মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের
জীবনের শেষ ভাষণঃ-
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল
জন্ম -১৯০৪ ২৯জানুয়ারী মৃত্যু-১৯৬৮, ৫ইঅক্টোবর।
আবির্ভাব এক
লক্ষ্মীপূর্ণিমায় তিরধান
আর এক লক্ষ্মীপূর্ণিমায়।
যোগেন্দ্রনাথের
মহাপ্রয়ানের ৩২ বৎসর পরে
২৯
জানুয়ারী ২০০০ ইং
গ্রাম+পোঃ হেলেঞ্চা কলোনীতাং
PIN No 743270
জেলা ২৪ পরগনা উত্তর।
STD No 03215
PHONE No.
264314
হেলেঞ্চা নিবাসী ডাঃ শশধর সরকার মহাশয় বিশেষ অনুরোধের দাবী নিয়ে মহাপ্রাণ
যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলকে ৪/১০/৬৮ ইং তারিখে হেলেঞ্চায় নিয়ে আসেন। পরদিন সাকালে
নির্বাচনী অফিস উদ্বোধন করার জন্য।
ঐ দিন
৪/১০/৬৮ তারিখ সন্ধায় রাতে স্বর্গীয় শ্রীমন্ত সমাদ্দার মহাশয়ের বাড়ীতে আসেন।
উল্লেখ্য স্বর্গীয় সমাদ্দার মহাশয়ের পাঁচ পুত্র সর্বশ্রী সুরেন্দ্র নাথ, মুকুন্দ, হরলাল,
মতিলাল ও মঙ্গল সকলেই মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথের একান্ত অনুগামী।
বারাসত লোকসভা সহ বাগদহ বিধান সভার ভোটে যতবার দাঁড়িয়েছেন ততবারই তাঁহার নির্বাচনী
অভিজানের সমারোহের স্থান ছিল এই সমাদ্দার বাড়ী।
সেই রাতে মহাপ্রাণের মুখনিসৃত কয়েকটি
স্মরণযোগ্য বানী উল্লেখ করা হল।
মহাপ্রাণ
বললেন,
"আমি কোনক্রমেই আজ আসতে চাইনি। আমার শরীর মন ভাল লাগছেনা। কারণ গতকাল বিপক্ষ
দলের কিছু যুবক ছেলে আমার কাছে গিয়ে বলে যে, আপনি এবার বাগদহ
কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়াবেন না। বাগদহ কেন্দ্র থেকে এবার আমরা অপূর্বদাকে (শ্রী
অপূর্বলাল মজুমদার) জিতিয়ে আনবো। আমাদের কথা উপেক্ষা করে দাঁড়ালে আপনার জীবন
সংসয় হতে পারে। এই রকম কথাবার্তা ও হুমকী
শোনার পরে আমি উত্তেজনাভরে বলেছি আমার
সামনে মুখোমুখী হয়ে এতবড় কথা বলতে পারলে? এতো সাহস তোমাদের
কে দিয়েছে? আজ পরিস্কার জামা কাপড় সুট প্যান্ট পরে চেয়ারে
বসার অধিকার কে এনে দিয়েছে? রিজার্ভেসনের কোঠার টাকায় লেখা
পড়া শিখে চাকুরী করার অধিকার কে এনে দিয়েছে? আমার জীবন সংসয়
হতে পারে বলতে পারলে? হ্যাঁ তোমরা বলতে পারো। যেহেতু আমি
তোমাদের শিক্ষা চাকুরীর সুযোগ সুবিধা ও সাহস বল এনে দিয়েছি । তবে এ কথা সত্যি
আমাকে কোন বর্ণহিন্দু ভাইয়েরা খুন করবে না। আমার স্বজাতীয়েরাই পারে।
ঐ সময় আমার মানসিক চাপে প্রেসার বেড়ে যায় । বুকটা ব্যথা করে ওঠে। তাই কয়েক দিন বিশ্রামে থাকতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া আগামীদিন
বৈকালে বিভিন্ন দিক থেকে কিছু নেতা ব্যক্তি জরুরী আলোচনার জন্য আমার বাসায় আসবেন।
সেখানে আমার থাকা একান্ত প্রয়োজন। আগামীদিন সকালে অফিস উদ্বোধন করে কলকাতা রওনা
দেবো।"
পরদিন ৫/১০/৬৮ (৫ই অক্টোবর ১৯৬৮ ইং) সকালে হেলেঞ্চা বাজারে
নির্বাচনী অফিস উদ্বোধন করার জন্য সমাদ্দার বাড়ী থেকে এক মাইল পাকা রাস্তা ধরে পদব্রজে বহুলোকের মিছিল
সহকারে উপস্থিত হন। অল্পক্ষনের মধ্যেই বিভিন্ন দিক থেকে হিন্দু মুসলমান নারী
পুরুষের সমাবেশ হয় এবং অফিস প্রাঙ্গনে জনতায় ভরে যায়।
মহাপ্রাণের অফিস উদ্বোধনী
ভাষণ নিম্নরূপ
