লেখক-জগদীশচন্দ্র রায়
বর্তমান ভারত বর্ষের সব থেকে বড় ধর্ম হচ্ছে হিন্দুধর্ম। এদেশের
বেশিরভাগ জনগণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁরা তাঁদের ধর্মকে বিশ্বাস করে আবার অনেকে নিজেকে ‘হিন্দু’ বলে গর্ববোধও করেন। যেটা স্বাভাবিক।
এখানে এই আলোচনায় কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত করার
উদ্দেশে নয়। আর
আঘাত লাগলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ, কখনও কখনও বিশ্বাসে আঘাত লাগাটাও স্বাভাবিক হয়, যখন সেটাকে যুক্তিতর্ক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা না করা হয়। অথবা সুদীর্ঘ দিনের বিশ্বাসকে এক ঝট্কায় ছুঁড়ে ফেলা অতসহজ নয়। তবুও বিশ্বাসের পাথরকে মূ্র্তিতে রূপান্তরিত করতে হলে
যুক্তি-তর্ক-তথ্য ও বিশ্লেষণের ছেনি ও হাতুড়ি দিয়ে সতর্ক ভাবে কাটার চেষ্টা করলে মূ্র্তিতে রূপান্তরিত হবে।
আমি কেবলমাত্র সেই বিশ্বাসের পাথরকে মূ্র্তিতে রূপান্তরিত
করার চেষ্টা করছি।
মূ্র্তি হবে কি না সেটা জানি না, সেটা পাঠকরা বলতে পারবেন। আমি আবার বলছি কারো ব্যক্তিগত
বিশ্বাসে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য, সঠিক তথ্যকে আপনাদের সামনে তুলে ধরা।
(১) হিন্দু শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ:
প্রথমেই আমরা চেষ্টা করি হিন্দু শব্দের
উৎপত্তি ও অর্থ সম্পর্কে জানতে। হিন্দু শব্দটি হচ্ছে পার্শি শব্দ। যার অর্থ হীন্ বা নীচতা। উর্দু অভিধানে ‘হিন্দু’ অর্থ
চোর, ডাকাত, ম্লেচ্ছ, ভৃত্য, দাস ইতিয়াদি উল্লেখিত আছে। ‘হিন্দু’ শব্দটি বৈদিক কোন ধর্ম গ্রন্থে নেই। সংস্কৃতের কোনো মৌলিক
গ্রন্থ, যথা- শ্রুতি,পুরাণ, বেদ,গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদিতে
‘হিন্দু’ শব্দটি নেই।
(২) ভারতীয়দের কেন হিন্দু নাম দেওয়া হল?
ভারতবর্ষে ৭ম শতাব্দি থেকে ১২ম শতাব্দি পর্যন্ত বিশেষ করে
বিদেশি মুসলমানদের আক্রমন হয়। আক্রমনকারী মুঘলরা ভারতবর্ষ জয় করার পর
এদেশে তাদের রাজত্ব স্থাপিত হয়। এদেশে শাসন কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে তারা দুটো প্রধান সমস্যার সম্মুখীন হয়।
প্রথমত,-তারা ভাবল, ‘আমরা বিজেতা, আমরা এখানের লোকদের পরাজিত করেছি, সুতরাং পরাজিতদের সঙ্গে আমাদের রক্ত ও সংস্কৃতি যেন মিশে না যায়।
কারণ, যারা পরাজিত হয় তারা হীন্ হয়। তাদের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি ও রক্ত মিশে যাওয়া উচিত নয়। এটা হল মিশ্রণের সমস্যা।’
দ্বিতীয়ত, এই পরাজিতদের
পৃথক রাখার জন্য তাদের নতুন পরিচয় দেওয়া। এটা স্বভাবিক যে পরাজিতদের কেউ ভাল নাম দেবে না। তাই আক্রমনকারী মুঘলরা এদেশের জনগনকে
‘হিন্দু’ (পরাজিত, হীন্, নীচ্) নাম দিল। যেমন-বৈদিকবাদীরা ভারতের মূলনিবাসীদের নাম দিয়েছে-দাস, দস্যু, দানব, রাক্ষস ইত্যাদি। পরবর্তিতে এরা SC, ST, OBC দের ENCOUNTER করার জন্য নাম দিল –হরিজন, গিরিজন, বনবাসি ও দলিত।
এবিষয়ে বাবা সাহেব Dr. B.R AMBEDKAR, ANNIHILETION OF CASTE এ বলেছেন-
“সর্ব প্রথম এই চরম সত্যকে অবশ্যই স্বীকার
করতে হবে যে, হিন্দু সমাজ একটি পৌরাণিক কাহিনি। হিন্দু নামটা একটা বিদেশি নাম। ‘হিন্দু’ নাম (আক্রমনকারী) মুসলমানদের দেওয়া নাম। স্থানীয় অধিবাসী এবং মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্র বোঝানোর
জন্য তারা স্থানীয় অধিবাসীদের ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করেছিল। ভারতে মুসলমানদের আক্রমনের পূর্বেকার
সময়ে সংস্কৃত ভাষার লেখকদের ‘নেশন’ (জাতি) সম্বন্ধে কোন ধারনা ছিলনা। তারা ভারতীয় অধিবাসীদের একটি সাধারণ
নামকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। তাই হিন্দু সমাজের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। এটা শুধু জাতিগুলির একটি সমষ্টিগত নাম।”
‘The first and foremost thing
that must be recognized is that Hindu Society is a myth. The name Hindu is
itself a foreign name. It was given by the Mohammedans to the natives for the
purpose of distinguishing themselves. It does not occur in any Sanskrit work
prior to the Mohammedan invasion. They did not feel the necessity of a common
name because they had no conception of their having constituted a community.
