Sunday, 28 September 2014

// // Leave a Comment

বুদ্ধ হরিচাঁদ ও আম্বেদকর-এর আন্দোলনের সম্পর্ক

বুদ্ধ হরিচাঁদ ও আম্বেদকর-এর আন্দোলনের সম্পর্ক
                                                                                                                            জগদীশচন্দ্র রায় 
মতুয়া আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন প্রায়ই দেখতে পাই যে, মতুয়া আন্দোলনের সঙ্গে বুদ্ধকে  এবং আম্ববেদকরকে কেন সংযুক্ত করা হচ্ছে। বিষয়টাকে সাধারণ দৃশটিতে বিশ্লেষণ করলে কিন্তু সঠিক তাৎপর্যকে অনুধাবন করা যাবে না । কারণ, যেকোন ঘটনার পিছনে যেমন কারণ থাকে, আর সেই কারণের সঙ্গে জুড়ে থাকে তার অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন 
     তো আমরা প্রথমেই দেখে নেই মতুয়া আন্দোলন বা হরি-গুরুচাঁদের সঙ্গে বুদ্ধের কি সম্পর্ক আছে ।
     আমি প্রথমেই এই ধরনের প্রশ্ন কর্তাদের অনুরোধ করব যে, তাঁরা যেন যুক্তিবাদী মানসিকতা  নিয়ে মতুয়া আদর্শকে বিচার বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেন । আর এই বিচার বিশ্লেষণের জন্য তাদের 'হরিলীলামৃত'কে গভীর ভাবে অধ্যায়ন করা দরকার । তা না হ'লে এই লেখা তাদের কাছে তেমন একটা সুরাহা জনক নাও হ'তে পারে । কেন লীলামৃত পড়তে বলছি ? কারণ, 'লীলামৃত'-এর ১৫ পৃষ্ঠায়- 'শ্রীশ্রীহরিঠাকুরের জন্ম বিবরণ'(প্রথম সংস্করণ ১৩২৩ বঙ্গাব্দ) -এ লেখা আছে -                                                   বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য।
                                      যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবর্তীণ ।।
অর্থাৎ বুদ্ধের কামনাকে পূর্ণ করার জন্য হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম হয় । এখন প্রশ্ন হচ্ছে বুদ্ধের কি  কামনা ছিল ? বুদ্ধের কামনাকে জানতে বা বুঝতে হ'লে বুদ্ধিজমকেও জানতে হবে । তা না হ'লে এর গভীর মর্ম অনুধাবন করা সম্ভব হবেনা ।
    অমরা এখানে দেখতে পাই যে,-বুদ্ধের কামনা কে পূর্ণ করার জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর জন্ম গ্রহন করেছেন বা অবতীর্ন হয়েছেন । আর্থাৎ বুদ্ধিজমের ভাবনায় বা বিচার ধারাকে পূর্ণ করার জন্যই তিনি অবতীর্ন হয়েছেন । অর্থাৎ বুদ্ধিজমের পরবর্তী stage হচ্ছে মতুয়াইজম । আর্থাৎ মূল হচ্ছে বুদ্ধিজম । সেটাকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নবরূপায়ন হচ্ছে মতুয়াইজম কেন এই ভবনা ? হ্যা, এই ভাবনার গভীরে প্রবেশের পূর্বে আমরা জেনে নেই বুদ্ধের কামনা সম্পর্কে-
চরথং ভিখ্‌খবে চারিক্কম্‌
বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায় ।  
অন্তানু হিতায়, লোকানুকম্‌পায় ।
আদি কল্যান, মধ্য কল্যান, অন্ত কল্যান
বুদ্ধ পাঁচ জন ভিক্ষুর সামনে এই গাথা বলেন । তাদের তিনি বলেন, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা চলতে চলতে ভিক্ষা করবে । আর্থাৎ পায়ে হেটে ভিক্ষা করবে । আর এই চলার সঙ্গে জনে-জনে বহুজনদের কাছে গিয়ে প্রচার করবে, যে বিচার ধারা প্রারম্ভে কল্যানকারী, মধ্যে কল্যানকারী, আর অন্তেও কল্যানকারী হবে । আর যেটা অল্পজনের হিত্‌ সংরক্ষণকারী নয় । যেটা হবে বহুজন হিতায় এবং বহুজন সুখায় ।
    আমরা আরও দেখতে পাই বুদ্ধের মূল আদর্শ হচ্ছে- সমতা, স্বতন্ত্রতা, বন্ধুতা ও ন্যায় ।
তো হরিচাঁদ ঠাকুরও সেই আদর্শ বা কামনায় অনুপ্রানিত হয়েছিলেন । আর সেই আদর্শকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা পরিবর্তন করে তিনি 'বৌদ্ধ ধম্ম'-এর নবরূপায়ন করলেন 'মতুয়া ধর্ম' নাম দিয়ে ।  এখানে আরও একটি কথা থেকে যায়, যে বুদ্ধের কামনাকে পূর্ণ করার কথা । অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুর ভাবনায় এটাও ছিল যে, বুদ্ধের কামনা বা আদর্শ পূর্ণতা পায়নি । পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি । সেই অপূর্ণতাকে তিনি পূর্ণ করতে চান । তাই তার আবির্ভাব । আর এই অপূর্ণতাকে তিনি পূর্ণ করার জন্য বুদ্ধের বিচার ধারার প্রচারক ভিক্ষুদের ন্যায় মতুয়া প্রচারক নির্মান করেন । যাদেরকে পাগল, গোসাই নাম দেন । তবে তিনি জানালেন, এই মতুয়া ধর্ম প্রচারের জন্য সন্যাসী হতে হবেনা । তিনি গৃহ ধর্মকে বেশী প্রাধান্য দিলেন । আর বললেন, হাতে কাম আর মুখে নাম করার জন্য কারণ সেই সময়ে অলস বৈষ্ণবরা বিনা পরিশ্রম করে শুধু নাম বিলিয়ে পরগাছা হয়ে চলত । যেটা সমাজ তথা দেশের পক্ষে ক্ষতি কারক ।  