এবং এটিই হ’ল তাঁর জীবনের শেষ ভাষণঃ-
"হে আমার হিন্দু মুসলমান ভাইবোনেরা। প্রথমে সকলকে আমার শ্রদ্ধা ও
ভালবাসা জানাই। আমি বাগদহ কেন্দ্রে পূর্বেও দাঁড়িয়েছি। হেরেও গিয়েছি। নির্বাচণী
লড়াইয়ে হার জিত আছে। হেরেছি বলে আমি দুঃখীতও নই, ভেঙ্গেও পড়িনি। কারণ আমি চার বার
মন্ত্রী হয়েছে। দু'বার রাজ্যে, দু'বার কেন্দ্রে। একবার মন্ত্রী হলে অনেকেই গাড়ী বাড়ী ব্যাঙ্ক ব্যালান্স করে
থাকেন। আমি চার বার মন্ত্রী হয়েও নিজের জন্য কিছুই করিনি। সারা জীবন অন্যায় ও
অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি এবং
প্রতিকারের চেষ্টা করেছি।
"যুগ যুগ ধরে অনুন্নত অবহেলিত নিপিড়িত জনগোষ্টি
যাঁরা সামাজিক ও আর্থিক অবস্থায় দূর্বল ও পিছিয়ে রয়েছেন। শিক্ষার আলো পাননি।
শিক্ষার অভাবে চাকুরীতে অধিকার ছিল না। তাদের জন্য সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধা আদায়
করার চেষ্টা করেছি। তারা যদি শিক্ষিত হয়, চাকুরী পায় তাহলে তাদের
আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি হবে। এতে তাদের প্রতি যে হিংসা বিদ্বেশ ও অস্পৃশ্যতার
অভিশাপ আছে তা থেকে মুক্ত হবে।
বর্ণহিন্দু ভাইয়েরা সামাজিক আর্থিক শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে উন্নত আছেন ।
তাদের ভাগের কিছুই ক্ষতি হয়নি। তাদের ভাগের অংশও কেড়ে নেইনি। পিছড়ে বর্গের লোকেদের
কোটা মাফিক সামান্য কিছু সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সংরক্ষণ বা রিজার্ভেশনের জন্য
সংগ্রাম করেছি।
একটা নিদির্ষ্ট সীমা রেখা থেকে যদি
সবল ও দূর্বলের প্রতিযোগিতা হয় তবে, দূর্বল ব্যক্তি কোনক্রমেই লক্ষ্য স্থানে পৌঁছতে পারবে না। তাই তাদের কোটা মাফিক
বিশেষ সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এতে অন্যায় কোথায়? এর ফলে বর্ণবিদ্বেশ হিংসা
নিন্দা কমবে। সামাজিক সার্বিক সাম্য আসবে।
যে হরিজনদের প্রতি উপদেশ বানী দিয়ে গান্ধীজি
হয়েছেন মহাত্মা, আর আমি সে কাজ কার্যে পরিনত করতে গিয়ে হয়েছি দুরাত্মা ও সাম্প্রদায়িক।
ইহাই অদৃষ্টের পরিহাস।
যখনই কোন বর্ণহিন্দু ভাই আমার কাছে কোন চাকুরী বা কোন সুযোগ, সুবিধার জন্য গিয়েছেন, আমি অগ্রভাগে তাদের কাজ করে দিয়েছি। কারণ কেহ বলতে না পারেন মন্ডল তার
নিজের জাতের লোক ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের কাজ করে না।
বর্ণ হিন্দু ভাইয়েদের কাছে আমার অনুরোধ আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। দেশ ভাগের জন্য আমাকে দায়ী করা হয়। মন্ডল দেশ ভাগ করেছে। সে
সম্বন্ধে বলি,
দেশ ভাগের ব্যপারে আমার কোন ক্ষমতা ছিল না। কংগ্রেস
কমিটি ও মুসলিম লীগ উভয় পার্টির নেতাগণ
মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বৃটিশ সরকারের কাছে স্বাধীনতার দাবী জানায়। বৃটিশ সরকার
মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয়ের দেশ ভাগের দাবী মেনে ভারত ও পাকিস্থানের জন্য পৃথকভাবে
স্বাধীনতা দেয়। তাই ভারত ভাগ করে তারত ও পাকিস্থান পৃথক রাষ্ট্র তৈরী হয়। তবুও দেশ
ভাগের জন্য আমাকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয় কেন?
