মরিচঝাঁপি-নৈঃশব্দের অন্তরালে-
-জগদীশচন্দ্র
মন্ডল (পৃষ্ঠা সংখ্যা-চ,ছ,জ)
এত বছর পরে কেন?
লেখক নিরঞ্জন হালদার
(আনন্দবাজার পত্রিকার অবসরপ্রাপ্ত সহ-সম্পাদক এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশালের
ভারতীয় শাখার প্রাক্তন সম্পাদক)
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, হাসনাবাদ ও মরিচঝাঁপিতে দণ্ডক-ফেরৎ উদ্ধাস্তুদের গণহত্যা হয়েছে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে, ২৩ বছর পরে হাসনাবাদ ও মরিচঝাঁপিতে গণহত্যার ঘটনা নতুন করে জানানোর কী দরকার? গণহত্যার এই কালো ইতিহাস বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসা প্রয়োজন
ইতিহাসকে পুরানো ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও অপরাধীদের শাস্তি
দেওয়ার জন্য। বামফ্রন্ট সরকারের
চাপে ঘটনাগুলি ঘটার সময়ে সংবাদপত্র কার্যত কিছুই ছাপতে পারেনি। গোটা মরিচঝাঁপি
আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে, ৪
দিনে ৩০টি লঞ্চে করে অধিবাসীদের অন্যত্র
সরিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে রেখে, অনেককে
প্রেপ্তার করে, নেতাদের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি
করে সরকার গণহত্যার কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে দেননি। ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট হাটু জলের মধ্যে আমি যখন নেতাজী নগরে যাই, তখনও মরিচঝাঁপি ঘিরে পুলিশ মোতায়েন।
নেতাজী নগরে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা আমার গহণা উদ্ধার করতে পারলে অর্ধেক তাদের
দেব, এই শর্তে পুলিশ আমাকে নেতাজী নগরে নিয়ে যায় এবং পরে কুমিরমারীতে নামিয়ে
দেয়। স্বভাবতই আমি ছবিও তুলতে পারিনি এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে না পারায়
অ্যামনেস্টি ইণ্টারন্যাশানালকে অভিযোগ জানানো সম্ভব হয়নি উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল
সমিতির সম্পাদক রাইহরণ বাড়ৈ মরিচঝাঁপিতে অপারেশানের আশঙ্কা করে, সযত্নে রক্ষার জন্য আমাকে একটি
বাণ্ডিল দিয়ে যান। তাতে কী আছে, আমি খুলে দেখিনি, বহুবছর তিনি না আসায় উৎসুক্যবশত বাণ্ডিলটি খুলে আমি তাজ্যব বনে যাই। তার
মধ্যে দণ্ডক ফেরৎ উদ্বাস্তুর উপর নৃশংসতার সব তথ্য রয়েছে। এই বইয়ের পরিশিষ্টে
সেই তথ্যগুলি ছাপানো হয়েছে (পৃ ৮৩–১৪৮)।
দ্বিতীয়ত, তফসিলী সম্প্রদায়ের নিজস্ব নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনের করুণ পরিণতিও
উদ্বাস্তু আন্দোলনের একটি ইতিহাস। দুঃখের
বিষয় ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা
হচ্ছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন, তারাও নমঃশুদ্র ও পৌণ্ডক্ষত্রিয়দের পরিচালিত এই আন্দোলনের ইতিহাসের রচনার
কোনো চেষ্টা করেননি। বরং চিরদিনের মত এই ইতিহাসকে
চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। UN High Commission for Refugees এর টাকায় এক প্রাক্তন নকশাল নেতা ডঃ রণবীর সমাদ্দার তার
নিজস্ব সংগঠন Calcutta Research Group এর উদ্যোগে
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনার করেছিলেন। সম্প্রতি সেমিনারের পেপারগুলি
নিয়ে ঐ সংগঠনের ডঃ প্রদীপ কুমার বসু সম্পাদিত Refugees in West Bengal নামে একটি বই ছাপা হয়েছে। এই বইতে
সি-পি-আই (এম) পরিচালিত ইউ-আর-সিকে উদ্বাস্তু আন্দোলন্দের একমাত্র সংগঠন বর্ণনা
করা হয়েছে। মরিচঝাঁপির উদ্ধাস্তু আন্দোলন ও গণহত্যা একটি পাদটীকায় স্থান
পেয়েছে। ডঃ রণবীর সমাদারের Marginal Nations নামে বইটিও উদবাস্তুদের
নিয়ে। সেই বইটিতেও মরিচঝাপিতে গণহত্যার কোনো উল্লেখ নেই। লেখক জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল
ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বাস্তু আন্দোলনকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন। এই বইটি
উদ্বাস্তু আন্দোলনেরও একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও বটে।
"১৯৬০ দশকের শেষার্ধে মিজোরামে “সৈন্য বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন" জারি হওয়ার পর সৈন্যবাহিনী নাগরিকদের
উপর যে অত্যাচার চালায় তা সুপ্রীম কোটের মামলায় শুধু যে স্বীকার করে নেওয়া
হয়েছে তাই নয়, প্রায় তিরিশ বছর
বাদে মিজোরামের নাগরিক অধিকার রক্ষা সংগঠনের দায়ের করা মামলায় প্রথমে গৌহাটি
হাইকেটে পরে সুপ্রীম কোর্ট ভারত সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩০ হাজার পরিবারকে মোট