Hindu society as such does not exist. It is only a collection of castes.’
(৩) বৈদিকবাদীরা
নিজেদের হিন্দু বলে স্বীকার করেনি কেন?
ঐ সময়ের বৈদিকবাদীরা নিজেদের হিন্দু বলে মেনে নিতে অস্বীকার
করে। তারা
বলল, যদি তোমরা
পরাজিতদের ‘হিন্দু’ অভিহিত কর তাহলে আমরা ‘হিন্দু’ নই। যেভাবে তোমরা আক্রমণকারী এবং বিজেতা ঠিক একইভাবে আমরাও আক্রমণকারী এবং আক্রমণ
করে আমরাও এখানকার লোকদের পরাজিত করেছিলাম। এর প্রমান হচ্ছে মুসলমান শাসকরা যখন জিজিয়া কর অর্থাৎ ধর্ম
কর (RELIGIOUS TAX) চালু
করেছিল সেটাতে বৈদিকবাদীদের ছাড় (EXEMPTION) ছিল। বৈদিকবাদীদের এই যে ছাড় ছিল যা প্রমাণ করে যে, তারা নিজেদের হিন্দু বলে মেনে নিতে স্বীকার করত না।
বর্ণাশ্রমে বেষ্টিত ভারতীয়দের হিন্দু বলে
প্রমাণিত করার রাস্তাটা প্রসারিত হতে শুরু করে ১৯২১ সাল নাগাদ। প্রকৃত পক্ষে বৈদিকবাদীরা
এখনও নিজেদের হিন্দু মনে করেনা। এর কারণ পরে বলছি। ১৯১৫ সালে তারা নাসিকে ‘হিন্দু মহাসভা’ এর স্থাপন করে।
কিন্তু কেন? সে ইতিহাস ধাপে
ধাপে প্রকাশ করছি। তার
আগে আমরা দেখছি রাজা রামমোহন রায় ২০ আগষ্ট ১৮২৮ সালে
‘ব্রাহ্ম সমাজ’ স্থাপন করেন। দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ সালে ‘আর্য সমাজ’ স্থাপন করেন। এই ‘আর্য সমাজ’ স্থাপনের পিছনেও একটা ষড়যন্ত্র আছে। কে এই দয়ানন্দ সরস্বতী? যিনি গুজরাটি ব্রাহ্মণ। তিনি রাজকোট জেলার টংকারা নামক জায়গা
থেকে বোম্বে (মুম্বাই) আসেন। বোম্বেতে কেন? কারণ, ১৮৭৩সালে মহারাষ্ট্রে মহাত্মা
জ্যোতিরাও ফুলে ‘সত্যশোধক সমাজ’ স্থাপণ করেন। ‘সত্যশোধক’ অর্থাৎ সত্য
কলুষিত হয়ে গিয়েছিল বৈদিকবাদীদের ষড়যন্ত্রে, তাই তাকে শোধন
করা দরকার পড়ে। কিন্তু চক্রান্তকারীর ষড়যন্ত্রের অভাব
হয় না। তাই ‘সত্যশোধক’ কে ENCOUNTER কারার জন্য এই ‘আর্য সমাজ’-এর স্থাপন।
এখানে একটা জিনিস আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কেউই হিন্দু সমাজ
স্থাপন করেননি।
অর্থাৎ ১৯২১সালের পূর্ব
পর্যন্ত ব্রাহ্মণ বা আর্য নামেরই সংগঠণ নির্মাণ হয়েছে। তাঁরা হিন্দু নামের কোন সংগঠণের নির্মাণ করেনি।(ব্যতিক্রম
থাকলেও থাকতে পারে)।
অর্থাৎ হিন্দু নামকে স্বীকার করেনি।
(৪) বৈদিকবাদীরা কখন ও কেন হিন্দু বলে মেনে নিল বা হিন্দু বলে
প্রচার শুরু করল?