আমি যোগেন মন্ডল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র
আন্দোলন করেছি। এ জন্য আমাকে বহু কটুক্তি শুনতে হয়েছে। যেমন “বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে
যোগেন মন্ডলের ওকালতি।” আমি বুঝেছি বঙ্গ ভঙ্গ
হলে হিন্দু মুসলমান উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে অশিক্ষিত ও গরীব
যারা সামান্য চাষ আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের ভাগ্যে চরম দূর্দশা নেমে
আসবে। তখন কংগ্রেস ও কমিউনিষ্ট পার্টি বঙ্গ ভঙ্গ সমর্থন করে আমাকে গালমন্দ করেছেন।
দেশ ভাগের পরে আমি পূর্বঙ্গে গেলাম কেন?
ইহার উত্তর বহু জন সভায় বহুবার দিয়েছি। দেশ ভাগ যখন অবধারিত হয়ে গেল তখন আমার নেতা
ডঃ বি.
আর. আম্বেদকরের সাথে আলোচনা করি এবং পরামর্শ
নেই। তিনি বলেন, “মিঃ মন্ডল কংগ্রেস ও লীগের দেশ ভাগের প্রস্তাব বৃটিশ সরকার নেমে
নিয়েছেন। আমাদের কথা শোনেননি। এক্ষেত্রে আমরা কি করতে পারি? কাজেই তুমি পূর্ব
বঙ্গে যাও। দেখো পূর্ব বঙ্গে বহু অনুন্নত হিন্দু থেকে যেতে বাধ্য হবেন। তুমি গিয়ে
তাদের সেবা করো।” তাই আমি পূর্ববঙ্গে যাই। আমাকে লীগ মন্ত্রীসভায় আইন মন্ত্রী পদে বহাল
করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, আর ১৯৫০ সালে পুনরায় ভারতে আসি। আমি পাকিস্থানে
করাচি থাকাকালীন পূর্ব বঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হল।
ঢাকা ত্রিপুরা নোয়াখালী খুলনা ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় হিন্দুদের উপর চরম অত্যাচার
খুন হত্যাকান্ড চলতে লাগল। অসহায় হিন্দুরা আমাকে বহু চিঠিপত্র টেলিগ্রাম করাচিতে
পাঠাতে লাগল। পাক সরকার কৌশলগত ভাবে আমাকে জানতে দেয়নি। যখনই আমি জানতে পারলাম
তখনই পূর্ববঙ্গে ছুটে গিয়ে অসহায় হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছি। দাঙ্গা বিদ্ধস্ত
এলাকায় ঘুরে ঘুরে বহু জনসভা করে বক্তৃতা দিয়ে তাদের শান্তনা দিয়েছি। আমার অনেক
বক্তৃতার অংশই শাসকগোষ্ঠির কাছে
দেশোদ্রহিতার রূপ নিয়েছিল। আমি করাচি পৌঁছানোর আগেই আমার
বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্টের পাহাড় জমে গেছে।
ইত্যাদি বহু ঘটনার পরে যখন বুঝতে পারলাম পাকিস্থানে হিন্দুদের বসবাস নিরাপদ
নহে। পাকিস্থান থেকে সংখ্যালঘুদের কল্যানের জন্য যত দাবিই করেছি, পাক সরকার তা
মানে নি। কথা দিয়েও কথা রাখেনি। যে হিন্দুদের কল্যানের জন্য পাকিস্থানে গিয়েছি
তাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিকার করতে না পারলে সেখানে থাকা উচিত হবে না বিবেচনা করেই
ভারতে চলে আসি। ভারতে এসে অল্প কয়েকদিন পরেই আমার সমস্ত অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে পাক