    এবার আমরা দেখে নেই হরিচাঁদ ঠাকুর বুদ্ধিজমকে কেন নবরূপায়ন করে মতুয়াইজম  করলেন ।
   প্রথমেই আমি বলেছি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হরিচাঁদ ঠাকুর এটা করে ছিলেন । কিন্তু সেই সময়টা কি ছিল ? সেই ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে বুদ্ধিজমের বীজ । যে বীজটার মধ্যে বুদ্ধিজমের সব গুণ নিহীত ছিল । কিন্তু কালের বিবর্তনে যেমন অনেক প্রাণীও পরিবর্তীত হয় । তেমনি এই কালের বিবর্তনে বুদ্ধিজমকে পরিবর্তীত করে মতুয়াইজম করতে হয়েছিল হরিচাঁদ ঠাকুরকে




     এবার আসি সেই কালের বিবর্তন বা সেই ইতিহাস সম্পর্কে ।
    আপনারা এটা নিশ্চয় জানেন যে, হরিচাঁদ ঠাকুরকে পতিত পাবন বলা হয় । পতিত এবং পাবন । দু'টি শব্দ । পতিত অর্থাৎ উপর থেকে নীচে পড়ে যাওয়া । আর পাবন অর্থাৎ উদ্ধার করা । পতিত পাবন অর্থাৎ নীচে পড়ে যাওয়াকে টেনে তোলা বা উদ্ধার করা । এবার কথা হচ্ছে- কে বা কারা  কিভাবে পড়ে গিয়েছিল ? কোথা থেকে পড়ে গিয়েছিল ? কে বা কারা এই পড়ে  যাওয়া বা ফেলে দেওয়ার কাজ করেছিল ? কেন ফেলে দিয়েছিল ?
   ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই বাংলায় প্রায় চারশ বছর পাল রাজত্ব ছিল । আর এই পালরা ছিল বুদ্ধিষ্ট । তাই 'গুরুচাঁদ চরিত'-এ আমরা দেখতে পাই-
                     পালবংশ মহাতেজা   বঙ্গদেশে যবে রাজা
                             বৌদ্ধ ধর্ম্ম আসিল এদেশে ।
                     বৌদ্ধ রাজ-ধর্ম্ম মানি বঙ্গবাসী যত প্রাণী ।
                             বৌদ্ধ ধর্ম্মে দীক্ষা নিল শেষে ।।
                                                       (পৃষ্ঠা নং ২৮ ,পঞ্চম সংস্করণ ২০০৯ )
 আর এই পালরা কেমন ছিলেন?
                       পালরাজন্য অকুতোভয় বীর্যবান।
                       অসুর মানব নমঃশূদ্রের সন্তান ।।
                       কাশ্যপের গোত্র এরা সুদাসের জ্ঞাতি ।
                       অশোকের রক্তধারক নীতিতে স্থিতি ।। (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃঃ নং ১২১)

আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বঙ্গে যে সংখ্যাবহুল জাতিটি বসবাস করছে তাদের বর্তমান নাম নম: শুদ্র এই ‘নমঃ’ কথার উদ্ভব হয়েছে বুদ্ধিজম থেকে । বুদ্ধের বন্দনায় আমরা দেখতে পাই- নমঃ তৎস ভগবতো আরা হত, সম্‌ভাশ্যং বুদ্ধশ্য... 
বঙ্গে ব্রাহ্মনদের অনুপ্রবেশে যারা ‍বাধা দিয়েছিল তারা বর্তমানের নম:শুদ্রদের পূর্বপুরুষ ছাড়া অন্য  কেউ হতেই পারেনা নম:শুদ্রদের পূর্বপুরুষেরা গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিল  বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল নৃপতিদের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণরা নম:শুদ্রদের উপর অত্যাচার করার সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি; কিন্তু বঙ্গে কর্ণাটকী ব্রাহ্মন সেন বংশের রাজত্ব স্থাপিত হলে ব্রাহ্মণরা সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে এবং সেই সময়ই সর্ব প্রথম নম:রা ব্রাহ্মনদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল কারণ সেই সময় রাজা বল্লাল সেননের আদেশে তার সৈন্যরা অহিংসমন্ত্রে দীক্ষিত বৌদ্ধদের ধরে ধরে নির্বিচারে হত্যা করেছিল,কারণ তার ঘোষণা ছিল-বাঙলার সমস্ত বৌদ্ধরা হয় ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহন করবে, নয়ত মৃত্যুকেই বরণ করবে। এই সময়ে বহু বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহন করে প্রাণ রক্ষা করে এবং সর্বনিম্ন শূদ্র বর্ণে স্থান পায়। পরবর্তীতে তারা মাহিষ্য, পৌন্ড্র ইত্যাদি নামে চিহ্নিত হয় । বাকি বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের কাছে নতি স্বীকার না করে কেঊ যুদ্ধে প্রাণ দেন, কেঊ পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। আবার কেঊ কেঊ রাতারাতি মুসলমান হয়ে যান। সে জন্য তাদের ‘শুনে মুসলমান’ বলা হয় । তাঁরা আশ্রয় নেন বর্তমান কালের যশোর, খুলনা,  ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিহ প্রভৃতি নদী-নালা, খাল-বিল, নলখাগড়ার জঙ্গল পূর্ণ দুর্গম  অঞ্চলে । অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রাণ বাঁচাতে তাঁদের পূঁথিপত্র নিয়ে পালিয়ে যান তিব্বতে । কেউ কেউ চীনেও চলে যান। এই কারণে পরবর্তীকালে বাংলাভাষার আদি নিদর্শন বৌদ্ধসাহিত্য “চর্যাপদ” আবিষ্কৃত হয় তিব্বতে । আর যারা যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরাই পরবর্তীকালে নমঃজাতি বলে পরিচিত হন। এই কারণেই বল্লাল সেন এবং তার বংশবদ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই নমঃজাতির লোকদের প্রতি অর্থাৎ বৌদ্ধদের প্রতি ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁদের চন্ডাল নামে আখ্যায়িত করে সমাজে জল-অচল অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করে। (*১)  নম:দের  প্রতি এই অমানসিঅত্যাচার চালানোর ফলে, কেউ কেউ আবার পরে   প্রা বাচাঁনোর  ভয়ে নিজস্ব ধর্ম এবং সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন  তাই আমরা দেখতে পাই-  
                            নমঃজাতি প্রতি বাড়ে তীব্র অত্যাচার ।
                            ধর্ম আচরণে নাহি রহে অধিকার ।।
                            নিজধর্ম বৌদ্ধধর্ম নারে আচরিতে ।
                            না পায় ঢুকিতে হিন্দু ধর্ম আঙিনাতে ।।
                                                              (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃঃ নং ১২৭)