ইংলন্ডে ১৯১৭-১৮সাল নাগাদ প্রাপ্ত বয়ষ্কের ভোটাধিকারের আন্দোলন শুরু হয়। কারণ ইংলণ্ডেও সকল প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ভোটাধীকার ছিল না। ওখানে যারা ট্যাস্ক দিত এবং যারা
লেখাপড়া শেখা লোক ছিল তাদেরই ভোটাধীকার ছিল। আন্দোলন ইংলণ্ডে শুরু হয় আর বিপদের ঘন্টা ভারতের বর্ণবাদীরা
শুনতে পায়। কেন? কারণ, ঐসময় ভারত ছিল ব্রিটিশদের অধীন। ভারেতর বৈদিকবাদীরা মনে করল যে, ইংলণ্ডে যদি প্রাপ্ত বয়ষ্কের ভোটাধীকার
চালু হয়ে যায়, তাহলে তো সেটা
ভারতেও লাগু হবে।
কারণ, ব্রিটেনে যে আইন পাশ হবে ভারতেও সেটা যেকোনো সময় লাগু হতে পারে। আর ভারতে যদি প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ভোটাধিকার আইন লাগু হয়, তাহলে ভারতে যে শুদ্র (OBC) ও অতিশুদ্ররা (SC & ST) আছে এদের সংখ্যা অনেক গুণ বেশি হওয়ায় ভোটাধিকার হিসাবে নির্বাচন হলে যাদের সংখ্যা বেশি রাজ ক্ষমতা তাদেরই হবে। বৈদিকবাদীরা তাদের বর্ণের হিসাবে ভোট চাইলে সব বর্ণবাদী যদি এক জনকে ভোট
দেয় সেটা 3.5% থেকে ৭%-ই হবে। ফলে তারা কোন নির্বাচন ক্ষেত্রেই জিততে
পারবেনা। এর
ফলে তাদের যে হাজারো বছর ধরে শাসনপ্রনালী
চলে আসছিল সেটার সমূহ বিপদ ঘনিয়ে আসবে। কিন্তু হিন্দু নামের সংগঠন হলে নেতা ব্রাহ্মণই হবে, আর সমস্ত SC,ST, OBC -দেরকে নিজেদের CONTROL -এ রাখতে পারবে। এই ভাবনা থেকে তারা ১৯১৫ সালে নাসিকে ‘হিন্দু মহাসভা’এর স্থাপন করে। আর ১৯২৫ সালে R.S.S. অর্থাৎ
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-এর স্থাপন করে। এই ‘হিন্দু’ শব্দ হচ্ছে
বর্ণবাদীদের একটা রণকৌশলের মাধ্যম। তাই তারা প্রচার করছে ‘গর্ব করে বল আমি হিন্দু’।
(৫) ব্রাহ্মণরা সত্যি সত্যি কি নিজেদের হিন্দু বলে মনে করে?
এবার ভাবুন ব্রাহ্মণরা সত্যি সত্যি কি নিজেদের হিন্দু বলে
মনে করে? যদি করে তবে
তারা ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতির মেয়েকে কেন বিয়ে করেনা? ব্যতিক্রম ২/১ টা ধরার মধ্যে নয়, তার পিছনেও গভীর ষড়যন্ত্র থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু কখনও তাদের মেয়েকে অন্য জাতের
ছেলের সঙ্গে যখন বিবাহ দেয়, সেটাও রণকৌশল হিসাবে। কারণ, অন্য জাতের ছেলেটি যদি মেধাবী হয় তাহলে সে যাতে তার সমাজ নিয়ে না ভাবে- তাকে তাদের গোলাম বানিয়ে রাখার জন্য তুলে নেয়। ব্রাহ্মণরা শুধু SC,ST, OBC-দের সামনে এসে বলে যে তারাও হিন্দু। কিন্তু লোক গণনায়ও তারা নিজেদের ধর্ম ও জাত দুটোই ব্রাহ্মণ বলে লেখায় বেশির ভাগ।
বর্ণবাদীদের অনুসারে ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যাখ্যা কি?