সরকার প্রধান মঃ লিয়াকৎ আলীর কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। সমস্ত হিন্দু
ভাইদের ভারতে আসার আহ্বান জানিয়েছি। আমার পদত্যাগ পত্রের কপি বাংলা ইংরাজী বহু
সংবাদ পত্রেই প্রকাশিত হয়েছে।
আমি ভারতে আসার পরেও তিন বছর ভারত ও পাকিস্থানের যাতায়াতের দরজা খোলা ছিল।
কেন এখনও পূর্ব বঙ্গে হিন্দুরা রয়েছেন? ইহার কারণ ঐ উক্ত একই বঙ্গ বঙ্গের অভিশাপ।
বাগদাবাসী ঘোষ কপালিক মাহিষ্য ভাইদের কাছে আমার আবেদন আপনারাতো গান্ধীজির
কথায় একই হিন্দুদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই বলে তাঁর সাথে পংতিভোজের মাধ্যমে জল চলের
সামিল হয়েছেন। কিন্তু শিক্ষায় ও চাকুরী ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও পিছে পড়ে আছেন। আসুন
আমাকে ভোট দিন। আপনাদের উন্নতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
মুসলমান ভাইদের বলছি- আপনারা আমাকে ভোট দিবেন না কেন? আপনারাও আমার অবহেলিত
ভাইদের একই জমির পাশাপাশি চাষ আবাদ করি।
চাষবাসের গল্প করি। একই জমির আলে বসে নাস্তা খাই। আপনাদের ও আমাদের অবস্থা একই
প্রকার। সে জন্যই আমি লীগ মন্ত্রী সভায় যোগদান করি। তার জন্য আমাকে “যোগেন আলী
মোল্লা” খেতাব নিতে হয়েছে। লীগ মন্ত্রী সভায় হিন্দু মন্ত্রীও ছিলেন, যেমন ফজলুল হক
মন্ত্রী সভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন। তাকে বলা হত “শ্যামাহক মন্ত্রী সভা”। তারা
কেউই মোল্লা পদবীতে ভূষিত হননি। আপনারা আমাকে ভোট দিন। আপনাদের কল্যানের
জন্যও চেষ্টা করবো। আমি জয়ী হতে পারলে
হিন্দু মুসলমান জাতিধর্ম নির্বিশেষে জন সেবা করবো। ইাই আমার বাসনা।
পুনরায় বলি আমি চার চার বার মন্ত্রী হয়েও জনহিতকর কাজ ছাড়া নিজের জন্য কিছু
করিনি। এক ভদ্রলোক সৌজন্য বশতঃ থাকার জন্য আমাকে একটা ঘর দিয়েছেন। সামান্য একটা এম.
এল. এ. হলেই ধন্য হব মনে করিনা। জনহিতকর কর্মি আমার জীবনের ব্রত। কিছু ক্ষমতা না
পেলে কিছু করা যায় না। তাই আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করে আইন সভায় পাঠান।
সকলকেই আমার শ্রদ্ধা ভালবাসা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি।”
ঐ দিন মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের একক ভাষণের মাধ্যমেই নির্বাচনী অফিস
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
প্রত্যক্ষ্যদর্শী শ্রোতা ও লেখক
শ্রীমুকুন্দলাল সমাদ্দার
ঠিকানা প্রথমে দেওয়া
আমাদের অক্ষমতা যে আমরা এখনও মহাপ্রাণ যগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কে জানতে বুঝতে পারিনি । ----প্রদীপ মণ্ডল
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteখুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
ReplyDelete