             এই ঘটনা কোন মতেই খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে ঘটতে পারেনা
 পরে কিছু নম:রা ব্রাহ্মণ্যধর্মে যোগ দিলে তারা ব্রাহ্মণদের মুঠির মধ্যে এসে যায় তখন সুযোগ পেয়ে  ব্রাহ্মণরা তাদের মনের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে সঞ্চিত বিষ নম:দের উপর বর্ষণ করতে শুরু করে ব্রাহ্মণরা নম:দেরকে তাদের (ব্রাহ্মনদের) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত চতুর বর্ণ ব্যাবস্থার বাইরে বের করে দেয়      
                            নিজ ধর্ম হারিয়েছে আরো বহুজাতি।  
                           হিন্দুধর্ম মাঝে তারা পেয়ে গেল স্থিতি ।।
                           পাল রাজাদের জাতি নমঃজাতি যারা ।
                           ধর্মহীন হয়ে বঙ্গে পড়ে রল তারা ।।
                                                             (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃঃ নং ১২৭)

 আর এদের অর্থাৎ এই ধর্মহীনদের  নাম দেয় পতিত, অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ গত আটশ বছর ধরে  এই নম:রা পতিত অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ অবস্থায় পতিত হওয়ার ফলে প্রতিহিংসাকারী ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, অপমান, অবহেলা ঘাত এবং অবরোধ সহ্য করতে করতে বঙ্গের একদা সংখ্যাবহুল এবং শক্তিশালী জাতিটি আজ করুন অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে  
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যাতা কলে প্রবেশের পূর্বে নম:দের ধর্ম কি ছিল সেটা পাল যুগের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ  করলে অতি সহজে বোঝা যায় বর্তমান কালের পরিস্থিতিতে বিচার করে যদি একজন হিন্দু তথা ব্রাহ্মণকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করার কথা মনে করা হয়, সেটা যেমন কল্পনা করা সম্ভব নয়, যেহেতু সেখানকার অধিকাংশ জনগণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী তেমনি পশ্চিমবঙ্গে একজন বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীকে মুখ্যমন্ত্রী বানানোর কথা কল্পনা করাও অবাস্তব বর্তমানে যদি এই পরিস্থিতি হয় তাহলে অষ্টম শতাব্দীতে বাংলার জনগণ সর্বসম্মতিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ধর্মপালকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিলে, সেটা কোন মতেই সম্ভব হত না যদি সেই সময় সেখানকার  অধিকাং জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী না হতেন এখানে আমাদেরেএকটা কথা মনে রাখতে হবে যে গুপ্ত এবং সেন বংশ অস্ত্রবলে বঙ্গ দখল করেছিল কিন্তু ধর্ম পালকে বঙ্গের জনগণই রাজসিংহাসনে  বসিয়েছিলেন এর থেকে প্রমানিত হয় যে সেই সময় বঙ্গের বা বাঙলার অধিকাংশ জনগন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন
অতি প্রাচিন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত নম:রা বাঙলার একটি সংখ্যা-বহুল জাতি তাদের মধ্যে থেকে বহু সংখ্যক লোক ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার পরেও তারা পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা মিলে হিন্দুদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি অষ্টম শতাব্দীতে যদি বাঙলার অধিকাংশ লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হন তাহলে সেই সময় নম:দের ধর্ম, ‘‘বৌদ্ধ ধর্ম(ধম্ম)’’ ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না তাই আমরা একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে হিন্দু ধর্মের খোঁয়াড়ে প্রবেশের পূর্বে নম:রা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল আর বল্লাল সেনের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে স্বীকার করে নিয়েছিল