বর্ণবাদীরা প্রচার করছে ‘গর্ব করে বল আমি হিন্দু’। এই ভাবে বহুজনদের কাছে এসে শ্লোগান দেয়। কারণ এটা ওদের কথা। ওদের মনে আশঙ্কা শুরু হয়েছে যদি কেউ
জানতে চায় যে, কীসের ভিত্তে গর্ব করা হবে? ‘হিন্দু’ নাম তো আক্রমনকারী মুসলমানদের দেওয়া? তাই তারা প্রচার করছে ইতিহাসের পাতায়
পাতায় যে, সিন্ধু থেকে
হিন্দু হয়েছে। কীভাবে? মুসলমানরা ফার্সি ভাষায় কথা বলত। ফারসিতে ‘স’ ‘হ’ –এর মত উচ্চারিত হয় বা তারা ‘স’ কে ‘হ’ বলত, তাই সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়েছে। কিন্তু এদের কথা তর্কের খাতিরে মেনে
নিলেও, সেটাতো
মুসলমানদের দেওয়া নাম। তা
নিয়ে হিন্দুদের গর্ব করা কী করে সম্ভব? কারণ
হিন্দুত্ববাদীরাতো সব সময় মুসলমানদের বিরোধিতা করছে।
যদি সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকে তবে সেটা শুধু সিন্ধু
অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিল। সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের লোকদের ক্ষেত্রে
হিন্দু নামাঙ্কণ হওয়ার দরকার পড়ে না। সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের লোকদের ক্ষেত্রে হিন্দু নামে চিহ্নিত
হওয়ার আসল কারণ হচ্ছে- সারা ভারতে
(আক্রমনকারী) মুসলমানদের শাসন কায়েম ছিল। তাই হিন্দু শব্দের প্রসার সারা ভারতব্যাপী হয়েছিল। আর
একটা কথা সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকলে শুধুমাত্র সিন্ধু অঞ্চলে এই নাম সীমাবদ্ধ
থাকা উচিত ছিল। এতে প্রমাণ হয় সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়নি। আরও একটা কথা ‘স’ কে যদি ‘হ’ বলত তাহলে‘স’ দিয়ে আরও যে সব শব্দ আছে সেগুলোরও পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু সেটা তো হয়নি। যেমন মুসলমান উচ্চারণ ‘মুহলমান’ হয়নি। পার্সি ‘পার্হি’ শিয়া
‘হিয়া’ সুন্নি ‘হুন্নি’ বা সুলেমান ‘হুলেমান’ হয়নি।
যদি সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকে তাহলে হিন্দুধর্ম অনুসারে ‘গঙ্গা’নদীর পরিবর্তে সিন্ধু নদীকে পবিত্র হিসাবে মানা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা মানা হয় না। অতএব সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়েছে একথাটি
মিথ্যা। * (এ বিষয়ে নতুন তথ্য হাতে এসেছে দেখুন
Subject- সিন্ধু থেকে হিন্দু না হিন্দু থেকে সিন্ধু?https://roymulnivasi.blogspot.com/2022/04/blog-post_16.html)
(৬) মুসলমানরা কি
তলোয়ারের জোরে হিন্দুদের মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে ছিল? যদি করে থাকে তখন বর্ণবাদীরা কি করছিল?