প্রায় ১৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ ২০.৩.৯৫ তারিখে দেন। ভারত সরকার
১৯৯৫ সালের ১৯মে সরকারী নির্দেশনামা (৪/১/৯২Mz) মারফৎ সেই অর্থ মঞ্জুর করেছেন।”-অধ্যাপক সুজাত ভদ্র। ( পৃঃ 48)
এত বছর পরে জ্যোতি বসুর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে
অনুষ্ঠিত গণহত্যার বিবরণ প্রকাশের অন্য কারণও আছে। ১৯৭৫ সালে পাশ হয় UN Declaration of
the protection of All Persons from Torture and Other Cruel, Inhuman or
Degrading Treatment or Punishment. এই ঘোষণা অনুসারে "responsibility is placed on the state to provide
the machinery for complaints, trials and compensation." (Torture in
Greece. The First Torturers Trial, 1975. Amnesty International) রাষ্ট্রপুঞ্জের ঐ ঘোষণার ৯ ধারায় বলা হয়েছে, "wherever
there is reasonable ground to believe that an act of torture as defined in
article-1 has been committed, the competent authorities of the state concerned
shall promptly proceed to an impartial investigation even if there has been no
formal complain." (Tor
ture in Greece. P.8) international Committee
of the Red Cross জাতীয় গণহত্যার তদন্ত করতে পারে।
দ্বিতীয়
মহাযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ আদালতে জার্মান নাৎসীদের বিচার হয়। গ্রীসে সামরিক
নেতাদের বিচারের জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘নুরেমবাগ প্রিন্সিপলস' দুটি
ধারা উদ্ধৃত করে। Nurembers Principles দুটি ধারা হচ্ছেঃ Article 3. The fact
that a person acted as Head of State or as responsible official does not
relieve him of responsibility for committing any of the offences defined in
this code.
Article 4: The fact that a person charged
with an offence defined in this code acted pursuant to an order of his
government or of a superior does not relieve him of responsibility in
international law, if in the circumstances at the time, it was possible
for him not to comply with that order. (ঐ Torture in Greece, P. 5.)
“১৯৭৮
সালে খমের রুজ শাসনকালে কম্বোডিয়ার গণহত্যার জন্য পলপট এবং তার সঙ্গীদের বিচারের
ব্যবস্থা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল টমাস
হ্যামারবাগ নিজে কম্বোডিয়াতে গিয়ে গণহত্যার মামলার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্ৰহ
করেন। কম্বোডিয়াতে আলোচনা চলছে যে, বিচার রাষ্ট্রপুঞ্জের
আস্তর্জাতিক ' অপরাধ বিচারালয়ে হবে, না
কম্বোডিয়ার বিচারব্যবস্থায় হবে। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, মরিচঝাঁপিতে
গণহত্যা হয়েছিল ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে"। —অধ্যাপক সুজাত
ভদ্র। (পৃঃ-১৭৮)
এই ধারাগুলি
অনুসারে দেশে দেশে গণহত্যার বিচার হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে চিলিতে সামরিক বাহিনীর প্রধান
পিনোশেত নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে। তারপর ক্ষমতা ছাড়ার পর তার
অপরাধের বিচার শুরু হয়। ইংলণ্ডের আদালতে এবং চিলিতে অসুস্থতার মিথ্যা সার্টিফিকেট
দেখিয়ে তিনি স্পেনে ও চিলিতে অপরাধের বিচার এড়িয়ে যান। কাজেই এতদিন পরেও
মরিচঝাঁপির হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের গণহত্যার বিচারের দাবি খুবই সঙ্গত হবে।
হাসনাবাদে সে সমষে উদ্বাস্তুদের খেতে না
দিয়ে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেই সময়ে হাসনাবাদ লঞ্চ ইউনিয়নের সম্পাদক সি-পি-আই কর্মী আমার মেজদা
প্রশাস্ত হালদার পরিস্থিতি বর্ণনা করে
আমাকে এক হৃদয়-বিদারক চিঠি লেখেন। কমুনিস্ট কর্মী হিসাবে তিনি একদা
খুলনা ও যশোহর জেলার যে সব নমঃশূদ্র ও পৌণ্ডক্ষত্রিয় চাষীদের মধ্যে আন্দোলন করেছিলেন। তাদের অনেকেই মরিচঝাঁপিতে বাসিন্দা
হয়েছেন। তিনি নানাভাবে তাদের সাহায্য করেছেন। জগদীশ মণ্ডল আমাকে লেখা ঐ চিঠিটি
পড়ে ঐ দিন থেকে মরিচঝাঁপি আন্দোলনের সঙ্গে
যুক্ত হন,
প্রয়াত সন্তোষ কুমার মল্লিক ও প্রয়াত শক্তি সরকারের
অনুগামী হয়ে কাজ করেছেন। তিনি এই বইটি লিখে গণহত্যার কালো ইতিহাস হারিয়ে যেতে
দেন নি। সেজন্য তাকে ধন্যবাদ।
২০ জানুয়ারি, ২০০২ নিরঞ্জন হালদার ( আনন্দবাজার পত্রিকার অবসরপ্রাপ্ত সহ-সম্পাদক এবং
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখার প্রাক্তন সম্পাদক। )
0 comments:
Post a Comment