বল্লাল সেনের অত্যাচারের কথা বংশ পরম্পরায় আটশ বছর পরে এখনও নম:দের মস্তিষ্কে বিরাজ করছে নম:রা মনে করে যে বল্লাল সেনের তাদের পূর্ব পুরুষকে ব্রাহ্মণ থেকে চন্ডাল  বানিয়েছিল এই ধারনা সম্পুর্ণ রুপে ভুল বল্লাল সেনের  তাদের(নম:) পূর্ব পুরুষকে ব্রাহ্মণ থেকে নয় ,বৌদ্ধ ধম্মের ম্মানজনক স্থান থেকে বিচ্যুত করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অসম্মান জনক স্থান স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছিল কোন পরাজিত জাতির এরকমই পরিনতি হয়
ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী সেন-রা বঙ্গে ছিল বহিরাগত নম:রা যদি তাদের সঙ্গে একই ধর্মাবলম্বী হতেন তাহলে তাদের (নম:) উপর অত্যাচার করে দূর-দূরান্তে তাড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না বল্লাল সেন পালবংশকে হটিয়ে বাঙলা দখল করেছিল বল্লাল সেন বাঙলা দখল করে নম:দের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিল কারণ নম:রা পাল বংশের সমর্থক ছিলেন  পাল এবং নম:রা স্বধর্মবলম্বী ছিল, এই সন্দেহই বল্লাল সেনকে নম:দের প্রতি অত্যাচারী করে তুলেছিল বল্লাল সেন বিদেশ থেকে ব্রাহ্মণ ডেকে এনে এবং বঙ্গের কোন কোন জাতিকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজের দলে টেনে সংখ্যা ভারী করেছিল
আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে যে গুপ্ত যুগে খুব সামান্য সংখ্যক ব্রাহ্মণই বাংলায় প্রবেশ করেছিল আর পাল রাজত্বের শেষদিন পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের কিংবা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়নি তাই সেই সময় বাংলার সব থেকে বড় জাতি নম:রা কোনমতেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুগামী হতে পারে না হিউয়েন সাঙ্-এর ভ্রমন কাহিনি (629- 645) খৃষ্টাব্দ থেকে এটাও জানা যায় সেই সময় বাংলায় দেব মন্দির থাকলেও বৌদ্ধ বিহারের সংখ্যাই বেশী ছিল তিনি বাঙলার সব জাগায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক দেখেছিলেন (*২)
এই আলোচনা থেকে আমরা নির্দিধায় আমরা এই সমাধানে আসতে পারি যে, নম:রা বা আজকের নম:শুদ্রদের পূর্বপুরুষরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন যে কথা হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর উদ্ভাবনী দৃষ্টিতে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । তাই তিনি বুদ্ধের কামনা কে পূর্ণ করার জন্য ধর্মহীন পতিতদের স্বধম্মে প্রত্যাবর্তনের জন্য ধর্মহীন পতিত হওয়া থেকে উদ্ধার করার জন্য মতুয়াধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন । এতক্ষণে আমরা জানার চেষ্টা করলাম বুদ্ধের বা বৌদ্ধ ধম্মের সঙ্গে হরিচাঁদ ঠাকুর বা মতুয়া ধর্মের সম্পর্ক ।   

এবার আমরা দেখে নেই বাবা সাহেবের সঙ্গেই বা কি সম্পর্ক আছে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর বা মতুয়া ধর্মের সঙ্গে
        বাবা সাহেব ১৯৩৫ সালে ঘোষণা করেন 'আমি হিন্দু হয়ে জন্ম গ্রহন করেছি । যেটা আমার হাতে ছিল না । অর্থাৎ আমার কিছু করার ছিলনা । তবে আমি হিন্দু হয়ে মৃত্যু বরণ করব না ।' আর তিনি ১৯৫৬ সালের অশোক বিজয় দশমীর দিন বৌদ্ধ ধম্ম স্বীকার করেন  বা স্বধম্মে প্রত্যাবর্তন করেন । স্বধম্মে কেন বলছি ? কারণ বাঙলার নমঃদের যেমন ব্রাহ্মণরা ধর্মহীন করে  পতিত করে রেখে ছিল । তেমনি ভারত বর্ষের বাকীদেরও  অর্থাৎ যারা ব্রাহ্মণ ধর্ম স্বীকার  করেননি তাদের অস্পৃশ্য করে রেখে ছিল । এদের ও কোন ধর্ম ছিল না । কিন্তু পূর্বে এঁরা সকলে          বৌদ্ধ ধম্মের ছিলেন । তাই সামগ্রিক ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পূর্বের বৌদ্ধরা পরবর্তিতে  পতিত ও অস্পৃশ্যে পরিনত হন । বাবা সাহেব এই ইতিহাস খুব ভাল করে জানতেন তাই তিনি  স্বধম্মে প্রত্যাবর্তন করেন । এবং এই অস্পৃশ্যদের কে পূনঃরায় বৌদ্ধধম্ম স্বীকার করানোর প্রকৃয়া শুরু করেন । 