ইতিহাস অনুসারে আমরা জানতে পারি যে, ৩য় শতাব্দীর পর বর্ণব্যবস্থা জাতিব্যবস্থায় রূপান্তরিত
হয়েছে।
জাতিব্যবস্থার সঙ্গে বৈদিকবাদীরা অস্পৃশ্যতার সৃষ্টি ও প্রয়োগ করে তাদের কট্টর
বিরেধীদের তারা অস্পৃশ্য ঘোষণ করল। ৭ম শতাব্দীতে আমরা ইসলামের অনুগামী সুফি-সন্তদের কেরালা অঞ্চলের আশে পাশে দেখতে পাই। এই সময় কেরালায় প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। ইসলাম কেরালার মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভারতে
আসে। সুফি-সন্তদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ভারতে
শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে ইসলামের অনুগামীরা রাজত্ব করার মানসে ভারতে
আসতে থাকে। তারা এদেশের মানুষদের যুদ্ধে পরাজিত করে।
ভারতের বৈদিকবাদীরা বলেছে যে, মুসলমানরা তরবারির শক্তিতে ভারতীয়দের
ইসলাম ধর্মে পরিবর্তিত করেছে। এটা কতটা সঠিক? না কি তারা নিজেদের অক্ষমতাকে লুকিয়ে রাখার জন্য এই চালাকি করছে? আমরা এটা জেনেছি যে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম দেশের সাধারণ জনগণকে নীচ্ মনে করত। তারা শিক্ষা, সম্পত্বি ও
অস্ত্রের অধিকার হরণ করেছিল এবং এদেশের মূলনিবাসীদেরকে অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করেছিল। তাদের সঙ্গে পাশবিক অত্যাচার করত। এই সব পাশবিক অত্যাচার থেকে রক্ষা
পাওয়ার জন্য লোকেরা ধর্মান্তর করে ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে
মুসলমানরা তরবারির জোরে এদেশের জনগণকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে যে, তখন বৈদিকবাদীরা কী করছিল? তারা তাদের ধর্ম রক্ষা করার জন্য কোনো
সংগ্রাম বা আত্মত্যাগ বা আত্মবলিদান করেছিল কি? যদি করে থাকে তাহলে দু’চারজন তো শহীদ হয়ে থাকবে? কিন্তু তার কোনো নাম গন্ধ আজ পর্যন্ত
কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুঁজে পওয়া যাবে কী করে, থাকলে তবে তো? যদিও গীতায় তারা লিখে রেখেছে-‘ধর্ম রক্ষোতি রক্ষম’। অর্থাৎ তুমি ধর্মকে রক্ষা কর, ধর্ম তোমাকে রক্ষা করবে। সুতরাং জীবন দিয়ে বৈদিকবাদীদেরকে ধর্ম পরিবর্তন রোখা উচিৎ ছিল এবং তার জন্য
আত্মবলি দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে ধর্ম পরিবর্তন রোখার জন্য বৈদিকবাদীরা কোনো প্রকার
আত্মত্যাগ করেছে এরকম কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না।
‘এ বিষয়ে,
স্বামী বিবেকানন্দ আরো স্পষ্ট এবং তীক্ষ্ম ভাষায় দরিদ্র এবং নিম্নবর্ণের
হিন্দুদিগের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মূলগত কারণ সম্বন্ধে বলেছেনঃ ভারতবর্ষে দরিদ্রগণের
মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশি কেন? এ কথা বলা মুর্খতা যে, তরবারির সাহায্যে
তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহনে বাধ্য করা হইয়াছিল। বস্তুত জমিদার ও পুরোহিত বর্গের
হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল।’
(তথ্যঃ জাতি-ধর্ম ও
সমাজ বিবর্তন – যতীন বাগ্চী পৃ. ৩২)
আশ্চর্য জনক কথা হচ্ছে যে, যাদের উপর তরবারির জোরে ধর্ম পরিবর্তন করার আরোপ লাগানো হয়েছে, তাদের প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ব্রাহ্মণদের হাতে। ঔরঙ্গজেবের উপদেষ্টা ছিল শ্রীধর কুলকার্ণী নামক ব্রাহ্মণ। উল্টা বৈদিকবাদীরা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজার বদনাম করে বলেছে, তিনি ‘হিন্দবী’ অর্থাৎ হিন্দু স্বরাজ স্থাপন করেছিলেন। তিনি না থাকলে সকলের ছুন্নত করেদিত মুসলমানরা। কিন্তু ইতিহাস বলছে তিনি বিশেষ কোনো ধর্মের জন্য পক্ষপাতিত্ব কখনও করেননি। কারণ, তাঁর প্রশাসনে তাঁর পরামর্শদাতা ছিলেন কাজী হায়দর নামের একজন মুসলমান। তাঁর সেনাবাহিনীতে ৩০% মুসলমান সেনা ছিল। বাংলায় নবাব হুসেন শাহ্-এর সময়ে ধর্মান্তর ঘটেছে। কিন্তু তখন তার মন্ত্রী ছিলেন সুবুদ্ধি রায় নামের ব্রাহ্মণ। জানিনা তিনি কি সুবুদ্ধি দিতেন। তবে একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, অবিভক্ত ভারতের ৯৮%মুসলমান SC, ST এবং OBC থেকে ধর্মান্তরিত।
(৭) ভারত বা INDIA কে হিন্দুস্থান বলে প্রচার করা হয় কেন?
