“নেড়ে” কথার ইতিহাস: -
ঐতিহাসিক
সুরঞ্জিত দাশ গুপ্ত লিখিত ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থের ৫৪-৫৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ‘ব্রাহ্মণ্য শক্তি ভারতের বৌদ্ধদের প্রতি
এত বেশী অত্যাচার করত যা অতীব দুঃখের। বৌদ্ধরা মাথা মুণ্ডণ বা নেড়া করতেন।
অত্যাচার যখন সহ্য সীমা অতিক্রম করে তখন তাঁরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধদের
বলা হত ‘নেড়ে’। তাই মুসলমানদেরকে অনেক অশিক্ষিত এবং
অজ্ঞ লোকেরা ‘নেড়ে’ বলে থাকেন। এই নেড়ে কথাটি যতদিন থাকবে ততদিন ভারতীয় প্রাচীন হিন্দুদের দ্বারা
বৌদ্ধদের প্রতি অত্যাচারের ইতিহাসকে জীবন্ত করে রাখার সামিল হবে। এই নেড়ে
তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যাবে অধ্যাপক বিনয় ঘোষ লিখিত ‘ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘ গ্রন্থে ।
নেড়ে ও
বৌদ্ধ
‘সেকশুভোদয়া’,
গোবর্ধন আচার্যের লেখা ‘আর্যা সপ্তশতী’ ও ধোয়ীর লেখা ‘পবনদূত’ কাব্যে তৎকালীন
বাঙালী সমাজের বিশদ চিত্র পাওয়া যায়- উচ্চ-বর্ণের হিন্দুরা সেসময় বৌদ্ধদের ও
নিম্ন-বর্ণের হিন্দুদেরকে নিকৃষ্ট জীব বলেই গণ্য করত। সম্ভবত সেনদের মতো রক্ষণশীল
শাসককূলের পক্ষপুটে থেকে সনাতনপন্থী হিন্দুরা প্ররোচিত হয় বৌদ্ধদের প্রতি ঘোর
দুর্ব্যবহারে এবং মূণ্ডিতমস্তক
বৌদ্ধদেরকে ব্যঙ্গ করত ন্যাড়া বা নেড়ে বলে। পরবর্তীকালে এই বৌদ্ধদের অনেক
আচার-রীতি-প্রথা হিন্দুত্বের ব্রাহ্মণ্য আচার-রীতি-প্রথার আড়ালে আত্মগোপন করে- বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব শিবের থান বা মূর্তি বা
পূজাবেদী আছে সেসমস্তই আদতে বুদ্ধের অধিকারে ছিল এবং বুদ্ধই রূপান্তরিত হন বুড়ো
শিবে; চড়কের গাজোনে যারা সন্ন্যাস নেয় তারা পীতবস্ত্র পরিধান করে এবং
ওই পীতবস্ত্রও প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধদের সংসার ত্যাগ করে ভিক্ষুর জীবন গ্রহণেরই প্রতীক।
এভাবে যেমন অনেক বৌদ্ধ আচার-প্রথা তাদের রূপ পাল্টে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুসমাজে শামিল
হয়ে যায় তেমনিই বৌদ্ধদের অনেকে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুদের পীড়নের হাত থেকে আত্মরক্ষার
জন্যে বাংলায় মূসলিম বিজয়ের পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে- তখন রক্ষণশীল হিন্দুরা বৌদ্ধ থেকে ওই সব ধর্মান্তরিত
মুসলিমদেরকেও ন্যাড়া বা নেড়ে বলে অভিহিত করতে থাকে।
বাংলাদেশে যা
হয়েছে তা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা প্রক্রিয়া নয়; সমস্ত হিন্দুস্তান জুড়েই অনুরূপ প্রতিক্রিয়াদি কম-বেশি
হয়েছিল এরকম মনে করার সংগত কারণ আছে। ---- বাংলায় বৌদ্ধদের মতো দক্ষিণ ভারতের
জৈনরাও রক্ষণশীল শৈব হিন্দুদের হাতে নিপীড়িত হয় এং একবার একদিনে আট হাজার জৈনকে
শূলে হত্যা করার কথা তামিল পুরাণেই উল্লিখিত হয়েছে। স্পষ্টতই এসময়টাতে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্ম পরমতসহিষ্ণুতার
আদর্শকে জলালাঞ্জলি দিয়েছিল। (তথ্য- ভারতবর্ষ ও ইসলাম, লেখক- সুরজিৎ দাশগুপ্ত, পৃ. ৫৪-৫৫)
0 comments:
Post a Comment