 এবার আমরা একটু অন্য ভাবে ভেবে দেখি । হরিচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলনকে অগ্রগতি দেওয়ার  কাজ করেন  গুরুচাঁদ ঠাকুর । তিনি সব চেয়ে বেশি জোর দেন শিক্ষা আন্দোলনের উপর । যার ফলে সমাজের অবহেলীত লোকেরা মুক্তির আলো দেখতে পান । অনেক সুফল উপভোগ করেন । তবে সেই আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করেন মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল । তিনি তাঁর কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠাতে সক্ষম হনবাবা সাহেব সংবিধানের মাধ্যমে এই  অবহেলীত, পতিত, অস্পৃশ্যদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে তাদের উত্তরণের রাস্তাকে সুদূর প্রসারী করেন । সাংবিধানিক নিরাপত্তা দেন Scheduled Caste, Scheduled Tribe এবং Other Backward Class নাম দিয়ে । যার ফলে এই লোকেরা এই সাংবিধানিক সুবিধা গ্রহন করে শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রগতি করেছেন
  তো এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি হরিচাঁদের আন্দোলন কে অগ্রগতি দেন গুরুচাদ ঠাকুর । গুরুচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলনকে আরো প্রসারিত করেন মহাপ্রাণ । আর এই আন্দোলনকে সাংবিধানিক ভাবে রক্ষা করার জন্য মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠান । আর আজও আমরা যারা শিক্ষায় ও চাকরীতে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি  সেটা এই সাংবিধানিক কারণে । তো আমরা বিচার ধারা এবং বিচার ধারার প্রগতির আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখ্‌তে পাচ্ছি যে, একটা সুদৃঢ় যোগসুত্র রয়েছে । কারো অবদান অন্যের থেকে কম বা বেশি নয়।  একটার সঙ্গে একটা অঙ্গা অঙ্গিভাবে জড়িত । একটার অনুপস্থিতে অন্যটা ও লুপ্ত প্রায় । তাই আমরা আন্দোলনের দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি যে, হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুররের সঙ্গে যেমন বুদ্ধের  আন্দোলন ও ধম্ম মিলেমিশে আছে, তেমনি এর সঙ্গে জুড়ে আছে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মাধ্যমে বাবা সাহেব কে সংবিধান সভায় প্রেরণের সংগ্রাম । আর এই সংবিধানের রক্ষা কবচ  হচ্ছে সমস্ত আন্দোলনের ফসল । যে ফসল কে আমরা উপভোগই করে চলেছি । কাঁরা কিভাবে  আমাদের এই সুবিধা এনে দিলেন সেটা আজ আমরা জানতেও আগ্রহী নই উল্টা সেই সব মহামানবদের অবদানকে একদিকে উপভোগ করছি আর অন্য দিকে তাঁদের কে অস্বীকার করছি । এটা একটা জাতির ক্ষেত্রে মারাত্ত্বক cancer স্বরূপ । অচিরেই এর প্রভাব পড়তে বাধ্য । তাই আশাকরি, আপনারা আপনাদের  উদ্ধারের জন্য যে মহামানবরা আজীব আমরণ সংগ্রাম করেছেন তাদের যোগ্য সম্মান দেবেন এবং তাদের প্রদর্শিত আদর্শকে অনুসরণ করে pay back to the society করে ঋণ মুক্ত হওয়ার কাজে ব্রতি হবেন ।
----------------------------------------------------------------------------------
তথ্য সূত্রঃ *১ অতীতের সন্ধানে- সুধীর রঞ্জন হালদার।
          *২ ‘‘অদল বদল এর ১৫ই  গষ্ট সংখ্যার’’ সত্যরঞ্জন তালুকদারের লেখা চন্ডাল নমশূদ্র এবং কাশ্যপগোত্র-তাদের পরিচয় কী ?   
  