ভারতবর্ষ বহু ধর্মীয় ও বহু ভাষাভাষীর দেশ। ভারত, সংবিধান অনুসারে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু সেই ভারতের দুটো নাম (ভারত ও INDIA) থাকা সত্বেও এদেশের নামটা প্রচার করা হয় ‘হিন্দুস্থান’ বলে। হিন্দুদের স্থান হিন্দুস্থান। তাহলে সংবিধান অনুসারে দেশটা ধর্ম নিরপেক্ষ থাকল কি
করে? শুধু মাত্র
সরকারীভাবে ভারত বা INDIA বলা বা লেখা হয়।
কিন্তু প্রচার মাধ্যম এবং তথাকথিত দেশপ্রেমী নেতারা হিন্দুস্থান বলেই
প্রচার করেন। যে
রাজনৈতিক পার্টির নাম ‘ভারতীয়’ দিয়ে শুরু তাঁরা
কিন্তু সব সময় হিন্দুস্থানই বলেন। আর আমজনতার কথা কি বলব। তাদের নিজেদের মাথাটাকে তো প্রচার মাধ্যম CAPTURE করে নিয়েছে। প্রচার মাধ্যম যেটা ২৪ ঘন্টা প্রচার করছে, জনতার মুখেও সেই কথা বেরিয়ে আসছে। তাইতো দেখি মুসলমানরাও এদেশটাকে হিন্দুস্থান বলে
চলেছেন। তাই
তো একজন বলেছিলেন যে, এদেশটাকে তো মুসলমানরাও হিন্দুস্থান বানিয়ে দিচ্ছে। INDIRECTLY বৈদিকবাদীদের উদ্দেশ্যকে সফল করছে।
আসলে এসব কিছুর পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। যেটা বাবাসাহেব ড. আম্বেদকর বুঝতে
পেরেছিলেন। তিনি
এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে এরা একদিন INDIA বা ভারতের অর্থকে হিন্দুস্থানে পরিবর্তনকরবে। তাই তিনি PRIAMBALE OF THE CONSTITUTION –এ সেই অর্থটা পরিস্কার করে দিয়ে লিখেছেন –INDIA THAT IS BHARAT.
তবে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের হিন্দুস্থান করার
প্রক্রিয়া নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে। আর সেই প্রক্রিয়াকে জেনে না বুঝে সাধারণ জনগণ ও
অন্য ধর্মাবলম্বীরা সাথ দিচ্ছে। এটা খুবই গভীর ভাবনার বিষয়। তাই আপনাদের জানতে ও বুঝতে হবে যে আপনারা যেটা বলছেন বা করছেন সে বিষয়ে আপনার
বিচার-ধারা কতটা আছে। স্রোতের অনুকুলে চললে আপনি নিজেও একদিন
না বুঝে ভেসে যেতে পারেন। আর যেদিন বুঝতে পেরে পিছন দিকে তাকাবেন তখন দেখবেন প্রতিকূলে ফিরে যাওয়ার আর কোন অবকাশ নেই।
কেউ কেউ বলেন- না, আমরা তো ভালবেসেই দেশটার নাম হিন্দুস্থান বলছি। ভালবাসার এই অযৌক্তিক কথা শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। মানুষ কোন গড্ডালিকার প্রবাহে ভেসে চলেছে! কারন, দেশশুধু মাটিতে নয়। দেশ, গঠিত প্রধানত তার জনগণকে নিয়ে। তারপর তাদের ভাষা-সংস্কৃতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও মতপ্রকোশের সতন্ত্রতা নিয়ে। কিন্তু এর প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু বাধা আর লাঞ্ছনা, অন্যায় আর অবিচার, বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে। হিন্দুস্থান বলে দেশকে ভালবাসা নয় দেশের মধ্যে বিভেদের বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
(তথ্য ১.
দৃষ্টিকোন ও জন আন্দোলন। লেখক- ওয়ামন মেশ্রাম। অনুবাদক- জার্নালিস্ট ভীমরাজ। প্রকাশক – মূলনিবাসী পাবলিকেশান ট্রাস্ট, পুনা,
মহারাষ্ট।
২. মূলনিবাসী বহুজন কি হিন্দু? লেখক, অনুবাদক ও
প্রকাশক- ঐ
(৮) নম: শুদ্ররা কি হিন্দু ছিল?
0 comments:
Post a Comment