিক উৎসবের আগে
সবাই গায়ে কাঁচা হলুদ বাঁটা গায়ে মাখত। একই উদেশ্যে বিয়ের সময় ছেলে এবং মেয়েকে কাঁচা হলুদ বেঁটে স্নান করান হয় ঐ রোগ
মুক্তির জন্যই। যা বর্তমানে গাত্রহরিদ্রা নামে পরিচিত।
(৪) জয়ন্তীঃ-
জয়ন্তী মূল ঔষধ তৈরীতে লাগে। জয়ন্তী ধবল কুষ্ঠের মহাঔষধ। সাত রকম কুষ্ঠের চার
রকমের কুষ্ঠ জয়ন্তীর মূলেই সেরে যায়। তাই জয়ন্তী গাছকে মানুষ সম্মান জানাত বা পূজা
করত।
(৫) অশোকঃ-
যাকে হিন্দিতে বলে সীতা অশোক। এই অশোক হল সমস্ত স্ত্রী ব্যাধির মহাঔষধ অশোক গাছ
থেকে মদ বা ঔষধ তৈরী হয় তাকে বলা হয় অশোকারিস্ট বা অশোক সিরাপ।
(৬) বেলঃ-
কাঁচা বেল সমস্ত উদর বা পেটের রোগের সবচেয়ে ভাল ঔষধ। কাঁচা বেল পুড়িয়ে খেতে হয়। একদম কচি বেল রোদে শুকিয়ে গুড়ো বা
ছাতুর ন্যায় করে হাল্কা মধু দিয়ে খেতে হয়। তাহলে দীর্ঘ দিনের আমাশয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
বেলের অশেষ গুণের জন্য এর অপর নাম শ্রীফল।
(৭) ডালিমঃ-
ডালিমের ছাল, শেকড় ও ফুল সমস্তই স্ত্রীরোগের খুব ভাল ঔষধ বর্তমানে ক্যানসার আক্রান্তদের কেমো বা রে দেবার সময় বেশি করে
ডালিম ফলের রস খেতে বলা হয়। ডালিমের এতই গুণ।
(৮) মানঃ-
যাকে বলা হয় ওল। গরমের সময় এর খাদ্য গুণ শরীরকে ঠান্ডা রাখে। অত্যাধিক গরমে
মানুষের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে; সেই সময় মান এর রস ঔষধের কাজ করে। তাই মান খাদ্য এবং
ঔষধ দুই-ই।
(৯) ধানঃ-
ধান থেকে চাল, চিড়া, খই সবটাই মানুষের বেঁচে থাকার উপাদান পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে ভাত পচিয়ে মদ তৈরী হ’ত যা থেকে নানা
ধরনের ঔষধ তৈরী হ’ত।
এই নয় রকমের গাছের বিশেষ গুণ থাকায় মানুষ
এই গাছ গুলোকে শ্রদ্ধা করত। এই নয়টি গাছের একত্রিত নাম ছিল চন্ডিকা শক্তি। এই নয়
রকমের গাছপালা-এর মধ্যে যে চন্ডিকা (শক্তিশালী) শক্তির অভিব্যক্তি তার মিলিত
শক্তির নাম হল নবচন্ডী। আর এই নয় রকম গাছের মিলিত নাম হল নবপত্রিকা। আজ থেকে ১৩০০
বছর আগে বাংলায় এই নবপত্রিকার পূজাই প্রচলিত ছিল। কলাগাছকে কেন্দ্র করে বাকি আটটা
গাছের প্রতীকি জড় করে পূজা করা হত।
আজ থেকে বাংলায় ১৩০০ বছর আগে যখন কাল্পনিক
দুর্গাপূজার প্রচলন হ’ল তখন কৌশল করে দুর্গাপূজাকে প্রচার প্রসারের জন্য গাছের ঔ
নয়টি শক্তিকে নাম দেওয়া হল নবদুর্গা এবং দুর্গাপূজার সঙ্গে কাল্পনিক চরিত্র
লক্ষ্মী, গনেশ, কার্তিক প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে নয় নয়টি গাছের মিলিত শক্তিকে কলাবৌ
সাজিয়ে স্থান দেওয়া হল।
লজ্জার বিষয় বাঙালী সমাজ দুর্গাপূজায় মেতে
ওঠে; কিন্তু ঔ কলা ‘বৌ’ রূপী নবদুর্গার প্রকৃত ইতিহাস জানেনা। প্রকৃতি এবং সত্যের
প্রতীক ঐ কলাবৌ বা নবদুর্গাই যে আসল। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ
সবটাই কাল্পনিক এবং মিথ্যা। সত্যের পূজা না করে বাঙালী মিথ্যার পূজার করে চলেছে।
(সহায়ক
গ্রন্থঃ ‘নমঃশিবায় শান্তায়’ -লেখক আন্দমূর্তি)
0 comments:
Post a Comment