Read More

Monday, 22 September 2014

// // 1 comment

মুলনিবাসী রাজা অসুর--মনি মোহন বৈরাগী

মূলনিবাসী রাজা অসুর
দুর্গা উৎসব না অসুর নিধন যজ্ঞ ? কে এই অসুর ? সত্যিই কি অসুর অশুভশক্তির প্রতিক ? নাকি প্রকৃত অশুভশক্তির লোকেরা তাদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুলনিবাসী মহান রাজাকে বা তাদের বংশধরদের মহান কর্মকে লুকিয়ে রেখে উল্টা তাদের বদনাম করছে ? 
এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্যনের জন্য -
-মনি মোহন বৈরাগীর লেখা বই-
বৌদ্ধ ও মতুয়া ধর্মের আলোয় অবৈদিক ধর্মীয় সামাজিক সংস্কৃতি-এর থেকে তুলে দিলাম (পৃ:নং (17,18)
বিষয়:- অতীত অন্ধকারে চাপা পড়া ভারতীয় ইতিহাস ও ধর্মসংস্কৃতি-র সমীক্ষা ও পর্যালোচনা
প্রাগার্য তাম্র যুগে অর্থাৎ ৫০০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়ে সাম্যবাদী পূর্ববুদ্ধ সনাতনী ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস বড়ই অন্ধকারাচ্ছন্ন । কারণ স্বার্থান্বেষী নর্ডিক আর্যরা ভারতীয় সনাতনী পূর্ববুদ্ধদের যাবতীয় ইতিহাসই ধ্বংস করে দেয় । তবে নর্ডিক আর্য আগমনের বহু পূর্বে অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ৫০০ বৎসর পূর্বে আলপাইন মানবগোষ্ঠীর পূর্ববুদ্ধ সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষেরাই ভারতবর্ষের সিন্ধুনদকে কেন্দ্র করে যে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন উহাই সিন্ধু সভ্যতা নামে খ্যাত । এই আলপাইন মানবগোষ্ঠীর এক বৃহত্তম অংশকে আবার অসুর জাতিও বলা হয় । ভারতীয় প্রাচীন হিন্দুধর্ম গ্রন্থগুলিতে বারবারই এই অসুর জাতির উল্লেখ পাওয়া যায় । আবার প্রাচীন পারস্যের অসুর সভ্যতাই ছিল বিশ্বের এক বিস্ময় । কারণ একথা ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য যে তাম্রযুগে আবার প্রাচীন পারস্যের এই অসুর সভ্যতাই হল বিশ্বের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা । আর যে সময়ে তথাকথিত পশুপালক নর্ডিক আর্যরা ছিলেন ভারতীয় অসুরদের কাছে যাযাবর পশু-মানব বলেই গণ্য।’(ভোলগা থেকে গঙ্গা; রাহুল সাংকৃত্যায়ন; অষ্টম মুদ্রণ;সেপ্টেম্বর২০০৫;পুরুধান; পৃ:৬৫) সিন্ধু সভ্যতা প্রবর্তনের সমসাময়িককালে এই অসুর জাতির এক বৃহত্তম অংশ পূর্ব ভারতেও এক নতুন সভ্যতা প্রবর্তন করেন । বগুড়ার করতোয়ানদী কূলে অবস্থিত মহানগড়ের ধ্বংসাবশেষই এ সত্যের প্রকৃত প্রমাণ । তাই দেখা যায়, পশ্চিম ভারতে সিন্ধুনদকে কেন্দ্র করে আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুর জাতির দ্বারা যেমন গড়ে উঠেছিল নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতা, ঠিক সমসাময়িক কালে অনুরূপভাবে পূর্বভারতেও কেবলমাত্র আলপাইন অসুর জাতির দ্বারা করতোয়া এবং গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল উন্নত নগরকেন্দ্রিক আর এক অসুর সভ্যতা । যার অধীশ্বর ছিলেন আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুর জাতির গর্বিত কোল, শরব, পুলিন্দ, ডোম, চন্ডাল(নম:), পৌন্ড্র, কৈবর্ত্য, ইত্যাদি সম্প্রদায় সমূহ । অতীত বঙ্গ রাজ্যে ছিল যেমন নম:দের (চন্ডাল) আধিপত্য, আসামের কামরূপে ছিল কৈবর্ত্যদের আধিপত্য, তেমনি পৌন্ড্রদের আধিপত্য ছিল পৌন্ড্র রাজ্যে । সপ্তম শতকেও কামরূপের রাজারা দানবাসুর, হাটকাসুর, সম্বরাসুর, রত্নাসুর, নরকাসুর প্রভৃতি অসুরদের পূর্বপুরুষ বলে পরিচয় দিতেন । মহাভারতের আদি পর্বেই দেখা যায় অসুররাজ বলির পাঁচ পুত্রের নামানুসারে পূর্বভারতের পাঁচটি রাজ্যের নামকরণ হয় যথাক্রমে -অঙ্গ(পূর্ব বিহার), বঙ্গ, কলিঙ্গ(সুবর্ণরেখা নদী থেকে গোদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত উড়িষ্যা ও অন্ধ্রের কিছু অংশ),সুহ্ম ও পুন্ড্র (দক্ষিণ বঙ্গ) এছাড়া প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ আর্য মঞ্জুশ্রী মূলকল্প’-তেও বলা হয়েছে বঙ্গদেশের মানুষ অসুর ভাষাতেই কথা বলে । অসুরানাং ভবেত বাচা গৌড়পুন্ড্রোদ্ভবা সদা: নীহার রঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থেও এ কথা স্বীকার করেছেন । বৈদিক যুগে আর্যরা বিহারের মিথিলা পর্যন্ত দখল করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পূর্ব ভারতের আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুর জাতির কাছে বারবার পরাজিত হয়ে পূর্বভারত দখলের যাবতীয় স্বপ্ন ত্যাগ করতে বাধ্য হয় । কারণ এই অসুর জাতির যেমন ছিল এক বিশাল হস্তীবাহিনী তেমনি ছিল তাদের শক্তিশালী এক রাজতন্ত্রও। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে(/১৪) এই অসুর জাতির রাজতন্ত্রের মধ্যে একমাত্র প্রাচ্যদেশেই এই একরাট বা সম্রাট ব্যবস্থার প্রচলন ছিল । যেহেতু অসুর রাজতন্ত্রের সর্বাধিনায়ককে সম্রাট বলা হত সেহেতু বৌদ্ধ যুগে অসুর জাতির বংশধর হিসাবে সম্ভবত: মৌর্য শাসকদের সর্বাধিনায়কের উপাধীও ছিল সম্রাট । তবে সুচতুর নর্ডিক আর্যরা, পরাজিত আলপাইন অসুর জাতির লোকদের দেবতার ভয়ে ভীত করে চিরদিনের মত দাবিয়ে রাখতে তাদেরই সৃষ্ট কাল্পনিক দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটিয়ে এই অসুরদের রাজত্ব বঙ্গদেশে ব্যাপকভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন; যা ভারতবর্ষের আর কোন রাজ্যে দেখা যায় না । কাল্পনিক এই দুর্গার আসরে অসুরদের এমন ভাবে তারা অত্যাচারী এবং অশুভ শক্তির ধারক ও বাহকরূপে প্রকাশ করেন যাতে ভবিষ্যতে কোন বাঙালি যেস ঘৃণা ভরে কোনদিনও জানতে না চান যে আসলে তারাই হল আলপাইন অসুর জাতির মানুষ । কখনও যেন তাদের মনে এ প্রশ্ন না আসে যে অসুর নামে কোন মানবজাতি সত্যিই কোন দিন ছিল কি না-আর যদি থাকে তবে কারাইবা ছিল এই অসুর জাতির মানুষ, কিইবা ছিল তাদের ধর্ম ।……………… 
Read More

Sunday, 21 September 2014

// // 1 comment

বাবা সাহেবের ধম্ম পরিবর্তন, ধম্ম চক্র প্রবর্তন ও ও সম্রাট অশোকের বিজয়া দশমী -লেখক- জগদীশ রায়

          

              বাবা সাহেবের ধম্ম পরিবর্তন, ধম্ম চক্র প্রবর্তন ও সম্রাট অশোকের বিজয়া দশমী। 
লেখক-জগদীশ রায় (মুম্বাই) 
    আমরা জানিযে, 14October 1956 সালে বাবা সাহেব ডঃ বি. আর. আম্বেদকর  বৌদ্ধধম্ম গ্রহণ করেছিলেন বা স্বধম্মে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। 
    কিন্তু এখানে বিশেষ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বাবা সাহেব 14October 1956 হিসাবে বৌদ্ধধম্ম গ্রহণ করেননি। তিনি 1935 সালে 13October মহারাষ্ট্রের ইওলা (Yeola) তে ঘোষণা করেন যে, ‘আমি হিন্দু ধর্মে জন্ম গ্রহণ করেছি, যেটা আমার হাতে ছিলনা। (অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে আমি কিছু করতে পারিনা।) কিন্তু আমি হিন্দু হয়ে মৃত্যু বরণ করব না।’ এই ঘোষণার স্থলকে  বাবা সাহেব নাম দিয়েছেন–‘মুক্তিভুমি’
    এখন কথা হচ্ছে,1935 সালে ধর্ম পরিবর্তনের কথা ঘোষোণা করেন, কিন্তু তিনি 1956 তেই কেন ধর্ম পরিবর্তন করেন? 1935 থেকে 1956 পর্যন্ত তো অনেক সময়। তবে তিনি 1956 কেই কেন ধম্মপরিবর্তনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ? এর পিছনে কি কোন বিশেষ কারণ আছে ?
    হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী বাঙ্গালিদের দুর্গা পূজার মধ্যে একদিন হয় দশমী। প্রচলিত কথায় বলা হয়, রাম, রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হয় ; তাই এই বিজয় দশমী। বাস্তবে কি তাই? দুর্গা পূজার ইতিহাস তো সেদিনকার। আর রাম বিজয় প্রাপ্ত হয়েছিল বলে বিজয়া দশমী করা হলে বাংলার  বাইরে কেন হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী বাঙালিরা ছাড়া অন্য কেউ এই পূজা করেন না?
আসলে এই বিজয়া দশমীর ইতিহাসকে Encounter করা হয়েছে। আর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের সুবিধা মত কাহিনীতে রূপান্তারিত করেছে।  
    এবার আসি আসল প্রসঙ্গে। মহারাষ্ট্রে বিশেষ করে বৌদ্ধধম্মে বিশ্বাসীরা বিজয়া দশমীকে খুব করে পালন করেন। কারণ বাবা সাহেব বিজয়া দশমীর দিন ধর্মান্তর করেছিলেন। কিন্তু সাধারণতঃ প্রচার হয় যে, বাবা সাহেব 14 October ধর্মান্তর করেছিলেন। এর পিছনে আসল ঘটনা কি ?   
    আপনারা অনেকেই হয়তঃ জানেন যে, সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধম্ম গ্রহণ করেছিলেন কলিঙ্গ  বিজয়ের পর। সম্রাট অশোকের জীবনে ধম্মানুভুতির মাইলস্টোন হিসাবে কলিঙ্গ বিজয়কে মনে করা হয়। তিনি যে দিন এই বৌদ্ধধম্ম গ্রহণ করেন, সেই দিনটি ছিল আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীর দিন। তিনি হিংসার নিতি থেকে মুক্ত হয়ে বিজয় প্রাপ্ত হন। সারা দেশে পালিত হোল উৎসব। শারদোৎসব। অর্থাৎ শরৎকালের বিজয় উৎসব। সম্রাট অশোকের ধম্মবিজয় উৎসব। যা পরবর্তীকালে সারা ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয়  উৎসবে পরিণত হয়।  বাবা সাহেব কিন্তু 14 October  মনে করে ধর্মান্তর করেননি। তিনি একাধারে সম্রাট অশোকের প্রতি যেমন শ্রদ্ধার্পণ করেন। তেমনি 1956 সালের October মাসের দশমীর দিনকে ঐতিহাসিকভাবে স্মরণ করেন এবং সবাইকে এই দিনটির গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাই October মাসের দশমীর দিনটাকে বৌদ্ধিক ভাবনায় বলা হয় অশোক বিজয় দশমী সেই অশোক বিজয় দশমীকে Encounter করে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিজয় দশমীতে রূপান্তরিত করেছে।   
     এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, বাবা সাহেব ১৯৩৫ সালে ঘোষণা করেন তিনি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করবেন; কিন্তু তিনি অন্য ধর্ম গ্রহণ করার জন্য ১৯৫৬ পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করলেন? 
এর পিছনে নিশ্চয় বাবা সাহেবের গভীর ভাবনা থেকে থাকবে। সেই গভীর ভাবনা হচ্ছে- ১৯৫৬ সালে গৌতম বুদ্ধের সঙ্ঘে প্রবেশের ২৫০০ সাল পূর্ণ হচ্ছিল। যেটা ঐতিহাসিকভাবে খুবই মহত্বপূর্ণ।

      গৌতম বুদ্ধের জন্ম  খৃষ্টপূর্ব ৫৬৩ সালে। তিনি ১৯ বছর বয়সে সঙ্ঘে প্রবেশ করেন। যেটা সঙ্ঘের নিয়ম ছিল। বুদ্ধের এই সঙ্ঘে প্রবেশের ২৫০০ বছর পূর্ণ হচ্ছিল ১৯৫৬ সালে।
(৫৬৩-১৯=৫৪৪+১৯৫৬=২৫০০) এই দিনটিকে ঐতিহাসিকভাবে স্মরণ করার জন্য বাবা সাহেব ১৯৫৬ তে বৌদ্ধম্ম  গ্রহণ করেছিলেন বা স্বধম্মে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। 
এবার এই Encounter এর ইতিহাস কিছুটা আলোচনা করা যাক। তারপর আবার এই দিন সম্পর্কে আলোচনায় আসা যাবে।
     ব্রাহ্মণরা যখন প্রতিক্রান্তি করে অর্থাৎ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ দ্বারা সম্রাট অশোকের নাতি(চতুর্থ পিড়ি)  বৃহদ্রথকে বধ করে (185 খ্রীষ্টপূর্বাব্দে) ব্রাহ্মণ্যবাদের সুত্রপাত করে। তারপরেই রামায়ণ লেখা হয়। এর পূর্বে রাম  আর রাব ছিলই না। রাবণের যে  প্রতীক তাঁকে রাক্ষস বলে, অশুভ-এর প্রতীক বলে ঘোষণা করে আর রাবণের ‘দশমুখ’ দেখানো   হয়। আসলে বুদ্ধিজমে ‘দশপারমিতা’-এর বেশী মান্যতা দেওয়া হয়। আর সে জন্য রাবকে দশ  মুখওয়ালা বানিয়ে দেখানো হয়েছে। আট, নয় বা এগার মুখ ওয়ালা কেন দেখানো হয় নি ?   
    ব্রাহ্মণরা যখন প্রতিক্রান্তি করে তখন থেকে ভারতে বিজয়া দশমী উৎসব হিসাবে  পালন করে। আর সম্রাট অশোক যে বিজয় প্রাপ্তি করেন দশমীর দিন তাকে সমাপ্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র চালু করে। মারাঠীতে যাকে ‘দসরা’ বলে, আর হিন্দীতে লোকেরা একে ‘দশ্‌হরা’ বলে। যেটা দশ মুখওয়ালা রাবণকে ‘দশহরা’ নাম দিয়েছে, আর বিজয়া দশমীকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। আর এর  জন্য রাবণকে জ্বালানোর প্রকৃয়া করে।
    ফিরে আসি পূর্বের আলোচনায়। বাবা সাহেব যে ধম্ম গ্রহন করেছিলেন, এখানে 14 October  কিন্তু মহত্ত্বপূর্ণ নয়। মহত্তপূর্ণ হচ্ছে-‘অশোক বিজয়া দশমী’র যেটা 1956 সালে হয়েছিল। আর দিনটি ছিল 14 October. তাই আমাদেরকে বাবা সাহেবের ধর্মান্তরের দিনকে 14 October না বলে ‘অশোক বিজয় দশমী’-এর দিন বলা বা লেখা উচিত। কারণ বাবা সাহেবের উদ্দেশ্যে ছিল আশ্বীন মাসের সারদ শুক্লা বিজয়া দশমীকে পালন করা। কারণ সম্রাট অশোকের ধম্মপরিবর্তন দিন ইংরেজী তারিখ হিসাবে পালিত হয়নি। কিন্তু 1956 সালের 14 October ছিল অশোকা বিজয়া দশমীর দিন। তাই আমাদেরও বিজয়া দশমীকে সম্রাট অশোকের ‘অশোক  বিজয় দশমী’ দিন এবং বাবা সাহেবের ‘ধম্মচক্রপরিবর্তন’ দিন হিসাবে পালন করা উচিত।  কারণ বাবা সাহেব যে দিন অর্থাৎ এই অশোক বিজয় দশমীর দিন ধর্মান্তর করেন সেটা কে ‘ধম্মচক্র প্রবর্তন’ দিন বলা হয়। অর্থাৎ সম্রাট অশোকের বৌদ্ধধম্ম গ্রহণের দিন হচ্ছে অশোক বিজয়া দশমী, আর এই অশোক বিজয়া দশমীর দিন বাবা সাহেব যে বৌদ্ধধম্ম গ্রহণ করেন তাকে নতুন নাম দেওয়া হয় ‘ধম্মচক্র প্রবর্তন’ দিন । ধম্মচক্র প্রবর্তন এর অর্থ হচ্ছে- বৌদ্ধ ধম্মের চাকা (সমতা, স্বতন্ত্রতা, বন্ধুতা ও ন্যায়) কে গতিশীল করা। এই ইতিহাস আমাদের জানা ভীষণ দরকার বলে মনে করি। কারণ সঠিক ইতিহাসই সঠিক দিশা নির্দেশ করে।আশা করি, এই লেখাটি আমাদের  বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে সাহায্য করবে ।  
                             ____________________________
Read More